তিরাশি বছরের ফাদার স্ট্যান স্বামী, ভার্সেস দ্য স্টেট— কোন দিকে চলছে দেশ?

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

 


 লেখক গদ্যকার, প্রাবন্ধিক

 

 

 

 

এক বোকা বুড়োর গল্প। তিরাশি বছরের জেসুইট প্রিস্ট এবং সমাজকর্মী ফাদার স্ট্যান স্বামী। ভার্সেস দ্য স্টেট। না, দেশ না। লড়াই দেশের হয়ে। এবং স্টেটের বিরুদ্ধে। এই দেশ আর বিচারবিভাগীয় ভাষায় স্টেটের পার্থক্য খুঁজতে গেলে অনেক ইতিহাস খুঁড়তে হবে। চলে আসবে দলিত এবং দলিতদের হয়ে আন্দোলনকারীদের উপর একপেশে অত্যাচারের একঘেয়ে চিত্রনাট্য, যে ট্র্যাডিশনের কমতি হয় না কোনও। তো, কে এই স্ট্যান স্বামী? কেনই বা তাঁর কথা? কোথায় সাম্প্রতিকতা? আর কেনই বা ভার্সেস দ্য স্টেট? আসুন শুরু করি …

রাঁচির নামকুমের বাগাইচা। স্ট্যান এই তিরাশি বছরেও আদিবাসীদের নিয়ে পড়ে থাকেন। কেরল থেকে আসা এই অক্লান্ত সমাজকর্মীর লড়াই বিগত পাঁচ দশক ধরে চলছে। বাধা আপাতত একটাই ছিল। পারকিনসন্স। চায়ের কাপ ঠোঁট পর্যন্ত নিয়ে যেতে গেলে কাঁপে। তবু, জমি এবং অরণ্যের অধিকার নিয়ে লড়েন। দাবি আদায়, প্রতিবাদ এবং লাগাতার আন্দোলন। সংবিধানের পঞ্চম তপশিল অনুযায়ী ট্রাইবাল অ্যাডভাইসারি কাউন্সিল তৈরি হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, যেখানে প্রতিনিধিত্ব করবেন শুধুই আদিবাসীরা, স্ট্যানের ভাষায় ‘মূলবাসী’রা। সম্প্রতি বর্তমান শাসক দলের ল্যান্ড ব্যাঙ্ক কৌশলেরও তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তীব্র ঠোঁটকাটা স্ট্যান বলে দিয়েছেন, এইসব গালভরা ব্যাঙ্কট্যাঙ্ক জমিকে আদিবাসীদের হাত থেকে বের করে বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দিতে, কর্পোরেট হাতে তুলে দিতে একধরনের চালাকি, ফাঁদ। অসংখ্য আদিবাসীকে নকশাল তকমায় গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, বিনা বিচারে আটকে রাখা হচ্ছে দিনের পর দিন। স্ট্যান সেসবের বিরুদ্ধে গলা তুলেছেন। বলেছেন, সরকার, ওদের ছাড়ুন। নিজেদের ব্যর্থতার দিকে নজর দিন।

আর এখানেই আপত্তি। পথের কাঁটা। সরিয়ে দাও। হিন্দি ছবির চিত্রনাট্য। বাস্তব, সেলুলয়েড— তফাত কোথায়? নেই। ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি বা সংক্ষেপে এনআইএ স্ট্যানকে গত মাসে তিনবার বাগাইচা গ্রামে গিয়ে জেরা করল। তিন দিনে মোট পনেরো ঘণ্টা সিটিং। এই তিরাশিতেও। এই অতিমারিতেও। স্ট্যান প্রতিবাদ করেননি। যা জানতেন, বলেছেন। এইটুকুতে আশ মেটে নাকি? শাসক সেফ থাকবে। তুলে নিতে হবে সমস্ত প্রতিরোধ কণ্ঠ। মুছে দিতে হবে ট্র্যাক রেকর্ড। অতিমারির দুহাজার কুড়ির শেষবেলায় উনিশশ চুরাশির অরওয়েলীয় রেট্রোস্পেক্টিভ। গ্রেপ্তার স্ট্যানকে। কেন? কোন মামলা। এলগার পরিষদ-ভীমা কোরেগাঁও মামলা। সেসব কী?

২০১৮। ১ জানুয়ারি। পুনের ভীমা কোরেগাঁওতে পেশোয়াদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ জয়ের ২০০ বছর। দলিতদের উপর দিনের পর দিন অসম্ভব শোষক এই পেশোয়াদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ লড়াইয়ে স্বাভাবিকভাবেই সঙ্গ দিয়েছিল দলিত কমিউনিটি। এ জয় আসলে তো তাদের জয়। তাই সমাবেশ। আর এখানেই হামলা। গাড়ি পোড়ানো হল। আরও নানারকম ভাবে সমাবেশ আটকানোর চেষ্টা করা হল। ২ তারিখ পিম্প্রি পুলিশ স্টেশনে এফআইআর করা হল স্থানীয় হিন্দুত্ববাদী নেতা মিলিন্দ একবটে এবং সাম্ভাজি ভীরার বিরুদ্ধে। গত মাস দুয়েক ধরে লাগাতার দলিত বিরোধী প্রচার এবং উসকানি দেওয়ার প্রমাণপত্র পাওয়া গেছিল এই দুজনের বিরুদ্ধে। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে পুনে পুলিশ থেকে আট জানুয়ারি আরেকটি এফআইআর-এ আনা হল ২০১৭-র ৩১ ডিসেম্বর পুনের শনিবারবারা দুর্গের এলগার পরিষদ সমাবেশকে। বলা হল হামলার জন্য দায়ী এই ঘটনাই। আসল উসকানি দিয়েছে এলগার পরিষদ। দলিতরাই।

অতএব ধরপাকড়। আরবান নকশাল। মোট ষোলো জনকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা হল। স্ট্যান ছাড়াও আছেন অধ্যাপক আনন্দ তেলতুম্বড়ে, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যানি বাবু, আইনজীবী সুধা ভরদ্বাজ, সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, কবীর কলা মঞ্চের তিনজন গায়ক পারফর্মকারী। বলাই বাহুল্য, এঁদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত স্ট্যান সর্বশেষ এবং সর্বজ্যেষ্ঠ। স্ট্যান হতবাক। তিনি কিভাবে ভীমা কোরেগাঁও মামলার সঙ্গে যুক্ত? শাসক যেখানে বধির এবং হিংস্র, সেখানে সত্য বলে কিছু হয় না। হয় উত্তর-সত্য। হয় পোস্ট ট্রুথ। আর এই পোস্ট ট্রুথ বলছে, স্ট্যান মাওবাদীদের সঙ্গে জড়িত। তাদের ফোরফ্রন্ট পিপিএসসি অর্থাৎ পারসেকিইউটেড প্রিজনার্স সলিডারিটি কমিটির তিনি নাকি আহ্বায়ক। তাঁর কম্পিউটার থেকে সেসব বহু তথ্য পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হল। স্ট্যান এইসব ফেব্রিকেশন বলে অস্বীকার করেছেন। বলেছেন তাঁকে ফাঁসাতে কম্পিউটারে ঢোকানো হয়েছে বাইরের তথ্য, ছবি, যেসব আজকের কুখ্যাত আইটিসেলের কাছে জলভাতের মতো কাজ।

আপাতত অবস্থান এটুকুই। স্ট্যানকে ২৩ অক্টোবর অবধি জুডিশিয়াল কাস্টডিতে রাখার নির্দেশ এসেছে। বৃদ্ধ নিজে অনশন শুরু করেছেন। অন্যান্য জেসুইট যাজকেরা ছুটে গিয়েছেন বৃদ্ধের পাশে। তবু অটল স্ট্যান। ফাদার সেড্রিক প্রকাশের মতে, ‘এসবই ভয় তৈরি করার জন্য করার চেষ্টা। টু ক্রিয়েট সাইকোসিস। একজন পারকিনসন্স ডিজিজে আক্রান্ত তিরাশি বছরের বৃদ্ধও যদি শাসকের রোষের শিকার হন, তাহলে এই দেশে কে সেফ?’ পাশে দাঁড়িয়েছেন ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন। লড়বেন ফাদারের হয়ে। এই আশ্বাসটুকুই অনেক। সোশ্যাল মিডিয়া ভরে গেছে প্রতিবাদে। রাঁচি শহরে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করা হচ্ছে লাগাতার।

তবু, ভয়ের দিকটি থাকছেই। অতিমারি হোক, তবু শাসকের চোখরাঙানি চলবেই। ছাড় দেওয়া হবে না বৃদ্ধকেও। আদিবাসী আন্দোলনকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে অন্য কোনও মামলায় ফাঁসিয়ে। বেছে বেছে টার্গেট করা হবে দেশের শিক্ষাবিদ, সৃষ্টিশীল অংশকে। একটা জাল তৈরি করা হবে। আশঙ্কা এটাই, ঘৃণা ছড়াতে ছড়াতে, অত্যাচারের সীমা বাড়তে বাড়তে ইন দ্য লং রান, অত্যাচারিত ভারতবাসী একটা সময়ে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।

অ্যান্ড ইন দ্য এন্ড হি উইল লাভ বিগ ব্রাদার … !

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4418 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...