প্রবুদ্ধ ঘোষ
লেখক সাহিত্য-গবেষক, দাবা-প্রশিক্ষক
নব্বইয়ের দশকে যাদের বাল্যকাল, তারা লোকাল কমিটির অফিসে পাঁচটা ছবি ঝুলতে দেখতুম। বাঁদিক থেকে দ্বিতীয় ছবিটি এঙ্গেলসের। বোধবেলায় পৌঁছে শুনতুম মার্ক্স-এঙ্গেলস এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হচ্ছে। যদিও দর্শনের নাম মার্ক্সবাদ, তবু অবিচ্ছেদ্য দুটো নাম। আরেকটু পরিণত বয়সে জানলুম যে, মার্ক্সবাদের দর্শনকে কেন্দ্র করে কয়েকশো কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি হয়েছে, কারও ব্র্যাকেট আছে কারও নেই। কিন্তু, এই কমিউনিস্ট পার্টিগুলির নিজেদের মধ্যে ‘সাচ্চা’ প্রমাণের অম্লমধুর সম্পর্ক আর প্রতিযোগিতার মধ্যেও মার্ক্স-এঙ্গেলস এদের প্রত্যেকের কাছেই ঈশ্বরতুল্য মান্য! কেন ‘এঙ্গেলসবাদ’ হল না (এঙ্গেলসের কিচ্ছু যায় আসেনি তাতে) সে অন্য আলোচনা। কিন্তু, এই শ্রেণিবিভক্ত, ধর্ম-বর্ণ-জাতি-লিঙ্গবিভক্ত সমাজকাঠামোয় ফ্রেডেরিক এঙ্গেলসের প্রতিস্পর্ধী অবদান তাঁর জন্মের দুশো বছর পরেও আলোচ্য।
#
এঙ্গেলস ইংল্যান্ডের ম্যাঞ্চেস্টারে সওদাগরী অফিসের ম্যানেজার ছিলেন, তাঁর বাবা সেই অফিসের অন্যতম অংশীদার ছিলেন। এঙ্গেলস শুধুমাত্র ম্যানেজারি করতেন না, বরং শ্রমিকবস্তিতে ঘুরে ঘুরে তাঁদের যাপন ও সামাজিক অবস্থান খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন। ১৮৪৫ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়েসে গবেষণাগ্রন্থ ‘দ্য কন্ডিশন অফ ওয়র্কিং ক্লাস ইন ইংল্যান্ড’ লিখেছিলেন এবং শ্রমিকশ্রেণির তত্ত্বায়নের সেটাই সূচনা। শ্রমিকশ্রেণির রাজনৈতিক লক্ষ্য ও নির্বিত্তের অধিকারের সংগ্রাম যে আগামীর বিশ্বরাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে, এঙ্গেলস তার দিশা দেখতে পেয়েছিলেন। এঙ্গেলস হেগেলীয় দর্শনকে যুগপৎ গ্রহণ ও বর্জন করে প্রতিষ্ঠা করলেন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনকে। ভাববাদের সঙ্গে সেই যে প্রকাশ্যে তাত্ত্বিক ও অনুশীলনগত সংগ্রাম শুরু হল বস্তুবাদের, তা আর থামল না বরং মেরুকরণ স্পষ্ট হতে লাগল। ১৮৪৮ সালে ‘কমিউনিস্ট ইস্তেহার’ লেখার আগে পর্যন্ত প্যারিস ও ব্রাসেলসের শ্রমিকদের সঙ্গে ফের মিশে যান, তত্ত্বের সঙ্গে ব্যবহারিক কাজকে মিলিয়ে নেওয়ার পুনর্প্রস্তুতি। মাত্র কয়েকপাতার একটি বইয়ের প্রতিটি শব্দেই ভবিষ্যতের বহু দ্রোহসম্ভাবনার বীজ উপ্ত ছিল। আর, তত্ত্ব ও অনুশীলনের সামঞ্জস্য, তত্ত্বের সঙ্গে ব্যবহারিক প্রয়োগের মেলবন্ধনই পেরেছিল নির্বিত্তের বিপ্লবের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠতে।
আমাদের প্রজন্ম এই সামঞ্জস্যের খোঁজ করে চলেছে এখনও। আমাদের ভার্চুয়াল বিচরণের জগতে, আমাদের পণ্যকামী আকাঙ্খায়, আমাদের ক্রমশ ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যাষ্টিবিমুখ যাপনে, আমাদের নীতি-দুর্নীতির ধূসর প্রান্তরে এই সামঞ্জস্য কোথায়? এঙ্গেলস বা মার্ক্সের প্রয়োজন কোথায়? তাঁদের নামে বিপ্লবের রসিদবই কাটার চল আছে, তাঁদের নামে রচিত সাহিত্য-শিল্পের বাজারদর মন্দ নয়, তাঁদের নামোচ্চারণে বিতর্কসভায় পুরস্কার মেলে, তাঁদের উদ্ধৃতি দিলে ফেসবুকে লাইক-শেয়ার বাড়ে এবং তাঁদের নির্বিত্তের মতাদর্শকে নিশ্চয়তামতো সংশোধন-মাপেমাপ করে নিলে মধ্যবিত্তের সহানুভূতি আকর্ষণ টান টান থাকে। কিন্তু, তারপর? ষাট-সত্তর দশক গোটা বিশ্বজুড়ে এঙ্গেলস-মার্ক্সের তত্ত্বানুশীলনের উদ্যাপন দেখেছে, ভারতবর্ষে নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহ দেখেছে। তারপর? পুঁজিবাদ ডুবে যেতে যেতেও বীরবিক্রমে উদারনৈতিক-বেসরকারি-বিশ্বায়নী খড়কুটোয় সামলে নিয়েছে। ব্যক্তিপ্রবণতা ও সামাজিক স্টেটাসের ধোঁয়াশায় শ্রেণিবোধকে গুলিয়ে দিয়েছে, ‘নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নেওয়ার বোধকে পোক্ত করেছে। নিরাজনীতিকরণের ধারাবাহিকতায় রাজনীতিকে বিপজ্জনক, ‘ছোটলোকের আখড়া’ ইত্যাদি বোধে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে এবং সচেতন ক্রিয়াশীলতাকে নিস্পৃহ-নিরাপদ দূরত্বে ঠেলে রেখেছে। না, আমার দিব্যি ভাত হজম হয় মার্ক্স-এঙ্গেলস না আউড়েও। আর, এই লেখা যিনি পড়ছেন তাঁরও ভাত-রুটি সবই দিব্যি হজম হয় মার্ক্স-এঙ্গেলসের পাতা কয়েকদিন না উল্টোলেও।
If by chance, they are revolutionary, they are only so in view of their impending transfer into the proletariat; they thus defend not their present, but their future interests, they desert their own standpoint to place themselves at that of the proletariat.
আর্থ-সামাজিক দুরবস্থা আর রাজনৈতিক অন্ধকারে আমাদের প্রতিক্রিয়া হয়, আমরা প্রতিক্রিয়া দিতে ভালবাসি, আমাদের স্বোপার্জিত চেতনা-বন্ধু-বিবেক-সম্পর্ক ইত্যাদি তৃপ্ত হয়। কখনও খুব ভয়ে আঁতকে উঠে দুটো বক্তৃতা, তিনটে কবিতা, পাঁচজোড়া কথোপকথন। তারপর হেমন্তের শেষসন্ধের মতোই অমোঘ হিম সবকিছুর ওপরে আর মার্ক্স-এঙ্গেলসকে আকাশপ্রদীপের মতো টাঙিয়ে রাখা।
কিন্তু মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন, মাও এই নামগুলো জ্বলে থাকে শাসক যতই তাদের নিভিয়ে দিতে চাক। কেন থাকে? এঙ্গেলস না জন্মালেও নিপীড়িতের বিদ্রোহ হত, মার্ক্স না লিখলেও নির্বিত্তরা ক্ষোভে ফেটে পড়ত, এঙ্গেলস-মার্ক্স নিষ্ক্রিয় থাকলেও নিম্নবর্গের দ্রোহ উচ্চবর্গের সংস্কৃতি-রাজনীতিতে আছড়ে পড়ত। এঁরা নির্বিত্ত, নিপীড়িত, নিম্নবর্গের ক্ষোভ-দ্রোহের সামাজিক সূত্রায়নটুকু করেছিলেন। অধিকাংশ নির্বিত্ত-নিম্নবর্গ সেই সূত্রায়ন আর তত্ত্ব না পড়লেও জীবনযাপনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় তা উপলব্ধি করেন। রাষ্ট্র কী, শোষণ কী, অর্থ-পণ্য কী, মেহনতী-মালিক সম্পর্ক কী— তাঁরা জানেন। মার্ক্স-এঙ্গেলস সেই জানার পরিধিতে শ্রেণিবোধ আর শাসক-মতাদর্শের আড়ালে লুক্কায়িত প্রতিষ্ঠানসমূহের পরিচিতি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন তত্ত্বে। নির্বিত্ত-নিম্নবর্গের বিপন্নতা প্রবহমান, রাষ্ট্রের সাঁড়াশিচাপ অব্যাহত। তাঁদের অনুশীলনের সঙ্গে এই তত্ত্বের মেলবন্ধনটুকু প্রয়োজন। আমাদের প্রজন্মের, বিশেষত যে শ্রেণি-অবস্থান থেকে এই লেখা লিখছে এবং যে/যাঁরা পড়ছেন, তাঁদের দায়িত্ব এই মেলবন্ধনের। ব্যবহারিক প্রয়োগ ছাড়া এঙ্গেলস মার্ক্স লেনিন মাও কারও কোনও প্রয়োজন আছে কি আমাদের দৈনন্দিনে, বাস্তবতায়?
#
লেনিন এঙ্গেলসের রাষ্ট্রধারণাকে সামনে রেখে এবং বুর্জোয়াবিকাশের রাষ্ট্রব্যবস্থার বিলোপসাধনের তত্ত্বকে প্রাধান্য দিয়ে রাজনীতির তত্ত্বকে বিবর্তিত করলেন। শোষিত শ্রেণির দ্বারা শোষক শ্রেণির রাষ্ট্রকে পরাভূত করার রাজনীতি। নির্বিত্তের মতাদর্শকে জয়ী করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক প্রয়োগের প্রয়োজনীয় তত্ত্বায়ন।
… the theory of Marx and Engels of the inevitability of a violent revolution refers to the bourgeois state. The latter cannot be superseded by the proletarian state (the dictatorship of the proletariat) through the process of “withering away”, but as a general rule, only through a violent revolution… the necessity of systematically imbuing the masses with this and precisely this view of violent revolution lies at the root of the entire theory of Marx and Engels . (Lenin, The State and Revolution, 14-5)
বহু বিশিষ্ট তাত্ত্বিক মার্ক্সবাদের রাজনৈতিক মতাদর্শে আস্থাশীল এবং ‘রাষ্ট্র’ সম্বন্ধে এঁদের মতামতও এই ধারণার সঙ্গেই মেলে; যদিও, ‘ভায়োলেন্ট রেভ্যলুশন’ শব্দবন্ধে এসে এঁদের মতামতের ভিন্নতা চোখে পড়ে। এই ‘ভায়োলেন্স’ ব্যাপারটাতেই মধ্যবিত্তের যাবতীয় বিপ্লববোধ কবিতার-শব্দে সঙ্কেতের মতো থাকে। আমাদের প্রজন্মকে বা আগের প্রজন্মকে ‘সত্তর দশকের ভায়োলেন্সে’-র কল্পনা-সত্য মেশানো বর্ণনার পাঠ দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকেরা দাবিদাওয়ার আন্দোলন করবেন এবং অর্থনৈতিক দাবির আশু লক্ষ্যে ইউনিয়ন যেটুকু বলবে সেটুকুই লক্ষ্যস্থির করবেন— এটাতেই অভ্যস্ত হয়ে যায় মধ্যবিত্ত বিপ্লববিলাসী চোখ। কিন্তু, শ্রমিকেরা যদি বলে ওঠেন, ‘আর আমাদের পোষাচ্ছে না দিনমজুরির ভরণপোষণ/ চাই আমাদের গোটা কারখানাটাই, চাই কয়লাখনি, চাই রাষ্ট্রশাসন’— তখনই ‘ভায়োলেন্সে’-র গন্ধ ম ম করে উঠবে এবং আমাদের ঘিরে ধরবে সংশয়বাদ।
The Communists fight for the attainment of the immediate aims, for the enforcement of the momentary interests of the working class; but in the movement of the present, they also represent and take care of the future of that movement.
কতটুকু ‘আশু’ আর কতটা ‘ভবিষ্যপ্রসারী’— নিম্নবর্গের কতটুকু দ্রোহচেষ্টায় কতটা সুরক্ষানিশ্চিন্তি অব্যাহত থাকবে উদারমনা উচ্চবর্গের— এই দ্বিধা আজও কি ফুরোল? ম্যাথু আর্নল্ড উনিশ শতকের মাঝামাঝি শ্রমিকের সংস্কৃতিকে ‘নৈরাজ্য’ বলেছিলেন। ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এলিট-সংস্কৃতির সঙ্গে জনগণের-সংস্কৃতির দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের তত্ত্বায়নে সাংস্কৃতিক বিদ্যাচর্চার নতুন দিগন্ত খুলে গেল। কিন্তু, এলিট-সংস্কৃতি চুঁইয়ে আসা ভদ্রলোক-মধ্যবিত্তের মনোধারণার কতটা বদল হল? ভদ্রলোক-মধ্যশ্রেণি বিপ্লবের-বিক্ষোভের-প্রতিরোধের যে ঠেকা/দায় (এজেন্সি) নিয়ে রেখেছে যুগান্তব্যাপী, তাতে কী বদল হল? ভদ্রলোকের আকাঙ্খা, ভদ্রলোকের মিডিয়াবয়ান, মধ্যবিত্তের শান্তিপ্রিয়তা, মধ্যবিত্তের শ্রেণিচাহিদার বাইরে বেরোলেই শ্রমিকদের ‘এঙ্গেলস-মার্ক্সের তত্ত্বের শ্রমিক’দের থেকে আলাদা করে দেয় সংসদীয় কমিউনিস্ট দলগুলো। ‘… নইলে লড়াই জঙ্গি হবে’ স্লোগানে উচ্চারিত হয় বামপন্থীদের মিছিলে, কিন্তু কতটা ‘জঙ্গি’ হলে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনযন্ত্রের বাহবা পাওয়া যাবে, তা মেপে দেন অ-শ্রমিক তাত্ত্বিক ভদ্রলোকেরা। শ্রমিকেরা প্রাপ্যের দাবিতে ধর্মঘট করবেন, মালিক কারখানায় লক-আউট করবেন এবং কয়েক বছর পরে ‘লসে রান করছে’ দেখিয়ে মালিক সেই কারখানা প্রমোটারের হাতে বেচে দেবে। ঊষা কারখানায় সাউথ সিটি, স্মল টুলস্ ম্যানুফ্যাকচারিং উঠে গিয়ে কাঁকুড়গাছি প্যান্টালুন্স বা বাসন্তী কটন মিলের জমিতে বিলাসবহুল আবাসন, কাদাপাড়ার বিখ্যাত ক্যালকাটা জুট মিল তালাবন্ধ হয়ে বিক্রি হয়ে যাবে। সংসদীয় ঘেরাটোপ আর ক্ষমতা-নিশ্চয়তার ছায়ায় ছায়ায় বাঁচা ‘বামপন্থী’ ব্যক্তিত্বরা এঙ্গেলস-লেনিনের নামে বিপ্লবের রসিদ কেটে যাবে। ‘শান্তি’, ‘ধীরজ’, ‘চুনাও’ ইত্যাদি শব্দের মুহুর্মুহু প্রয়োগে গুলিয়ে দেওয়া হয় ‘আশু লক্ষ্য’ আর ‘দীর্ঘস্থায়ী লক্ষ্য’! এঙ্গেলস বইয়ের পাতায় থাকবেন, মার্ক্সের নামোচ্চারণে কচিনেতার শ্লাঘা বাড়বে, ‘কমিউনিস্ট ইস্তেহার’ থেকে উদ্ধৃতি দিলে নিজবৃত্তের বন্ধুমহলে খ্যাতি বাড়বে। বুনিয়াদী শিল্পভিত্তি আর মূল অর্থনৈতিক-ভিত্তির কৃষিব্যবস্থাকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে ফাটকা-পুঁজি আর রিয়েল-এস্টেটকে মূল অর্থনৈতিক ভিত করে তোলার চেষ্টা চলেছে বিগত দু-তিন দশক। শ্রমআইন, জমিআইন, মৌলিক অধিকার ইত্যাদিকে কাঁচকলা দেখিয়ে SEZ, FEZ, Essential Commodities (Ammendment) Bill, FPTCA রমরমিয়ে উঠেছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি জাঁকিয়ে বসেছে, বিদেশি বিনিয়োগের প্রাবল্যে দেশি সরকারের নিয়ন্ত্রণ ক্ষীণতর এবং ‘হোয়াইট কলার’ হোক বা ‘গ্রে কলার’ শ্রমিকদের (সামাজিক স্টেটাসবোধে ‘হোয়াইট কলার’রা উচ্চাবস্থানে) অধিকার-কেড়ে-নেওয়া একের পর এক বিল-আইনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে আর্থ-রাজনীতি। শোষিত-শোষক শ্রেণির সঙ্গে গুলিয়ে দেওয়া হয়েছে সামাজিক অবস্থানের স্তরবিভেদ। পণ্যকামুক সমাজে উৎপাদন সম্পর্কের শ্রেণিঅবস্থানের সঙ্গে পণ্যের ভোগদখল দ্বারা অধিকৃত ‘স্টেটাস’ জগাখিচুড়ি পাকিয়ে রাখে শাসক-মতাদর্শ। আর, ভারতের ক্ষেত্রে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গগত বৈষম্য শ্রেণিবৈষম্যের সঙ্গে ওতঃপ্রোত— অর্থনীতি থেকে রাজনীতিতে গভীর প্রভাব বিস্তারকারী। আমাদের প্রজন্ম দেখল অভিবাসী শ্রমিকদের চিরকালীন দুরবস্থার হদিশ রাখেনি কোনও কমিউনিস্ট পার্টি; তাঁদের নীরব-নিস্পৃহ-আইনি গণহত্যার পরে সহানুভূতি জেগে উঠেছে, শিল্পকলা চেগে উঠেছে। কৃষিক্ষেত্রে কৃষকদের চিরন্তন শোষণকথা একুশ শতকে নতুন নতুন আইনি মোড়কে মুড়ে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু, আমাদের মধ্যশ্রেণির অবস্থানের নিরাপদ দূরত্ব দিয়েই প্রতিবাদ ঝালিয়ে নিচ্ছি আমরা, সংসদীয় গণতন্ত্রের ফুটোক্ষয়া কলসী মাথায় নিয়ে বিদ্রোহের স্থিতাবস্থা নির্ধারণ করে দিচ্ছি। নির্বিত্তের রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যই শিরোধার্য কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর, কিন্তু আমরা দেখলুম সিংহভাগই নির্বিত্তের ক্ষমতায়নের উলটোপথে ছুটছে ভোটের লোভে জনতোষের দায়ে।
Of all the classes that stand face to face with the bourgeoisie today, the proletariat alone is a really revolutionary class. The other classes decay and finally disappear in the face of Modern Industry; the proletariat is its special and essential product.
এঙ্গেলসকে ফিরে ফিরে পড়ার প্রয়োজন আজও ঠিক এইজন্যেই, ইস্তেহারে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিস্তরের বিশ্লেষণ যেভাবে করেছিলেন, তা বুঝতে। সমাজ আর অর্থনৈতিক রীতিনীতি পাল্টে গেছে পৌনে দুই দশকে। ভুবনগ্রামে পৌঁছানোর পরে বদলের হার আরও দ্রুত। কিন্তু, সমাজ বিশ্লেষণের পদ্ধতিগুলো যদি নাই জানি আমরা, যদি নাই ফিরে যাই সেই বিশ্লেষণের প্রস্তুতির ভিতে (নিরন্তর অনুশীলন ও মেহনতী মানুষের যাপননৈকট্যে) তাহলে বিপ্লবের আশায় পাঁজি খুলে বসে থাকতে হবে, বলপ্রয়োগে রাষ্ট্রক্ষমতা বদলের অনুশীলন হবে না।
#
এঙ্গেলস ধর্মকে যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, তা যুগান্তকারী। মতাদর্শের বিভিন্ন প্রেক্ষিতে ধর্ম যেভাবে জুড়ে থাকে, এঙ্গেলসের সেই বিশ্লেষণের সঙ্গে আমাদের প্রজন্মের দেখা ধর্মাভিঘাত মিলে যায়। মার্ক্সের থেকেও এঙ্গেলস বেশি ভাবিত ছিলেন সমাজে ও ইতিহাসে ধর্মের ভূমিকা নিয়ে এবং মতাদর্শের সঙ্গে তার নিরন্তর মিথস্ক্রিয়ার পদ্ধতি আবিষ্কারে। মূলত খ্রিস্টধর্মের আলোচনা করলেও শ্রেণির মতাদর্শে ধর্মীয় প্রভাবও যে থেকে যায়, এঙ্গেলসের বিশ্লেষণে সে কথা এসেছে। প্রথমদিকের খ্রিস্টধর্মকে এঙ্গেলস তৎকালীন শোষিত, নিম্নবর্গের দ্রোহসহায়ক হিসেবে দেখেছেন। আদি খ্রিস্টধর্ম আর সমাজতন্ত্র দুইই শোষকশ্রেণির বিরুদ্ধে নিপীড়িতকে সংগঠিত করার কথা বলে, দাসত্ব থেকে মুক্তির কথা বলে। কিন্তু, দুয়ের মূল পার্থক্য থাকে অনুশীলনে এবং কারা এই দুইকে ব্যবহার করছে, তাদের ওপরে। এঙ্গেলস বিশ্বাস করতেন যে, ইংল্যান্ডের বিপ্লবেই শেষবার ধর্ম এক বৈপ্লবিক ভূমিকা নিয়েছিল নিপীড়িতের হয়ে। কিন্তু, ফরাসি বিপ্লব ধর্মীয় মতাদর্শের দোনামনার অবকাশটুকুও মুছে দিল। ১৭৮৯-এর প্রবল আর্থ-রাজনৈতিক সংঘাতের পরে ধর্মের ভূমিকা সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র রক্ষণশীলই নয় বরং পশ্চাদ্মুখী। এঙ্গেলস ১৮৮০-র দশকে যখন ইউরোপের ধর্ম ও রাজনীতির বিশ্লেষণ করেছেন তখন দেখেছেন যে, মেহনতি মানুষের সমাজতন্ত্রাভিমুখী আন্দোলন সম্পূর্ণ অ-ধর্মীয়। ‘এথেইস্ট’ শব্দের বদলে ‘অ-ধার্মিক (নন-রিলিজিয়াস)’ শব্দই অভিপ্রেত ছিল তাঁর, “this purely negative term does not apply to them, because they are not any more in theoretical opposition, but only in a practical one, with the belief in God; they have simply finished with God because they live and think in the real world and are therefore materialists” এঙ্গেলসের আগে ধর্মীয়-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ এত বিশদে সম্ভবত কেউ করেননি।
একথা মনে রাখা দরকার যে, এটা সম্পূর্ণত আমাদের ভারতীয় সমাজের ক্ষেত্রে খাপে-খাপ মেলে না। কিন্তু, লোকায়ত ধর্ম কি নিপীড়িতের দ্রোহ-হাতিয়ার হয়নি ভারতীয় সমাজে? আধিপত্যকামী ধর্মীয় মতাদর্শের বিরুদ্ধে অবজ্ঞাত ধর্মের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। মাদারিয়া ফকির আর গিরি সন্ন্যাসীদের সম্মিলিত দ্রোহ ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে; মন্বন্তর-পরবর্তী বাংলার উৎপীড়িত গ্রামবাসীর সহায়তা তাঁরা পেয়েছিলেন। পালসাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন দিব্যোক ও তাঁর সহযোদ্ধারা। বীরসা মুণ্ডার ‘ঈশ্বরসম’ হয়ে ওঠা নিছক মহাশ্বেতা দেবীর উপন্যাস-কল্পনা নয় বরং প্রবল বাস্তব; অত্যাচারীর বিরুদ্ধে অত্যাচারিতের নির্ভরযোগ্য ধর্মাশ্রয়। বীরশৈবদের বিদ্রোহ, আলোয়ারদের ক্ষোভ, ভক্তি ও সুফি আন্দোলনের ইতিহাস, চৈতন্যের বৈষ্ণবপন্থা উচ্চবর্গের ধর্ম, রাজনীতি ও সংস্কৃতির দিকে বর্শামুখ ধারালো রেখেছিল। বিপ্লব না হলেও অন্ততঃ সংস্কারের বোধটুকু সতেজ-সজাগ ছিল। আমাদের প্রজন্ম ধর্ম ও রাজনীতির অদ্ভুত দ্বান্দ্বিকতা দেখেছি ও দেখছি। একদিকে হিন্দুত্বের আধিপত্যের দাবিতে শাসক-মতাদর্শের জবরদস্তি অন্যদিকে লোকায়ত ও এতদিনের-অবজ্ঞাত ধর্মানুশীলনকে আত্মসাৎ করে ‘সনাতন’ বর্গভুক্ত করে নেওয়ার জনতোষী শাসকনীতি। আমাদের সমাজে ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতি রীতিপালন আর উৎসব-আচার-আমোদ অভিন্ন বহু ক্ষেত্রে। ধর্মীয় উৎসব সাংস্কৃতিক হয়ে ওঠে, ধর্মীয় আচারের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী রীতির সংঘাত বেঁধে যায়, প্রগতিশীলতার সঙ্গে চিরন্তনের দ্বন্দ্ব আর্থ-সামাজিক যাপনের অবিচ্ছেদ্য বিষয় হয়ে ওঠে। আর, সমাজ-ধর্ম-সংস্কৃতি-রীতি-অর্থনীতি-ঐতিহ্য-উৎসব প্রত্যেকটি উপাদান ব্যক্তিগত ও সামাজিক রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে থাকে। কখনও নির্বাচনী আশু ফায়দার নীতিকৌশলে কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর কাজকর্মে শ্রেণিচেতনাকে ছাপিয়ে উঠতে থাকে আল্গা জনতোষ। কিন্তু, ধর্মীয় সন্ত্রাস যখন উপমহাদেশে ক্রমশ থাবা শক্ত করছে, শাসক ফ্যাসিস্ট দলের নয়া পদ্ধতিতে ধর্মের ষাঁড়েরা রক্তলোলুপ হয়ে উঠেছে, তখন এঙ্গেলসের চিন্তাসূত্রের ওই অ-ধর্মীয় বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে ফের।
#
মাতৃতন্ত্রের উচ্ছেদ হচ্ছে স্ত্রীজাতির এক বিশ্ব ঐতিহাসিক পরাজয়। পুরুষ গৃহস্থালির কর্তৃত্বও দখল করল, স্ত্রীলোক হল পদানত, শৃঙ্খলিত, পুরুষের লালসার দাসী, সন্তানসৃষ্টির যন্ত্র মাত্র… পুরুষদের এই যে একচ্ছত্র শাসন এখন প্রতিষ্ঠিত হল তার প্রথম ফল হল পিতৃপ্রধান পরিবারের উদীয়মান একটি মধ্যবর্তী রূপ… এই ধরণের পরিবারে দেখা যায় স্ত্রীলোকের সতীত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হবার জন্য, অর্থাৎ সন্তানসন্ততির পিতৃত্বের নিশ্চয়তার জন্য স্ত্রীলোককে সম্পূর্ণভাবে পুরুষের অধীন করা হয়।
‘দ্য অরিজিন অফ দ্য ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রপার্টি অ্যান্ড দ্য স্টেট (১৮৮৪)’ লেখার সোয়া একশো বছর পরে আমাদের প্রজন্ম এখনও কি উপরিউক্ত বক্তব্যগুলি নিয়ে চর্চা করে না? আমাদের প্রতিদিনের ব্যক্তিগত ও সামাজিক পরিসরে নারী ও পরিবারের এই মূল্যায়ন প্রাসঙ্গিক। এখনও নারীর ভূমিকা ‘মাতৃত্ব’তে সীমাবদ্ধ, জনতোষী গল্পে-কবিতায় মাতৃত্বের উজ্জ্বলীকৃত ধারণাই বাহবাযোগ্য! অর্থনৈতিক প্রয়োজনের তাগিদে নারীকে ‘বাইরে যাওয়া’র (চাকরি বা অন্য কাজ করার) ‘অনুমতি’ দিয়েছে সমাজ কিন্তু, নারীর ‘সাফল্য’ পারিবারিক অনুশীলনের সফলতায়, মাতৃত্বের উদ্যাপনে এবং পুরুষের প্রতি নিষ্ঠায়! নারীস্বাধীনতার প্রগতিশীল তত্ত্বে-অনুশীলনেও পিতৃতান্ত্রিক প্রভাবমুক্ত হওয়া যায়নি এখনও, তাই ‘গৃহস্থালিই মেয়েদের স্থান’— এই বস্তাপচা বক্তব্য নিয়ে হাজির হয় ধর্মগুরু থেকে রাজনৈতিক নেতা থেকে পরিবারের গুরুজনেরা। ব্যক্তিসম্পর্কের পরিসরকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে রাষ্ট্রের মতাদর্শ, পরিবার সেই রাষ্ট্রেরই অংশ। ভারতীয় সমাজে নারীদের শোষিত অবস্থান শুধুমাত্র শ্রেণির জন্যেই হয় না, বরং ধর্ম-বর্ণ-জাতিগত বিভেদের জন্যেও হয়। নারীর লড়াই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে মৌলবাদ ও সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধেও। এঙ্গেলস পরিবারের ধারণা ও নারীর শোষিত অবস্থানের বিশ্লেষণকে বিস্তৃত করলেন রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও সামাজিক শোষণের আলোচনায়। এই আলোচনার পরিসর আরও বেড়েছে বিশ শতকে, আরও নতুন আঙ্গিক যুক্ত হয়েছে।
ব্যক্তিসম্পত্তিনির্ভর বুর্জোয়া সমাজকাঠামো নারীকে, শ্রমিককে তথা কোনও শোষিতকেই মুক্তি দিতে পারে না কারণ, এই সমস্তই তার পণ্য। উৎপাদনচক্র টিঁকিয়ে রাখার হাতিয়ার আর তার জন্যে প্রয়োজনীয় মতাদর্শ-বিভ্রম দিয়ে শোষিতের চেতনা-প্রক্ষালন করে চলে রাষ্ট্র। একেই নাম দেওয়া হয় ‘শৃঙ্খলা’— যা শাসনের স্থিতাবস্থা, শাসকের নিশ্চয়তা এবং শাসকশ্রেণির মতাদর্শগত আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখে। আর, পুঁজিবাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে নারী থেকে শিশু, ধর্ম থেকে সংস্কৃতি, চিন্তাসূত্র থেকে অনুশীলন যা কিছুই অ-শাসক অবস্থানে সবটাই পণ্য। বিক্ষোভ আর প্রতিবাদকেও পণ্যে রূপান্তরিত করে নেওয়া গেছে ক্ষেত্রবিশেষে। ভার্চুয়াল জগতের ধারণা এঙ্গেলসের পক্ষে অসম্ভব ছিল। ভার্চুয়াল জগতের কেন্দ্রেও সেই পণ্যমুখীনতা। অতিবাস্তব ক্ষেত্রে (হাইপার রিয়েল) পণ্যকামী সমাজের চাহিদা আর বিনোদনের পরিসরবিস্তৃতি শাসক-মতাদর্শের অঙ্গ হিসেবে প্রকট হচ্ছে প্রতিদিন। ‘মুক্তি’র হাজার খোঁয়ারি থাকলেও, বৈষম্যমূলক-শোষক সমাজকাঠামো থেকে মুক্তির বাস্তব দিশা সেখানে নেই, থাকা সম্ভবও নয়। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এঙ্গেলসের প্রয়োজন এইজন্যেই আজও ফুরোয়নি। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের প্রতিটি উপাদানের প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ করে যিনি শোষণের উৎস রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই উৎখাত করার সম্ভাব্য পথের কথা বলেছিলেন। দুশো বছরের জন্মদিনে এঙ্গেলসপুজোর কী ভোগপ্রসাদ হবে জানি না, কিন্তু, এঙ্গেলসের ভূত তথা তাঁর খোয়াব বাস্তবায়িত না-হওয়ার অতৃপ্ত ভূত রাষ্ট্র নামক মহাশক্তিমানকে তাড়া করে ফিরবেই।
রাষ্ট্রেরও পতন হবে। উৎপাদকের স্বাধীন ও সমান সম্মিলনের ভিত্তিতে যে সমাজ উৎপাদনকে সংগঠিত করবে, সে সমাজ সমগ্র রাষ্ট্র-যন্ত্রকে পাঠিয়ে দেবে তার যোগ্যস্থানে। পুরাতত্ত্বের যাদুঘরে, চরকা ও ব্রোঞ্জের কুড়ুলের পাশে।
- https://www.marxists.org/ebooks/lenin/state-and-revolution.pdf
- https://www.marxists.org/archive/marx/works/1848/communist-manifesto/ch04.htm
- Michael Löwy, Friedrich Engels on Religion and Class Struggle, Science and Society, 1998
- কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস রচনা-সঙ্কলন, দ্বিতীয় খণ্ড প্রথম অংশ, পৃ- ১৬৭-৩০৬, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭২