লাট্টু

লাট্টু -- রোদ্দুর মিত্র

রোদ্দুর মিত্র

 

 

এই একটা দিন সূর্য ওঠার আগেই লাট্টুর ভেতরে আলো ফোটে। ঘুমচোখে বালিশের তলা হাতড়ে পাতলা একটা ডায়েরি বের করে সটান কপালে ঠেকিয়ে বিড়বিড় করল, ‘হ্যাট্রিক। হ্যাট্রিক। হ্যাট্রিক। আর কিচ্ছু চাই না তোমার কাছে।’

ডায়েরির প্রথম পাতায় বড় বড় করে লাল-হলুদ অক্ষরে লেখা— ‘আই লাভ ইউ বাইচুং’

বিছানা ছেড়ে নামামাত্র লাট্টু গায়ে চাপিয়ে নেবে ইস্টবেঙ্গল জার্সি। মেঝেতে লাট্টুর মা অকাতরে ঘুমোচ্ছেন। বাবার নাইট ডিউটি, ফিরতে ফিরতে সে সাইকেল নিয়ে স্টেশানে। পঁয়ত্রিশ বাড়ি পেপার বিলি করে আজ আর রিন্টুদার চায়ের দোকানে পা ফেলা নেই। বাপের জন্মে মাঠে যায় না, খরিদ্দারের মুখে মুখে খেলার যে একপেশে খবর রটে, রিন্টুদা সেই ঝুটা গল্পই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে লাট্টুকে বলে, টোন কাটে, দুয়ো দেয়। একপেশেই বটে! রিন্টুদার চায়ের দোকান সংলগ্ন অঞ্চলটা আসলে মোহনবাগানিদের আঁতুড়ঘর– মানে সবার বুকে সবুজ-মেরুন। মাচারা রটিয়েছে, বাইচুং আদ্যোপান্ত ফাটকা প্লেয়ার। লিগের দ্বিতীয় পর্যায়ে নাকি খুঁজেই পাওয়া যাবে না!

কে বলেছে খুঁজে পাওয়া যাবে না? আজ এই এমন তুড়ি মারতে মারতে যখন প্রশান্ত ডোরাকে পরপর তিনবার ঘোল খাওয়াবে, লাট্টু যখন মায়ের ঘেমো আঁচলের মতো গায়ে জড়িয়ে নেবে লাল-হলুদ পতাকা, তখন দেখা যাবে বাইচুং কত টাটকা। একেবারে জাত স্ট্রাইকার।

এই একটা দিন বাবার ধ্যাতানি থেকে লাট্টুর ছুটি। বাড়ি ফিরে পেপারের শেষ তিনটে পাতা আগে মুখস্থ করে ফেলা চাই। ট্রেনে-বাসে এঁড়ে তর্কই বেশি। পেটে বিদ্যে নেই, ফুটবলে পা ঠেকানো তো বহুদূর! মাঠের বাইরের যুদ্ধে লাট্টু আজ অর্জুন সাজবে। অকাট্য যুক্তির সামনে একে একে সব ভোকাট্টা। ভোকাট্টা! সে চোখ বন্ধ করলে দেখতে পায় অনন্তকালব্যাপী লাল-হলুদ রঙের একটা ঘুড়ি উড়ছে আকাশে। একা। যেন বলছে, ‘আয় আয় আয়। কে খেলবি, আয়। দেখি বুকের কত পাটা!’ আরও একটু সময় চোখ বন্ধ করে রাখলে লাট্টুর ভারহীন শরীরটা ঘুড়ি হয়ে উড়ে যায়। লাল-হলুদ রং। ঘুড়ি হয়ে ইচ্ছে করে বাইচুং-এর পায়ে পেঁচিয়ে যেতে। তবু তো ছুঁয়ে দেখা যাবে! ছুঁয়ে থাকা যাবে বেশ কিছুক্ষণ!

চায়ের আদলে মা যে রোজ মিষ্টি গরম জল বানিয়ে থাকেন, আজ সেটাই অমৃত। সঙ্গে দুটো লেড়ো বিস্কুট। টাইম কলে জল আসার আগেই লাট্টুর খবর মুখস্থ, বাবার পকেট থেকে দু-পাঁচটাকা সরিয়ে উল্টোডাঙার টিকিট আর জার্সি রেডি। ম্যাচের টিকিট আনবে রতন। সাড়ে এগারোটা বাজতে এগারো মিনিট বাকি। লাট্টুর মনে হয়, পৃথিবীটা ফন্দি করে মন্থর হয়ে গেছে। একমাত্র সেই ঘামছে, দৌড়চ্ছে, ইস্টবেঙ্গলের জার্সি গায়ে আঁচড় কাটছে পৃথিবীর গায়ে।

স্নান সেরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঘেঁটে ঘেঁটে বাইচুং-এর ছবির সঙ্গে নিজেকে বারবার মিলিয়ে দেখে নেয় লাট্টু। চুলের সামনের অংশ খানিক ছুঁচলো হবে। ডানপাশে ঠিক মানাচ্ছে না, বাঁদিকটা ছড়িয়েছে… আয়নার ওপারে যেন লাট্টু এবং বাইচুং মিলেমিশে একাকার হয়ে এক আশ্চর্য দ্যোতনার জন্ম দেয়।

এই একটা দিন, তেইশ বছরের রোগা শরীরটা শুধু লাট্টুর, বাদবাকিটা ইস্টবেঙ্গলের, বাইচুং-এর।

 

২.

-ঢ্যামনা রেফারি! বেজন্মা রেফারি! হারামি কোথাকারের! কত পয়সা খেয়েছিস বে?
-সামান্য একটা ফাউলে কার্ড হয়?
-ব্যারোটো এত কাঁদুনি গাইছে কেন রে লাট্টু?
-স্ট্রেচার কই? স্ট্রেচার? মালটাকে হাসপাতালে ভর্তি কর শিগগির। ন্যাকা!
-মাইরি লাট্টুদা, মাঝেমধ্যে তুমি যা দাও না!
-এবার বাইচুং দেবে। কই রে রতন, বিড়িটা দে।

এই হচ্ছে লাট্টুর দলবল। রতনকে বাদ দিলে, প্রতিটা ছেলেই আঠেরো, মেরেকেটে উনিশের চৌকাঠে। কেউ বস্তিতে, কেউ ভাঙা টালির বাড়িতে, কেউ আবার একঘর ভাড়ায় পোকার মতো জীবনযাপন করে। শাহরুখ খানের সিনেমা দেখা ছাড়া নির্দিষ্ট কাজ নেই ওদের। শুধুমাত্র ডার্বির দিনে ওরা পোকার খোলস ছেড়ে রাস্তায় নামে। লাল-হলুদ জার্সি গায়ে চাপালেই কেমন লড়াকু হয়ে ওঠে লাট্টুর দলবল। দুপুরে পেটভরে হয়তো খায়নি, রাতেও নিশ্চিত জুটবে না, বিড়ি বাঁধতে বাঁধতে অবসন্ন বাবা– সবকিছু ভুলে ওরা বেঁচে নিতে চায় এই নব্বই মিনিট। জীবনের এই নব্বই মিনিট ওরা মানুষ। ওদের স্বপ্নের বাজপাখি তখন পেনাল্টি বক্সের মধ্যে ডানা ঝাপটাচ্ছে। বাইচুং, বাইচুং! ঐ তো বাইচুং বল পেয়েছে।

হাফ টাইমের তিন মিনিট আগে, মাঝমাঠ থেকে দুই ডিফেন্ডারের ফাঁক দিয়ে একটা থ্রু বাড়িয়েছিল ডগলাস। লেফট উইং-এ তখন অ্যালভিটো। বল নিয়ে কর্নার ফ্ল্যাগ অব্দি এসে ছিনেজোঁকের মতো পায়ে লেগে থাকা রেনেডি সিং-কে ডজ করেই দুরন্ত সেন্টার। বলের জন্যে লাফিয়েছিল ওকোরো, পেল না। ক্লিয়ারেন্স হওয়ার আগেই বল পেয়েছিল বাইচুং। এবার, এবার, এবার ইস্টবেঙ্গল গ্যালারি হিংস্র বাঘ, ইস্টবেঙ্গল গ্যালারি বারুদ।

ডিফেন্সের জটলায় শট নেওয়া ঠিক হবে না ভেবে বাইচুং একটু একটু করে ডানপোস্টের দিকে সরে যাচ্ছিল। অদ্ভুত, গ্যালারিতে লাট্টুও নিজেকে বলছিল, ‘এখন নয়। আর একটু অপেক্ষা, আর একটু ধৈর্য।’ পাশ থেকে রতন চেঁচাচ্ছে, ‘গোলে মার শালা। পেনাল্টি বক্সে ধ্যাড়াচ্ছিস কেন?’

এমন সময়ে একমাত্র লাট্টুর পৃথিবী ধীরে চলে। স্লো মোশনের দুনিয়ায় পায়ে-বলের সংস্রবের শব্দ শুনতে পায় সে। পৃথিবীকাঁপানো চিৎকার তাকে ছুঁতে পারে না। ওরা লাট্টুর কেউ নয়, লাট্টু একজন ধ্যানী। লাট্টু জানে, বামপোস্টের একেবারে কোণা দিয়ে বল ঢুকবে। এতই আচমকা হবে যে, তখন মোহনবাগান ডিফেন্স স্থবির। নিরবিচ্ছিন্ন আর্তনাদ কয়েক সেকেন্ডের জন্যে থামিয়ে দিয়ে বাইচুং বামপোস্টের কোণা ঘেঁষেই শট নিল। লাট্টু যেমনটা ভেবেছিল। প্রশান্ত ডোরা ঈগলের মতো লাফিয়েও বলের নাগাল পেল না। গোল, গোল, গোওওওওল! লিগের প্রথম ডার্বিতে ইস্টবেঙ্গল এক, মোহনবাগান শূন্য।

হাফ টাইমের বাঁশি বাজার আগে লাট্টু হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল। এই প্রথম। রতনকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে সদ্যোজাতর মতো কাঁদছে। পাঁচ বছর ধরে নিজেকে শাসন করে, আঘাত করে পুষে রেখেছিল এই জল। ভেবেছিল শুকিয়ে গেছে, কিন্তু ভুলে যাওয়া কি অতই সহজ?

প্রতি অমাবস্যা-পূর্ণিমায় লাট্টুকে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়— এখনও। ডান পায়ের হাঁটুতে কী নাছোড়বান্দা যন্ত্রণা! এ যেন জন্মদাগের মতো লাট্টুর শরীরে মিশে গেছে।

ইস্টবেঙ্গলে ট্রায়াল দিতে যাওয়ার দিনতিনেক আগে বাড়িতে রতন এসেছিল।

-সর্বনাশ হয়ে গেছে লাট্টু। শ্যামলদার অ্যাক্সিডেন্ট…
-শ্যামলদা? মানে তোদের ক্লাবের বুড়ো স্ট্রাইকারটা?
-মুখ সামলে ভাই। শ্যামলদা মোটে বত্রিশ। আগের ম্যাচে হেডে দুটো গোল করেছে। সে যাইহোক, কাল বাজার যাওয়ার পথে খালি অটো ধাক্কা মেরেছে শ্যামলদাকে। ডানহাতটা বোধহয় বাদ যাবে। এদিকে আজকে বেলেঘাটার সঙ্গে ফাইনাল। তোকে খেলতে হবে।
-ক্ষেপেছিস? পরশুর পরদিন ইস্টবেঙ্গলে ট্রায়াল।
-টাকা দেব। কড়কড়ে দুশো। পঞ্চাশ অ্যাডভান্স দিতে এসেছি। মানা করিস না লাট্টু।
-খেপ খেলায় রিস্ক আছে রতন। ধুমধাড়াক্কা লাথি মারে, উটকো ফাউল করে বেলেঘাটার ছেলেগুলো। একটা কিছু হয়ে গেলে তোদের সোদপুর স্পোর্টিং দায়িত্ব নেবে?
-আড়াইশো দেবো। আর তোর সমস্ত দায়িত্ব আমার, এই রতন হালদারের। বল রাজি?
-বিড়ি আছে?’

তার মানে হ্যাঁ। লাট্টু সোদপুর স্পোর্টিং-এর হয়ে ফাইনালে খেলছে। গতমাসে মায়ের রান্নার কাজটা চলে গেছে। পাঁচবাড়ি বাসন মেজে কী আর ফুটবলারের মা হওয়া যায়? তিনমাস হল, বাবা মাইনে পায়নি। কাল রাতে ঘেন্নায়, আক্রোশে লাট্টুর টেরিলিনের প্যান্ট আর একপাটি কেডস পুড়িয়ে দিয়েছে। ভাগ্যিস জার্সিটা হাতের কাছে ছিল না। এই মুহূর্তে আড়াইশো টাকা লাট্টুর ছেঁড়া ছেঁড়া জীবনের প্রলেপ।

শ্যামনগর থেকে ট্রেনে ওঠার সময় রতনের কাছে লাট্টু আরও একটা জিনিস চেয়েছিল, দামী নয়, রোগাপাতলা হলেও চলবে, একটা ডায়েরি।

-আমার চাই হ্যাট্রিক, রতন একগাল হেসে ট্রেনে উঠে যায়।

শুরু থেকেই নিজেকে বাঁচিয়ে, আড়াল-আবডাল খুঁজে নিয়েই খেলছিল লাট্টু। হাফটাইমের কিছু আগে, লেফট উইং থেকে ভেসে আসা সেন্টারের নাগাল লাট্টু পেল না বটে, কিন্তু পেনাল্টি বক্সের ভিড়ের মধ্যে থেকে কে যেন লাট্টুর পায়ে বল সাজিয়ে দিল। সামনে বেলেঘাটার দুটো ছেলে, বয়সে বড়, লাট্টুর দিকে তেড়ে আসছে। ছোট্ট টোকায় একজনকে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে লাট্টু ডানপোস্টের দিকে বল নিয়ে এগোচ্ছে। এখন নয়, এখন নয়, আর একটু অপেক্ষা।

তারপর যা হয় আর কী, ডানপোস্টের কোণা ঘেঁষে বল ঢুকল গোলে। তারপর যা হওয়া উচিৎ ছিল না, সেটাও হল। ডিফেন্সের জঙ্গল থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল লোহাকঠিন দুটো পা, মারল সপাটে এক লাথি। ছিটকে পড়ার আগে লাট্টু শুধু দেখতে পেয়েছিল, সাইডলাইন থেকে রতন ওর দিকে প্রচণ্ড বেগে ছুটে আসছে।

 

৩.

সেকেন্ড হাফ শুরুর দশ মিনিটের মধ্যে দীপক মন্ডল চোট পেয়ে মাঠের বাইরে চলে গেল। ব্যারেটো-সুনীল ছেত্রীর বারংবার গোলমুখী হানা ঠেকাতে ঠেকাতে সন্দীপ নন্দী বেজায় ক্লান্ত। ফরোয়ার্ড লাইনে বাইচুং একা, বল পাচ্ছে না, রেগে যাচ্ছে ক্রমশ। বাধ্য হয়ে সেও নেমে এল ডিফেন্সে। পঞ্চান্ন মিনিটের মাথায় পেনাল্টি বক্স থেকে কুড়ি গজ দুরত্বে একটা ফ্রি-কিক পেল ব্যারেটো। মোহনবাগান গ্যালারি তখন আক্ষরিক অর্থে ফুটছে।

ব্যারেটো ভেতরে ভেতরে দারুণ নিশ্চিত ছিল, অপেক্ষা শুধু রেফারির বাঁশির। সন্দীপ নন্দীকে একচুল নড়বার সুযোগ দিল না সে। গোল দিয়েই ছুটে এল ইস্টবেঙ্গল গ্যালারির দিকে, এমনটা আগে কখনও ঘটেনি। ব্যারেটো যেন লাট্টুকেই দুয়ো দিতে এসেছে। আকাশের দিকে মাথা না তুলে, লাট্টুর চোখে চোখ রেখে একচিলতে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ফিরে গেল। তাকে সামনে পেলে হয়তো বলত, ‘ওয়েলকাল টু মাই ওয়ার্ল্ড বয়!’

গোল খাওয়ার পর থেকে ইস্টবেঙ্গল যাচ্ছেতাই রকমের খারাপ ফুটবল খেলতে শুরু করল। ডগলাসের মাঝমাঠের সংসার বিধ্বস্ত, সুলে মুসা পায়ে অতিরিক্ত সময় বল রাখছে, গোলের জন্যে দৌড়ঝাঁপ করছে না কেউ। লিগের প্রথম ডার্বি শেষমেশ কিনা ড্র হবে?

দুই কোচের হাবভাবে তখন স্পষ্ট, অহেতুক আক্রমণ চাইছেন না তারা। মাঝমাঠে অবিন্যস্ত খেলার স্রোতে, বাইচুং ওকোরোর সাথে ওয়াল খেলে হঠাৎ বল নিয়ে ঢুকে পড়ল পেনাল্টি বক্সে। জেতার খিদেটা হারিয়ে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল অষ্টআশি মিনিটে।

সামনে মোহনবাগানের পাঁচজন স্টপার। দুজনকে অনায়াসে কাটিয়ে নেওয়া সম্ভব, কিন্তু তারপরেও দুর্ভেদ্য দেওয়াল। বাঁদিকে ওকোরো খালি নেই, শেষের বাঁশি বাজবে ঠিক দু মিনিটের মাথায়, ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে আকাশছুঁই চিৎকার, ‘বাইচুং, বাইচুং!’ লাট্টু বুঝতে পারে এই সময়ে বাইচুং কত একা, কত আত্মমগ্ন! এত মানুষের চিৎকার আদপে নিঃস্ব। বল নিয়ে সামান্য পিছিয়ে এসে, আলতো টোকায় মেহতাব হোসেনকে কাটিয়ে সহসা গোলের দিকে ঘুরে গেল বাইচুং– কোমর থেকে এক অমানুষিক ঝটকায় শট করল। বলটা যখন ইনসুইং করে গোলে ঢুকছে, লাট্টু চেঁচিয়ে উঠল, ‘ম্যাজিক!’

এমন অযাচিত মুহূর্ত যেকোনও সমর্থকের জীবনে দৈবাৎ আসে। তবুও তো আসে। অপেক্ষার সেই অনিবার্য টানেই যে মাঠে আসা, গলা ফাটানো, সস্তার প্যাটিসে কামড়। কাতারে কাতারে উল্লাস স্রেফ এটুকুর জন্যেই।

লিগের প্রথম ডার্বিতে মোহনবাগানকে ২-১ গোলে হারিয়ে লাট্টুদের কী নাচ! মাঠের বাইরেও সেই নাচ ক্রমাগত ছড়াচ্ছে, মশাল জ্বলছে, পটকা ফাটছে– লাট্টু এক মায়ার দেশে পুতুলের মতো ছুটে বেড়াচ্ছে। কে আর পায় তাকে। সে এখন উড়বে, উল্টোডাঙা স্টেশান অবধি ভাসতে ভাসতে চলে যাবে… পেছন থেকে হ্যাঁচকা টান মারল রতন। যুবভারতীর চৌহদ্দিটুকু পেরোতে পারেনি, তার আগেই লাট্টুকে ঘিরে ধরেছে দশ-পনেরোটা ছেলে। দু-একজনের গায়ে মোহনবাগান জার্সি।

লাট্টুর দলবল এতক্ষণে নাচতে নাচতে এগিয়ে গেছে। স্ট্রিটলাইটের দৃপ্ত আলোয় একটুকরো উৎসব যেন লাট্টু আর রতনকে ফেলে মিলিয়ে যাচ্ছে বেলেঘাটা ক্রসিং-এর দিকে।

-এত উড়লে চলবে চাঁদু? একটু মাটিতেও পা ফেলতে হবে তো!
-আমাকে বলছেন?’
-আরে এটা তো সেই মালটা!

লাট্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে পেল্লাই চেহারার একজন জিজ্ঞেস করল, ‘কোন মালটা?’

-আরে সেই মালটা, যাকে মেরে, গুঁতিয়ে পা ভেঙে দিয়েছিলি তুই। মনে নেই?

গোটা দলটা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল। রতন পেছন থেকে বলল, ‘লাট্টু, ফিরে চল। অন্য রাস্তা ধরব।’

রতনের তোয়াক্কা না করে লাট্টু বলল, ‘তা একটু উড়ছি বটে। পা ভেঙেছে, ডানা তো আর নয়!’

-আজকে সেটাও গুঁড়িয়ে দেব। এক গোলে জিতে কত রোয়াব!
-মালটা বহুত দাবড়ায়। অনেক কটা ছেলেপিলেও জুটিয়েছে দেখলাম।
-এই রতন, সেদিন বেলেঘাটাও এক গোলে হেরেছিল না?
-শুয়োরের বাচ্চা!

হোঁতকা ছেলেটা পকেট থেকে ছুরি বের করে ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো তেড়ে গিয়ে চেপে ধরল লাট্টুর থুতনি।

-আজকে তুই, কাল তোর বাবা, পরশু তোর ক্লাব। এইভাবে ছারপোকার মতো টিপে টিপে মেরে ফেলব।

লাট্টু আকাশ থেকে পড়ল, ‘বাবা!’

অষ্টআশি মিনিটের মাথায় বাইচুং বল পেয়েছিল। বল পেয়েই শট করেনি, পিছিয়ে এসেছিল অল্প। এবার লাট্টুর পায়ে বল। রতন দেখতে পাচ্ছে লাট্টু এক পা, এক পা করে পিছিয়ে আসছে। সাক্ষাৎ দানবের থাবা লাট্টুকে গ্রাস করে নিচ্ছে মুঠোর মধ্যে। এরপরেই দু আঙুলের চাপে পিষে দেবে। অথচ ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে, ‘লাট্টু, লাট্টু, লাট্টু!’

কোমর থেকে অমানুষিক ঝটকা দিয়ে লাট্টু নিজেকে ছাড়িয়ে নিল প্রথমে। দানবের চোখে আঙুল খোঁচা মারতেই ছুরিটা পড়ে গেল। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে একতাল মাংসের দলার ভেতর আস্ত ছুরিটা ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, ‘আজকে আমি, কালকে আমি, পরশুও আমি।’

-লাট্টু পুলিশ! রতন দৌড়তে শুরু করেছে।

শেষবার লাট্টুর দিকে চাইতে গিয়ে, রতন কাউকে দেখতে পেল না। একঝলক ধরা দিয়েছিল তীব্র অবয়ব, ইস্টবেঙ্গল জার্সিতে একছটাক রক্তের দাগ।

উল্টোডাঙা স্টেশানে ঢোকার আগে লাট্টুর চোখ আটকে রইল অন্তহীন জ্যোৎস্নায়। পূর্ণিমার চাঁদ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কই, আজকে হাঁটতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হচ্ছে না। কই, লাট্টু খোঁড়াচ্ছে কই?

 

৪.

-ধেড়েকুমারের নাচন কোদনের কীত্তন শেষ হল? দিনকে দিন আদেখলেপনা বাড়ছে বই… বাবা!! কী কাণ্ড হল গো ঠাকুর?
-লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়েছে তোমার ঠাকুর। শান্তি?
-কই গো লাট্টুর বাবা, দেখে যাও ছেলের কীত্তি।
-আস্তে মা, আস্তে। পটলাকাকার মাইকটা মুখে ধরিয়ে দিই তোমার?
-ছেলে আমার প্রথম সাবানজলে হাত লাগিয়ে নিজের জামা নিজেই কাচছে। সবাইকে জানাব না? বা রে!
-না জানাবে না। এবার ঘরে যাও। প্লিজ।
-খেলার মাঠ থেকে কীসব ছাইপাঁশ শিখে এসে আমার ওপর ঝাড়বে। বয়েই গেল!
-মা!
-হ্যাঁ যাচ্ছি। ঘাড়ের কাছে কিন্তু ময়লা এখনও যায়নি। আরেকবার সাবান ঘষ।
-ঠিকাছে, এবার–
-তাড়িয়ে দিচ্ছিস কেন রে? তোর বাইচুং আজ কেমন খেলল বললি না যে?
-হে হে, দুটো গোল।
-দুগ্গা দুগ্গা!

মায়ের প্রগাঢ় দৃষ্টির কাছে লাট্টু যখন ধরা পড়েনি, এ যাত্রায় তাহলে বেঁচে গেল। জামাটা ধুয়ে পচা পুকুরে ফেলে দিতে হবে। একটু কেন, ভীষণ কষ্ট হবে, কিন্তু নিশ্চল এই রক্তের ছিটে থেকে মুক্তির পথ যে আর নেই! আবেগী হলে নিশ্চিত মৃত্যু।

পুকুরপাড়ে অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকল লাট্টু, রাতে খেল না, কান্না লুকোতে জলের বালতিতে মুখ গুঁজল, তবু অনুভূতি। বাতাবিলেবু গাছের গোড়ায়, গর্ত খুঁড়ে ইস্টবেঙ্গল জার্সিটা মাতৃস্নেহে পুঁতে দিল লাট্টু। অনুভূতি আপাদমস্তক এক লম্পট চরিত্র।

অন্ধকারের বিপ্রতীপেই নাকি আলোর অবস্থান। রাতের বেলা বিদ্যুৎ চমকালে লাট্টু যখন ভয়ে কুঁকড়ে যেত, মা বলত, ‘আলো ফুটলেই ভয় কেটে যাবে পাগল।’ মা মিথ্যে বলেছিল। পেপার দিতে বেরিয়ে লাট্টু বেশ টের পাচ্ছে, ভোরের এই আলগা আলো তার জীবনের অভিশাপ-অন্ধকারেরই সমার্থক। স্টেশানে, চায়ের দোকানে, রাস্তাঘাটে প্রত্যেকটা চোখ যেন লাট্টুকে মেপে দেখছে। রক্তমাংসপিণ্ড ভেদ করে তারা পড়ে নিচ্ছে লাট্টুর ভয়ার্ত চিত্ত। সবাই মিলে এক্ষুনি ছেঁকে ধরে প্রশ্নের পর প্রশ্ন, প্রশ্নের পর প্রশ্ন… তোমার হাতে রক্ত কেন?

পেপারে লিখেছিল, ইস্টবেঙ্গলের রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের যোগ্য উত্তরসূরি এই দল। এরা ধারণ করতে পেরেছে সেই অনাদি রক্ত। জমাটি মাঝমাঠ, ক্ষুরধার ফরোয়ার্ড লাইন, আর সুভাষ ভৌমিকের বিস্ময়কর ম্যাচরিডিং আমাদের প্রতি ম্যাচেই মনে করিয়ে দেয় রক্ত, সংগ্রাম এবং ইস্টবেঙ্গল একই সরলরেখার ওপর বিস্তৃত। এই অনন্ত লড়াইটাই ইস্টবেঙ্গলের আত্মা। লাট্টুকেও লড়তে হবে। কিন্তু সে যে মানুষ খুন করেছে। মারতে বাধ্য হয়েছে, নইলে তাকে মরতে হত। মা কিম্বা বাবা, কেউ একদিনের জন্যেও এই দুনিয়ার অনুগ্রহ পায়নি। অহর্নিশি আঁচড়ে-কামড়ে-ছিনিয়ে নেয় বলেই লাট্টু বেঁচে আছে। তাকে বেঁচে থাকতে হবে। বেঁচে থাকার অমোঘ চেতনা কি বাইচুং-এর মনেও কাল ঘুরপাক খাচ্ছিল? কে জানে!

-পরিমলের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। আজ থেকেই তুই ওর মুদির দোকানে খাতা লেখার কাজে ঢুকে পড়।
-বাবা, আর কটা দিন অপেক্ষা করো, আমি কিছু একটা… পেপারের দেওয়ার পাশাপাশি ভাবছি টিউশানি…
-টিউশানি? টেনেটুনে উচ্চমাধ্যমিক পাশের কাছে কোন বাপে নিজের ব্যাটাকে পড়তে পাঠাবে?
-আসছে মাসেই রতন বলেছে জুটিয়ে দেবে। কটা দিন-
-পাঁচ পাঁচটা বছর তোকে মাথায় তুলে নেচেছি হারামজাদা। ফুটবল, ফুটবল করে ফুটোকড়িও মিলল? হাসপাতালের অত খরচা, মাসের ওষুধ, আজ ডিম, কাল দুধ… কখনও আমার দিকে চেয়েছিস? চেয়েছিস বাইচুং-এর হ্যাট্রিক। আমি আর সইতে পারছি না, কারখানাও কাল থেকে লকআউট।

লকআউট? লাট্টু সত্যি সত্যি কেঁপে উঠল বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে। চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গেছে, গালে মাংস নেই, কালকের চাইতে আজকে আরও রোগা লাগছে। খেলাটা লাট্টুর কাছে দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে। এ কোনদেশি ডিফেন্স, যেখানে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে লাট্টু!

-আজ মিছিল-টিছিল হবে। দল বেঁধে মালিকের কাছে যাব দল বেঁধে। শুয়োরের নাতিরা মনে হয় না কারখানা খুলতে দেবে। যদি খোলেও, মাইনে থোড়াই পাব!

সন্ধের আগে খবর এল, লাট্টুর বাবাকে পুলিশ বেধড়ক পিটিয়েছে। মাথা ফেটে প্রচুর রক্ত পড়েছে। বিক্ষোভ তবু থেমে থাকেনি, কারখানার সামনে এখন তিনি দাঁড়িয়ে আছেন সকলের কাঁধে ভর দিয়ে।

পাড়ার টেলিফোন বুথ থেকে বারকয়েক চেষ্টা করেও ক্ষতবিক্ষত বিক্ষুব্ধ বাবার গলা শুনতে পেল না লাট্টু। কারখানার ফোনলাইন ডেড। কী মনে হতে, রতনের বাড়িতে ফোন করল সে।

-কেমন আছিস?
-তোকে পুলিশ খুঁজছে লাট্টু। আজ আমার বাড়িতে এসেছিল।
-তুই কী বলেছিস?
-আমাকে ক্ষমা করে দে।

ফোনটা তৎক্ষণাৎ নামিয়ে রাখত লাট্টু, কিন্তু রতন থামল না।

-ঐ ছেলেগুলো নিখিলকাকুকেও চেনে, বোধহয় কম্পানির মালিকের কেউকেটা। লাট্টু? লাট্টু?

রাত যখন ঘন, বাবার ওষুধ, মাথার ব্যান্ডেজ, মলম, তুলো ইত্যাদি গুছিয়ে রেখে লাট্টু বাড়ি থেকে বেরোল। মাকে একবার প্রণাম করা উচিত ছিল ভেবেও ফিরে গেল না। ফুটিফাটা গেঞ্জি, বারমুডা আর বাইচুং-এর ডায়েরি বুকে চেপে সে বোধহয় পালিয়েই গেল। কোন ঘাটে যে ভিড়বে, নিজেই জানে না!

এবং লাট্টু খুব স্বাভাবিকভাবেই ভুলে গেল, রক্তমাখা জার্সিটা সে মাটিতে পুঁতে রেখেছে।

 

৫.

মানুষের মতোই, একেকটা স্টেশানেরও নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম ভাঙে। ধরা যাক সোদপুর। চায়ের ঝুপড়িতে সদ্য উনুন জ্বলল, ডিম-পাউরুটির স্টলে ইয়াব্বড়ো তাওয়াখানা এখনও স্নানরত, তুমুল ঘষামাঝা চলছে, ঝুরিভাজা-ঝালবাদাম-চানাচুরের ঝাঁপ খুলবে খুলবে করছে। ঘুমচোখে প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করছে ষাটোর্ধ্ব যুগল। জটপাকানো লম্বা চুলের বছর তেরো উকুন বাছতে মগ্ন আরেক বছর তেরোর। কুকুরছানার পাশে ন্যাংটো হয়ে ঘুমোচ্ছে বছর তিন– লালায় মাখো মাখো। চায়ের ঝুপড়ির আড়ালে, যেখানে প্রকাণ্ড জারুল গাছ আকাশের খানিকটা খেয়ে নিয়েছে, তার নীচে দাঁড়িয়ে আছে লাট্টু। রতন আসবে। কথা দিয়েছে। রতনের এক বন্ধুর মেসে দু-তিন সপ্তাহ গা ঢাকা দিতে হবে। পরিস্থিতি থিতোলে ভেবে দেখা যাবে। আপাতত শীতঘুম। টুপ করে জারুল ফুল খসে পড়ল লাট্টুর মাথায়। পিঠে টোকা পড়ল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।

-চলে আয়।
-নিরাপদ তো? পুলিশ যদি আসে?
-লাট্টু তুই এসব বলছিস?
-ধরা পড়লে নির্ঘাত ফাঁসি। বাবার কোর্টে যাওয়ার পয়সা নেই।
-বাহ! হাফটাইমের আগেই ওয়াকওভার দিয়ে দিই চল।
-একটা ডার্বি আর বাস্তবের মধ্যিখানে ফারাক আছে রতন।
-যদি বলি নেই? যদি বলি এই বেঁচে থাকাটাই আসলে ডার্বি?
-তাহলে আমি হেরে গেছি। আর জিততে চাইছি না আমি। খুশি?
-হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে তুই ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিলি মনে আছে? মনে আছে হাতে আড়াইশো টাকার বেশি গুঁজে দিয়েছিলাম বলে কাঁপা কাঁপা হাতেও চড় কষালি?
-শুধু থাকার জায়গা পেলেই তো হবে না, সকাল-সন্ধে খাবার কে দেবে?
-জানি, তুই মনে মনে আমাকে দারুণ ঘেন্না করিস। সোদপুর স্পোর্টিং খেলায় জেতার পরে সবাই আমাকে খিস্তি করল, তোর ইস্টবেঙ্গল খেলার স্বপ্নটা গুঁড়িয়ে দিলাম, তারপরেও আমিই পুলিশের সামনে উগড়ে দিলাম তোর নাড়িনক্ষত্র– প্রতিবার হেরেছি আমি, এই রতন হালদার। অথচ দেখ, তারপরেও তুই জিতেছিস। ডজ করে হোক, ড্রিবল করে হোক, পিছিয়ে এসেও বাইচুং-এর মতো বেঁচে থেকেছিস খেলায়– তোর আপন বাস্তবে। লাট্টু জীবনে এই একবারের জন্যে আমাকে বাইচুং হতে দে, প্লিজ!’
-ডায়লগ দিস না, ঝেড়ে কাশ।
-তোর থাকার দায়িত্ব যেমন আমার, তেমনি খাওয়ার ভারও আমি নেব। এবার যদি না বলিস…

রতনের বন্ধুর মেসবাড়ি স্টেশান থেকে অনেকটাই ভেতরে, এমনকি তার বাড়ি থেকে সাইকেলে কুড়ি মিনিট। বাড়ির আড়ালে, টিফিনবাক্সে রুটি-আলুচচ্চড়ি নিয়ে এল রতন। রতনের এই বন্ধুটিও মিশুকে। ইস্টবেঙ্গল ফ্যান। কেষ্ট বণিক।

দুপুরের দিকে রতন বাড়ি যাবে, সন্ধেতে আসবে রাতের খাবার নিয়ে। অযথা এ বাড়াবাড়ি– শুরু হল এক জ্বালা। রতনের অনুগ্রহ ছাড়াই লাট্টু কিন্তু বেঁচে থাকত, আজ স্টেশানে, কাল গঙ্গার ঘাটে, পরশু শ্মশানে। জনবিস্ফোরণের পৃথিবীতে আর যাই হোক, উচ্ছিষ্টের অভাব নেই। লাট্টু তো কোনওদিন আদর পায়নি, মায়ের রুক্ষ হাতদুটোই চুলে বিলি কেটে দিয়েছে, তাই দীর্ঘ তেইশ বছর পরে আচম্বিতে কেউ প্রশ্রয় দিচ্ছে ভেবে তার ভয় হয়। রতনকে যদি পুলিশে ধরে কিম্বা রতন যদি হারিয়ে যায় লাট্টুকে একা ফেলে?

প্রকাণ্ড পৃথিবীর হাজার একটা নিয়মের তালিকায় আশ্চর্যজনকভাবে যুক্ত হয়ে পড়ল লাট্টু আর রতন। সকাল দশটায় জলখাবার, দুপুরবেলা ভাত-ডাল-তরকারি, বিকেল ফুরিয়ে অন্ধকার জমাট হলে মেসবাড়ির উল্টোদিকের চায়ের দোকানে এক কাপ চা এবং বিড়ি, রাতের বেলার রুটি, দুপুরের অবশিষ্ট তরকারি।

দিনের অর্ধেক সময় লাট্টু জানলার পাশে বসে থাকে, হাওয়াই চটির শব্দ, সাইকেলের ক্রিং ক্রিং, পাখির পিরীত, সান্ধ্যমাস্টারের বকুনি ইত্যাদি গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনে। বাকি অর্ধেক সময়, কখনও হিসি করতে গিয়ে, কখনও ঘুমের ভেতর বাবার রক্তাক্ত মুখটা উত্যক্ত করে। কাঁপুনি দেয় কেমন। নিশ্চিন্ত যাপনে লাট্টুকে আদৌ মানায়? ইতিহাসে লড়াইবিমুখ হয়ে থেকেছে একমাত্র পরজীবীরাই।

শনিবার। ঝুপ করে একটা সপ্তাহ শেষ হয়ে গেল। আজ রাতে মাংস-ভাত। কাল যুবভারতীতে ইস্টবেঙ্গল-চার্চিল ব্রাদার্স।

-তোর মাথাটা সত্যি সত্যি খারাপ হয়ে গেছে। তাই বলে দেশি মুরগি? এত কে খাবে?
-ভুলেও ভাবিস না, ন্যাকা সেজে পার পেয়ে যাবি।
-এই রতন, বলছিলাম কী, তুই ফোনে বলেছিলি না, যে ওরা আমার বাবাকেও চেনে, কোম্পানির মালিকের চেনাজানা…
-হ্যাঁ হ্যাঁ। ওদের মধ্যে নেতাগোছের ছেলেটাই বোধহয় নিখিলকাকুকে চেনে।
-বেলেঘাটাতেই বাড়ি নাকি?
-তাই হবে আশা করি। ওসব বাদ দে না, তুই খাওয়া শুরু কর।

রতন বেরিয়ে যাওয়ার পর ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। দশটার পরে কেষ্ট বণিক জেগে থাকে না। মিনিট পনেরোর মধ্যে স্টেশানে পৌঁছতে পারলে শেষ কৃষ্ণনগর-শিয়ালদায় অনায়াসে উঠে পড়া সম্ভব। নিঃশব্দে কেষ্ট বণিকের ছাতা হাতে লাট্টু মেসবাড়ির বাইরে পা রাখল। মুরগির ঠ্যাং চিবোতে চিবোতে তার সিক্ত নির্জন ছায়ার পিছু নিল একটা ঘেয়ো কুকুর। বাবার ওষুধগুলো ফুরিয়ে যাওয়ার কথা আজই।

 

৬.

বেলেঘাটা যুবকবৃন্দ ক্লাবের পাশে একটা বিরাট বটগাছ আছে। তলায় দাঁড়ালে বৃষ্টি গায়ে লাগে না, পাতা চুইয়ে মাথায় টুপটাপ জল পড়ে পড়ে লাট্টুর জামার অনেকটা ভিজিয়ে দিল, এই যা। ছাতাটা গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখে সে প্রহর গুনছে। টুপটাপ, টুপটাপ…

শিয়ালদা স্টেশানের ঘড়ি বলেছিল, রাত পৌনে এগারোটা। কপালে একটা অটো জুটে গেলেই লাট্টু পায়ে বল পাবে। সম্ভাবনা ক্ষীণ, তবু পেনাল্টি বক্সে ঢোকার চেষ্টা করলে ক্ষতি কী!

বৃষ্টিটা তখন সদ্য ধরেছে, হিন্দি সিনেমার ঢঙে কোত্থেকে একটা অটো উড়ে এসে দাঁড়াল লাট্টুর সামনে। কেষ্ট বণিকের থেকে ঝাঁপা পঞ্চাশ টাকার নোটটাই এইমুহূর্তে লাট্টুর সম্বল। এরপরেও যদি… উঁহু, যদির প্রশ্ন উঠলে মন টলে যায়। ওয়ান টু ওয়ান বল পেয়েও শট পোস্টে লাগতে বাধ্য!

সাড়ে এগারোটার পরে পরেই ক্লাবের হইহুল্লোড় থেমে গেল। হুলিয়ে মদ-মাংস ঠাসাঠাসির পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে লাট্টু অবগত। পাকস্থলী নিংড়ে নিংড়ে একটা ছেলে বমি করতে করতে বটগাছের সামনে এসে দাঁড়াল। দৃষ্টিগোচরতার বাইরে দাঁড়িয়ে লাট্টু দেখতে পাচ্ছে, এই ছেলেটাকে ফেলে রেখে এলোপাথাড়ি পায়ে সবাই চলে যাচ্ছে। চকচকে জামা, কেতাদুরস্ত প্যান্ট সত্ত্বেও মদ বমি আর দামি পারফিউমের গন্ধ মিলেমিশে ছেলেটা বেমালুম হারিয়ে ফেলেছে তার শ্রেণির দাপট। দিনের শেষে একজন রিকশাওয়ালাও ঘরে ফেরে, অথচ ছেলেটা… তাহলে কীসের এত আধিপত্য, প্রভুত্বের চোখরাঙানি!

-কুত্তার বাচ্চা। আমার টাকায় গিলবি আর আমাকে ফেলেই পালাবি?, শব্দ জড়িয়ে আসে ছেলেটার এবং দাঁড়ানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আগেই আড়াল ভেঙে বেরিয়ে লাট্টু এসে ধরে নেয় তাকে।
-ক্লাবের শালা প্রেসিডেন্ট আমি। দেখি কোন হারামি ক্লাবে ঢুকতে দেয় তোদের!

লাট্টু মুহূর্তের জন্যে পাঁচ বছর পিছনে গিয়ে চিনতে পারে, সেদিন ডিফেন্সের জঙ্গলে এই ছেলেটাও ছিল। এই ছেলেটাই বেলেঘাটা ক্রসিং-এর আগে, লাট্টুকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এত উড়লে চলবে চাঁদু?’

বল পায়ে পেনাল্টি বক্সে ঢুকে পড়েছে লাট্টু। সামনে গোলকিপার, কাঁধের ওপর মুহুর্মুহু শ্বাস ফেলছে জোলো স্টপার অসীম দত্ত। সারা রাস্তা লাট্টু কিচ্ছু বলল না। একবার শুধু জানতে চেয়েছিল, ‘তোমার বুঝি অনেক টাকা?’

-কম্পানি কম্পানি। আমার, বাবার…কলকাতার সব কারখানা আমাদের নামে…

ডাহা মিথ্যে। হাতে গুনে মোটে পাঁচটা কারখানা চলে সুশীল দত্তর কম্পানির নামে– লাট্টুর কাঁধের ওপরে যে ঢ্যামনা ভর করেছে, তার বাবা। লাট্টু নিখুঁত জানে। মাঝরাস্তায় অসীম কয়েকবার হোঁচট খেল, কুকুরের ঘেউ ঘেউ-এর সঙ্গে তার প্রলাপের ক্যাকোফনির সাক্ষী হয়ে থাকল একমাত্র লাট্টু।

অসীমের তাকলাগানো তিনতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে লাট্টু তাকে একা ছেড়ে দিল। টলতে টলতে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলার সময় অসীমের ঘাড়ে ছাতার বাঁট দিয়ে সজোরে আঘাত করল লাট্টু। সন্তর্পণে গেট খুলে কলিংবেল বাজাল সে।

সুশীল দত্ত পরশ্রীকাতর। তার ওপরে বৃষ্টির রাত। গেলাসে গেলাস ছাড়াও আরও কত ঠোকাঠুকি চলবে। ঘুমচোখে বাড়ির চাকর বোধহয় দরজা খুলল।

-সুশীল দত্ত বাড়িতে আছেন?
-এত রাতে কী চাই?
-আসলে ওনার ছেলে জ্ঞান হারিয়ে রাস্তায় পড়েছিল, তাই আমি…

কলিংবেলের শব্দ পেয়ে সুশীল দত্তও নীচে নেমে এলেন। মুখোমুখি হওয়ার আগেই বয়স্ক চাকরকে ধাক্কা মেরে লাট্টু চেপে ধরল সুশীল দত্তর বছর পঞ্চাশের মুখখানা। পকেট থেকে ভোঁতা ছুরি বের করে পেটের নরম মাংসে খোঁচাতে শুরু করল লাট্টু।

-এখন কী হবে? কোথায় পুলিশ? মেরে আমার মাথা ফাটিয়ে দিচ্ছে না কেন? আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছেন না, গোলের আর্তনাদ? আমরা জিতে গেছি। কাল থেকে মহালক্ষী ওয়ার্ক হাউস খুলবে। প্রত্যেক কর্মচারী মাইনে পাবে। আপনার অন্তঃসারশূন্য শরীর ড্যাবড্যাব করে দেখবে, কয়েক হাজার মানুষ, অভুক্ত, নিপীড়িত মানুষ ছিনিয়ে নিচ্ছে তাদের রোজগার, তাদের রক্তঘামের মূল্য। ফোট শালা! ছুরিটা বুকে গুঁজে দিয়েই লাট্টু চলে গেল।

অতঃপর ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে মশাল জ্বলে উঠল। কালিপটকা ফাটছে মাঠজুড়ে। লাট্টুর গোলে ম্যাচ জিতে ইস্টবেঙ্গল লিগ-টেবিলের শীর্ষে। লাট্টুর সংগ্রাম প্রকৃত প্রস্তাবে সত্যি হয়েছে। একটানে জার্সি খুলে মাঠের মাঝখানে মাচোম্যানের মতো দাঁড়িয়ে সে থুতু ফেলল অসীমের মুখে। ততক্ষণে রক্তের ধারাস্রোত শুঁকে চলে যাচ্ছে একটা দুটো পিঁপড়ে।

 

৭.

লাট্টুর মায়ের শরীর ভেঙে গেছে। রোববার থেকে কাজে যায়নি। পাশের বাড়ির সঙ্গে কথা বলেন না, রান্নায় নুন দিতে ভুলে যান, এক কাপড়েই হয়তো কেটে যায় সারাবেলা। আজ সকাল হতে না হতেই পচা পুকুরের দিকে একদঙ্গল কুকুরের কী চিৎকার! অনেকদিন পরে শরীরে হঠাৎ বেগ পেলেন তিনি, হাত দুটো হয়ে উঠল যন্ত্র, মনে হল কুকুরগুলোকে থেঁতলে দিতে– উঠোন থেকে থান ইট কুড়িয়ে নিলেন। ততক্ষণে বাতাবিলেবু গাছের গোড়ায়, আপদগুলো ভিজে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে টেনে হিঁচড়ে বের করেছে লাল-হলুদ রঙের একখণ্ড কাপড়। কাছে গিয়েই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল লাট্টুর মায়ের, উবে গেল তার তেজ, অনর্গল ঘামতে ঘামতে এক্ষুনি হয়তো আবার মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। এ যে লাট্টুর সাধের জার্সি! লাট্টুর ঘামের গন্ধ আছে এই জার্সির প্রতিটা সুতোয়।

বলেছিলাম কিনা, অনুভূতি আদ্যোপান্ত এক লম্পট চরিত্র।

লাট্টু উধাও হয়েছে গত শনিবার রাতে। পরপর তিনদিন পুলিশ হানা দিয়েও যখন কোনও হদিশ পায়নি, এতদিনে বোধহয় হাত গুটিয়েই নিয়েছে তারা। লাট্টুর মায়ের হাতে অস্পষ্ট রক্তমাখা ইস্টবেঙ্গল জার্সি, উঠোনের দরজা প্রায় ভেঙেই ঢুকল পুলিশ।

-তলে তলে এত?
-আমি জানি না স্যার। মাক্কালির দিব্যি স্যার, আমি কিছু জানতাম না–‘
-চোপ! অতই যখন জানিস না, তাহলে এই জার্সি কোত্থেকে এল? মা কালী উড়ে উড়ে দিয়ে গেল?
-আজ সকাল থেকেই কুকুরগুলো চেঁচাচ্ছিল। উঠে দেখি…
-অসাধারণ! পাছায় ডান্ডা পড়লে গাঁজাখুরি গল্প বেরিয়ে যাবে। এখনো সময় আছে, লাট্টুকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস বল। কাল রাতেই এসেছিল না?
-আমি কোথায় লুকোব স্যার? সাতদিন হয়ে গেল, ছেলের মুখ অব্দি দেখিনি।
-একরাতে দুটো মার্ডার। কীসের জন্ম দিয়েছিস তুই?

লাট্টুর মায়ের চোখের জলে টান পড়ছে, টান পড়েছে সংসারেও। তাকে শক্ত করে ধরে আছেন নিখিল। লাট্টুকে নিজের ছেলে হিসেবে পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি আজকাল মেরুদণ্ড খুঁজে পান না। মরে যায় না কেন সে?

পুলিশ তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে উঠোনে, লাট্টুর মায়ের সারামুখে কান্নার কষ, দরজায় এসে দাঁড়াল নিখিলের একজন সহকর্মী। আর্দ্র চোখ দুটোয় সূর্যমুখী ফুলের আলো।

-শুনেছেন সুশীল দত্ত খুন হয়েছে? আরও বড় খবর, আজই কারখানা খুলছে। সেক্রেটারি বলেছে নাকি আমাদের মাইনেও দেবে। ব্যাটা ভয় পেয়েছে নির্ঘাত!

কয়েক হাজার অসহায় কর্মচারীর সঙ্গে কী স্বার্থ জড়িয়ে আছে লাট্টুর! লাট্টু তো কেবল চেয়েছিল ইস্টবেঙ্গল লিগ জিতুক, বাইচুং হ্যাট্রিক করুক। বাবার মুখের দিকে চাইতে গেলে বুঝি রক্ত ঝরাতে হয়! এক অনির্বচনীয় পরিতৃপ্তির স্রোত নিখিলের মজ্জায় মজ্জায় বইতে শুরু করেছে। এক্ষুনি লাট্টুর মা’কে জাপ্টে ধরে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘লাট্টু আমাদের সব্বাইকে জিতিয়ে দিয়েছে, জানো!’

 

৮.

রবিবারের যুবভারতীতে ইস্টবেঙ্গল তিন গোলে হেরে গেল চার্চিল ব্রাদার্সের কাছে। ইউসুফ ইয়াকুবুর হ্যাট্রিক। বাইচুং ফ্লপ। পরের ম্যাচ মঙ্গলবার, প্রতিপক্ষ মহামেডান। শিয়ালদা স্টেশান সংলগ্ন বস্তিতে, লজঝড়ে রেডিওয় খেলার ফলাফল শুনে লাট্টুর অসাড় শরীর নর্দমার পাশে পড়ে গেল। ভিখিরি ভেবে লাট্টুর সামনে বাসি খিচুড়ি ছুড়ে দিয়ে ভেগে গেল একটা মোটরবাইক।

সোমবার থেকে লাট্টুর জ্বর এল। একবার ভাবল বাড়ি যাবে, একবার ভাবল কেষ্ট বণিকের মেসে। কিন্তু এতক্ষণে হয়তো লাট্টুর নামে হুলিয়া লেগেছে, স্টেশানে স্টেশানে তার ছবিওয়ালা পোস্টার সাঁটিয়েছে পুলিশের লোক। দাঁড়াতে না পারলে যে নর্দমা-আবর্জনার স্তূপ লাট্টুর জীবনরস শুষে নেবে। তখন ইস্টবেঙ্গলের হয়ে গলা ফাটাবে কে? কার গলায় অত জোর আছে?

বস্তির কয়েকজন মিলে লাট্টুকে তুলে নিয়ে গেল বস্তিরই গুমটিতে। চুলে তেল নেই, ফ্যাকাশে ঠোঁট, সূর্যপোড়া গাল, খুদে চোখ– প্রকৃতিই লাট্টুকে চেনার পর্যায়ে রাখেনি। সেই গুমটিতে লাট্টু ঘুমিয়ে থাকল সারাদিন। বিড়বিড় করল, ‘ইস্টবেঙ্গল জিতবে। জিততে হবে। আমি বেঁচে থাকতে ইস্টবেঙ্গল হারবে না।’ মিছিমিছি কপালে কিছু একটা ঠেকিয়ে সে আবার বলল, ‘হ্যাট্রিক। হ্যাট্রিক। হ্যাট্রিক…’ শেষটুকু জড়িয়ে জড়িয়ে হাওয়া। রাতের দিকে রুটি-তরকারি দিয়েছিল বস্তির লোকেরাই, সে মুখে তুলল না।

আরও একটা দিন। নতুন দিন। কাউকে না জানিয়ে বস্তির ঘর ছেড়ে লাট্টু পালিয়ে গেল। আবার। গুমটি ঘরের গামছাটা মুখে জড়িয়ে নিয়ে উঠে পড়ল ট্রেনে। ভারি অদ্ভুত এই অভিবাসন। দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে বেড়ায়, আজ এখানে, পরশু ওখানে… লাট্টুর নিস্পন্দ ঘুম কেড়ে নেয়।

শ্যামনগর স্টেশানে নেমে লাট্টু খেয়াল করল, আপাতত কেউ তাকে চিনতে পারেনি। এমনকি পটলাকাকা পর্যন্ত না। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ছে। সন্তর্পণে বাড়ি অবধি পৌঁছেছিল সে, তার গামছাঢাকা মুখ চিনতে পেরেছিল মা, ঠিক সেই মুহূর্তেই ঝাঁপিয়ে পড়ল পুলিশ। ছোটলোকের দল নজর রাখবেই লাট্টু জানত, তবু মাকে বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছিল যে!

পুলিশের নাগাল ফসকে লাট্টু দৌড়তে শুরু করল। দৌড়েছিল লাট্টুর মা, দরজায় আছড়ে পড়লেন আর ভুলে গেলেন দুর্গা নাকি কালী নাকি তেত্রিশ কোটির কোন দেবতাকে ডাকলে লাট্টু বেঁচে যাবে।

ছুটতে হবে, এখন শুধুই ছুটতে হবে। রাজেনদার কাছে ট্রেনিং করতে গিয়ে মনে পড়ে, দশপাক দৌড় করানোর পরেই আবার দশপাক। যে থেমে যাবে, রাজেনদা লাথি মেরে তাড়িয়ে দেবে তাকে। লাট্টু পেরেছিল, লাট্টু আজকেও পারবে। থেমে গেলে লাট্টু একা হেরে যাবে না, হেরে যাবে ইস্টবেঙ্গলও।

‘ডাউন রানাঘাট-শিয়ালদা লোকাল দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসছে… ক্রিপেয়া ধিয়ান দে…’

রেললাইনের সমান্তরালে লাট্টু দৌড়চ্ছে। তার অন্তরস্টেশানেও একটা আলোময় ট্রেন এক্ষুনি ঢুকবে– অ্যানাউন্স হয়ে গেছে। আর মিনিটখানেক দৌড়লেই শ্যামনগর স্টেশান। নিজেকে বাঁচিয়ে খেলছিস কেন শালা, উজাড় করে দে সবটুকু– রাজেনদা চিৎকার করছে। পেছনে পুলিশ, সামনে ট্রেন, ইস্টবেঙ্গল, এবং গোওওওওওল! মধ্যবর্তী ঘুর্ণিপাকে লাট্টু ছুটছে, পৃথিবীর গায়ে আঁচড় কাটছে, জার্সি উড়িয়ে মোহনবাগান গ্যালারির সামনে দাঁড়িয়ে উদগ্র উষ্ণ শরীরে বলছে, ‘আয় আয় আয়! কে খেলবি মাঠে নেমে আয়…’

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...