এক মাস পেরোল কৃষক আন্দোলন, সিংঘুতে সড়কবাস জারি অন্নদাতাদের

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

পিৎজা লঙ্গর, কয়েকশো দেশি গিজার, ঝলমলে তাঁবু, ট্রাক্টর, লন্ড্রি সার্ভিস, বড় বড় সোলার প্যানেল, বিশালকায় রুটি তৈরির মেশিন, ম্যাসাজ চেয়ার, একটা লাইব্রেরি কাম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, একটা ট্যাটু স্টল…

পাঠক, সিংঘু সীমান্তে আপনাকে স্বাগত। আজ একটা নগর পত্তনের গল্প শোনাই।

এটা একটা রাজপথের অংশ। ১৫ কিলোমিটার জায়গা। কিছু মানুষ সেখানে বসবাস শুরু করেছেন আজ পুরো এক মাস পূর্ণ হচ্ছে। তা তাঁদের বসবাস করার পরিকল্পনা বেশ কিছুদিন ধরে। চাইছেন বসবাস করতে এমনটা নয়। সবারই বাড়িঘর আছে, আর আছে ক্ষেতি। সেই ক্ষেতি সেই মাটির যে কী টান এ আমি আপনি বুঝতে পারব না। কৃষকই বোঝেন সে টান। যাই হোক, আপাতত সেই টান উপেক্ষা করে, তাঁরা এসেছেন এখানে থাকতে। আসলে উপেক্ষাও নয়। সেই ক্ষেতির টানেই, মাটিকে বাঁচাবার টানেই আজ তাঁদের এই সড়কবাস।

এখানে আরও একটা কথা স্পষ্ট করে দেওয়া যাক। এই যে তাঁরা হরিয়ানা-দিল্লি সীমান্তে সড়কবাস করছেন, তার বৃহত্তর বাধ্যতা তো তাঁদের আন্দোলন, তার সঙ্গে তাৎক্ষণিক বাধ্যতাও রয়েছে। তাঁরা এখানে থাকতে আসেননি বাড়িঘর ছেড়ে। তাঁরা দিল্লি যাচ্ছিলেন। পুলিশ তাঁদের যেতে দিতে নারাজ। অতএব, আবারও বলি, কৃষকরা নিতান্ত উপায়ান্তর না পেয়েই এখানে রয়েছেন বসে এই ঠান্ডায় এক মাস ধরে।

যাই হোক, এসব আমরা জানি। ভূমিকা বাড়িয়ে লাভ নেই।

কিন্তু তাঁরা এমনি এমনি বসে থাকবেন না। তাঁরা ভিখারি নন। তাঁদের নির্দিষ্ট দাবি আছে। সেই দাবি পূরণের লক্ষ্যেই তাঁদের আসা। এবং তাঁরা দেখিয়ে দিয়েছেন তাঁরা এক কথার মানুষ। সরকার যতবারই ধানাইপানাই করতে চেয়েছে তাঁরা মুখেও বলেননি, প্ল্যাকার্ড তুলে ধরেছেন হাতে— ‘ইয়েস’ অর ‘নো’? হ্যাঁ না না? নতুন যেসব কর্পোরেট-তোষামোদি কৃষি আইন এনেছ, ওগুলো প্রত্যাহার করে নিচ্ছ, না নিচ্ছ না? যদি নাও, খুব ভালো, বসো, দুটো রুটি খাও আমাদের সঙ্গে, পিৎজা চাইলে তাই খাও, ভাঙরা নাচো, তারপর যাও তোমার ডেরায়, আমরাও তল্পিতল্পা গুটিয়ে আমাদের ক্ষেতিবাড়ি সামলাই গিয়ে। আর যদি বলো নিচ্ছ না, তাহলেও ভালো। আমরা থাকব এখানে। থাকার সব ব্যবস্থা করে নেব নিজেরাই।

সেই ব্যবস্থাগুলির কথাই বললাম শুরুতে। আসুন ধরে ধরে নেড়েচেড়ে দেখি জিনিসগুলি।

 

একটা ফাঁপা চোঙের মতো কাঠামো, মাঝে একটা গর্ত করা যার মধ্যে কাঠ পোড়ানোর ব্যবস্থা। একপাশে একটা ফানেলের মতো পাইপ দিয়ে জল ঢালা হলে আরেকপাশের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে গরম জল। এই হল গিজার। সম্পূর্ণ দেশি পদ্ধতিতে জনগণের উদ্ভাবিত ব্যবস্থা। পাঞ্জাবের গ্রামাঞ্চলে ঘরে ঘরে এরকম গিজার দেখতে পাওয়া যায়। দিল্লিতে এইসময় ঠান্ডা তো কম পড়েনি! আর হ্যাঁ, এখানে প্রতিদিন যত জঞ্জাল হচ্ছে তারই একটা অংশ এই গিজারগুলির জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেটাও খুব একটা মামুলি ব্যাপার নয়।

দিল্লির একটি শিখ সঙ্গত (শিখদের সংগঠন) এখানকার সমস্ত লঙ্গরে এটি গিজার লাগিয়ে দিয়েছে। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। সবার ব্যবহারের জন্য।

প্রথম প্রথম জামাকাপড় ধোওয়া হচ্ছিল পেট্রোল পাম্পে বা রাস্তার ধারের কলে। কিন্তু একদিকে ঠান্ডা বাড়ছে, অন্যদিকে লোকও বাড়ছে প্রতিদিনই। ফলে সমস্যাও বাড়তে লাগল। প্রিন্স সাধু নিজের লুধিয়ানার বাড়ি থেকে আসার সময় দুটো ওয়াশিং মেশিন নিয়ে চলে এলেন। তার দেখাদেখি জুটে গেল আরও কয়েকটা। আর এগুলো দিয়ে এখন পুরোদস্তুর লন্ড্রি সার্ভিস চালু হয়ে গেছে সিংঘু বর্ডারের এই রূপকথানগরীতে।

দিল্লি পুলিশ আটকেছিল হরিয়ানা-দিল্লি সীমান্তে। হরিয়ানা সরকার সেখানকার ইলেকট্রিসিটি বন্ধ করে দিয়েছিল। কিসের তোয়াক্কা? ট্রাক্টর-ট্রলিতে বসে গেছে কয়েকশো সোলার প্যানেল। বিদ্যুৎ সেখানেই তৈরি হচ্ছে। বিদ্যুৎ প্রয়োজন। সাউন্ড সিস্টেম চালাতে হয়— মিটিং হচ্ছে, নাচগান হচ্ছে, রাতে আলো জ্বালাতে হয়, আর মোবাইল চার্জ দিতে হয়। সরকার সূর্য বন্ধ করতে পারছে না। কৃষকরাও পরিষ্কার বলে দিচ্ছেন সরকারের ওপর তাঁরা মোটেও নির্ভরশীল নন। তাঁরা এসেছেন থাকবেন বলে যতদিন না দাবি মানছে সরকার। এবং সেই থাকবেনও নিজেদের দমে।

অতিকায় রুটি বানানোর মেশিন বসানো হয়েছে লঙ্গরে। দিল্লি শিখ গুরদোয়ারা ম্যানেজমেন্ট কমিটির তত্ত্বাবধানে। আটা মেখে দিয়ে দিলেই মেশিন থেকে বেরিয়ে আসছে হাতেগরম রুটি। কটা? একেকবারে ২০০০। সকাল ৭টা থেকে বেলা ১২টা অব্দি চলছে মেশিন। খাওয়ার তৈরি হচ্ছে ৫০০০ লোকের!

এবার সনঝি সাথ-এর কথা বলি। সনঝি সাথ-এর অর্থ ভাগ করা চৌপল। চৌপল-এর অর্থ দেখা করার আড্ডা মারার জায়গা। সেই সনঝি সাথ বানানো হয়েছে এই নগরে। আছে একটা লাইব্রেরি। তাতে বইপত্র, পত্রপত্রিকা থাকছে। কিছুই বিক্রি করার জন্য নয়। এমনকি বিতরণের জন্যও নয়। এখানে এসো, পড়াশোনা করো, দেশের পরিস্থিতি, বর্তমান আন্দোলনের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানো, আলোচবা-তর্কবিতর্কে অংশ নাও। এই হচ্ছে চিন্তাভাবনা এবং কর্মপদ্ধতি। লাইব্রেরিতে রাখবার জন্য ভাতিন্দার শিল্পী গুরপ্রীত সিং তাঁর আঁকা ছবি দিয়েছেন। সেই প্রদর্শনীও চলছে পাশাপাশি।

বেলা ১১টা থেকে ২টো পর্যন্ত সনঝি সাথ পরিণত হচ্ছে স্কুল-এ। পড়ানো হচ্ছে স্থানীয় বস্তির বাচ্চাদের। এখানে অবস্থান করা কৃষক পরিবারের যুবক-যুবতীরা তাদের পড়াচ্ছেন, ছবি আঁকা-গান এসবও করাচ্ছেন।

সেইসমস্ত বস্তির মানুষদের স্যানিটাইজেশন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি নিয়ে বোঝানো হচ্ছে, জিনিসপত্রও দেওয়া হচ্ছে প্রয়োজন এবং সাধ্যমতো। কৃষকরা বলছেন, “আমরা তো ডোনেশন পাচ্ছি। ফলে এই মানুষগুলোর জন্য কিছু করা তো আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।”

লুধিয়ানার কয়েকজন ট্যাটুশিল্পী ট্যাটু পার্লার বসিয়েছেন। কৃষকদের ট্যাটু করে দিচ্ছেন তাঁরা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। কৃষকরাও লিখিয়ে নিচ্ছেন “নিশ্চয় কর আপনি জিত করো”, “কর হর ময়দান ফতেহ”।

আর আছে ওপেন-এয়ার জিম। হরিয়ানার অনেক কুস্তিগির এসেছেন। তাঁরা সবাই কৃষক পরিবারের সন্তান। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন তাঁদের শরীরচর্চার যাবতীয় উপকরণ। সেসব নিয়ে চলছে রোজ সকাল বিকেল শরীরচর্চা। পহেলবানরা ছাড়া অন্যরাও যোগ দিচ্ছেন শরীরচর্চায়।

যদি দু-একটা বীজ ভিজে ওঠে’-তে দিল্লি থেকে ঘুরে এসে প্রত্যক্ষদর্শীরা আমাদের জানিয়েছেন, প্রতিবাদস্থলের তো এরকম মেলা হয়ে ওঠারই কথা ছিল, গণতন্ত্রে প্রতিবাদ তো জনগণের উৎসবই বটে, আজ রাজধানীতে যেন সে নিজের সেই প্রত্যক্ষ রূপেই বিদ্যমান হয়েছে।

মেলাও নয়, আধুনিক সুযোগসুবিধাসম্পন্ন এ এক আস্ত নগর। চোখের সামনে ইতিহাস রূপকথা সমস্তটাই গড়ে উঠতে দেখছি আমরা।

 

শেষে একটা দিয়ে রাখি। মহারাষ্ট্র থেকে প্রায় ৭০০ কৃষক রওনা হয়েছেন দিল্লি-রাজস্থান সীমান্তের বিক্ষোভস্থলে যোগ দিতে। আরও বাড়বে নগর। নগরে বাড়বে লোক।


তথ্যসূত্র: নিউজক্লিক, এনডিটিভি, এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনাল

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4858 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...