গণশিক্ষা ও বিদ্যাসাগর: কিছু প্রশ্ন, কিছু উত্তর

শিবাশীষ বসু

 


লেখক একজন মুক্তমনা ইতিহাস অন্বেষক। নিরপেক্ষ এবং বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিকোণ থেকে ঐতিহাসিক ঘটনা বিশেষত গৌরবময় উনবিংশ শতাব্দীর বিশ্লেষণে আগ্রহী।

 

 

 

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকেই ভারতবর্ষের পূর্বতন শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়তে আরম্ভ করেছিল। তা সত্ত্বেও ব্রিটিশরা প্রথমদিকে ভারতের শাসনব্যবস্থা ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে প্রাচ্যভাষাকেই প্রাধান্য দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করতেন। ইতিমধ্যে ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভারতে ইংরেজ শাসনের ভিত্তিকে দৃঢ় করেছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা যতই ইংরেজদের হাতে কেন্দ্রীভূত হতে লাগল ততই তাঁরা ভারতবাসীকে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের শিক্ষাদান করবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। Anglicist-দের বক্তব্য হল, “কোম্পানির শিক্ষাখাতে বরাদ্দ অর্থের সমস্তটাই কেবল ইংরেজি শিক্ষার জন্য ব্যয় করা উচিত; কারণ ইংরেজি শিক্ষার ফলে ভারতবর্ষের মানুষের কাছে পাশ্চাত্য জ্ঞানভাণ্ডারের দরজা খুলে যাবে।”[1] উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক, চার্লস ট্রিভেলিয়ান এবং টমাস মেকলে ছিলেন এঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য।

১৮৩৫ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি শিক্ষা কমিটির সভাপতি টমাস ব্যাবিংটন মেকলে তাঁর কুখ্যাত প্রতিবেদনের ৩৪ নম্বর অনুচ্ছেদে মন্তব্য করলেন, “We must at present do our best to form a class who may be interpreter between us and the millions whom we governs ; a class of persons, Indian in blood and colour, but English in taste, in opinions, in morals, and in intellect.”[2] মেকলের সুপারিশের ভিত্তিতে তৎকালীন গভর্নর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ৭ই মার্চ ১৮৩৫ ঘোষণা করলেন যে এবার থেকে ভারতবর্ষে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ অর্থ স্রেফ ইউরোপীয় সাহিত্য ও বিজ্ঞানবিষয়ক শিক্ষার জন্য ব্যয় হবে। কাজেই ইংরেজি শিক্ষার দ্বারা ভারতীয়দের সামনে পাশ্চাত্য জ্ঞানভাণ্ডারের দরজা খুলে দেওয়া মেকল-বেন্টিঙ্ক-ট্রিভেলিয়ানের কোনও নিঃস্বার্থ সেবা ছিল না। তাঁদের উদ্দেশ্যই ছিল কালক্রমে একটি ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির জন্ম দেওয়া যা ভবিষ্যতে ব্রিটিশ শাসনকে স্থায়িত্ব দিতে সাহায্য করবে। তাঁরা এটাও জানতেন ইংরেজি শিক্ষা ব্যয়সাধ্য বলে তা ভারতীয় সমাজের স্রেফ উচ্চশ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এবং ‘Downward filtration’এর তত্ত্ব অনুযায়ী উচ্চশ্রেণির মানুষেরা শিক্ষিত হলে সেই শিক্ষার ধারা চুঁইয়ে সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষকেও অল্পবিস্তর শিক্ষিত করে তুলবে। অনেকের মতে, এই তত্ত্ব সম্পূর্ণ অবাস্তব ছিল এই কারণেই যে, উচ্চশ্রেণির যে সব মানুষ ইংরেজি শিখে ক্ষমতা, প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাড়িয়েছেন এবং শাসকশ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা অর্জন করেছেন, তাঁরা নিজ স্বার্থেই এবং সচেতনভাবেই তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী সৃষ্টি করতে আগ্রহী হবেন না। ১৮৬৮ সালে লালবিহারী দে মন্তব্য করেছিলেন, উচ্চবিত্তশ্রেণি আসলে ফিল্টার নয়, বরং এটি হল ‘Jar hermitically sealed’. কিন্তু একটা কথা এঁরা ভুলে যান যে, Anglicist-দের এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার ভারতীয় সমর্থকদের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য ছিল— “ভারতীয় সমর্থকরা পাশ্চাত্য শিক্ষা ও বিজ্ঞানচেতনাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন দেশের মানুষকে কুসংস্কার ও কুপ্রথা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য এবং দেশের ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার জন্য।”[3]

এই ঘটনার কয়েকবছর পরেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ। অর্থাৎ ভারতীয় শিক্ষাঙ্গনে যখন আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা সবেমাত্র প্রবেশ করতে শুরু করেছে।

 

(দুই)

সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন ব্যালেন্টাইন বিতর্কের সময় অর্থাৎ ৭ই সেপ্টেম্বর, ১৮৫৩, শিক্ষা সংসদের সচিব এফ জে মৌয়াটকে বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন, “What we require is to extend the benefit of education to the mass of the people. Let us establish a number of Vernacular schools, let us prepare a series of Vernacular class-books on useful and instructive subjects, let us raise up a band of men qualified to undertake the responsible duty of teachers and the object is accomplished.”[4] এখানে প্রশ্ন জাগে যে শিক্ষকতার জন্য ‘উপযুক্ত মানুষ’ বলতে বিদ্যাসাগর কী বোঝাতে চেয়েছিলেন? তিনি লিখছেন, “The qualification of these teachers should be of this nature : they should be perfect masters of their own language, possess a considerable amount of useful information and be free from the prejudices of their country.”[5] শিক্ষাবিস্তার প্রসঙ্গে একজন বিজ্ঞানমনস্ক সমাজসচেতন মানুষের কী দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত, বিদ্যাসাগরের এই মন্তব্যটি তার একটি বলিষ্ঠ উদাহরণ।

কিন্তু স্রেফ আহ্বান করেই তিনি থেমে যাননি। নিজে এ কাজ করে দেখিয়েছেন। ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে টোমাসনের শিক্ষা পরিকল্পনায় উৎসাহিত হয়ে বড়লাট লর্ড ডালহৌসির আদেশক্রমে বাংলা গভর্নমেন্ট ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে নভেম্বর ‘কাউন্সিল অফ এডুকেশন’কে বাংলাশিক্ষা সম্বন্ধে একটি পরিকল্পনা রচনার নির্দেশ দিলেন। ফ্রেডরিক জে হ্যালিডে তখন কাউন্সিলের একজন সদস্য। অন্যান্য সদস্যদের মতো তিনিও ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে মার্চ একটি মিনিটস লিখে জমা দেন। হ্যালিডে তাঁর বিখ্যাত ‘মিনিটস’-এর প্রেরণা পেয়েছিলেন বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে। কারণ তাঁরই উৎসাহে বিদ্যাসাগর বাংলাশিক্ষা প্রচলনের জন্য ১৮৫৪ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা পেশ করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের পরিকল্পনার মর্ম এই:

Vernacular Education on an extensive scale, and on an efficient footing is highly desirable, for it is by this means alone that the condition of the mass of the people can be ameliorated. Mere reading and writing, and a little of Arithmetic should not comprise the whole of this Education ; Geography, History, Biography, Arithmetic, Geometry, Natural Philosophy, Moral Philosophy, Political Economy and Physiology should be taught to render it complete.[6]

তিনি আরও লিখলেন, এর জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে একাধিক শিক্ষকের প্রয়োজন। শিক্ষকদের ট্রেনিং-এর জন্য একটি স্কুল প্রয়োজন। স্কুলগুলি নিয়মিত পরিদর্শনের জন্য একটি যোগ্য পরিদর্শক কমিটি প্রয়োজন, ইত্যাদি, ইত্যাদি।

বিদ্যাসাগরের উপরোক্ত বক্তব্যের কারণ খুঁজতে চাইলে তা পাওয়া যাবে সেই সময়ে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে। এ বিষয়ে আমরা পরে আলোচনা করব।

১৮৫৪ সালে বাংলাদেশে ছোটলাটের পদ সৃষ্টি হয় এবং প্রথম ছোটলাট হলেন হ্যালিডে। তিনি কতকগুলি মডেল স্কুল গড়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে বিদ্যাসাগরের উপরে মডেল স্কুলের স্থান নির্বাচনের ভার দিলেন। ২১শে মে থেকে ১১ই জুন, ১৮৫৪, সংস্কৃত কলেজের ছুটির সময় হুগলি জেলা চষে ফেলে হ্যালিডেকে রিপোর্ট দিলেন বিদ্যাসাগর। সময়াভাবে নদীয়া, বর্ধমান ও চব্বিশ পরগণা জেলাতে যেতে না পারলেও ওই জেলাগুলিতে মডেল স্কুল খোলার ব্যাপারে বহু প্রয়োজনীয় সংবাদ সংগ্রহ করে দিলেন বিদ্যাসাগর। ইতিমধ্যে ১৯শে জুলাই ইংল্যান্ডে বোর্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি স্যার চার্লস উড ভারতের শিক্ষা সম্বন্ধে তাঁর বিখ্যাত ‘উডস ডেসপ্যাচ’ পাঠালেন। উডের শিক্ষা-সনদ এদেশে পৌঁছানোর পর শিক্ষা-সংসদ উঠে গিয়ে ‘ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশন’ তৈরি হল। প্রধানত হ্যালিডে সাহেবের আগ্রহে ১লা মে ১৮৫৫ থেকে বিদ্যাসাগরকে দক্ষিণবঙ্গের স্কুলগুলির সহকারী ইন্সপেক্টর পদে নিযুক্ত করা হল। ১৭ই জুলাই শিক্ষকদের ট্রেনিং-এর জন্য বিদ্যাসাগরের পরামর্শে একটি নর্মাল স্কুল খোলা হল। ওই স্কুলটির ভার বিদ্যাসাগর দিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত ও মধুসূদন বাচস্পতির উপর। ১৮৫৬ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে বিদ্যাসাগর তাঁর এলাকার প্রত্যেকটি জেলায় পাঁচটি করে স্কুল স্থাপন করলেন। এবার সংস্কৃত কলেজ, নর্মাল স্কুল, চারটি জেলার কুড়িটি মডেল স্কুল এবং বাংলা পাঠশালা— সবগুলি একসঙ্গে তত্ত্বাবধানের ভার পড়ল বিদ্যাসাগরের উপর। যৌবনের সমস্ত উদ্যম নিয়োগ করে বিদ্যাসাগর মডেল স্কুল পরিকল্পনাকে সার্থক করে তুললেন। বীরসিংহে নিজের খরচায় স্থাপন করলেন একটি অবৈতনিক স্কুল।

এই প্রসঙ্গে একটি কথা না বললে নয়, যে বাংলাদেশের গ্রামে আধুনিক শিক্ষার আলোক বিদ্যাসাগরই যে প্রথম বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন, তা নয়। এর আগে খ্রিস্টান মিশনারিরা এবং লর্ড হার্ডিঞ্জ গ্রামাঞ্চলে স্কুল খুলেছিলেন। তাতে মানুষের আগ্রহও জাগেনি যে তাও নয়। “কিন্তু সেই আগ্রহের বীজ অল্পকালের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যেত, কোনও ফসল ফলত না, যদি বিদ্যাসাগর পরবর্তীকালে এইভাবে বাংলাশিক্ষার ক্ষেত্রে মডেল-স্কুলের পরিকল্পনা নিয়ে অবতীর্ণ না হতেন।”[7]

বিদ্যাসাগরের স্ত্রীশিক্ষা প্রচলনের প্রচেষ্টার বিষয়টি আপাতত আমাদের আলোচনার অঙ্গীভূত করছি না। বরং আলোচনা করা যাক বঙ্গে শিক্ষাবিস্তারের কাণ্ডারী বিদ্যাসাগরের শিক্ষানীতি নিয়ে কী কী প্রশ্ন উঠেছিল, তা নিয়ে আলোচনায়।

 

(তিন)

শিক্ষাবিস্তার সংক্রান্ত বিষয়ে বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হল যে, মেকলে-বেন্টিঙ্কের সঙ্গে যোগসাজস করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালাল বিদ্যাসাগর বঙ্গের বর্ধিষ্ণু শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। “ব্রিটিশ আসার আগে বাংলা লেখা, পড়া আর অঙ্ক শেখার অসংখ্য ধর্মনিরপেক্ষ পাঠশালা দেশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে এক হিসাবে এইরকম পাঠশালার সংখ্যা ছিল প্র‍ায় এক লক্ষ।”[8] অভিযোগটি করেছেন পরমেশ আচার্য। পরমেশবাবুর এই বক্তব্যের প্রধান উৎস হল ১৮৩৫ সালে বঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থার উপর আলোচিত ‘অ্যাডাম রিপোর্ট’ যাতে বলা হয়েছিল, “A distinguished member of the General Committee of Public Instruction in a minute on the subject expressed the opinion, that if one rupee per mensem were expended on each existing village school in the Lower Provinces, the amount would probably fall little short of 12 lakhs of rupees per annum. This supposes that there are 100,000 such schools in Bengal and Behar, and assuming the population of those two Provinces to be 40,000,000, there would be a village school for every 400 persons.”[9]

উইলিয়াম অ্যাডামের প্রথম রিপোর্টের একলাখি অঙ্কটা এতটাই অবিশ্বাস্য যে অ্যাডাম সাহেব যে পরের মুখে ঝাল খেয়ে এ রিপোর্ট লিখেছিলেন, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ঘটনাটা বাস্তবিকই তাই-ই; প্রথম রিপোর্টটি পেশ করবার কালে অ্যাডাম সাহেব নিজে গ্রামেগঞ্জে গিয়ে পাঠশালার সংখ্যা মোটেই গণনা করেননি, কয়েকটি সেকেন্ড হ্যান্ড সোর্সকে ভরসা করে “এক লক্ষ” পাঠশালা আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন, তিনি নিজেই তাঁর প্রথম রিপোর্টের তথ্যসূত্র হিসেবে ওই পাঁচটি সোর্স উল্লেখ করেছেন, “The sources from which the principal facts and statements have been drawn are five. The first is the Buchanan Reports, which are deposited in the office of the Secretary to Government, … The second source from which I have drawn materials is the records of the General Committee of Public Instructions, … The third authority to which I have referred is Hamilton’s East India Gazetteer, … The fourth source from which I have obtained information is Missionary Collage and School reports. … The fifth authority to which I have had resource is a memoir, with supplement, compiled by the Searcher of records at the India House …”[10]

বস্তুত, ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গ-বিহারের একাধিক জেলা পরিভ্রমণ করে অ্যাডাম যখন তৃতীয় রিপোর্টটি লেখেন তাতে তিনি স্বীকার করে নেন, “Many villages did not contain a single person able to write, or even to count.”[11] এবং “Two pandits followed me to Calcutta from the Burdwan district to communicate the details respecting their schools, of which when in the district itself I had not been able to find any trace.”[12] বুঝতেই পারছেন উইলিয়াম অ্যাডামের প্রথম রিপোর্টের বিশ্বাসযোগ্যতা কতখানি!

প্রকৃতপক্ষে ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদেশের তিনটি বৃহৎ জেলায় ব্যক্তিগতভাবে সার্ভে করে অ্যাডাম সাহেব যে পাঠশালার সংখ্যা পেলেন তা হল, মুর্শিদাবাদ— ১১৩, বীরভূম— ৫৪৪ এবং বর্ধমান— ৯৩১; অর্থাৎ মোট ১৫৮৮টি। এর মধ্যে বাংলা, হিন্দি, ফারসি, আরবি ও গোটাকয়েক ইংরেজি পাঠশালাও আছে। এছাড়া মিঃ অ্যাডামের সহকারী জনৈক মিঃ ম্যলেট মেদিনীপুরে ৭৭৮টি পাঠশালার সন্ধান পেয়েছিলেন যদিও সেগুলির সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ রিপোর্টে নেই। অ্যাডাম নিজে রাজশাহী জেলার নাটোর সাবডিভিশনে আরও ২৭টি পাঠশালার খোঁজ পান। কিন্তু রিপোর্টে এদের বিস্তারিত তথ্য ও পরিসংখ্যান না থাকায় থাকায় প্রাথমিকভাবে উক্ত ওই তিনটি জেলার উপরেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছি। ওই তিনটি জেলা মিলিয়ে বাংলা ভাষার পাঠশালা পাওয়া গেল মাত্র ১১০৮টি, কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া যার প্রতিটিতে মাত্র একজন করে শিক্ষক। হায় রে, মাত্র দুই বছরেই কোথায় যে হারিয়ে গেল বঙ্গবিহারের তথাকথিত একলাখ পাঠশালা!

পরমেশবাবুর মতো কিন্তু, যাঁরা এই বহুচর্চিত ‘অ্যাডাম রিপোর্টসে’ বর্ণিত বঙ্গ ও বিহারের তথাকথিত একলাখ স্কুল তথা পাঠশালার কথা পড়ে উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করতে থাকেন তাঁদের অবগতির জন্য তৎকালীন বঙ্গে ‘পাঠশালা’ বস্তুটি ঠিক কেমন ছিল এবং তাতে কী পড়ানো হত তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ পরে পেশ করছি।

 

(চার)

একই অনুচ্ছেদে পরমেশ আচার্য লিখেছেন— “উইলিয়াম অ্যাডাম যিনি লক্ষ পাঠশালার হিসাব দিয়েছিলেন, তিনি লক্ষ করেছিলেন যে এইসব পাঠশালাগুলিতে ক্রমেই বেশি করে নীচু জাতের শিশুরা পড়তে আসছিল। শুধু কি তাই, শিক্ষকদের বেশিরভাগই ছিল নীচু জাতের লোক। কায়স্থর সংখ্যা বেশি হলেও একেবারে নিচের তলার হাড়ি, ডোম, বাউরি, বাগদি, এবং অন্যদিকে মুসলমান গুরুর সংখ্যাও একেবারে কম ছিল না।”[13]

তথ্যবিকৃতি এবং অর্ধসত্য পরিবেশনের চরম নিদর্শন এই মন্তব্যটি। অ্যাডাম সাহেব তাঁর তৃতীয় রিপোর্টে ওই তিনটি জেলায় ধর্ম ও জাতিগত ভেদে শিক্ষক ও ছাত্রদের সংখ্যার বিস্তারিত পরিসংখ্যান দিয়েছেন। এতে দেখা যাচ্ছে, তিনটি জেলায় মোট ১১০৮টি বাংলা পাঠশালায় শিক্ষকের সংখ্যা ছিল মোট ১১১৮ জন। এর মধ্যে ১১০০ জন অর্থাৎ ৯৮.৩৯ শতাংশ হচ্ছেন হিন্দু। মাত্র ১৪ জন অর্থাৎ ১.২৫ শতাংশ ছিলেন মুসলমান এবং তথাকথিত নিচু জাতের শিক্ষকের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৩ অর্থাৎ ২.৯৫ শতাংশ। এবার ছাত্রদের পরিসংখ্যানে আসি। ১১০৮টি পাঠশালায় মোট ছাত্রসংখ্যা ২০৬৫৩। এর মধ্যে ১৯৫৩১ জন অর্থাৎ ৯৪.৫৭ শতাংশ হিন্দু ছাত্র, ১০৮৩ জন অর্থাৎ ৫.২৪ শতাংশ মুসলমান ছাত্র এবং মাত্র ৩৭৬ জন অর্থাৎ ১.৮২ শতাংশ তথাকথিত নিচু জাতের ছাত্র। এখানে বিনয় ঘোষের বই থেকে প্রাপ্ত ১৮৭১-৭২ সালের একটি পরিসংখ্যানের তুলনা করা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হবে। শিক্ষাবিভাগের রিপোর্ট থেকে পাওয়া বাংলায় স্কুলছাত্রের সংখ্যা ১,৯৩,৩০২। এর মধ্যে হিন্দুছাত্র ১,৪৯,৭১৭ অর্থাৎ ৭৭.৪৫ শতাংশ এবং মুসলমান ছাত্র ২৮,০৯৬ অর্থাৎ ১৪.৫৩ শতাংশ।[14] অর্থাৎ কেবলমাত্র পরমেশবাবু তথ্যবিকৃত করেছেন শুধু তাই নয়, এই পরিসংখ্যান থেকে প্রমাণ হচ্ছে, নবজাগরণের ফলে স্রেফ হিন্দুসমাজই উপকৃত হয়েছেন, মুসলমানসমাজ নয়; এটি কিছুটা হলেও একটি ভ্রান্ত তত্ত্ব।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা মনে হওয়া কি অস্বাভাবিক নয় যে, পরমেশবাবু সহ সমস্ত সমালোচকরা কেউ নিজের চোখে অ্যাডাম রিপোর্টগুলি আদ্যপান্ত পড়ে দেখেননি, সকলেই একে অপরের মুখে ঝাল খেয়েছেন! পরমেশবাবু তাঁর গ্রন্থের এক জায়গায় বিনয় ঘোষ, গোপাল হালদার, বদরুদ্দীন উমর ইত্যাদি সকল বিদ্যাসাগর গবেষককে বেশ ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, “তথ্যের ভিত কাঁচা থাকলে তত্ত্বের ফানুস ফুটো হতে কতক্ষণ। বাঙালি বুদ্ধিজীবী বিশেষ করে প্রগতিশীল বলে পরিচিত বুদ্ধিজীবীদের তত্ত্বের আস্ফালন বড় বেশি, সেই তুলনায় তথ্যের তহবিলদারির ক্ষমতা বড় কম।”[15] ভুল কিছু লেখেননি। এখন প্রশ্ন হল, তাঁর নিজস্ব পাঠশালার তত্ত্বের ফানুসটি ফুটো হয়ে যাওয়ার পর তিনি নিজের করা মন্তব্যটি নিজেই গিলবেন কি?

 

(পাঁচ)

পরমেশবাবুর পরবর্তী অভিযোগ, এর ফলে, “খেটেখাওয়া মানুষ যাও-বা পাঠশালামুখী হচ্ছিল তাও বন্ধ হয়ে গেল। বাংলা শিক্ষা খেটে খাওয়া মানুষকে শিক্ষা থেকে বরখাস্ত করে পুরোপুরি একটা ভদ্রলোকের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল।”[16]

এটা বোধহয় কেউ অস্বীকার করবেন না যে, পাঠশালাগুলিতে সর্বসাধারণের জন্য যে শিক্ষাব্যবস্থা ছিল তাতে মূলত শেখানো হত দৈনন্দিন জীবনযাপনের প্রাথমিক শিক্ষাগুলি— হাটবাজারের ব্যবসাবাণিজ্যের জন্য, মামুলি চিঠিপত্র লেখা, গণিতের প্রাথমিক কিছু অঙ্ক আর পুরাণ-রামায়ণ-মহাভারত-কোরাণ-হাদিস-গীতা ইত্যাদির পাঠ। এছাড়া জীবিকার জন্য শিক্ষা তো ছিলই। পরমেশবাবু লিখেছেন, “আসলে পাঠশালাগুলিতে জোর দেওয়া হত ব্যবহারিক শিক্ষার উপর। যেমন জমি আর শস্যের মাপ, ওজনের হিসাব, জমিদারি হিসাব, দোকানদারি হিসাব, জমির দলিল, খত আর হরেকরকম চিঠিপত্রের মুসাবিদা, এসব শেখানো হত পাঠশালাগুলিতে। আবার রাজমিস্ত্রির মাপজোখ বা পুকুর খোঁড়ার মাপজোখ শেখানো পাঠশালার আওতার মধ্যে ছিল।”[17] পরমেশবাবু এটা বোধহয় মনে রাখেননি যে, এই ধরনের শিক্ষার মূল সীমাবদ্ধতা হল, এই গতানুগতিক শিক্ষাপ্রচেষ্টা কেবল অসম্পূর্ণ তাই-ই নয়, সমকালীন পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত জ্ঞান ও প্রযুক্তির যে অগ্রগমন হচ্ছে তার সম্বন্ধেও এটি সম্পূর্ণ অচেতন— এককথায় বদ্ধ জলা বিশেষ।

অবশ্য কেবলমাত্র আধুনিক বুদ্ধিজীবীরা নন, বিদ্যাসাগরের শিক্ষানীতির উপর খড়গহস্ত ছিলেন বিবেকানন্দও। তবে তাঁর সমস্যা ছিল আধুনিক শিক্ষার বদলে ধর্মশিক্ষা কেন হচ্ছে না তাই নিয়ে! প্রসঙ্গক্রমে শিষ্যের প্রতি তাঁর মন্তব্য, “ও তো বিলাতি ঢঙে হচ্ছে। তোদের ধর্মশাস্ত্রানুশাসনে, তোদের দেশের মত চালে কোথায় কটা স্কুল হয়েছে?”[18]

উনিশ শতকের পাঠশালা, যার প্রশংসায় পরমেশবাবু একেবারে পঞ্চমুখ, ঠিক কেমনটি ছিল শিবনাথ শাস্ত্রীর ভাষায় একটূ দেখা যাক, “পাঠশালায় পাঠনার রীতি ছিল এই যে, বালকেরা প্রথমে মাটিতে খড়ি দিয়া বর্ণ পরিচয় করিত; তৎপরে তালপাত্রে স্বরবর্ণ, ব্যাঞ্জনবর্ণ,  যুক্তবর্ণ, শটিকা, কড়াকিয়া, বুড়িকিয়া প্রভৃতি লিখিত; তৎপরে তালপাত্র হইতে কদলীপত্রে উন্নীত হইত; তখন তেরিজ, জমাখরচ, শুভঙ্করী, কাঠাকালী, বিঘাকালী প্রভৃতি শিখিত; সর্বশেষে কাগজে উন্নীত হইয়া চিঠিপত্র লিখিতে শিখিত।”[19] ওই পাঠশালাগুলিতে কী ধরনের পাঠ্যপুস্তক ছিল? উত্তর হল, “বালকেরা স্বীয় স্বীয় মাদুরে বসে লিখিত। লিখিত এই জন্য বলিতেছি, তৎকালে পাঠ্যগ্রন্থ বা পড়িবার রীতি ছিল না।”[20] সাধে কি আর বিদ্যাসাগর মন্তব্য করেছিলেন—

The Patshalas, or indigenous schools under Gurumohashoys, such as they are now, are very worthless institutions.[21]

পাঠশালায় শাস্তির কার্যক্রম সম্বন্ধে যদি জ্ঞানলাভ করতে চান তাহলে জানাই, অ্যাডাম সাহেব তাঁর রিপোর্টে বঙ্গের পাঠশালায় ছাত্রদের সাজা দেওয়ার চতুর্দশ রকমের প্রণালীর কথা উল্লেখ করেছিলেন। তাদের অনেকগুলির বিবরণ শুনলে আপনি আঁতকে উঠবেন। “হাতছড়ি, নাড়ুগোপাল, ত্রিভঙ্গ প্রভৃতি সাজার বিবিধ প্রকার ও প্রণালী ছিল। পাঠশালে আসিতে বিলম্ব হইলে হাতছড়ি খাইতে হইত; অর্থাৎ আসনে বসিবার পূর্ব্বে গুরুমহাশয়ের সমক্ষে দক্ষিণ হস্তের পাতা পাতিয়া দাঁড়াইতে হইত, অমনি সপাসপ, পাঁচ বা দশ ঘা বেত তদুপরি পড়িত। এই গেল হাতছড়ি। নাড়ুগোপাল আর এক প্রকার। অপরাধী বালকটিকে গোপালের ন্যায়, অর্থাৎ চতুস্পদশালী শিশুর ন্যায় দুই পদ ও এক হস্তের উপরে রাখিয়া তাহার দক্ষিণ হস্তে একখানি এগারো ইঞ্চি ইট বা অপর কোনো ভারি দ্রব্য চাপাইয়া দেওয়া হইত; হাত ভারিয়া গেলে, বা কোনও প্রকারে ভারী দ্রব্যটি স্বস্থানভ্রষ্ট হইলে তাহার পশ্চাদ্দেশের বস্ত্র উত্তোলন পূর্ব্বক গুরুতর বেত্র প্রহার করা হইত। ত্রিভঙ্গ আর এক প্রকার। শ্যামের বঙ্কিম মূর্ত্তির ন্যায় বালককে এক পায়ে দণ্ডায়মান করিয়া হস্তে একটি গুরু দ্রব্য দেওয়া হইত; একটু হেলিলে বা বারেক মাত্র পাখানি মাটিতে ফেলিলে অমনি পশ্চাদ্দেশের বস্ত্র তুলিয়া কঠিন বেত্রাঘাত করা হইত। কোনও কোনও গুরু ইহার অপেক্ষা গুরুতর শাস্তি দিতেন। তাহাকে চ্যাংদোলা বলিত। কোনও বালক প্রহারের ভয়ে পাঠশাল হইতে পলাইলে বা পাঠশালে না আসিলে এই চ্যাংদোলা সাজা পাইত। তাহা এই, তাহাকে বন্দী করিবার জন্য চারি পাঁচ জন অপেক্ষাকৃত অধিক-বয়স্ক ও বলবান ছাত্র প্রেরিত হইত। তাহারা তাহাকে ঘরে, বাইরে, পথে, ঘাটে, বা বৃক্ষশাখায়, যেখানে পাইত সেখান হইতে বন্দী করিয়া আনিত। আনিবার সময় তাহাকে হাঁটিয়া আসিতে দিত না, হাতে পায়ে ধরিয়া ঝুলাইয়া আনিত। তাহার নাম চ্যাংদোলা। এই চ্যাংদোলা অবস্থাতে বালক পাঠশালে উপস্থিত হইবামাত্র গুরুমহাশয় বেতহস্তে সেই অসহায় বালককে আক্রমণ করিতেন। সেই প্রহার এক এক সময়ে এত গুরুতর হইত যে হতভাগ্য বালক ভয়ে বা প্রহারের যাতনায় মলমূত্রে ক্লিন্ন হইয়া যাইত।”[22] সম্ভবত আজকের দিনে উপরোক্ত একটি প্রণালী ব্যবহৃত হলেই অভিভাবকরা রে রে করে এসে স্কুল এবং তার সামনের রাস্তা ঘেরাও করে দোষী শিক্ষকের বিতাড়ন দাবী করবেন, অথবা মানবাধিকার কর্মীরা সোশাল মিডিয়ায় ওই শিক্ষকের মিডিয়া ট্রায়ালের ব্যবস্থা করবেন।

না, এখানেই শেষ নয়, আরও আছে, “বালক মাটিতে বসিয়া নিজের একখানা পা নিজের স্কন্ধে চাপাইয়া থাকিবে; বা নিজের উরুর তল দিয়া নিজের হাত চালাইয়া নিজের কান ধরিয়া থাকিবে; বা তাহার হাত পা বাঁধিয়া পশ্চাদ্দেশের বস্ত্র তুলিয়া জলবিছুটী দেওয়া হইবে, সে চুলকাইতে পারিবে না; বা একটা থলের মধ্যে একটা বিড়ালের সঙ্গে বালককে পুরিয়া মাটিতে গড়ানো হইবে এবং বালক বিড়ালের নখর ও দংষ্টাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হইবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।”[23] পাঠকপাঠিকা, আপনাদের কি হিন্দি সিনেমায় দেখা স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য পুলিশের থার্ডডিগ্রি প্রয়োগের সিনগুলির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে?

এমন নয়, যে এদেশে উচ্চশিক্ষা ছিল না। সংস্কৃত টোল ও চতুষ্পাঠীগুলিতে ন্যায়, দর্শন, কাব্য ইত্যাদিরও চর্চা হত, কিন্তু তা ছিল মূলত ব্রাহ্মণসন্তান, বড় জোর বৈদ্যসন্তানদের জন্য— সর্বসাধারণের জন্য নয়। ষোড়শ শতাব্দীতে লেখা মধ্যযুগীয় রক্ষণশীল স্মার্ত পণ্ডিতদের রচনা তখনও ছাত্রদের পাঠ্য। রঘুনন্দন ও কুল্লুকভট্টের ন্যায়, সাংখ্যের গবেষণা যা স্রেফ ব্রাহ্মণ ও কিছু সীমিত শিক্ষার্থীর কাছে অধিগম্য ছিল, তার মধ্যে আধুনিক চিন্তাধারার কোনও প্রতিফলন ছিল না। পাশ্চাত্য জগতের বিজ্ঞান ও সমাজদর্শনের চিন্তায় ততদিনে যে বিপ্লব এসে গিয়েছিল, বঙ্গদেশ তা থেকে বহু শতাব্দী পিছিয়ে ছিল।

শিক্ষাব্যবস্থার এই স্থবিরতা উনিশ শতকের প্রথমভাগের বঙ্গদেশকে কিভাবে প্রাণশক্তিহীন এক জড়বস্তুতে পরিণত করেছিল তার কিছু পরিচয় আমরা পাই রমেশ মজুমদারের লেখনীতে— “While the world outside had made rapid progress in different branches of secular learning during the preceding two hundred years, India practically stood still where it was six hundred years ago.”[24]

 

(ছয়)

বিড়ম্বনার এখানেই শেষ নয়। আগেই দেখিয়েছি, অ্যাডাম সাহেবের সার্ভে থেকে জানা গেছে পাঠশালায় পড়তে আসা মাত্র ১.৮২ শতাংশ তথাকথিত নিচু জাতের ছাত্র। অথচ পরমেশবাবুর দাবী, “আগের পাঠশালাগুলিতে একেবারে নিচুতলা থেকে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের ছেলেপুলে পড়তে আসত।”[25]

আপাতদৃষ্টিতে পরমেশবাবুর বক্তব্য বেশ যুক্তিগ্রাহ্য লাগলেও এই বক্তব্যটির মধ্য লুকিয়ে আছে অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল একটি ভাবনা। এটা স্বতঃসিদ্ধরূপে ধরে নেওয়া হচ্ছে জনসাধারণ চিরকাল অশিক্ষিত জনসাধারণই থাকবে, তাদের শিক্ষাসংস্কৃতির মান কোনওদিনও উন্নত হবে না। কাজেই তাদের উন্নত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা না করে শিক্ষাব্যবস্থাকে তাদের বর্তমান বোধশক্তির আয়ত্তের মধ্যে এনে দাঁড় করাতে হবে। এতে অবশ্য তাদের কোনও সুবিধা হোক বা না হোক শহুরে বুর্জোয়াশ্রেণির বেশ সুবিধা হয়, পাঠশালায় পড়ে গ্রামের কৃষক-শ্রমিকদের ছেলেরা কিন্তু উচ্চশিক্ষা ও চাকরির বাজারে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারতেন না, একথা অস্বীকার করবার বোধহয় কোনও অবকাশ নেই। এই প্রসঙ্গে বিবেকানন্দের একটি মন্তব্য মনে পড়ে যায়, “জ্ঞানোন্মেষ হলেও কুমোর কুমোরই থাকবে, জেলে জেলেই থাকবে, চাষা চাষই করবে। জাত-ব্যবসা ছাড়বে কেন? ‘সহজং কর্ম কৌন্তেয় সদোষমপি ন ত্যজেৎ’— এইভাবে শিক্ষা পেলে এরা নিজ নিজ বৃত্ত ছাড়বে কেন? জ্ঞানবলে নিজের সহজাত কর্ম যাতে আরও ভাল করে করতে পারে, সেই চেষ্টা করবে। দু-দশ জন প্রতিভাশালী লোক কালে তাদের ভেতর থেকে উঠবেই উঠবে। তাদের তোরা (ভদ্র জাতিরা) তোদের শ্রেণীর ভেতর করে নিবি।”[26] সম্ভবত পরমেশবাবু ও তাঁর মতাবলম্বী শহুরে বুদ্ধিজীবীদের দল এটাই চান। অনেকদিন আগেই ‘বাঙালি মস্তিষ্ক ও তার অপব্যবহার’ প্রবন্ধে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র প্রশ্ন তুলেছিলেন, “… ভূদেব ও বঙ্কিমচন্দ্রের লিখিত অভিমতের উপর নির্ভর করিয়া যাহারা বাঙালীর, এমন কি, হিন্দু জাতির গৌরবের শ্লাঘা করিয়া থাকেন, তাহারা অজ্ঞাতসারে ভ্রান্ত অভিমত পোষণ করেন মাত্র। রঘুনন্দন ও কুল্লুকভট্টের টীকা টিপ্পনী শ্লাঘার বিষয় জ্ঞান করিয়া যদি উহারই আদেশ সুভ্রান্ত সত্য মানিয়া, সেই অতীতপ্রায় কূট শিক্ষায় মনোনিবেশ আমাদের গৌরবের বিষয় বলিয়া অনুমিত হয়, আর বর্তমানের নূতন আশা, নূতন উদ্দীপনা ঠেলিয়া ফেলিয়া প্রাচীনের প্রচলন স্থির ধীর কৰ্ম্ম বলিয়া আদৃত হয়, জানি না এ মৃতপ্রায় জাতি নূতনের প্রবল অসহনীয় সংঘর্ষে আর কত দিন বাঁচিতে সক্ষম হইবে!”[27]

বঙ্গের এইরূপ ভয়াবহ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ছাত্রছাত্রীদের মুক্ত করে ইউরোপীয় পদ্ধতিতে প্রথাগত বিদ্যালয়ে স্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষার প্রচলন করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যথেষ্ট অপকর্ম করেছিলেন বইকি!


  1. পৃষ্ঠা ২৪, প্রসঙ্গ বিদ্যাসাগর, অমিয় কুমার সামন্ত, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি
  2. পৃষ্ঠা ১১৬, সিলেকশন ফ্রম এডুকেশনাল রেকর্ডস ১ম খণ্ড, এইচ সার্প, ব্যুরো অফ এডুকেশন, ১৯২০
  3. পৃষ্ঠা ২৫, প্রসঙ্গ বিদ্যাসাগর, অমিয় কুমার সামন্ত, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি
  4. পৃষ্ঠা ৫২৯, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, বিনয় ঘোষ,  ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান
  5. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫২৯
  6. পৃষ্ঠা ৭৪৬-৭৪৭, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, ইন্দ্র মিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স
  7. পৃষ্ঠা ২১০, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, বিনয় ঘোষ, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান
  8. পৃষ্ঠা ৪২, বাঙালি প্রবুদ্ধ জীবনের সীমা ও বিদ্যাসাগর এবং অন্যান্য প্রবন্ধ, পরমেশ আচার্য, অনুষ্টুপ
  9. পৃষ্ঠা ১৮, অ্যাডাম রিপোর্টস অন ভার্নাকুলার এডুকেশন অফ বেঙ্গল অ্যান্ড বিহার,  রেভারেন্ড জেমস লং সঙ্কলিত, হোম সেক্রেটারিয়েট প্রেস
  10. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৪-১৫
  11. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৫১
  12. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৫১-১৫২
  13. পৃষ্ঠা ৪২, বাঙালি প্রবুদ্ধ জীবনের সীমা ও বিদ্যাসাগর এবং অন্যান্য প্রবন্ধ, পরমেশ আচার্য, অনুষ্টুপ
  14. পৃষ্ঠা ৩১১, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, বিনয় ঘোষ, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান
  15. পৃষ্ঠা ৯৮, বাঙালি প্রবুদ্ধ জীবনের সীমা ও বিদ্যাসাগর এবং অন্যান্য প্রবন্ধ, পরমেশ আচার্য, অনুষ্টুপ
  16. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৬৯
  17. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪৫
  18. পৃষ্ঠা ৩৩, বাণী ও রচনা নবম খণ্ড, স্বামী বিবেকানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়
  19. পৃষ্ঠা ৩০, রামতনু  লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, শিবনাথ শাস্ত্রী, এস কে লাহিড়ী অ্যান্ড কোং
  20. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩০
  21. পৃষ্ঠা ৭৪৮, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, ইন্দ্র মিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স
  22. পৃষ্ঠা ৩১, রামতনু  লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ,  শিবনাথ শাস্ত্রী, এস কে লাহিড়ী অ্যান্ড কোং
  23. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩২
  24. পৃষ্ঠা ১১, গ্লিম্পসেস অফ বেঙ্গল ইন দ্য নাইনটিনথ সেঞ্চুরি, রমেশচন্দ্র মজুমদার, ফার্মা
  25. পৃষ্ঠা ৫৪, বাঙালি প্রবুদ্ধ জীবনের সীমা ও বিদ্যাসাগর এবং অন্যান্য প্রবন্ধ, পরমেশ আচার্য, অনুষ্টুপ
  26. পৃষ্ঠা ১০৯, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা নবম খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়
  27. পৃষ্ঠা ৩, আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী, রমেশচন্দ্র চক্রবর্তী সম্পাদিত, চক্রবর্তী চ্য‍াটার্জী এণ্ড কোম্পানী লিমিটেড

ছবি সৌজন্য: ড্রয়িং একাডেমী, ইউটিউব।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...