কৃষক আন্দোলন: শ্রমিকশ্রেণির নিছক সংহতি?

সৌম্যজিৎ রজক

 



রাজনৈতিক কর্মী

 

 

 

বেচারা রাষ্ট্র পড়েছে ফাঁপড়ে।

রাষ্ট্র যাকে দিতে চায় না, সে সারাক্ষণ ‘আজাদি আজাদি’ চিল্লায়! অথচ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যাকে মুক্তি দিতে ছাইছে, সে রাজি নয় নিতে!

কৃষকদের আজাদি দেওয়ার জন্যই নতুন আইনগুলোর অবতারণা, সরকারের দাবি এমনটাই। কৃষকরা বলছে, এক্ষুণি ফিরিয়ে নাও তিনটে আইনই। চাই না এমন উপহার আমাদের, রেহাই দাও!

দেহাতি চাষির দল; বোকা-হাবা, গোমুখ্যু যত! মুফ্‌তে দিচ্ছে রাষ্ট্র তবু ওরা চায় না আজাদি। মুক্তি, ছুটকারা!

রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে ইতিপূর্বে মুক্তি মিলেছে পেট্রল-ডিজেলের। খোলাবাজারেই ঠিক হয় তেলের দাম। সুইগির ডেলিভারি বয় সুজিত রোজ সকালে যায় পাম্পে। যেদিন ওরা যে মূল্য ঠিক করে রাখে, তাতেই ভরাতে হয় ট্যাঙ্ক। দরাদরির সুযোগ থাকে না সুজিতের। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরেই আছে বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিং হোমগুলোও। ওরা যা বিল হাঁকবে, বিনা বাক্যব্যয়ে তৎক্ষণাৎ তত টাকাই দিতে হবে আপনায়। না পারলে রিপোর্ট আঁটকে দেবে, অপরেশন টেবিলে ফেলে রেখে অপরেশন শুরু করবে না রোগীর। ঢের অভিজ্ঞতা হয়েছে আমাদের। কোভিডের দিনকালে দশ দিনে দশ লাখ; দরাদরির সুযোগ পেয়েছেন কেউ?

খোলাবাজারে ‘আজাদি’ মানে দাম নির্ধারণে পুঁজির মালিকের একচেটিয়া আজাদি। এটা সহজ সত্য।

এমন নয় যে এ আইনের আগে খোলা বাজারে ফসল বিকিকিনি হত না! কিন্তু এবার থেকে ফসল বেচতে খোলাবাজার ছাড়া আর কোনও অপশনই থাকবে না কৃষকের সামনে। শুকিয়ে যাবে সরকার নিয়ন্ত্রিত বাজারকাঠামো। তাহলে এটা কি আদৌ আজাদি হল? নাকি, যেটুকু যা বিকল্প সুযোগ ছিল তাও কেড়ে নেওয়ারই ফন্দিফিকির?

এখন যদি মাঠের ফসল নির্বিকল্প খোলা বাজারেই বিক্কিরি হয় আর সে ফসলের দাম নিয়ন্ত্রণে যদি না থাকে রাষ্ট্রের ন্যূনতম কোনও নিয়ন্ত্রণ (এমনকি নজরদারিও) তাহলে আপনিই বলুন, আজাদি কে পাবে আদতে? ধারদেনা করে ফসল ফলানো চাষি নাকি রাঘববোয়াল ব্যবসায়ী?

প্রাইভেট প্লেয়ারকে প্রথম আইনে রাষ্ট্রের উপহার প্রথম আজাদি। যে দামে খুশি চাষার ফসল কেনার। দ্বিতীয় আইনে দ্বিতীয় আজাদি, যত খুশি কিনে নেওয়ার। ‘যত খুশি কেনার সুযোগ’ মানে যার পুঁজি যত বেশি তার তত বেশি সুযোগ। অর্থাৎ সমস্ত প্রাইভেট প্লেয়ারের সমান আজাদি রইল না আর! বৃহৎ পুঁজির মালিক, বড় বড় কর্পোরেশন— তাদের হাতেই একচেটে আজাদি সমস্ত ফসল কিনে নেওয়ার।

এখন বাজার খোলা। মুক্ত, অবাধ। কৃষক আর কর্পোরেট মুখোমুখি। মাঝে কেউ নেই। রাষ্ট্রও গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। আদালতও ছিটিকিনি তুলেছে কপাটে। তৃতীয় আইনে তৃতীয় আজাদি কর্পোরেটকে। কোর্টকাছারি মামলা-মোকদ্দমার ঝুটঝামেলা থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি। কৃষক-কোম্পানির যেকোনও বিবাদের মীমাংসা চেয়ে আদালতে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ চিরতরে। এবার জমবে খেলা দুনিয়া-ঘোরা লগ্নিপুঁজির।

জুন মাসে তিনটে অর্ডিনান্স। সেপ্টেম্বরে গুণ্ডাগর্দির পার্লামেন্টে তিনটে বিল। রাষ্ট্রপতির সই পেয়ে এখন তিনটে আইন। এক, দুই, তিন— কিন্তু প্যাকেজ একটাই।

আইনগুলোকে আলাদা আলাদা করে দেখার অবকাশ নেই। যেমন বিচ্ছিন্নভাবে দেখার অবকাশ নেই ‘বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিল ২০২০’কেও। চারের বিরুদ্ধে একযোগে লড়াই। কৃষিজীবী মানুষের। গোটা দেশজুড়ে।

কিন্তু কেবল কি এই চারের বিরুদ্ধেই? প্যাকেজ কি এই চারেরই কেবল?

তিনটে কৃষি আইন, একটা বিদ্যুৎ বিলকে আলাদা আলাদা করে দেখার যেমন সুযোগ নেই তেমনই বিচ্ছিন্নভাবে দেখা সম্ভব নয় চারটে শ্রম কোডকেও।

প্রথমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ও পরে বৃহৎ বুর্জোয়া পরিচালিত বুর্জোয়-জমিদার ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশের শ্রমিকশ্রেণি যে সকল শ্রম আইনের সামান্য রক্ষাকবচটুকু অর্জন করেছিলেন, সেই সব কেড়ে নেওয়া হল। বানানো হল চারটে শ্রম কোড। ২০১৯ সালে ‘মজুরি সংক্রান্ত কোড’ এবং ২০২০ সালে ‘শিল্প সম্পর্ক কোড’, ‘সামাজিক সুরক্ষা সংক্রান্ত কোড’ ও ‘পেশাগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও কাজের শর্ত সংক্রান্ত কোড’।

তিনটি কৃষি আইনের মতো এই চারটে শ্রম কোডও পুঁজির মালিককে দেবে একগুচ্ছ আজাদি।

প্রথম দানেই ন্যূনতম মজুরি দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে ছুটকারা পাবে মালিকপক্ষ। কেননা এবার থেকে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করেই সরকার খালাস। মালিক তা আদৌ মানছে কিনা, তার চেয়ে কম মাইনেতে শ্রমিক কর্মচারীদের কাজ করতে বাধ্য করছে কিনা, সেসব ব্যাপারে মাথাই ঘামাবে না রাষ্ট্র। মালিক ন্যূনতম মজুরির কম মাইনে দিলে শ্রমিকরা কার কাছে বিচার চাইবেন? কে বিচার করবেন? আইনভঙ্গকারী মালিকের বিরুদ্ধে কে ব্যবস্থা নেবেন? কিচ্ছুটি বলা নেই ‘ন্যূনতম মজুরি কোড’-এ। অর্থাৎ এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, যে যা খুশি করবে। ঠিক যেমনটা হবে চাষির ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের বেলাতেও।

ঘন্টার হিসেবে মজুরি নির্ধারণ এবং শ্রমিকদের সেইমতো মজুরি দেওয়ার আজাদি পাবে মালিকেরা। অর্থাৎ মালিকপক্ষ চাইলে একজন শ্রমিককে দিয়ে সারা দিনের বদলে, ধরুন, ২ ঘন্টা বা ৪ ঘন্টা কাজ করাতে পারবেন এবং শ্রমিককে সেই ২ বা ৪ ঘন্টার মজুরিটুকুই দেবেন।

‘শিল্প সম্পর্ক কোডে’-এ মালিককে আজাদি দেওয়া হচ্ছে ‘নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক কর্মী নিয়োগ’-এর। চুক্তির ভিত্তিতে কাউকে ৬ মাস, কাউকে ১ বছরের জন্য নিয়োগ করবে মালিক। এই স্বাধীনতা পেলে কে আর ‘ফালতু’ খরচ বাড়িয়ে স্থায়ী কর্মী নিয়োগ করতে যাবে নিজের কারখানায়? স্থায়ী কাজ উঠে যাবে, সব কাজই হবে নির্দিষ্ট সময়ের চুক্তিভিত্তিক। চুক্তি-চাষের আইনে যেমন বাধা-গোলামে পরিণত হবেন কৃষক, এক্ষেত্রে শ্রমিকরা হয়ে পড়বেন তেমনই ক্রীতদাস।

ক্লোজার হলে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায় থেকে ছুটকারা পেতে চলেছে মালিকেরা শ্রম কোডের বদান্যতায়। এটা আরেকটা।

চালু আইনে ট্রাইব্যুনালের রায়কে মালিক মান্যতা না দিলে শ্রমিকদের অধিকার ছিল ক্রিমিনাল কোর্টে যাওয়ার। শ্রম কোড কোর্ট-কাছারির ঝুট-ঝামেলা থেকে মালিককে মুক্তি দিয়েছে। শ্রম কোডে জুডিশিয়াল ক্ষমতা কমিয়ে বাড়ানো হয়েছে এক্সিকিউটিভ ক্ষমতা। যেমন এসডিও-দেরকেই বিচারক বানিয়ে দিয়েছে কৃষির ক্ষেত্রে।

শ্রম কোড মালিকদের লে-অফ, ছাঁটাই, ক্লোজার করার আগে সরকারের অনুমতি নেওয়ার দায় থেকে আজাদি দিয়েছে। ৩০০ জনের কম শ্রমিক কাজ করেন এমন শিল্পসংস্থার মালিকদের জন্য এই আজাদি। হিসেব বলছে, দেশের ৭৪ শতাংশ কারখানার মালিকই এই স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারবে।

শ্রমিকদের চূড়ান্ত হাতিয়ার ধর্মঘট করার অধিকারকেও সঙ্কুচিত করা হয়েছে। এও এক মস্ত আজাদি বটে মালিকের, নিঃসন্দেহেই!

চতুর্থ কোডে শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা, কর্মস্থলের নিরাপত্তা ইত্যাদি হাজার হ্যাপা থেকেও কার্যত মুক্তি দেওয়া হয়েছে মালিকপক্ষকে। এইসব ঠিকঠাক আইন মেনে হচ্ছে কিনা তা দেখভালের, না মানা হলে ব্যবস্থা নেওয়ার কেউ থাকবে না। মালিকেরা পাবে শোষণের খোলা মাঠ। খুল্লামখুল্লা লুটের মওকা।

চারটি শ্রম কোডে এইরকম আরও নানাবিধ আজাদি পাবে কর্পোরেশন, বৃহৎ পুঁজির মালিক, অতি ধনীরা। কৃষি আইনগুলোর মতোই।

কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের এই আন্দোলনের প্রতি দেশের ঐক্যবদ্ধ শ্রমিকশ্রেণির সমর্থনের নজির মিলছে প্রতিদিন। ২৬শে নভেম্বর কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও শিল্পভিত্তিক ফেডারেশনগুলির ডাকা সর্বভারতীয় ধর্মঘটের সাত দফা দাবির অন্যতমই ছিল, কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবি। ৮ই ডিসেম্বর কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের ডাকা ভারত বনধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হরতাল সফল করেছেন মজুরেরা। কেবল হরতাল-ধর্মঘটগুলোই নয়, প্রতিদিন দেশের প্রতিটি প্রান্তে শ্রমিকরা সোচ্চারে সংহতিজ্ঞাপন করছেন কৃষকদের প্রতি। কৃষকসমাজের লড়াইতে পাশে থাকা শ্রমিকশ্রেণির শ্রেণিগত রাজনৈতিক দায় ঐতিহাসিকভাবেই।

কিন্তু কৃষিজীবীর বাঁচার লড়াইতে এটা নেহাত সংহতিরই কাহিনি নয়, তারও বেশি কিছু। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষে ভারতবর্ষ প্রত্যক্ষ করছে এক দুর্দান্ত ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ।

কৃষি আইন, শ্রম কোড, বিদ্যুৎ বিল, তাবৎ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে লড়াই। সার্বজনীন খাদ্যনিরাপত্তা, আয়করের আওতার বাইরে থাকা পরিবার পিছু নগদ-রেশন, বেকারদের কর্মসংস্থান, গ্রাম-শহরে বছরে ন্যূনতম ২০০ দিনের কাজের গ্যারান্টি সহ একগুচ্ছ ইতিবাচক দাবির লড়াই। টুকরো টুকরো নয়, একাকার। বৃহৎ বুর্জোয়ার স্বার্থবাহী একটি অভিন্ন প্যাকেজের বিরুদ্ধে অভিন্ন সংগ্রাম।

এ নিছক সংহতিই নয়, সংগ্রামী একাত্মতা।

শ্রমিক-কৃষক-কৃষিশ্রমিকের সংগ্রামী একাত্মতা দীর্ঘজীবী হোক!

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...