আবার সাভারকর

অমিতাভ কর

 

গত ১০ অক্টোবর, ২০২০ আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় সাভারকরকে আবার দেশপ্রেমিক রূপে তুলে ধরার একটা চেষ্টা করা হয়েছে। চেষ্টাটা করেছেন আর কেউ নয়, খোদ বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। মোটামুটি রাজনীতিসচেতন জনতার কাছে সাভারকরের জাতীয় বিশ্বাসঘাতকের চরিত্রটি সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর আবর্তনের ঘটনার মতই সত্য, আর সেটিকে ঘুলিয়ে দেবার জন্যই কার্তিকচন্দ্র পালের জিওসেন্ট্রিক (সূর্য পৃথিবীর চারদিকে আবর্তন করার) তত্ত্ব হাজির করার মতই বিদ্যুৎ চক্রবর্তী সেই একই পুরানো “মুচলেকা ছিল একটা কৌশলগত প্রচেষ্টা”-র তত্ত্বই আমাদের গেলাতে চেয়েছেন। তাঁর এই লেখায় তিনি শুধুমাত্র সাভারকরের শেষ প্রকাশ্যে আসা মুচলেকাটির উল্লেখ করেছেন। তিনি এমন ভান করেছেন যেন সাভারকর ১৯২০ সালে ওই একটি মুচলেকাই দিয়েছেন। আসলে সাভারকর ১৯১১ সালে আন্দামানের সেলুলার জেলে আসার পর ১৯২১ সালে ভারবর্ষের মূল ভূখণ্ডে স্থানান্তরিত হওয়ার আগে পর্যন্ত কম করেও পাঁচটি ক্ষমাভিক্ষার চিঠি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে দিয়েছিলেন। তাঁর এই মুচলেকা দিয়ে ক্ষমাভিক্ষার বিনিময়ে মুক্তিপ্রার্থনার বিষয়টি প্রথম প্রকাশ্যে আসে যখন ১৯৭৫ সালে যখন ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্ত তাঁর “Penal Settlement in Andaman” বইতে দিল্লির মহাফেজখানা ঘেঁটে ১৯১৩ সালে তাঁর ক্ষমাভিক্ষার দ্বিতীয় আবেদনপত্রটি প্রকাশ করেন। সাভারকরের মুচলেকার বাকি চারটির মধ্যে শেষ ১৯২০ সালের পত্রটি যেটির উল্লেখ শ্রী চক্রবর্তী এখানে করেছেন, সেটি প্রথম প্রকাশ্যে আসে ফ্রন্টিয়ার পত্রিকার ১২-২৫ মার্চ, ২০০৫ সংখ্যাতে। এই দুটি আবেদনপত্রে সাভারকর আরও তিনটি— ১৯১১ সালে সেলুলার জেলে আসার কয়েক মাসের মধ্যে, ১৯১৪ সালে, এবং ১৯১৮ সালে ক্ষমাভিক্ষার আবেদনপত্রের উল্লেখ করেছেন। এই সবগুলিতেই তিনি তাঁর কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা জ্ঞাপন করে মুক্তিসংগ্রামের সবধরনের বেআইনি-আইনি পথ পরিহার করে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সবরকম সহযোহিতার বিনিময়েই মুক্তি ভিক্ষা প্রার্থনা করেছিলেন।

সবচাইতে বড় কথা, শ্রী চক্রবর্তী “যে চিঠিটি ১৯২০ সালে জেলমুক্তির জন্য দেন, … তার মধ্যে নিহিত ছিল তাঁর এক বিশেষ ভাবনা, যা পরবর্তীকালে তাঁর ভাবাদর্শে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে।” এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এক “বিশেষ ভাবনা”র উল্লেখ করলেন, কিন্তু কী সেই বিশেষ ভাবনা বা পরবর্তীকালের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সেসব বিষয়ে একটা কথাও খরচ করলেন না। তার পরিবর্তে তাঁর প্রথম বই “First War of Independence, 1857”-তে সাভারকরের মূল্যায়ন যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী হিন্দু-মুসলিম ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের কথা, তা লিখে তাঁর প্রবন্ধ শেষ করেছেন। তা সাভারকরের এই মূল্যায়ন তো ১৯০৭-০৮ সালের মূল্যায়ন। তারপর ১৯২০ সালে তাঁর ভাবাদর্শে কী সেই বিশেষ পরিবর্তন ঘটল, সে সম্পর্কে শ্রী চক্রবর্তী নীরব রইলেন কেন? কারণ সেই বিশেষ পরিবর্তন ছিল হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের জয়গানের পরিবর্তে হিন্দু-মুসলমান পরস্পরবিরোধী দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিভেদের বীজ বপনের “বৈপ্লবিক” পরিবর্তন। আর তাই সেটা সঙ্ঘ পরিবারের তাত্ত্বিক হিসাবে ব্যক্ত করা তাঁর পক্ষে যে অসম্ভব।

জেল থেকে ১৯২৪ সালে মুক্ত হওয়ার পর তিনি তাঁর দ্বিতীয় পুস্তক “হিন্দুত্ব”তে যে হিন্দুত্ব তত্ত্বের ফেরি করেন তার সার কথা ছিল— তারাই হিন্দুত্বের আওতায় আসবে যাদের মাতৃভূমি এবং পূণ্যভূমি ভারতবর্ষ হবে। মাতৃভূমি বলতে জন্মভূমি আর পূণ্যভূমি নিজ নিজ ধর্মের উৎসস্থল। সেই অর্থে উচ্চ-নিম্ন সব বর্ণের হিন্দু, দলিত, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, মায় আদিবাসীরা পর্যন্ত সবাই হিন্দুত্বের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু মুসলমান আর খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা হিন্দুত্বের মধ্যে গণ্য হতে পারে না কারণ তাদের জন্মভূমি ভারতবর্ষে হলেও পুণ্যভূমি তো এ দেশ নয়, তাদের ধর্মের উৎস ভারতবর্ষ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে আরব অথবা প্যালেস্তাইনে। সুতরাং হিন্দুত্বের বাইরে এরা অন্য জাতি। এই হিন্দুত্ব তত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে হিন্দু-মুসলমান দুটি আলাদা জাতির ধারণা ভারতীয় জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ প্রভুদের “Divide and Rule Policy”-কে ১৯২৪ সাল থেকে মদত জোগাতে লাগলেন সাভারকর। খুবই তাৎপর্যপুর্ণভাবে তিনি ১৯১৪ সালের ক্ষমাভিক্ষার আবেদনপত্রে অঙ্গীকার করেছিলেন, “আমার ক্ষমতা অনুযায়ী সরকারের চাহিদামত তার সেবা করতে চাই, কারণ আমার রূপান্তর যেহেতু বিবেকনির্দেশিত, সুতরাং আমার ভবিষ্যৎ ব্যবহারও আশা করি সেইরকম হবে। … অন্য যা কিছু হতে পারত তার তুলনায় আমাকে জেলে ভরে রেখে কিছুই অর্জিত হবে না।” আর ১৯২০ সালের শেষ চিঠিতে তিনি জানাচ্ছেন, “আমার জীবনারম্ভের উজ্জ্বল সম্ভাবনার সবকিছুই কিন্তু দ্রুত অন্ধকারময় হয়ে যাওয়াতে আমার মনে অনুশচনার যে যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়েছে তাতে একটা মুক্তি আমাকে নতুন জীবন দান করবে এবং আপনার দয়াশীলতা আমার সংবেদনশীল বিনয়ী হৃদয়কে এত গভীরভাবে স্পর্শ করবে যে সেটি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে যুক্ত হতে ও রাজনৈতিকভাবে কার্যকরী হতে সাহায্য করবে।”

সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় জনতার ক্ষোভকে প্রশমিত করতে ১৯১৯ সালে Indian Council Act, 1919-এর মাধ্যমে কিছু সংস্কার চালু করে যার একটা অংশ ছিল “রাজকীয় ক্ষমা প্রদর্শন” (The royal Clemency)। তাতে সেই সময়কার সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক বন্দিদের ক্ষমা প্রদর্শন করে মুক্তিদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। স্বয়ং রাজা পঞ্চম জর্জের পক্ষ থেকে এই ঘোষণায় সমস্ত রাজনৈতিক কারণে অর্থাৎ দেশের মুক্তির জন্য “… যারা সরাসরি আমার প্রজাদের হত্যা করার কাজে অংশ নিয়েছিল … তাদের অব্যাহতি দেওয়ার জন্য আমি আমার নামে এবং আমার হয়ে ভাইসরয়কে … আমার রাজকীয় ক্ষমা প্রদর্শন প্রয়োগ করার নির্দেশ দিচ্ছি।” আর এই মুক্তিদান ছিল নিঃশর্ত অর্থাৎ কোনওরকম মুচলেকা, জামিন দাখিল করার কথাই ছিল না। এই নির্দেশনামার ফলেই সেলুলার জেল থেকে বারীন ঘোষ, হেমচন্দ্র কানুনগো, উল্লাসকর দত্ত মুক্ত হন— এর জন্য এঁদের কোনও মুচলেকা দিতে হয়নি। সাভারকরেরও এই নির্দেশনামার ফলে মুক্তি পাওয়ার কথা। অথচ তাঁর যে মুচলেকামূলক চিঠিটির কথা শ্রী চক্রবর্তী তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন, সেখানে সাভারকর আগ বাড়িয়ে তাঁকে ও তাঁর ভাইকে এই ক্ষমা প্রদর্শনের আওতায় আনতে কর্তৃপক্ষ যাতে ভুল না করে সে কথা বিশদে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন— “রাজকীয় ঘোষণাটি অত্যন্ত মহানুভবতার সঙ্গে ব্যক্ত করেছে যে রাজকীয় ক্ষমা প্রদর্শন সেই সমস্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও সম্প্রসারিত করা হবে যারা ‘রাজনৈতিক অগ্রগতির স্বার্থে’ ব্যগ্রতার জন্য আইনভঙ্গ করে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। আমার ও আমার ভাইয়ের মামলাগুলিও সর্বদা এইধরনের।” এবং ব্রিটিশ সরকার তাঁকে মুক্তি দিলে তাঁর সেই মুক্তি তাদের কাছে “রাজনৈতিকভাবে কার্যকরী হতে সাহায্য করবে।” বলে অঙ্গীকার করছেন। যেখানে ব্রিটিশ সরকার নিজে থেকেই একতরফাভাবে সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিদের নিঃশর্তে মুক্তি দেওয়ার অঙ্গীকার করছে এবং বারীন ঘোষ, হেমচন্দ্র, উল্লাসকরদের আন্দামান জেল থেকে মুক্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করার মধ্য দিয়ে তার অঙ্গীকার পালন করছে, সেখানে আগ বাড়িয়ে ব্রিটিশ সরকারকে রাজনৈতিকভাবে সহযোহিতা করার “মুচলেকা ছিল একটা কৌশলগত প্রচেষ্টা”— বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর এহেন মূল্যায়নে ঘোড়াও হাসবে।

 

আন্দামান জেলে সাভারকরের ভূমিকা

সাভারকার ১৯১০ থেকে ১৯২১ পর্যন্ত আন্দামানে সেলুলার জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় ব্রিটিশ সরকারের কাছে একের পর এক ক্ষমাভিক্ষার আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন— তার একটিতে তিনি কথা দিচ্ছেন— “সুতরাং সরকার যদি এখন তার বহুমুখী দয়াদাক্ষিণ্যের বশবর্তী হয়ে আমাকে মুক্তিদান করে, তাহলে একা হলেও আমি সাংবিধানিক অগ্রগতির একনিষ্ঠ প্রবক্তা ছাড়া আর কিছুই হয়ে উঠব না এবং ইংরেজ সরকারের প্রতি বিশ্বস্ত থাকব। এই একনিষ্ঠতা এবং বিশ্বস্ততা (সাংবিধানিক) অগ্রগতির জন্য সবচাইতে বড় শর্ত।” আর ব্রিটিশ সরকারের দয়াদাক্ষিণ্যে তিনি যদি মুক্তি পান তাহলে “আমার এই রূপান্তর ভারতবর্ষ ও বিদেশের সেই সমস্ত বিপথগামী যুবক যারা পথপ্রদর্শক হিসাবে আমার দিকে তাকিয়েছিল, তাদেরকেও ফিরিয়ে আনবে। আমার ক্ষমতা অনুযায়ী সরকারের চাহিদামত তার সেবা করতে চাই, কারণ আমার এই রূপান্তর যেহেতু বিবেকনির্দেশিত, সুতরাং আমার ভবিষ্যৎ ব্যবহারও আশাকরি সেইরকমই হবে।” তাঁর শেষ আবেদনপত্রে তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ে ঘোষণা করছেন যে, “প্রতিটি বুদ্ধিমান ভারতপ্রেমীকে ভারতবর্ষের নিজের স্বার্থেই আন্তরিকতার সঙ্গে বিশ্বস্তভাবে ব্রিটিশ জনগণের সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে।… আমার মনে অনুশোচনার যে যন্ত্রণা সৃষ্টি হয়েছে তাতে একটা মুক্তি আমাকে নতুন জীবন দান করবে এবং আপনার দয়াশীলতা আমার সংবেদনশীল, বিনয়ী হৃদয়কে এত গভীরভাবে স্পর্শ করবে যে সেটি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে মুক্ত হতে ও রাজনৈতিকভাবে কার্যকরী হতে সাহায্য করবে। কারণ প্রায়ই যেখানে শক্তি ব্যর্থ হয়, মহানুভবতা সেখানে জয়লাভ করে।”

আর একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে যে অন্যান্য বিপ্লবী বন্দিরা জেল কর্তৃপক্ষের যে অত্যাচার সহ্য করেছেন, তার হাজার ভাগের এক ভাগ অত্যাচারও সাভারকার ভাইদের সহ্য করতে হয়নি। কারণ সহজেই অনুমেয়। যখন তাঁরই সঙ্গে আসা কলকাতার বিপ্লবী বন্দি উল্লাসকর দত্ত অত্যাচারের ফলে উন্মাদ হয়ে যান, যখন আর এক বন্দি ইন্দুভূষণ রায় আত্মহত্যা করেন, সেই সময়ে আন্দামান জেল পরিদর্শনে আসা এক ব্রিটিশ আমলা তাঁকে প্রশংসা করে বলেছিল, “এরকম শিক্ষাদীক্ষা, এতদূর পড়াশুনা … তুমি তো আমাদের সরকারের সর্বোচ্চ পদগুলিতে বসতে পারতে।” একথা সাভারকার নিজেই তাঁর ক্ষমাভিক্ষার চিঠিতে জানিয়েছিলেন। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। তাঁর নিজেরই লেখা “মাই ট্রান্সপোর্টেশন ফর লাইফ” বইতে খোলাখুলি জানিয়েছেন, কীভাবে ননীগোপাল নামে এক ১৬ বছরের তরুণ জেল কর্তৃপক্ষের অত্যাচারের বিরূদ্ধে হাঙ্গার স্ট্রাইক শুরু করেন, এবং সেই আন্দোলন তুলে নেওয়ার জন্য তিনি তাঁকে নানাভাবে ভুজুংভাজুং দিতে থাকেন। তিনি তঁকে বলেন যে জেলের মধ্যে অনশন করে মেয়েদের মত মরার কোনও মানে হয় না। যদি মরতেই হয় তাহলে সাহসের সঙ্গে একটা শত্রুকে মেরে মরা উচিৎ, ইত্যাদি। সাভারকরের ব্রিটিশ চাটুকারিতা দিনের আলোর মত এমন সত্য যে, তাকে ৩৫৪ কেন, ৫৪২x৫৬ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের ধামা দিয়েও চাপা দেওয়া যাবে না।

অবশেষে ১৯২১ সালে তাকে আন্দামান থেকে মূল ভূখণ্ডের প্রথমে রত্নগিরি, পরে ইয়ারভাডা জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। এই রত্নগিরি জেলে থাকাকালেই তিনি “হিন্দুত্ব” বইটি লেখেন। ১৯২৪ সালে শর্তাধীনে তিনি জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ব্রিটিশ সরকারের চাহিদামতই তার সেবা করার উদ্দেশ্যে তাঁর ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি’কে কার্যকর করার জন্য ‘হিন্দু মহাসভা’ গড়ে তুললেন এবং ভারতবর্ষের হিন্দু ও মুসলমান জনতার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে আমদানি করলেন হিন্দুত্ব তত্ত্ব— যেখানে মুসলমান বাদে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য শূদ্র দলিত সহ ভারতের আর সমস্ত জনজাতি— বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, এমনকি আদিবাসীদের হিন্দুত্বের ছত্রছায়ায় এনে সবাইকে হিন্দু জাতি হিসাবে ঘোষণা করে কার্যত মুসলমানদের আলাদা জাতি হিসাবে দেগে দেওয়া হল। কারণ মুসলমানেরা ভারতবর্ষে জন্মালেও তাদের পুণ্যভূমি ভারতবর্ষ নয়। তিনি পরিষ্কার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করলেন যে শুধু স্বাধীনতার আগে নয় স্বাধীনতার পরেও মুসলমানদের বিশ্বাস করা যাবে না। এইভাবে তিনি হিন্দু জনমানসে মুসলমানেদের প্রতি সন্দেহ, অবিশ্বাসের বাতাবরণ সৃষ্টি করে মতাদর্শগতভাবে ব্রিটিশদের ‘ডিভাইড আ্যন্ড রুল’ পলিসিকে কার্যকর করলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধপ্রচেষ্টাকে সর্বতোভাবে মদত দেওয়ার জন্য হিন্দু মহাসভার সমস্ত সদস্যদের নির্দেশ দিলেন। “এখন ভারতের প্রতিরক্ষা বিষয়ে বলতে গেলে, হিন্দুত্ববাদকে ভারত সরকারের (ব্রিটিশ সরকারের) যুদ্ধ প্রচেষ্টাতে দায়িত্বশীল সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত তা হিন্দু স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়, আমাদের নিঃসঙ্কোচে মৈত্রীর হাত বাড়িয়ে যত বেশি সংখ্যায় সম্ভব সৈন্য-নৌ-বিমান বাহিনীতে যোগদান কারতে হবে। … একমাত্র ভারতবর্ষকে রক্ষা করার জন্য সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে তীব্র করেই তা করা সম্ভব। অতএব হিন্দু মহাসভার সদস্যদের এক মিনিটও সময় নষ্ট না করে অতি অবশ্যই হিন্দুদের, বিশেষত বাংলা ও অসম প্রদেশের হিন্দুদের সামরিক বাহিনীর সব বিভাগে যোগ দিতে যথাসম্ভব কার্যকরী উপায়ে উদ্দীপিত করতে হবে।” (ভাগলপুরে ১৯৪১ সালে হিন্দু মহাসভার ২৩তম অধিবেশনে  বক্তৃতার অংশ)

আরও ন্যক্কারজনক ঘটনা এই যে যখন ১৯৪২ সালের ৮ই আগস্ট গান্ধি “কুইট ইণ্ডিয়া” আন্দোলনের ডাক দিলেন, তখন “গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট, ১৯৩৫” অনুসারে সমস্ত প্রদেশে নির্বাচনে গঠিত মন্ত্রিসভা থেকে কংগ্রেসি মন্ত্রিরা পদত্যাগ করলেন। আর সেই সুযোগে “হিন্দু মহাসভা” এই আন্দোলনের বিরোধিতা করে মুসলিম লিগের সঙ্গে জোট তৈরি করে সিন্ধ ও বাংলা প্রদেশে মন্ত্রীসভা গঠন করে ফেলল। “ব্যবহারিক রাজনীতিতেও মহাসভা জানে যে আমাদের অবশ্যই যথাযথ সমঝোতার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। সিন্ধের সদ্য সদ্য ঘটনাবলিই সাক্ষী আছে, সিন্ধ-হিন্দুসভা আমন্ত্রণ পেয়ে জোট সরকার চালানোর জন্য নিজে থেকেই লিগের সঙ্গে হাত মেলানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল। বাংলা প্রদেশের বিষয়টি সর্বজনবিদিত। ক্ষিপ্ত লিগওয়ালা, যাদের বশংবদ কংগ্রেসিরা পর্যন্ত শান্ত করতে পারেনি, সেই তারাও যে মুহূর্তে হিন্দু মহাসভার সংস্পর্শে এল, সেই মুহূর্ত থেকেই কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন সমঝোতাপূর্ণ মনোভাবী এবং সামাজিক কেতাদুরস্ত হয়ে উঠল এবং মিঃ ফজলুল হক-এর প্রধানমন্ত্রীত্বাধীন ও আমাদের মহামান্য মহাসভা নেতা ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর সক্ষম নেতৃত্বাধীন জোট সরকার উভয় সম্প্রদায়ের উপকারার্থে এক বছরের মত সার্থকতার সঙ্গে তার কাজকর্ম চালিয়ে গিয়েছিল।” (১৯৪২ সালে কানপুরে হিন্দু মহাসভার ২৪তম অধিবেশনে সভাপতির ভাষণ থেকে)

আরও মজার ঘটনা হচ্ছে যে সিন্ধ মন্ত্রিসভাতে থাকালীন ১৯৪৩ সালে সিন্ধ মন্ত্রিসভায় যখন মুসলিম লিগ পাকিস্তান গঠনের পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করে, তখন যারা সরকারিভাবে সবসময় দেশভাগের বিরূদ্ধে জান-প্রাণ লড়িয়ে দেওয়ার শপথ নিয়ে থাকে সেই হিন্দু মহাসভার মন্ত্রীরা কিন্তু সিন্ধ সরকার থেকে এই প্রস্তাব গ্রহণের বিরূদ্ধে পদত্যাগ করল না, শুধুমাত্র প্রতিবাদ জানিয়েই চুপ করে রইল।

সুতরাং সাভারকর জেল থেকে মুক্তিভিক্ষার আবেদনপত্রে ব্রিটিশ সরকারকে যে কথা দিয়েছিলেন, মুক্তি পাওয়ার পর তিনি সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন— সর্বতোভাবে ব্রিটিশের “ডিভাইড অ্যান্ড রুল” পলিশিকে কার্যকর করতে হিন্দু মহাসভা গঠন করে হিন্দু জনমানসে মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন, “কুইট ইন্ডিয়া” আন্দোলনের সক্রিয় বিরোধিতা করেছিলেন, সেই সাভারকারকে আজ মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সঙ্ঘ পরিবারের সদস্য হিসাবে শ্রী বিদ্যুৎ চক্রবর্তী উঠেপড়ে লেগেছেন। এ প্রচেষ্টাকে মতাদর্শগতভাবে প্রতিহত করতেই হবে।

 

“Indian War of Independence, 1857,” প্রসঙ্গে

সাভারকরই প্রথম ভারতীয় যিনি তাঁর “Indian War of Independence, 1857,” বা সংক্ষেপে IWI বইটিতে ১৮৫৭ সালের ঐতিহাসিক গণ অভ্যুত্থানকে সিপাহীদের একটা নিছক বিদ্রোহ বলে ব্রিটিশ অনুগত ঐতিহাসিকদের লালিতপালিত ৫০ বছর ধরে বিকৃত রটনার বিরোধিতা করে তাকে সঠিক প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠিত করে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসাবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন। এই বইটিকে ভিকাজি কামা থেকে শুরু করে এমনকি ভগৎ সিং পর্যন্ত সবাই উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন। তাঁর এই বইটির রচনাকাল ১৯০৭-০৯-এর মধ্যে, যখন তিনি ইংল্যান্ডে বৈপ্লবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই বইটির প্রকাশের ইতিহাসও কম কৌতূহলোদ্দীপক নয়। এই বইটির বিষয়বস্তু তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকারকে প্রচণ্ডরকম আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছিল এবং বইটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। তা সত্ত্বেও বইটি বিপ্লবীদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার বইটি স্বীকার করতেই হয় তাঁর আন্তরিক কঠোর পরিশ্রমলব্ধ গবেষণার ফসল।

এই স্বাধীনতা যুদ্ধ হিন্দু মুসলমান সহ ব্যপক জনতার গণ অভ্যুত্থান, মুক্তকণ্ঠে সাভারকর তার স্বীকৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, “শুধুমাত্র একক ব্যক্তি বা একক শ্রেণি তাদের দেশের গভীর দুর্দশাতে গভীরভাবে বিচলিত হয়নি। হিন্দু এবং মুসলমান, ব্রাহ্মণ এবং মৌলভি, … মায়ের এই পীড়ণ সহ্য করতে না পেরে অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বিপ্লব শুরু করল।” যে বাহাদুর শাহ জাফরকে মীরাটের বিদ্রোহী সৈন্যরা ভারতের সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করে তাঁর আদেশ মেনেই ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর বিরূদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন বলে অঙ্গীকার করলেন, সেই ঘটনার উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, “(বাহাদুর শাহকে সিংহাসনে বসানোর অর্থ) এটা ঘোষণা করা যে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সুদীর্ঘকালব্যপী যুদ্ধের অবসান ঘটল, স্বৈরাচারের অবসান ঘটল, এবং এই ভূমির জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের সম্রাটকে বেছে নিতে পারবে। কারণ, হিন্দু ও মুসলমান, সিভিল ও মিলিটারি সর্বস্তরের জনগণের স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে বাহাদুর শাহ তাদের সম্রাট এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতা হিসাবে মনোনীত হয়েছিলেন।… সুতরাং ১১ই মে, ১৮৫৭ সালে হিন্দু ও মুসলমানেরা এই মাতৃভূমির নির্বাচিত অথবা মনোনীত সম্রাটের প্রতি তাদের আন্তরিক, এবং পরম বিশ্বস্ত শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রেরণ করল।”। এই বইটির ছত্রে ছত্রে “ফিরিঙ্গি”দের বিরুদ্ধে জেহাদি ঘৃণা ফুটে উঠেছে।

কিন্তু আইরনি এটাই যে জেল থেকে মুক্তি দিলে ব্রিটিশ সরকারের বিরূদ্ধে কোনওরকম আন্দোলনে অংশ না নিয়ে তার বিশ্বস্ত প্রজা হিসাবে কালাতিপাত করবেন— ১৯১১ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত মোট পাঁচটি ক্ষমাভিক্ষার আবেদনপত্রে এইরকম শপথভরা আশ্বাস দেওয়ার পর প্রথমে তাঁকে আন্দামান জেল থেকে ভারতের জেলে স্থানান্তরিত ও তারপর শর্তাধীনে মুক্ত হলে তিনি প্রথম যুগের ব্রিটিশ-ঘৃণাকে মুসলিম-ঘৃণাতে রূপান্তরিত করে ফেলেন। তাঁর এই রূপান্তরের বিষয়টিকে ফ্রন্টলাইন পত্রিকা তার ভলিউম ১৯, ইস্যু ১৫, জুলাই ২০-আগস্ট ২, ২০০২ সংখ্যার একটি প্রবন্ধে সামারাইজ করেছে— “সংক্ষেপে বলতে হলে, সাভারকর একজন বিশাল হৃদয়ের বিপ্লবী হিসাবে শুরু করলেন, তারপর ন্যক্কারজনকভাবে আন্দামানে তঁর নীতিগুলিকে বিসর্জন দিলেন, সেখানে সহ-বন্দিদের সংগ্রামে যোগ দিতে অস্বীকার করলেন, জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সবরকম ব্রিটিশ-বিরোধী কার্যকলাপ থেকে দূরে সরে রইলেন এবং বিষাক্ত মুসলিম-বিরোধী অভিযান চালিয়ে ব্রিটিশের “ডিভাইড অ্যান্ড রুল” নীতিকে সাহায্য করা দিয়ে শেষ করলেন।”

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4651 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...