এঙ্গেলস ও সংশোধনবাদ— একটি পর্যালোচনা

কুণাল চট্টোপাধ্যায়

 


লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

 

মধ্যযুগে নাকি ইউরোপে রাজা বা অভিজাতদের সন্তানদের শেখানোর জন্য একটি অল্পবয়স্ক ছেলে রাখা হত। রাজপুত্র, বা ডিউকপুত্র, ভুল করলে বেত মারা হত সেই বালককে। এদের বলা হত হুইপিং বয়। মার্ক্সবাদকে “ভিতর থেকে” যাঁরা আক্রমণ করতে চান, তাঁরা সরাসরি মার্ক্সকে আঘাত করতে পারেন না। তাই তাঁদের হুইপিং বয় সবার আগে ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস। আর, যাঁরা বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী আন্দোলনের আদ্যন্ত বিরোধী, তাঁরা খুব ভালো করেই জানেন, দুজনকেই আক্রমণ করা জরুরি। তাই এঙ্গেলসের উপর খাঁড়া নামে ডবল ডোজে। ই পি টমসন বহুকাল আগেই মন্তব্য করেন, সমালোচকরা মার্ক্সবাদের মধ্যে যে যেমন দোষ ধরতে চেয়েছেন, সেইভাবে এঙ্গেলসের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়েছেন।

এখানে সবার কাছে একটা বিরাট সমস্যা আছে। মার্ক্সের জীবদ্দশায় তাঁর ও এঙ্গেলসের সৃষ্ট যে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব ও অনুশীলন, তার প্রথম সার্বিক ছবি তুলে ধরেছিলেন এঙ্গেলসই, মার্ক্সের সমর্থন নিয়ে। বইটির নাম হের ইউজিন ডুয়েরিং’স রেভল্যুশন ইন সায়েন্স, যা সাধারণত অ্যান্টি ডুয়েরিং নামে খ্যাত। জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দলে মার্ক্সের প্রভাব বাড়ে এই বই প্রকাশের ফলে।

পল টমাস এবং টেরেল কার্ভার বলেন, এঙ্গেলস বিজ্ঞানকে যেভাবে দেখেছিলেন, তা হল, বিজ্ঞান হল বিষয়ীগত দিক বাদ রেখে একটি নৈর্ব্যক্তিক জ্ঞানের ব্যবস্থা (সিস্টেম অফ নলেজ), যেটা মার্ক্সের মত নয়। কার্ভার আরও দাবী করেছেন, এঙ্গেলসের অর্থনির্ভর বলে মার্ক্স মতভেদ থাকা সত্ত্বেও নীরব থেকে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ, এখানে মার্ক্সকে ‘জ্ঞানপাপী’ বলে অভিযোগ তুলে এঁরা ‘আসল’ মার্ক্সকে উদ্ধার করতে চান। এঙ্গেলস নাকি জার্মান আইডিওলজির বস্তুবাদ ও ভাববাদের দ্বন্দ্ব অতিক্রম করার প্রয়াসকে অগ্রাহ্য করে বা তাকে ভুলে গিয়ে পুরনো বস্তুবাদে ফিরে গিয়েছিলেন।

গোটা তর্কটা অদ্ভুত, কারণ অ্যান্টি ডুয়েরিং রচনা করার মূল কারণ ছিল বিপ্লবী সমাজতন্ত্রের প্রাক্সিসের উপর জোর দেওয়া, যেহেতু অধ্যাপক ডুয়েরিং এক নীতিসর্বস্ব সংস্কারবাদের প্রচার করছিলেন এবং জার্মান পার্টিতে তার প্রভাবও ছিল। লেনিন এই বইটিকে বলেছিলেন প্রতিটি শ্রেণিসচেতন শ্রমিকের জন্য এক আকরগ্রন্থ। মার্ক্স যে হেগেলীয় চিন্তার ব্যবহার করেছিলেন, ডুয়েরিং তার সমালোচনা করেন। এঙ্গেলস এর জবাবে বলেন, এর সাহায্যেই মার্ক্স পুরনো বস্তুবাদের সীমাবদ্ধতাকে এবং ভাববাদকে অতিক্রম করে তাদের আংশিক সত্যের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছিলেন। কার্ভার দাবী করেছেন, মার্ক্স-এঙ্গেলসের ঐকমত্য বাস্তব নয়, মার্ক্সের মৃত্যুর পর এঙ্গেলসের বানানো গল্প। বাস্তবে, যদি এঙ্গেলসকে বেশি গোঁড়া বস্তুবাদী, মার্ক্সর বিকৃতিসাধনকারী বলা হয়, তাহলে দেখা যাবে, মার্ক্সের বেশ কিছু রচনা বড় বেশি ‘এঙ্গেলসীয়’— যেমন ১৮৫৯-এর প্রসিদ্ধ মুখবন্ধ।

অবশ্যই, দুজন স্বতন্ত্র মানুষ ছিলেন, তাই দুজনের চিন্তার ফারাক ছিল। একমাত্র ধর্মীয় ‘সোভিয়েত’ মার্ক্সবাদে দুজনকে একেবারে অভিন্ন বলা হত। বিভিন্ন রাজনৈতিক লেখাতেও জোরের তফাত দেখা সম্ভব। কিন্তু দুজনের রচনার বিষয়বস্তু, চিঠি বিনিময়, দেখায় যে তাঁরা প্রায় চল্লিশ বছর ধরে সহযোগিতা করে গেছেন, যেখানে এক এক জনের এক এক ক্ষেত্রে বেশি প্রাধান্য ছিল। একাধিক ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রথমে এঙ্গেলসের রচনাই মার্ক্সকে কোনও একটি দিকে ঠেলে দিয়েছে। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে, পেরী অ্যান্ডারসন দেখিয়েছিলেন, ইতিহাসের বিষয়ে, বিশেষত ইউরোপীয় ইতিহাসের বিষয়ে, এঙ্গেলসের অবস্থান সচরাচর মার্ক্সের চেয়ে নির্ভুল ছিল। আর, কার্ভার একরকম কাঁচা হাতসাফাই করতে চেয়েছেন। তিনি দাবী করেছেন, তিনটিমাত্র রচনাকে যৌথ কাজ বলা যায়— হোলি ফ্যামিলি, জার্মান আইডিওলজি, যেটা আবার মুদ্রিতই হয়নি, আর কমিউনিস্ট ইস্তাহার, যেটা নামে দুজনের, বাস্তবে মার্ক্সের লেখা। তিনি অগ্রাহ্য করে গেছেন যৌথভাবে লেখা বহু রাজনৈতিক দলিল, এবং মার্ক্সের নামে লেখা এঙ্গেলসের রচনা। ১৮৫০ সালের কমিউনিস্ট লিগের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের তরফে সংগঠনের প্রতি চিঠি, যাতে ১৮৪৮-এর বিপ্লবের অভিজ্ঞতা আলোচিত হয় এবং ভবিষ্যতের রণনীতি স্থির হয়, সেটা দুজনের লেখা। মার্ক্স জার্মান পার্টির গোথা কর্মসূচির যে সমালোচনা করেছিলেন তার অনেকটি ইতিমধ্যে এঙ্গেলসের লেখা চিঠির ভিত্তিতে। ১৮৭৮-এর প্রসিদ্ধ এক্সৌথ চিঠি দুজনের সইয়ে, কিন্তু খুঁটিয়ে পড়লে দেখা যায়, খসড়াটা প্রথমে এঙ্গেলসের।

১৮৫৯ সালে লেখা আ কন্ট্রিবিউশন টু দ্য ক্রিটিক অফ পলিটিক্যাল ইকনমি-র মুখবন্ধে মার্ক্স লেখেন:

ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস, যাঁর অর্থনৈতিক ক্যাটিগরিদের সমালোচনা করে অসাধারণ প্রবন্ধ প্রকাশের পর থেকে আমি চিঠি মারফৎ মত ক্রমান্বয়ে বিনিময় করে গেছি, তিনি… আরেকটা পথ ধরে আমার সঙ্গে একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন (তুলনা করুন তাঁর কন্ডিশন অফ দ্য ওয়ার্কিং ক্লাস ইন ইংল্যান্ড)। এবং যখন ১৮৪৫ সালের বসন্তকালে তিনিও ব্রাসেলসে বাস করতে এলেন, তখন আমরা স্থির করি, জার্মান দর্শনের মতাদর্শগত চেতনার বিপরীতে আমাদের ধারণাগুলি একত্রে ব্যক্ত করব, বস্তুত আমাদের প্রাক্তন দার্শনিক বিবেকের সঙ্গে হিসেবনিকেশ করব।

অর্থাৎ– এঙ্গেলস আমার থেকে ভিন্ন পথে একই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন, তিনি অর্থনীতি বিষয়ক একটি অসাধারণ প্রবন্ধ লেখার পর থেকে দুজনের মধ্যে ক্রমাগত মতবিনিময় হয়েছিল (পাঠক মনে রাখবেন, এই কথা লিখছেন সেই ব্যক্তি, যিনি ইতিমধ্যে গ্রুন্ড্রিসে রচনা করেছেন এবং ক্যাপিটাল নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন), এবং ১৮৪৫ সালে তাঁরা একত্রে নিজেদের পূর্বতন দার্শনিক অবস্থানের সঙ্গে হিসেবনিকেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাহলে, মার্ক্স, এঙ্গেলস, দুজনেই মনে করতেন, তাঁদের মৌলিক চিন্তা অভিন্ন, কিন্তু কার্ভার ভালো জানেন। আর, এঙ্গেলসের বৌদ্ধিক ক্ষমতা সম্পর্কে ১৮৫৩ সালে একটি চিঠিতে মার্ক্স বলেন, তিনি এক চলন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া, এবং ঠান্ডা মাথা বা মত্ত, যে কোনও অবস্থায়, দিনে রাতে যে কোনও সময়ে, কাজ করতে পারেন, দ্রুত লিখতে পারেন এবং দ্রুত বুঝতে পারেন।

মার্ক্স টাকার দরকার বলে নিজের নীতির প্রতি অসৎ হয়েছিলেন, এই কথা বলার অর্থ, এঙ্গেলসের চেয়ে মার্ক্সের প্রতি অনেক বড় আক্রমণ করা। আর কার্ভার কিন্তু তার কোনও প্রমাণ দেননি। তাঁর একটা অপ্রমাণিত অনুমানের সমর্থনে আর একটা অপ্রমাণিত অনুমান শুধু খাড়া করেছেন। হ্যাল ড্রেপার এবং সোমা মারিক দুজনেই মার্ক্সের যে অকাট্য উক্তি তুলে ধরেছেন, তা হল, তিনি এবং এঙ্গেলস একটি সাধারণ পরিকল্পনামাফিক, এবং আগাম আলোচনার ভিত্তিতে কাজ করেন।

কার্ভার যে কাজটা করেছেন, তা জরুরি, কারণ অ্যান্টি ডুয়েরিংকে একবার ‘অ-মার্ক্সীয়’ বলে দিতে পারলে মার্ক্সবাদের নামে অনেক কিছু ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। একটা প্রবন্ধে আমার পক্ষে দেখানো সম্ভব নয়, এঙ্গেলস বিতর্ক মার্ক্সবাদের উপরে আক্রমণ করার, বিশেষত ‘আরও ভালো মার্ক্সবাদী’ হওয়ার নাম করে আক্রমণ করার কতভাবে সহায়ক। বর্তমান প্রবন্ধে আমি একটা দিকের উপরে জোর দেব, যা হল দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে যে ক্রমে ক্রমে সংস্কারবাদী অনুশীলন এবং তত্ত্বগত সংশোধনবাদের দিকে ঝোঁক এসেছিল, তার জন্য এঙ্গেলস কতটা দায়ী, এই প্রশ্ন ফিরে দেখা। প্রশ্নটা একাধিকবার করা হয়েছে। লুসিও কোলেত্তি ১৯৭২ সালে বার্নস্টাইন অ্যান্ড দ্য মার্ক্সিজম অফ দ্য সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল প্রবন্ধে সবচেয়ে কৌশলীভাবে প্রশটা তোলেন। তিনি এঙ্গেলসকে সংশোধনবাদের জনক বলেননি। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, এঙ্গেলসের মার্ক্সবাদের দুর্বলতার ফলে সংশোধনবাদের উত্থান হতে সুবিধা হয়েছিল। কোলেত্তির বক্তব্য ছিল, ‘যান্ত্রিক’ মার্ক্সবাদ থেকে মুক্তি না পেলে এই সমস্যা থেকেই যাবে। আমি এখানে দেখাতে চাই, এঙ্গেলসের মার্ক্সবাদ বার্নস্টাইন কেন, কাউটস্কির মার্ক্সবাদ থেকেও ভিন্ন। এটা ব্যক্তিপূজা করার জন্য করছি না। করার দরকার, কারণ নানা মার্ক্সবাদী মোড়ক নিয়ে ঐ সংশোধনবাদ ফিরে আসে বারে বারে। স্তালিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টিদের অবক্ষয়ের পর, ইদানীং আবার কাউটস্কির মাহাত্ম্য বাড়িয়ে দেখা শুরু হয়েছে, আর লেনিন যেহেতু স্তালিনের উৎস না, তাই তিনিও কাউটস্কির ছায়া, এই প্রচার শুরু হয়েছে। লারস লি, এরিক ব্ল্যাঙ্ক এই প্রবণতা চালু করেছেন। এর জের টেনে এরিক ব্ল্যাঙ্ক, ভাস্কর সুঙ্কারা-রা কাউটস্কীয় ধাঁচে নির্বাচন আর ট্রেড ইউনিয়ন সর্বস্ব রাজনীতিতে ঠেলতে চাইছেন বাম আন্দোলনকে। তাই এঙ্গেলসের পুনর্বিবেচনা অতি প্রাসঙ্গিক ও আবশ্যক।

 

কোলেত্তির ব্যাখ্যা

১৯৬৮ সালে বার্নস্টাইনের বই সমাজতন্ত্র ও সোশ্যাল ডেমোক্রেসি পুনর্মুদ্রিত হলে কোলেত্তি এই প্রবন্ধটি ভূমিকা হিসেবে লেখেন। তিনি বলেন, কাউটস্কি ও প্লেখানভের মত মার্ক্সবাদীরা বার্নস্টাইনের সঙ্গে তর্কে অবতীর্ণ হলেও, তাদের মার্ক্সবাদের মধ্যে যে ত্রুটি ছিল, সেটাই বার্নস্টাইনের সুযোগ এনে দিয়েছিল। কোলেত্তি দেখিয়েছেন, এই যুগের মার্ক্সবাদীরা মার্ক্সের ক্যাপিটালের ভ্রান্ত পাঠের ফলে, ধনতন্ত্রের অনিবার্য পতনের কথা বলতেন। বাস্তবে, মার্ক্স কেবল বলেছিলেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অতি-উৎপাদন, মুনাফার হার কমার প্রবণতা, এবং তা থেকে সঙ্কট, বহু প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যাওয়া, এগুলো অনিবার্য। কিন্তু তার ফলে পুঁজির ঘনীভবন হবে, নতুন করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আসবে, ইত্যাদি। সঙ্কট অনিবার্য, কিন্তু পতন অনিবার্য নয়, তা্র জন্য চাই শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী রাজনীতি।

কোলেত্তি সঠিকভাবে বলেছেন, মার্ক্সের ‘ক্রিটিক’ অফ পলিটিক্যাল ইকনমির তাৎপর্য অনেক মার্ক্সবাদীরা বোঝেননি। বুর্জোয়া চিন্তায় ‘অর্থনীতি’ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সবচেয়ে জরুরি অংশ।  মার্ক্সের বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী চিন্তা তাকে অনুসরণ করে না। তিনি ‘অর্থনৈতিক’ ক্ষেত্রকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করেননি। আপাতভাবে যা নৈর্ব্যক্তিক, যেটা দেখলে মনে হয় শুধু বাজারে সমানে সমানে কেনাবেচা, তার পিছনে আছে রাজনীতি, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব। জ্ঞানকে খণ্ডিত করে, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মার্ক্সবাদীরা যে তত্ত্ব নির্মাণ করেছিলেন তা ক্রমেই বুর্জোয়া দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, যদিও তার রণনীতি ঘোষিতভাবে ছিল বিপ্লবী।

এ পর্যন্ত কোলেত্তির বক্তব্যকে আবার স্মরণ করা ভালো, কারণ ওই একই পথে নতুন করে অনেকে হাটছেন, যেখানে বিপ্লবী ঘোষিত রণনীতির সঙ্গে এমন তত্ত্ব আসে যা প্রলেতারীয় বিপ্লবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখে না। কিন্তু সমস্যা হল, কোলেত্তি এঙ্গেলসের একটি রচনাকে এই তত্ত্বগত দুর্বলতার উৎস বলে মনে করছেন। মার্ক্সের দ্য ক্লাস স্ট্রাগলস ইন ফ্রান্স-এর যে ভূমিকা ১৮৯৫ সালে এঙ্গেলস লিখেছিলেন তা থেকেই নাকি গোলযোগের সূচনা।

কোলেত্তি বারেবারে বলে রেখেছেন, তিনি এঙ্গেলসকে সরাসরি সংশোধনবাদের জন্য দায়ী করছেন না। কিন্তু তিনি ১৮৯৫-এর এই রচনাটির মধ্যে বিপদ দেখেছেন। এঙ্গেলসের লেখা ভূমিকাতে বলা আছে, ১৮৪৮ সালে তিনি ও মার্ক্স মনে করেছিলেন, ইউরোপ প্রলেতারীয় বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত। তাঁরা ভুল ভেবেছিলেন। পরবর্তী অর্ধশতকে ধনতন্ত্র প্রবল তেজ দেখিয়ে শিল্পায়ন এগিয়ে নিয়ে গেছে। এঙ্গেলসের মতে, শুধু তাঁদের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণেই ত্রুটি ছিল না, ত্রুটি ছিল বিপ্লবের পন্থা সম্পর্কে চিন্তা নিয়েও। তিনি বলেন, ১৭৮৯ এবং ১৮৩০-এর বিপ্লবের ইতিহাসের মোহে পড়ে তাঁরা মনে করেছিলেন, বিপ্লব সংখ্যালঘুর বিপ্লব হতে পারে। এঙ্গেলস বলেন, একথা প্রলেতারীয় বিপ্লবের আগের বিপ্লবদের সম্পর্কে প্রযোজ্য হতে পারে, কিন্তু প্রলেতারীয় বিপ্লব সম্পর্কে না। এ কথা বুঝতে হবে, যে মার্ক্স-এঙ্গেলস ১৮৪৮-এর সময় থেকেই যে নীতির কথা বলে আসছিলেন, তা হল ‘শ্রমিকশ্রেণির মুক্তি শ্রমিকশ্রেণির নিজের কাজ’। কিন্তু এর পূর্ণ তাৎপর্য যদি তাঁরা নিজেরাও রাতারাতি না বুঝে থাকেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ১৮৯৫ সালে গিয়ে এঙ্গেলস বলেন, ১৮৪৮-এর লড়াইয়ের পন্থা পুরো অকেজো হয়ে পড়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠকে বিপ্লবের দিকে টেনে আনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এঙ্গেলস জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেসির কাজের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, এই কাজে দুটো বিপদ আসতে পারে। একটা হল ১৮৪৮-এর মতো সংখ্যালঘু বিপ্লবের দিকে ঝোঁক, আর অন্যটা হল একটা এলাকায় অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখল, যেমন করেছিল পারী কমিউন। উপরন্তু, এঙ্গেলস বলেন, বুর্জোয়াশ্রেণি ভোটের অধিকার দিয়েছিল স্রেফ ঠকানোর জন্য, কিন্তু সেটাও শ্রমিকশ্রেণি মুক্তির হাতিয়ারে রূপান্তরিত করেছে।

এ পর্যন্ত আমি মোটামুটি কোলেত্তির সংক্ষেপ করে দেখালাম, তিনি কীভাবে এঙ্গেলসের উপস্থাপনা করেছেন। এবার আমাদের দেখতে হবে, সেই উপস্থাপনা কতটা সঠিক। কোলেত্তির এঙ্গেলস-সমালোচনার কেন্দ্রে আছে তাঁর বিশ্বাস যে এঙ্গেলস মনে করেছিলেন ভোটের অধিকার শ্রমিকশ্রেণিকে অল্প সময়ের মধ্যে ক্ষমতার দোরগোড়ায় নিয়ে যাবে। বাস্তবে, যে লেখাটা ১৮৯৫ সালে ছেপে বেরিয়েছিল, তাতে এঙ্গেলস এরকম কথা বলেননি। কোলেত্তি তাঁর লেখা থেকে ওইটা অনুমান করতে চাইছেন। এঙ্গেলস যা বলেছিলেন তা হল:

(১) নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণির দল নিজের সমর্থন মাপতে পারে।
[প্রসঙ্গত বলে রাখা জরুরি, তা হলে, বুর্জোয়া দলেদের সঙ্গে আঁতাতের কথা কিন্তু ওঠে না। এঙ্গেলস তো একেবারেই তোলেননি— তাই এই প্রবন্ধ থেকে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট, বা আমেরিকাতে ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে ঢুকে ‘বাম’ রাজনীতি করার স্বপ্ন ফেরি করা, এসবের রসদ মিলবে না]

(২) শ্রমিক দলের প্রচারের মাধ্যমে অন্য দলেদের নানা বিষয়ে তাদের প্রকৃত অবস্থান খুলে বলতে বাধ্য করা যায়।
[তার প্রথম শর্ত অবশ্যই, শ্রমিক দল নিজের মত সততার সঙ্গে বলবে।]

(৩) নির্বাচিত হলে সংসদ থেকে, বা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে, বিপ্লবী নীতি প্রচার করা হবে।
[কোথাও এঙ্গেলস বলছেন না, যে আরও আসন পাওয়ার জন্য, বা ভোট বাড়াবার জন্য, বা সরকারে যাওয়ার জন্য, দলের বিপ্লবী নীতি লুকিয়ে রাখা হোক। তিনি বেবেলের উদাহরণ তুলে ধরেছেন। তাঁর পাঠকরা জানতেন, বিসমার্কের যুদ্ধনীতির সমালোচনা করে বেবেল সাংসদ হয়েও জেলে গিয়েছিলেন।]

অর্থাৎ এঙ্গেলস কিন্তু কোথাও শ্রমিকশ্রেণি ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করতে পারে এই কথা বলেননি। তিনি বলেছিলেন, ভোটের দক্ষ ব্যবহার করতে পারলে শ্রমিকশ্রেণির দল ক্রমেই নিজের শক্তিবৃদ্ধি করতে পারবে। আর এর পাশাপাশি, তিনি কিন্তু বিপ্লবের কথা বলতে ছাড়েননি। তিনি লিখেছিলেন, “অবশ্যই আমাদের ভিনদেশি কমরেডরা তাঁদের বিপ্লবের অধিকার ত্যাগ করছেন না।” বিপ্লবের অধিকার একমাত্র ‘ঐতিহাসিক অধিকার’, সব আধুনিক রাষ্ট্র যার উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। ১৮৪৮-এর বিপ্লব আলোচনা করতে গিয়ে তিনি যেন লালকালির দাগ দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন কী বলতে চান। তিনি লেখেন,

The period of revolutions from below was concluded for the time being.
(তলা থেকে বিপ্লবের যুগ তখনকার মত শেষ হল।)

এটা কোনওভাবেই চিরতরে শেষ হল বলা নয়। বরং এর পরেই তিনি লেখেন, ধনতন্ত্র স্বয়ং সেই শর্ত গড়ে তুলছিল, যার ফলে বিপ্লবের পরিস্থিতি পরিপক্ক হবে।

পারী কমিউনের পরাজয় সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেননি অভ্যুত্থান করা চলবে না। তিনি পরাজয়ের দুটি কারণ উল্লেখ করেন। প্রথমত, পারী একা লড়েছিল, বাকি ফ্রান্স তার সঙ্গে ছিল না। দ্বিতীয়ত, নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা ছিল। কিন্তু তিনি একথাও লিখেছিলেন যে পারী কমিউন দেখিয়ে দিল যে পারীতে প্রলেতারীয় বিপ্লব ছাড়া কিছু সম্ভব না। এই যুক্তি ধরে এগোলে যে সিদ্ধান্ত হয়, তা বিপ্লব ছেড়ে সংস্কারবাদ না, বরং, বিপ্লবীরা যেন সংখ্যালঘু না থাকেন সেটা নিশ্চিত করার পথ ধরতে হবে। আর নিশ্চিত করতে হবে নেতৃত্বের মধ্যে ঐক্য এবং উন্নত রাজনৈতিক দিশা।

১৮৪৮ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়েও তিনি যে কথা লিখেছিলেন সেটা আর একটু খুঁটিয়ে দেখা দরকার। তিনি লেখেন, একটা সোজা চমক দেওয়া আক্রমণ করে সমাজ পুনর্গঠন করা যায় না। অর্থাৎ, অভ্যুত্থান না, পার্লামেন্টের পথ ধরো, এমন কোনও কথা তিনি বলেননি। তিনি বলছেন, এক ঝটকায় ক্ষমতা দখল হবে না।  শ্রমিকশ্রেণি নিষ্ক্রিয় থাকবে, এক সংখ্যালঘু ‘নেতৃত্ব’ তাদের হয়ে লড়াই করে ক্ষমতা দখল করবে, সেটা হবে না। বিপ্লবীদের প্রথমে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে আসতে হবে, শ্রেণির ব্যাপক অংশকে পথে নামাতে হবে। তবেই সম্ভব হবে পুরনো রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভেঙে ফেলা।

অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গে বলা হয়, তিনি অভ্যুত্থানের বিরোধী ছিলেন। ভালো করে পড়লে দেখা যায়, তিনি অভ্যুত্থান কোন শর্তে হবে তা নতুন করে ভাবতে বলেছেন। তিনি দেখান, ব্যারিকেডের লড়াইয়ের প্রধান মূল্য নৈতিক। ব্যারিকেডের ওপার থেকে ফৌজিদের নিজেদের দিকে টানা যায় কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন। ব্যারিকেডের লড়াই থেকে সেনাবাহিনীকে বিপ্লবী জনতা হারিয়ে দেবেন, এটা দুঃসাধ্য। তিনি আরও দেখান, সামরিক কৌশল পাল্টানোর ফলে ১৮৯৫ সালে বিপ্লবের গোড়ায় অভ্যুত্থান অকেজো। কিন্তু তারপর তিনি লেখেন:

Does that mean that in the future street fighting will no longer play any role? Certainly not. It only means that the conditions since 1848 have become far more unfavourable for civilian fighters and far more favourable for the military. In future, street fighting can, therefore, be victorious only if this disadvantageous situation is compensated by other factors.

১৯১৭র রুশ বিপ্লব বা ১৯১৮র জার্মান বিপ্লব সেই অন্য উপাদানদের দেখাল। দীর্ঘ যুদ্ধের ফলে সৈন্যদের মধ্যে সরকার, রাষ্ট্র ও সেনাপতিদের প্রতি ঘৃণা সেনাবাহিনীতে ফাটল ধরাল। সেটা না হলে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব সম্ভব হত না, অক্টোবরেও কয়েক হাজার সশস্ত্র রেডগার্ড কামান, সাঁজোয়া গাড়ি, ইত্যাদিতে সজ্জিত বিরাট সেনাবাহিনীর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারত না।

লিয়েবকনেশটের কৌশল ও কোলেত্তির চোখ বুজে থাকা

জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দলের অন্যতম নেতা ছিলেন ভিলহেলম লিয়েবকনেশট। মার্ক্স-এঙ্গেলস পত্রাবলি পড়লে মাঝেমাঝেই দেখা যায়, তিনি নিজেকে মার্ক্সের একনিষ্ঠ অনুগামী বলে দাবী করলেও, মার্ক্সের এ নিয়ে সংশয় ছিল। মার্ক্স ও এঙ্গেলস যে বহুদিন লাসালের প্রতি তাদের নানা আপত্তি সত্ত্বেও লাসালপন্থী শ্রমিকদলকেই সমর্থন করেছিলেন, তার কারণ লিয়েবকনেশট বুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেধে চলছিলেন। ১৮৯৫ সালেও গন্ডগোল পাকিয়েছিলেন তিনিই। সেই ইতিহাস একটু দেখা দরকার। কিন্তু তার আগে বলা দরকার, শুধু কোলেত্তি না, ডেভিড ম্যাকলেলানের মতো পণ্ডিত লেখকও দাবি করেছেন, এঙ্গেলসের শেষ জীবনের এই লেখা সোশ্যাল ডেমোক্রেসির নেতাদের প্রভাবিত করেছিল। অথচ ম্যাকলেলান একথাও লিখেছেন, যে এঙ্গেলস গভীর আপত্তির সঙ্গে কিছু বৈপ্লবিক অংশ বাদ দিতে রাজি হয়েছিলেন। তাহলে বোঝা গেল না, এঙ্গেলস প্রভাবিত করলেন কীভাবে? নাকি, যারা ইতিমধ্যেই বিপ্লবকে ভোট আর ট্রেড ইউনিয়নের রাজনীতির খোপে ঠেলে দিতে চাইছিলেন, তারা চাপ দিয়েছিলেন?

বস্তুত, চাপ দিয়ে কাটানো হয়নি। না বলে কেটে দেওয়া হয়েছিল। এঙ্গেলস সচেতন ছিলেন, যেভাবে কেটে দেওয়া হল, তাতে সুবিধাবাদী রাজনীতির হাত শক্ত করা হল। ম্যানফ্রেড সিগার, কার্ভার সম্পাদিত একটি বইয়ে আবারও বলার চেষ্টা করেছেন, এঙ্গেলস বিপ্লবী আর বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে ফারাক কমিয়ে দেখাতে চেয়েছিলেন। বাস্তবটা হল, তিনি ১ এপ্রিল ১৮৯৫ ক্ষোভের সঙ্গে কাউটস্কিকে চিঠি লিখলেন:

বিস্ময়ের সঙ্গে আমি দেখলাম আজকের ভোরওয়ার্টস-এ [লিয়েবকনেশট সম্পাদিত পার্টি দৈনিক] আমাকে আগে না জানিয়ে আমার লেখা ভূমিকা থেকে একটা অংশ ছাপা হয়েছে, এবং সেটা এমন কাটছাঁট করে,  যাতে আমাকে দেখানো হচ্ছে যে কোনও মূল্যে আইনি পথের শান্তিপূর্ণ উপাসক বলে। পুরোটা যে নয়ে জাইট-এ [কাউটস্কি সম্পাদিত তাত্ত্বিক পত্রিকা] বেরোবে, সেটা ভালো, কারণ তাতে এই লজ্জাকর ধারণাটা মুছে দেওয়া যাবে।

বাস্তবে কাউটস্কির মেরুদণ্ড এঙ্গেলসের মতো শক্ত ছিল না। ফলে তিনি লিয়েবকনেশটের চাপে কিছু বাদ দিয়েই ভূমিকাটা ছাপলেন।

এঙ্গেলসের আপত্তি কোথায় ছিল তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ফ্রান্সে পল লাফার্গকে তিনি চিঠি লেখেন,

লিয়েবকনেশট আমার উপর এক চমৎকার চাল চেলেছে। মার্ক্সের ১৮৪৮-৫০এর ফ্রান্সবিষয়ক প্রবন্ধগুলির জন্য আমার লেখা ভূমিকা থেকে সে নিয়েছে সেই সব, যা থেকে যে কোনও মূল্যে শান্তির রণকৌশল আর বলপ্রয়োগের বিরোধিতা করা যায়, কারণ সে হালে কিছুদিন ধরে ঐ রাজনীতিই প্রচার করছে, বিশেষত বার্লিনে নতুন যে আইন বানানো হচ্ছে তাকে দেখে। কিন্তু আমি এই কথাগুলি বলছি শুধু আজকের জার্মানি সম্পর্কে, এবং তাও একটা গুরুত্বপূর্ণ ছাড় মাথায় রেখে। ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইতালি ও অস্ট্রিয়াতে এই রণকৌশল পুরোপুরি অনুসরণ করা যাবে না, এবং কাল জার্মানিতেও এরা অচল হয়ে যেতে পারে।

১৮৯৯ সালে কাউটস্কি বার্নস্টাইনের জবাবে লেখেন, দোষ এঙ্গেলসের না, সেই সব জার্মান বন্ধুদের, যাঁরা এঙ্গেলসের সিদ্ধান্তগুলি বেশি বিপ্লবী বলে বাদ দিয়েছিলেন। কিন্তু তখনও কাউটস্কি দায়িত্ব নিয়ে গোটা লেখাটা ছাপলেন না। তিনি বলেন, একমাত্র কপি আছে বার্নস্টাইনের কাছে। ১৯২৪ সালে রুশ বলশেভিক ডেভিড রিয়াজানভ ওই কপির ছবি সংগ্রহ করলেন।

ঠিক কী করেছিলেন লিয়েবকনেশট? সেটা দেখার আগে কোলেত্তি বা ম্যানফ্রেড সিগারদের সম্পর্কে শেষ কথা বলব। ১৯৩০ সালে ইংরেজিতে গোটা লেখাটা অনুবাদ হয়ে বেরোয়। তার আগে কেউ বলতে পারতেন, তিনি জানেন না এঙ্গেলস ঠিক কী বলেছিলেন। যদিও আমি দেখাতে চেয়েছি, তা হলেও, যেটা মুদ্রিত ছিল তাতেই কোলেত্তির ব্যাখ্যা প্রশ্নের মুখে পড়ে। কিন্তু এখন ওই যুক্তিও খাটে না। অর্থাৎ, এঙ্গেলসকে বেত মারার সেই প্রবণতা থেকেই গেল।

এঙ্গেলসের প্রথম যে বক্তব্য নিয়ে ভোরওয়ার্টসের সম্পাদকের অস্বস্তি ছিল, তা হল ব্যারিকেডের লড়াই। আমরা দেখেছি, এঙ্গেলস বলেছিলেন, ব্যারিকেডের লড়াইয়ের মূল উদ্দেশ্য সেনাবাহিনীর মধ্যে ফাটল ধরানো। লিয়েবকনেশট কাঁচি দিয়ে কাটলেন যে জায়গাটা, সেখানে বলা ছিল; “এটাই মূল কথা, যা মনে রাখতে হবে, যখন আমরা ভবিষ্যতেও রাস্তায় লড়াইয়ের কথা ভাবব।” অর্থাৎ, এঙ্গেলস একেবারেই বলেননি যে ভবিষ্যতে আর রাস্তায় নেমে লড়াই হবে না। তাঁর কাছে প্রশ্নটা ছিল— কীভাবে সেই লড়াইকে সবচেয়ে ফলপ্রসূ করা যায়?

এক পৃষ্ঠা পরে আবার কাঁচির দরকার হল। এঙ্গেলস লিখেছিলেন, শুধু সামরিক দিক থেকে বিপ্লবী জনতার অবস্থা খারাপ হয়নি। বরং, প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলির পিছনে জনসমর্থন বেড়েছে। এর পর তিনি লেখেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে উত্তর ও পূর্ব বার্লিনের এলাকাগুলিতে ব্যারিকেডের যুদ্ধ করা হবে পাগলামি। যদি এইখানে তিনি থেমে যেতেন, তা হলে মনে করা স্বাভাবিক হত, যে তিনি শান্তিপূর্ণ পথের প্রবক্তা। কিন্তু তিনি তারপর বললেন, ভবিষ্যতে রাস্তার লড়াই জয়যুক্ত হবে বিপ্লবের গোড়ায় না, বরং বিপ্লব অনেকদূর এগোবার পর, এবং তাতে অনেক বেশি শক্তি থাকতে হবে। তারপর তিনি বলেন, সেক্ষেত্রে হয়তো ব্যারিকেডের লড়াই না, বিপ্লবীরা চাইবে সরাসরি আক্রমণ করতে। এই গোটা প্যারাগ্রাফটা আবার কাঁচির হাতে পড়ল।

আরও একাধিক জায়গায় লিয়েবকনেশট কাঁচি চালিয়েছিলেন। একটার কথা বলা দরকার। এঙ্গেলস সাবধান করে দেন যে আইনি অধিকার সবসময়ে থাকবে না। তিনি বলেন, তখন বিপ্লবী দলেরও হাত খোলা থাকবে। কিন্তু তারা আগাম বলে দেবে না, তখন তারা কী করবে বা করবে না। অবশ্যই। মূর্খ ছাড়া কেউ শত্রুর কাছে রণনীতি বলে দেবে না।

সুতরাং কোলেত্তি যদি সততার সঙ্গে এঙ্গেলসের আসল লেখাটা পড়তেন, তাহলে তিনি বুঝতেন, এঙ্গেলস ১৮৯৫ সালে, মৃত্যুর কয়েক মাস আগেও, ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিককে একজোট করে বিপ্লবের পথে ক্ষমতা দখলের প্রবক্তা। তার এই রচনা থেকে এগোনো যায় লেনিন এবং গ্রামশি, দুজনের দিকেই। কোনও অবস্থাতেই তাঁকে সংস্কারবাদ-সংশোধনবাদের জনক হিসেবে দেখা যায় না। সংস্কারবাদের উত্থান এঙ্গেলসের, বা কারও, চিন্তা থেকে নয়, বরং সামাজিক বাস্তবতা থেকে। একটা বিরাট দল, তার নিজের আমলাতন্ত্র। সীমিত বুর্জোয়া (এবং আধা সামন্ততান্ত্রিক) ব্যবস্থার মধ্যেও কিছু সুযোগসুবিধা। এগুলি ক্রমে পার্টির ও ট্রেড ইউনিয়নের উপরমহলে পরিবর্তন আনছিল। এই বাস্তব পরিস্থিতি চিন্তাকে পালটে দিচ্ছিল। তাই শুধু বার্নস্টাইন না, তাকে যারা সমালচনা করলেন, সেই কাউটস্কি ও প্লেখানভও বিপ্লবের বাস্তবতার সময়ে বিপ্লবের বিরোধী হয়ে পড়লেন।

আর এখানেই, এই দ্বিশতবার্ষিকীতেও, এঙ্গলসের প্রাসঙ্গিকতা।

 

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...