কাস্তেটা শান দাও ভাই রে

রৌহিন ব্যানার্জি

 



প্রবন্ধকার, রাজনৈতিক ভাষ্যকার

 

 

 

 

এক মাস হয়ে গেল, রাজধানী উত্তাল। কেন্দ্রীয় কৃষি বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত কৃষকেরা। যাঁরা দিল্লিতে আন্দোলন করছেন তাঁরা মূলত পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার সম্পন্ন কৃষক, কিন্তু এই আন্দোলনের সমর্থন এসেছে ভারতের প্রায় সব প্রান্ত থেকে এবং সম্পন্ন থেকে মাঝারি এবং প্রান্তিক— প্রায় সমস্ত কৃষক সমাজ এবং তার বাইরে অন্যান্যদের কাছ থেকেও। নিঃসন্দেহে সাম্প্রতিক অতীতে এই মাত্রায়, এই তীব্রতার কোনও আন্দোলন ভারত রাষ্ট্র প্রত্যক্ষ করেনি। এমনকি যারা তথাকথিত “অরাজনৈতিক” থাকার ভান করে থাকেন, তাঁরাও অস্বীকার করতে পারছেন না যে দিল্লিতে কিছু একটা চলছে। এক মাস যাবৎ বিভিন্ন রাস্তা অবরুদ্ধ, সরকারপক্ষ মরিয়া হয়ে কিছু একটা সমাধানসূত্র খুঁজছেন। আন্দোলনকারীরা শত হুমকি, মিথ্যা প্রচার, প্রলোভনের মুখে দাঁড়িয়ে এখনও অবধি নিজেদের মূল অবস্থানে অনড় আছেন। ফলাফল যাই হোক, ভাজপা সরকার যে গত ছয় বছরের কঠিনতম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে একথা বলাই যায়।

কৃষক আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে অনেক লেখাই লেখা হয়েছে, আমাদের বাংলাতেও এ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে, হচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণও আপনারা এই পত্রিকার পাতাতেই পড়েছেন। আসুন আমরা যা যা জেনেছি, সেখান থেকে মূল পয়েন্টগুলো আরেকটু ঝালিয়ে নিই। প্রথমত, আমরা জেনেছি, এই আন্দোলনের মূল দাবী, কেন্দ্রীয় কৃষি আইন ২০২০ বাতিল করতে হবে। হ্যাঁ, বাতিলই করতে হবে, কোনও ছোটখাট অ্যামেন্ডমেন্ট সহ সংশোধিত অবস্থাতেও এই আইন মানতে কৃষকেরা নারাজ। দ্বিতীয়ত সরকার বলছেন, এই আইন কৃষকদের স্বার্থরক্ষার্থেই করা, কৃষকেরা তা মানতে নারাজ। তাঁরা এই আইনের সরকারি ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন। সরকারপক্ষ এখনও তাঁদের অবস্থান থেকে সরে আসার লক্ষণ দেখাননি। তৃতীয়ত কৃষকেরা জানেন, লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হবে, তাঁরা প্রস্তুত হয়ে এসেছেন। সরকারি খাবার প্রত্যাখ্যান করেছেন, নিজেরা প্রায় ছয় মাসের মত রসদ এনেছেন, লঙ্গরখানা চালাচ্ছেন, সেখানে আন্দোলনকারীরা তো বটেই, অন্য যে কোনও ক্ষুধার্ত মানুষও খেতে পারছেন।

আরও অনেক খুঁটিনাটি বৈশিষ্ট্য তো আছেই, কিন্তু উপরের বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ করলেই বোঝা যায় এই আন্দোলন একটু বিশেষ। হ্যাঁ, গরীব চাষিরা হলে হয়তো এতটা প্রস্তুতি নিয়ে আসতে পারতেন না, কিন্তু তাঁরাও যে তাঁদের মত করে প্রস্তুত হতে পারেন, তা আমরা দেখেছি এর আগে মহারাষ্ট্রে। সেই আন্দোলনকে এবারের আন্দোলনের পূর্বসূরি বলা যেতেই পারে। সেবারে ওঁরা লং মার্চ করেছিলেন, ক্ষতবিক্ষত পা নিয়ে হেঁটেছিলেন, মুম্বাই শহর অকেজো করে দিয়েও পরীক্ষার্থীদের কথা ভেবে মিছিলের সময় বদল করে বুঝিয়েছিলেন, তাঁরা বিচক্ষণতার প্রশ্নেও আমাদের পিতৃস্থানীয়। এবারের আন্দোলনে এখন পর্যন্ত সেই বিচক্ষণতার বেশ কিছু প্রমাণ আমরা পেয়েছি, যা ভরসা জোগায়।

এই আন্দোলনের শুরুর দিকে যেটা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান ছিলেন, সেটা হল আন্দোলনকারীদের শ্রেণিচরিত্র। আমরা ঠিক “চাষা” বলতে যেরকম একটা ভদ্রবৃত্তীয় ধারণা পোষণ করি, এই পাঞ্জাব, হরিয়ানার সম্পন্ন কৃষকেরা তার অ্যান্টিথিসিস বললেও সবটা বলা হবে না। এঁরা প্রান্তিক এবং “গাঁইয়া” নন, গরীব তো ননই। উত্তর-পশ্চিম ভারতের সবুজ বিপ্লবের ফসল তোলা কৃষকদের এই বংশধরেরা নিজেরাই ছোটখাটো কর্পোরেট। ফলে আন্দোলনের পুরোভাগে এঁদের দেখে প্রথমেই অনেকেই ভেবেছিলাম (আমিও তাদের মধ্যেই পড়ি) এঁদের হাতে গরীব কৃষকের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে তো? এঁরা কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে শেষমেশ শুধু ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) নিশ্চিত করতেই ব্যবহার করবেন না তো? আন্দোলন শেষ পর্যন্ত কর্পোরেট লেনদেনের প্রেক্ষাপট হয়ে দাঁড়াবে না তো? সত্যি বলতে কি, তীব্র আশঙ্কা ছিল যে এগুলি সবই হবে। এবং কার্যত, অন্তত এখন অবধি এগুলি ঘটেনি। কৃষকেরা কৃষকদের জন্যই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। সব কৃষকের জন্যই।

আরও একটা কারণে এই আন্দোলন অপরিসীম গুরুত্ব দাবী করে— সেটা হল সময়। এক বছর আগে এই সময়ে আর একটা আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছিল— এনআরসি, সিএএ-বিরোধী আন্দোলন। দিল্লিরই শাহিনবাগে চলছিল লাগাতার ধরনা, জমায়েত, সেই আন্দোলনের রেশ আমরা এই কলকাতাতেও দেখেছি পার্ক সার্কাসের জমায়েতে। সেবারও আন্দোলনকারীরা কঠিন চরিত্র দেখিয়েছিলেন এবং সরকারপক্ষ ক্রমশ মরিয়া হচ্ছিলেন। দিল্লিতে পরিকল্পিত দাঙ্গা বাঁধানো হয়েছিল সরকারি মদতে, আন্দোলনকে কমজোরি করার জন্য, কিন্তু আন্দোলন চলছিল। কিন্তু তারপরেই এল বিশ্বজোড়া অতিমারি— যা প্রাথমিকভাবে সকলের কাছেই অভূতপূর্ব ছিল। কিন্তু এই অতিমারিই শেষ অবধি সরকারের রক্ষক হিসাবে দেখা দিল। শাহিনবাগ, পার্ক সার্কাস সহ সর্বত্র আন্দোলনকারীরা কার্যত বাধ্য হলেন সাময়িকভাবে আন্দোলন স্থগিত রাখতে। মানুষকে ঘরে ঢুকতে বাধ্য করার ছুতো চলে এল সরকারের হাতে।

এরপর যত দিন গেছে, আমরা দেখেছি এই ছুতো ক্রমশ সরকারের রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লকডাউনের কারণে সব সমাবেশ, জমায়েত নিষিদ্ধ থাকার সুযোগে, বন্ধ সংসদে অর্ডিনান্স পাশ করিয়ে একের পর এক জনবিরোধী, পরিবেশবিরোধী সিদ্ধান্ত সরকার পাশ করিয়ে নিয়েছেন এবং প্রয়োগও করেছেন, বিনা প্রতিবাদে, বিনা প্রতিরোধে। লক্ষ লক্ষ একর জঙ্গল চলে গেছে কর্পোরেট লুটেরাদের হাতে, ধ্বংস হয়েছে পরিবেশ, স্থানীয় জীবিকা। পরিযায়ী শ্রমিকেরা কাজ হারিয়ে বাড়ি ফিরেছেন পায়ে হেঁটে, হাঁটতে হাঁটতে প্রাণ দিয়েছেন। এরকম একটা অন্ধকার সময়ে প্রয়োজন ছিল একটা আলোকশিখার। এই কৃষি আন্দোলন একটা মশালের মত জ্বলে উঠেছে, জ্বালিয়ে দিয়েছে আরও হাজার মশাল।

শেষ অবধি এই আন্দোলন সফল হবে কি না আমরা জানি না। তবে আন্দোলনের সাফল্য তো শুধু সাদা কালোয় বিচার্য নয়। তার দাবী অনুযায়ী কৃষি আইন প্রত্যাহৃত যদি না ও হয়, এই বিল কেন ভয়ঙ্কর, কীভাবে সরকার আমাদের একরকম বুঝিয়ে অন্যরকম উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টায় আছেন, এই প্রসঙ্গগুলি উঠে আসা এই আন্দোলনের অন্যতম সাফল্য। গত ছয় বছরের অধিকাংশ সময় (এনআরসি আন্দোলন বাদে) আমাদের প্রতিবাদ প্রতিরোধের কেন্দ্রে থেকেছে শাসকদলের অ্যাজেন্ডা, তাদের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া। এই প্রথম, আন্দোলন হচ্ছে আমাদের অ্যাজেন্ডা অনুযায়ী, সরকারপক্ষ এবং দক্ষিণপন্থী রাজনীতি প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে মাত্র। দিতে বাধ্য হচ্ছে বলা যায়। এবং তার চেয়েও বড় কথা, সম্পন্ন হলেও, কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন কৃষকেরা নিজেরাই— লড়াইটা হচ্ছে রুটিরুজির প্রশ্নে, বাজারের প্রশ্নে, ধর্মীয় অ্যাজেন্ডায় নয়, জাতপাতের অ্যাজেন্ডায় নয়, তথাকথিত “সংস্কারের” অ্যাজেন্ডায় নয়। পাপি পেট কা সওয়াল-এর কোনও উপযুক্ত জবাব সরকারের কাছে এখনও পর্যন্ত নেই। ভারত জাগছে। ভারতের চাষি নেতৃত্ব দিচ্ছে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...