এঙ্গেলস ও মার্কসবাদ

প্রতীপ নাগ

 


লেখক রাজনৈতিক কর্মী, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত

 

 

 

 

এঙ্গেলসকে লেখা মার্কসের এক ব্যক্তিগত চিঠির একটি বাক্য দিয়ে এই আলোচনার সূচনা করা যেতে পারে। মার্কস এঙ্গেলসকে লিখেছিলেন যে তিনি (মার্কস) “সবসময়ই তাঁর পথকে অনুসরণ করেন।” মার্কস নীতিগতভাবে কোনও অকারণ প্রশংসা করতেন না। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বিবিসি-র করা এক সমীক্ষায় ‘বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চিন্তক’ মার্কসের এমন উক্তি বাস্তবে এঙ্গেলসকে, মার্কসের গভীর স্বীকৃতি। ‘মার্কসবাদ’-এর সূত্রায়নের আসল রূপকার এঙ্গেলস। তথাকথিত মার্কসবাদীরা হয় এঙ্গেলসকে শুধুমাত্র মার্কসের অনুগামী হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত নয় শুষ্ক প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বাস্তবে ব্রিটেনের শ্রমিক আন্দোলন ও ইউরোপের বিপ্লবী কমিউনিস্টদের সঙ্গে মার্কসের পরিচয় ঘটিয়েছিলেন এঙ্গেলস।

এঙ্গেলস ও বিপ্লবী সমাজতন্ত্র

ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস ছাড়া মার্কসবাদের কোন অস্তিত্বই হয়ত থাকত না। সর্বহারাশ্রেণির নতুন সামাজিক তত্ত্বের সূত্রায়ণে এঙ্গেলসের ভূমিকা অপরিসীম। এই কথা বলার মধ্যে দিয়ে মার্কসের ভূমিকাকে কোনওভাবেই অস্বীকার করা হয় না। এঙ্গেলস তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকাকে নিজেই ছোট করে রেখেছিলেন। কনরাড স্মীডকে এক ব্যক্তিগত চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন “মার্কসের জীবৎকালে আমি সবসময়ই দ্বিতীয় হিসেবেই ভূমিকা রাখতাম”। ‘দ্বান্দ্বিক’ মার্কসের বিপরীতে ‘যান্ত্রিক’ এঙ্গেলসকে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার ‘মার্কসবাদী’ বিশ্লেষণ সঠিক নয় বা উপরের উক্তি থেকে তা প্রতিভাতও হয় না।

প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক নিয়ে চর্চা (ডায়ালেকটিক্স অফ নেচার) ও মানব সমাজের ইতিহাস নিয়ে শিক্ষানবিশ থাকাকালীন (অরিজিন অফ ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রপার্টি অ্যান্ড স্টেট) এঙ্গেলসই নৃতত্ত্বের বস্তুবাদী ভিত্তি সূত্রায়িত করেছিলেন। তিনি তাঁর অনুমান ও সমকালীন জীববিদ্যা সংক্রান্ত বিতর্ক নিয়ত সংশোধন করেছেন। প্রকৃতি বিজ্ঞান বিষয়ে এঙ্গেলস ‘ডায়ালেকটিক্স অফ নেচার’ (Dialectics of Nature)-এ লিখেছিলেন,

rigid and fast lines are incompatible with the theory of the evolution… the old Metaphysical method does not serve for more than a period of apprenticeship in the vision of nature where all the differences converge in intermediate degrees, and all the opposites are mutually reconciled through immediate connections. The dialectic, which does not follow rigid and fast strictures, not having universal and unconditional validity…. and reconciles the opposites, is the only method of thinking appropriately in the highest degree during this period of formation.

জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার উদ্দেশ্য বাস্তবকে বোঝা, যেখানে প্রকৃতি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাইরে নয়। এইভাবেই এঙ্গেলস তাঁর দার্শনিক চিন্তার মাধ্যামে প্রকৃতিকে বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন। দ্বন্দ্বতত্ত্ব যদি প্রকৃতিতে বৈধ হয়, তবে তা অবশ্যই প্রতিফলিত হবে বিজ্ঞানের মর্মবস্তুতে। প্রকৃতিকে সূত্রায়িত করার ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বতত্ত্ব শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় নয়, উপকারীও বটে। কিন্তু এটার আগে যা দেখানো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তা হল বিজ্ঞানের নীতি ও মর্মবস্তুতে দ্বান্দ্বিকতার উপস্থিতি। কিন্তু এঙ্গেলস বুঝতে পেরেছিলেন যে বিজ্ঞান ও দর্শনের মধ্যে লড়াই সমস্যার।

এঙ্গেলস দীর্ঘ সময় ধরেই প্রকৃতিবিজ্ঞানের চর্চা করছিলেন। ১৮৭৩ এর পরে তিনি ডায়েলেকটিক্স অফ নেচার বিকশিত করতে শুরু করেছিলেন। ১৩ বছর ধরে এই বইটি লিখলেও তিনি তা শেষ করে যেতে পারেননি। যদিও ১৮৮৩ সালে মার্কসের মৃত্যুর আগেই তিনি এই বিষয়ে বহু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন এবং অনেকগুলো পরিচ্ছদ লিখেছিলেন। মার্কসের মৃত্যুর পর তিনি সব দায়িত্ব একাই নিয়েছিলেন, ফলত তাঁর পক্ষে এই গ্রন্থটি সমাপ্ত করা সম্ভব হয়নি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ অসমাপ্ত গ্রন্থ হল ডায়ালেকটিক্স অফ নেচার। এর কেন্দ্রীয় ধারণা আমরা পাব এঙ্গেলসের ‘আন্টি-ড্যুরিং’ (Anti-Duhring)-এ, যা মার্কসবাদের বিকাশের এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেসির ঐতিহাসিক গ্যারি পি স্টিনসনের মতে, “the publication of Anti-Dühring signals the beginning of a school of Marxist thought in the master’s motherland. In the context of the history of Marxism, the significance of Anti-Dühring demonstrates the extent to which Engels linked the work of Marx to a conception of the world, based in the development of natural sciences of his time.”

বানর থেকে মানুষে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে শ্রমের ভূমিকা (The role of work in the transition from ape to man) ১৮৯৬ সালে এঙ্গেলসের মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছিল। মানুষের বিবর্তনের ক্ষেত্রে এঙ্গেলস তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেছিলেন।  ১) কথা বলতে পারা, ২) উন্নত মস্তিষ্ক, ৩) সোজা হয়ে দাঁড়ানো। এর প্রথম ধাপ হিসেবে তিনি বলেছিলেন গাছ থেকে নামা ও আমাদের পূর্বসূরীদের বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর কথা। সোজা হয়ে দাঁড়ানোটাই ছিল বানর থেকে মানুষ হওয়ার চূড়ান্ত ধাপ। এর পরিণতিতে তার হাত দুটো মুক্ত হয়। ফলে বিভিন্ন ধরণের যন্ত্রাদি তৈরি করতে সে সক্ষম হয়েছিল (যদিও এঙ্গেলসের ভাষায় শ্রম)। এর পর আসে বুদ্ধিমত্তা। অতএব,

Thus the hand is not only an organ of labour, but also a product of labour. Only by labour, by adaptation to ever new operations…. and by the ever-renewed employment of this inherited finesse in new, more and more complicated operations, have given the human hand the high degree of perfection required to conjure into being the pictures of a Raphael, the statues of a Thorwaldsen, the music of a Paganini.

সমকালীন জীববিদ্যা বিশারদ স্টিফেন জে গুল্ড মন্তব্য করেছেন যে এই বিষয়ে এঙ্গেলস কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হননি। কিন্তু এর গুরুত্ব নিহিত আছে তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক বিশ্লেষণের যুক্তি হিসেবে, অথচ পাশ্চাত্য বিজ্ঞান মস্তিষ্ককে গুরুত্ব দিয়ে জোর দিয়েছে বৌদ্ধিক নিশ্চয়তার ওপরে। এঙ্গেলস বলেছেন যে, যখন মানুষ তার নিজের বস্তুগত চারপাশ আয়ত্ত্বের মধ্যে আনতে পারল, তখন আদিম কৃষি ও শিকার ছাড়াও অন্য অনেক কিছু করার সামর্থ্য অর্জন করেছিল। যেমন— মৃৎশিল্প, নৌবিদ্যা, শিল্পকলা ও বিজ্ঞান, আইন ও রাজনীতি এবং পরিশেষে, “the fantastic reflection of human matters in the human mind: religion” সম্পদের সঞ্চয়নের প্রারম্ভ কাল থেকেই স্বল্প কিছু মানুষের গোষ্ঠী শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং বাকিদের বাধ্য করে তাদের হয়ে কাজ করতে। শ্রম, সমস্ত সম্পদের উৎস এবং মানুষের বিবর্তনের চালিকাশক্তি। মানুষের শ্রমশক্তির অবমূল্যায়ন ঘটে যখন সে শক্তিশালীর হয়ে শ্রম দেয়। শক্তিশালীরা যখন অন্যদের ইচ্ছাশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করল, তখন মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপও তদনুরূপ হল। পেশাদারি দর্শন স্বাধীনতার এক অবাস্তব আদর্শ তৈরি করেছিল আর এই দার্শনিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল রাষ্ট্র— ধর্ম।

পলিটিকাল ইকোনমি

১৮৪৩ সালে ক্রিটিসিজম অফ পলিটিকাল ইকোনমি (Criticism of Political Economy) প্রকাশিত হয়। এঙ্গেলসই এর প্রথম লেখক। এই লেখাকে মার্কস ‘অসাধারণ’ বলেছিলেন। সুতরাং, এঙ্গেলসই মার্কসকে অর্থনীতির বিষয়ে দিকনির্দেশ করেছিলেন যার ফলশ্রুতিতে মার্কসের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘পুঁজি’। মার্কসের মতো তত্ত্বগত ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও এঙ্গেলসের ছিল সমসাময়িক সময়ের বিষয়ে স্বতঃস্ফূর্ত, সর্বব্যাপী, অন্তর্নিহিত দৃষ্টি। এর ফলে মার্কসকে অন্য কোন পথের সন্ধান করতে বা সঠিক দিশা পেতে বিলম্ব হয় নি, যার পরিণতিতে সৃষ্টি হয় প্রভাবশালী, বৌদ্ধিক-রাজনৈতিক ক্লাসিকগুলি।

এঙ্গেলস ও মার্কসের ক্ষেত্রে ১৮৪৪ সালটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সেই সময়ে ফ্রান্সের লিঁয় শহরে রেশম শ্রমিকদের বিদ্রোহ ঘটেছিল, যার শ্লোগান ছিল শ্রম করে বাঁচব বা লড়াই করে মরব। শিল্পোন্নত ইংল্যান্ডে থাকার ফলে এঙ্গেলস রচনা করলেন ‘ইংল্যান্ডে শ্রমিকশ্রেণির অবস্থা’ (The Situation of Working Class in England)। আর মার্কস লিখলেন ‘ইকনমিক- ফিলসফিকাল ম্যানুস্ক্রিপ্ট’ (Economic- Political Manuscript)। এখানে মার্কসের মূল প্রশ্ন শ্রমিকের সঙ্গে তার উৎপাদনের সম্পর্ক নিয়ে ছিল না। বরং তিনি শ্রমিকের সঙ্গে তার উৎপাদিত দ্রব্যের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। হেগেলীয় ধারণা ‘বিচ্ছিন্নতা’ (Alienation)-কে মার্কস বস্তুবাদী ধারণায় রূপান্তরিত করেন। এই প্রসঙ্গে গ্যারেথ স্টেডম্যান জোন্সের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য, “আধুনিক শিল্পে শ্রেণিসংগ্রাম গড়ে ওঠার প্রথম ধারণা তৈরি করেছিলেন এঙ্গেলস।”

দার্শনিক-রাজনৈতিক যাত্রাপথ

এই সময় পর্যন্ত এঙ্গেলসের যে দার্শনিক-রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল তার সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটে। এতদিন তিনি প্রভাবিত ছিলেন মোসেস হেসের ‘দার্শনিক সাম্যবাদ’-এর দ্বারা। মোসেস হেস বিশ্বাস করতেন সাম্যবাদী নীতিতে। তিনি অহঙ্কার ও খণ্ডন বর্জন করে ঐক্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। হেসের কাছে সাম্যবাদ কোনও শ্রেণিসংগ্রামের ফলাফল নয়। সাম্যবাদের ভবিষ্যত খোদিত আছে এক নির্ধারিত শ্রেণির ভবিতব্যের উপরে। ১৮৪৩ সালেও এঙ্গেলস, হেসের দ্বারা এতটাই প্রভাবিত ছিলেন যে তিনি ‘ফেডারেশন অফ জাস্ট’ (Federation of Just)-এ তাঁর দেওয়া অঙ্গীকার প্রত্যাহার করেছিলেন। যদিও এঙ্গেলসকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ফেডারেশনের জার্মান সংগঠক বাউয়ার, মল আর শাপার। ১৮৪৪ সাল নিশ্চিতভাবেই মার্কসবাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বছরেই শুধুমাত্র মার্কসের সঙ্গে ফয়েরবাখের বিচ্ছেদ ঘটেনি, এঙ্গেলসের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ ঘটে হেসের।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এঙ্গেলস লক্ষ করেন যে ইউরোপ জুড়ে সামাজিক ব্যবস্থা নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে আর একটি প্রবণতা লক্ষিত হচ্ছিল। এই প্রবণতা সরাসরিভাবে যুক্ত ছিল জনপ্রিয় গণ আন্দোলনগুলোর সঙ্গে। সমতার প্রস্তাবের এই গণতান্ত্রিক বিপ্লবগুলোর মধ্যে ছিল এক র‍্যাডিক্যাল দিশা। এই প্রস্তাবগুলো ক্রমান্বয়ে ‘কমিউনিজম’ এর অর্থ বহন করেছিল। এই প্রবণতার মধ্যে মার্কস দেখতে পাচ্ছিলেন “বাস্তবে কমিউনিস্ট পার্টি তাদের ক্রিয়াকলাপ করছে।” অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহগুলোর প্রাথমিক উৎস এঙ্গেলস খুঁজে পেয়েছিলেন,

at the time of Reformation and the struggle of farmers of Germany, the trend of Anabaptists and Thomas Munzer; the great English revolution, the levellers; and the great French Revolution, Babeuf. And in their turn, these revolutionary uprisings of a budding class were accompanied by corresponding theoretical demonstration; in the 16th and 17th centuries utopian description of an ideal regime of society appear; and in the 18th century declaredly communist theories as of Morelly and Mably, appear. The claim of equality was not limited to political rights: it also encompassed each individual’s social condition of life. It was aiming not only to abolishing the privileges of certain class, but also abolishing class difference itself.

হেগেলীয় বামপন্থার থেকে বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে এঙ্গেলসের ভূমিকা ছিল ছিল কেন্দ্রীয় ও নির্ণায়ক। ১৮৪৪ সালের আগে মার্কস ও এঙ্গেলস উভয়েই হেগেলীয় বামপন্থার দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। গ্যারেথ স্টেডম্যস্ন জোন্সের মতে, “জার্মানির বাম দার্শনিকদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম যিনি রাজনৈতিক-অর্থনীতির বিতর্কগুলোর স্থানচ্যুতি ঘটিয়েছিলেন। তিনি স্পষ্ট করে বিশদে ব্যাখ্যা করেছিলেন ব্যক্তিগত সম্পত্তি, রাজনৈতিক-অর্থনীতি এবং বর্তমান সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কমিউনিজমে উত্তরণের মধ্যেকার সম্পর্ক।”

মার্কসের সঙ্গে প্রণালীবদ্ধভাবে যৌথ কাজ শুরু করার পূর্বেই এঙ্গেলস মার্কসবাদের নিউক্লিয়াস ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ’ নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করেছিলেন। এই ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ’ হল ‘হেগেলীয় দ্বন্দ্বতত্ত্বের’ বিপরীত এবং সমস্ত রক্ষণশীলতা ও আর্দশবাদ থেকে মুক্ত। তৎকালীন প্রুশীয় রাষ্ট্র হেগেলীয় দ্বন্দ্বতত্ত্বকে আক্রমণ করার দায়িত্ব দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেলিং (Schelling)কে। শেলিং এর আক্রমণের প্রত্যুত্তরে হেগেলের জবাবেরও সমালোচনা এঙ্গেলেস করেছিলেন। এঙ্গেলস হেগেলীয় দ্বন্দ্বতত্ত্বের দুর্বলতা সন্ধান করেছিলেন,

the principle always rest on independence and free thought, while conclusions are frequent toned down and even conservative… the only true thing is liberty which, in itself contains necessity।

মার্কস ও এঙ্গেলেস দুজনেই আলাদা মানুষ। তাঁদের চিন্তা ভাবনারও ফারাক পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু মার্কসবাদী তত্ত্ব নির্মাণে মার্কসের মত এঙ্গেলস সমস্থান অধিকার করবেন। দুই বন্ধুর মধ্যে এঙ্গেলসই প্রথম যিনি ফয়েরবাখের তত্ত্বের, তৎকালীন রাজনৈতিক-অর্থনীতির ধারার ও ধর্মের সমালোচনা করেছিলেন। এঙ্গেলস শ্রেণির ও পুঁজিবাদের আভ্যন্তরীণ চলনের বিশ্লেষণে পথিকৃৎ। মার্কস নিজেই এর স্বীকৃতি দিয়েছেন। ১৮৬৪ সালের ৪ জুলাই মার্কস এক চিঠিতে এঙ্গেলেসকে লিখেছিলেন, “তুমি জানো যে ১) প্রত্যেকটা বিষয় আমি পরে জেনেছি, ২) আমি সবসময় তোমার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছি।”

১৮৪৫ সালে মার্কস ও এঙ্গেলস যৌথভাবে কাজ শুরু করার পূর্বেই ১৮৪২ সালে তাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয়। এই সময়কালে মার্কস ও এঙ্গেলস একই উদ্দেশ্যে সমান্তরালভাবে কাজ করতে শুরু করেন। মার্কস ইতিমধ্যে হেগেলীয় দ্বন্দ্বতত্ত্বের ও ফয়েরবাখের সমালোচনা শুরু করে দিয়েছেন।

দর্শনশাস্ত্রের চলনপদ্ধতি

এঙ্গেলস প্রাথমিকভাবে দর্শনশাস্ত্রের চলনপদ্ধতি (philosophy of action) খুঁজতে শুরু করেছেন, হেসের অনুগামী হিসেবে। এতে তিনি উপলদ্ধি করেছিলেন যে জার্মান দর্শনশাস্ত্রকে পরিত্যাগের সময় এসেছে। দর্শনশাস্ত্রের চলনপদ্ধতি সৃষ্টি করতে তাঁর মনে হয়েছে স্পিনোজার মর্মবস্তুর সঙ্গে স্যাঁ সিমোঁর ভাবনা একত্রিত করা জরুরি। অন্যদিকে মানবপ্রজাতির বিষয় নিয়ে ফয়েরবাখ ইয়ং হেগেলীয়দের প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছিলেন। হেস এই আন্দোলনের বামপন্থী অংশের সঙ্গে ফরাসি সমাজবিজ্ঞানের পরিচয় ঘটিয়েছিলেন। ১৮৪৩ সালের নভেম্বর মাসে এক চিঠিতে এঙ্গেলস স্বীকার করেন হেগেলীয় বামপন্থীদের কাছে কমিউনিজমের ধারণার পরিচয় ঘটিয়েছিলেন হেস। কারণ এঙ্গেলসের মতে, “যদিও ফয়েরবাখের প্রভাব জার্মান দর্শনে বিপ্লাবাত্মক, তবুও তিনি চলনপদ্ধতি বা তার প্রকৃতি উপলদ্ধি করতে অসমর্থ ছিলেন। যেখানে ফয়েরবাখ ব্যর্থ, তাঁর শুন্যস্থান পূরণ করেছিলেন হেস।” তিনি এর জন্য হেগেলীয় দর্শনকে দায়ী করেছিলেন। কারণ, এই দর্শন অতীত ও বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের ধারণা উপলদ্ধির পথকে পরিহার করেছে যা ভবিষ্যতের জায়মান পর্যায়কে প্রভাবিত করবে। এটি সাধারণভাবে সাঁ-সিমোর ধারণা। যে ধারণা পরবর্তীকালে মার্কস ও এঙ্গলেসকে তাঁদের ধারণায় নতুন সমাজব্যবস্থার ভিত্তিভূমি।

এই সমস্ত ধরনের ধারণাকে একত্রিত করে এঙ্গেলস ইংলান্ডের সামাজিক, রাজনৈতিক সংগ্রামকে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।তিনি বলেছিলেন, “এটা স্বীকার করা জরুরি যে ইংলান্ডের অগ্রগতি নির্ভর করবে মতাদর্শের সংঘাতের উপরে নয়, বরং স্বার্থের সংঘাতের উপরে।” ১৮৪৪ সালে রচিত ‘ইংলান্ডে শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা’ গ্রন্থে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ধারণা অঙ্কুরিত হয়েছে, কিন্তু দর্শনের ইতিহাসে তা তখনও স্থান পায়নি।

এঙ্গেলসের দৃঢ়ভাবে এই ধারণা ছিল যে পুঁজিবাদী আধুনিকতার উত্থানের ভিত্তি হল ঐতিহাসিক-অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া:

the discovery of America made it a seat of gold which previously Had the Portuguese setting for Africa, because the European industry, enormously developed in 14th and 15th centuries, and the corresponding trade, reclaimed more than half of the exchange which could be supplied to Germany, the great producer of silver between 1450 and 1550.

অর্থনীতিবাদী বিশ্লেষণের বিপদ

এঙ্গেলস শুধুমাত্র অর্থনীতিবাদী (economic reductionist) বিশ্লেষণের বিপদ থেকে সতর্ক করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর ঠিক আগে তিনি লিখেছিলেন

in contemporary history, we will be quite often forced to consider this most decisive factor, as a constant factor. We will be forced to consider the economic situation in which we found ourselves in the beginning of the period in question, as valid for all Period and as invariable. Or else we will be forced not to consider more than those exchanges operating in this, situation, which will become obvious and clear. Therefore, the materialistic method will tend hers, quite frequently, to be limited for reducing the political conflict of interest of social classes and fractions of existing classes determined for the economic development, and to show that political parties are more or less the political expression of these classes and fraction of classes.

উপসংহারে তিনি বলেছিলেন,

It goes without saying that this inevitable under estimation of the changes operating simultaneously in the economic situation-true base of all the events under analysis-which necessarily has to be the source of errors.

২১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯০ সালে ব্লককে লেখ এক চিঠিতে এঙ্গেলস বলেছিলেন,

ইতিহাসের বস্তুবাদী বোধ অনুসারে শেষ বিচারে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার নির্ধারক দিক হল বাস্তব জীবনের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন। আমি বা মার্কস কেউ এর বেশি কখনও বলিনি। সুতরাং কেঊ যদি বক্তব্যকে এই অর্থে বিকৃত করে যে অর্থনৈতিক দিকটাই বুঝি একমাত্র নির্ধারক দিক, তাহলে সে এটাকে পরিণত করবে বিমূর্ত, অর্থহীন এক বুলিতে।

ঐতিহাসিক বস্তুবাদে ক্ষেত্রে ভিত্তি আর উপরিকাঠামোর মধ্যে এক মিথষ্ক্রিয়া চলে। এই মিথষ্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিষয়টি প্রাসঙ্গিক। এক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় ভিত্তির কাঠামোগত বিশ্লেষণে পাঁচটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যথা—

১) অর্থনৈতিক বিকাশের সঙ্গে উপরিকাঠামোর কতগুল উপাদান— রাষ্ট্র, অধিকার, মতাদর্শের বিকাশ ঘটে। ভিত্তির সঙ্গে সঙ্গে তা শুরু হয় এবং একই সঙ্গে চলে।

২) উপরিকাঠামো ভিত্তির উপর নির্ভরশীল। লম্বা সময়ে তার বিকাশ ভিত্তির উপর নির্ভরশীল।

৩) উপরিকাঠামো ভিত্তির উপর নির্ভরশীল হলেও, উপরিকাঠামোর আপেক্ষিক, শর্তাধীন স্বায়ত্ত থাকে। কারণ, ভিত্তি থেকেই এর বিকাশ ঘটে। কিন্তু এই উপরিকাঠামো অনন্য। নির্দিষ্ট কিছু সূত্র মানে সে তৈরি করে তার কাঠামোগত চরিত্র।

৪) ভিত্তি ও উপরিকাঠামো একে অন্যকে প্রভাবিত করে। কারণ হিসেবে বলা যায় যে, একের সঙ্গে অন্যের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা। যদিও, তাদের নির্দিষ্ট কিছু স্বাধীনতা আছে, একের সঙ্গে অন্যের সম্পর্কের ক্ষেত্রে।

৫) নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতিতে উপরিকাঠামোর আপেক্ষিক স্বায়ত্ত এতটাই হতে পারে যে, উপরিকাঠামো নিজেকে অস্থায়ীভাবে বা আংশিকভাবে রূপান্তর করতে পারে যা গোটা বিকাশকে প্রভাবিত করতে পারে এবং তা প্রাথমিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

উপসংহার

দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের বিকৃতি পরবর্তী সময়ে লক্ষ করা যায়, বিশেষত স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নে। ১৯৩৮ সালে স্তালিনের ‘Dialectical and Historical Materialism’ প্রকাশিত হওয়ার পরে দেখা গিয়েছিল যে দ্বন্দ্বতত্ত্বের অন্যতম মূল সূত্র, ‘নেতির নেতিকরণ’ প্রায় উপেক্ষিত। ফলে, ১৯৩৯ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত বিজ্ঞান ও দর্শনের গবেষণার ক্ষেত্রে একাধিক ত্রুটি লক্ষ করা যায়, এই সূত্রটিকে উপেক্ষার ফলে। (Guy Planty Bonjour, The Categories of Dialectal Materialism. Contemporary Soviet Ontology, pp. 129-131).

ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে যান্ত্রিকভাবে দেখা হয়েছে বহু ক্ষেত্রে। একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ।  প্লেটো, এ্যারিস্টটল প্রমুখ দার্শনিকদের চিন্তা বিষয়গতভাবে দাস সমাজ ব্যবস্থা থেকে উৎসারিত হলেও তাঁদের দার্শনিক চিন্তাকে দাস ব্যবস্থার মতাদর্শগত সমর্থন মনে করাটা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক, কারণ চিন্তার জগতে যুক্তির বিকাশ তার নিজস্ব নিয়মে ঘটে যার উপরে সামাজিক ভিত্তির প্রভাব একান্তই পরোক্ষ। অর্থাৎ, যে কোনও তত্ত্বের বিকাশকে শুধুমাত্র একটি শ্রেণির মতাদর্শগত রক্ষাকবচরূপে চিহ্নিত করা হবে নিকৃষ্ট বস্তুবাদের (Vulgar Materialism) নামান্তর মাত্র। (Theodor Oizerman, Problems of the History of Philosophy, pp.401-405).

বিষয়টি খুবই আশ্চর্যের, এঙ্গেলস যিনি দ্বান্দ্বিকতাকে সার্বজনীন রূপ দিয়েছিলেন, তাঁকে দ্বান্দ্বিকতার বিরোধী বলে অভিযুক্ত করা হয়। দ্বান্দ্বিকতা এমন এক প্রকল্প যা নিয়ে অতীতে কেউ বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। এই প্রসঙ্গে গ্যারেথ স্টেডম্যান জোন্সের পর্যবেক্ষণ হল, “আমরা সবাই বুঝতে পারি কেন এঙ্গেলস দ্বান্দ্বিকতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। কেন তাঁর প্রথাগত ধারণা বিশেষ ব্যবহৃত হয় নি ক্যাপিটালেঃ দ্বন্দ্বতত্ত্ব হল ইতিহাসের আয়না। আর ইতিহাসই হল সবকিছু। হেগেলীয় দ্বন্দ্বতত্ত্ব চুক্তি সম্পর্কিত ধারণার অনড়তাকে ধ্বংস করে যা চিন্তার দ্বারা তৈরি হয় বা তার প্রভাবে। একইভাবে ইতিহাস কোন নির্দিষ্ট রাষ্ট্র কাঠামোর অনড়তাকে স্বীকৃতি দেয় না, আসে ও ধ্বংস হয়। ইতিহাসের বিচারে সবই ক্ষণস্থায়ী। একই কথা প্রযোজ্য মানব প্রজাতি ও প্রকৃতির ক্ষেত্রে। হেগেলের ভ্রান্তি হল, তিনি ভাবলেন এটি একটি চিন্তা পদ্ধতি। এবং একে তিনি নির্বিচারে ব্যবহার করলেন। কিন্তু বাস্তব হল, এ এক বিশ্বজনীন পদ্ধতি। চিন্তা শুধুমাত্র তার প্রতিফলন ঘটায়, বা সচেতনতার মাত্রা স্থির করে।”

এঙ্গেলসের হাত ধরে দ্বন্দ্বতত্ত্ব আন্তর্জাতিক বিপ্লবী রাজনীতির তত্ত্ব হয়ে ওঠে। “শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ”  মার্কস তাঁকে নিজের পূর্বসূরী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং সেই কথা মাথায় রেখেই আজকের দিনে আমাদের এঙ্গেলসের মূল্যায়ন করতে হবে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...