অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রযুক্তিবিদ্যার ছাত্র, গবেষক
বালকবেলায় রেলে চেপে যখন দূরদূরান্তে বেড়াতে যেতাম, একটা প্রশ্ন বারেবারেই আমাকে তাড়া করে ফিরত। মা বাবাকে জিজ্ঞেস করতাম কখনও কখনও। উত্তর পেতাম। মনটা ভরে উঠত এক আশ্চর্য বিস্ময়ের অনুভূতিতে। রেলে চেপে যেতে যেতে দেখতাম, দিগন্ত ছাড়িয়ে দিগন্তে প্রসারিত মাঠ, ক্ষেত, শস্যের ফলন। এক অদ্ভুত বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম, আর ভাবতাম কতজন— কত মানুষের অবর্ণনীয় পরিশ্রমে এই ফসলের উৎপত্তি। হয়ত বা খুব গদগদে শোনাল, কিন্তু এই অনুভূতি আমার কাছে সত্য। এই অনুভূতিকে আমি অনুভব করেছি বহুবছর। এখনও রেলে চেপে কোথাও গেলেই এই অনুভূতিকে আমি উপলব্ধি করি। কলেজ পাশ করে এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে একদিন এক সকালে বন্ধুটি বলল “চল, তোকে ধানকল দেখিয়ে নিয়ে আসি।” সেই আমার প্রথম ধান থেকে চাল হওয়া দেখা। বিশাল একটি ঘরে সেইরকমই প্রকাণ্ড একটা মেশিনে ধান-ভাঙা চলছে। একমুঠো চাল আমার হাতে দিয়ে গেল কেউ। তখনও গরম, তপ্ত— সেই উষ্ণতা, সদ্য মেশিন থেকে বের হয়ে আসা উত্তাপ। আমরা কেবল এই অনুভূতিগুলোকেই মনে রাখি। আর, এই ‘শহুরে’ অনভূতিগুলোই বোধহয় আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয়— মাঠ আর শহরের মধ্যেকার দুস্তর ব্যবধানের কথা। যে ব্যবধান কেবল বেড়েই চলেছে। ফেরবার উপায় নেই।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের নিয়ন্ত্রণে থাকা চূড়ান্ত ভাবে একদলীয় এই শাসনব্যবস্থায় ডিসেম্বর মাস যেন ক্রমশই বিপ্লবের মাস, বিদ্রোহের মাস, অসহযোগিতার মাসে পরিণত হতে বসেছে। গতবছর একই সময়ে আমরা দেশজুড়ে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে বেনজির গণবিদ্রোহ দেখেছি। সেই বিদ্রোহ নিয়েও কম রাজনীতি হয়নি। সেই বিদ্রোহীদেরকেও ‘দেশদ্রোহী’, ‘সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যা দিয়ে দাগিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা হয়েছে। এমনকি বরেণ্য বুদ্ধিজীবী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণের পর যে দলের প্রধানমন্ত্রী আবেগতাড়িত হয়ে লম্বা ট্যুইট করেছিলেন, তিনি বোধহয় তখন ভুলে গিয়েছিলেন যে দিকে দিকে গোরক্ষকদের গণপিটুনির বিরুদ্ধে তাঁকে খোলা চিঠি লেখবার অপরাধে শ্যাম বেনেগাল, নাসিরুদ্দিন শাহ, অপর্ণা সেন সহ এই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দলীয় সংগঠনের সদস্যেরা আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। সেই চিঠিতে সই করা সমস্ত বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে ‘দেশদ্রোহিতা’র অভিযোগ এনে মামলা করা হয়েছিল। ‘শ্রদ্ধা’র যে কি অপার নমুনা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী-সাহেব! দ্বিচারিতার সার্থক ডেফিনেশন বোধহয় আপনার থেকেই শেখা উচিত।
একমাস অতিক্রান্ত। কৃষকেরা দিল্লির সীমান্তে অবস্থান করছেন। এই লেখা যখন লিখছি, সকাল এগারোটায়— কলকাতার তাপমাত্রা তখন ২২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। দিল্লির তাপমান কমবেশি ১৬ ডিগ্রির আশেপাশে রয়েছে (সূত্র: ইন্টারনেটের আবহাওয়া সংক্রান্ত ওয়েবসাইট)। গতরাতে দিল্লির সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের আশেপাশে। কলকাতার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৪ ডিগ্রির কিছুটা তলায়, ১৩.৭ ডিগ্রি আনুমানিক। এই শীতের সময়ে কফি খাওয়া যায়, বিয়ার নিয়ে বেরিয়ে পড়া যায়— আবার পিজ্জা খেতে খেতে কৃষক-আন্দোলনেও শামিল হওয়া যায়! তাই নয় কি? অন্তত আমাদের মতো অনেক ‘বুদ্ধিমান’ মানুষেরই তো আজকাল যেন অনেকটা এইরকমেরই একেকটা জম্পেশ ধারণা তৈরি হয়ে রয়েছে। উত্তর ভারতের ৭ ডিগ্রির তাপমাত্রাতে খোলা আকাশের নীচে বসে থাকাটা যে ঠিক কেমন, একবার অনুভব করে দেখবেন। ২০১৮তে কানপুরের সরকারি মেডিক্যাল কলেজের এমার্জেন্সির সামনে ২৪শে ডিসেম্বর ভোররাতে সেই শীতের খানিকটা নমুনা দেখেছিলাম। সে কথা নাহয় অন্য কোথাও বলব। আজ এই কৃষকেরা নাকি পিজ্জা সাঁটাচ্ছেন, ট্র্যাক্টর-লরিতে তাঁবু খাটিয়ে নিয়ে নিশ্চিন্তে রাত কাটাচ্ছেন, এক-এক সপ্তাহ করে আজ এক মাস পুরে গিয়েছে। খোলা আকাশের নীচে ‘পাঁচতারা’ ট্র্যাক্টরের শামিয়ানার তলায় তাঁদের এই ‘বিদ্রোহ’যাপন! হ্যাঁ, সমর্থন দিতে না পারলে— এভাবেই তাঁদেরকে কটাক্ষ করুন। পথ বেছে নেওয়ার সময় হয়েছে।
২০শে ডিসেম্বর, ২০২০। ‘নয়া শাহিনবাগ’ দিল্লির প্রবেশপথে, সিংঘু-র সীমান্তে কৃষক সংগঠনগুলির নেতৃত্বে ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি দিবস’ পালিত হয়েছে। দিল্লির সমস্ত প্রবেশপথে, যেখানে যেখানে কৃষকেরা অবস্থান করছেন, প্রত্যেকটি জায়গাতে এই ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি দিবস’ পালিত হয়েছে। কিসের এই শ্রদ্ধাঞ্জলি? ২৬শে নভেম্বর থেকে ২০শে ডিসেম্বর, এই সময় পর্যন্ত এই দীর্ঘ কৃষক বিক্ষোভ চলাকালীন, প্রবল ঠান্ডায়, অথবা বিক্ষোভে যোগ দিতে আসার পথে পথ-দুর্ঘটনায়, অথবা দিল্লি-পুলিশ হরিয়ানা-পুলিশের হিমশীতল জলকামানের নৃশংস আক্রমণের সঙ্গে যুঝতে গিয়ে প্রবল শৈত্যে অন্ততপক্ষে ৩৩জন কৃষক, অথবা কৃষক-পরিবারের সদস্য মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁদেরকে মনে রাখতেই এই শ্রদ্ধাঞ্জলি। শহীদ-তর্পণের আয়োজন। ‘খলিস্তানি’ বলে দাগিয়ে দিতে দিতেও, একবার অন্তত সেই সমস্ত শহীদদের বিরাট ছায়াটুকুর সামনে আপনারা নতজানু হবেন, লজ্জিত হবেন, সঙ্কুচিত বোধ করবেন। এভাবেই, আজ প্রত্যেকে নিজেদের নিহত বিবেকের অতৃপ্ত আত্মাটুকুকে সামান্য জল দেবেন। প্রায়শ্চিত্ত করবেন। অন্নদাতারা আজ অপেক্ষায়। অন্নদাতারা আজ অবহেলায়। এতদসত্ত্বেও তাঁরা কিন্তু জানিয়ে দিয়েছেন, রসদ শেষ হলেও দিল্লির প্রবেশপথ থেকে তাঁরা নড়বেন না। হাইওয়ের বুলেভার্ড খুঁড়ে ফেলে তাঁরা সেখানে বীজ রোপণ করেছেন। বেগুন, ধনেপাতা প্রভৃতি সহজে ফলানো যায় এমন শস্যের বীজ ছড়িয়ে দিয়েছেন। দীর্ঘ আন্দোলনের প্রস্তুতিস্বরূপ এই পদক্ষেপ। আর তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে এও জানিয়েছেন যে, সরকার তাঁদের দাবি মেনে নিলে— ডিভাইডারের এই শস্যকে দিল্লিবাসীর প্রতি উপহার হিসেবে তাঁরা রেখে যাবেন। আমরা আরব বসন্তের তাহরির স্কোয়ার দেখিনি। আমরা সিংঘু দেখছি।
সুখদেব সিং (৬৩), পঞ্জাব স্টেট টিউবওয়েল কর্পোরেশন (বর্তমানে পঞ্জাব ওয়াটার রিসোর্সেস এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন)-এর অবসরপ্রাপ্ত কর্মী, এবং কৃষক। তাঁর সন্তান গুরপ্রীত সিং, কৃষক— নিজেই স্বীকার করছেন যে বেশিদূর লেখাপড়া করেননি বলে তিনি কৃষিকে তাঁর জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। যদিও গুরপ্রীত সিংয়ের ছোট ছেলে পঞ্জাবের স্বাস্থ্য দপ্তরে ফার্মাসিস্টের চাকরিতে ঢুকেছেন। এই সুখদেব সিং গত ১২ই ডিসেম্বর থেকে সিংঘু-সীমান্তে চলতে থাকা কৃষক আন্দোলনে শামিল হন। এরপর, ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে অবসর নেওয়া সুখদেবকে, তাঁর পেনশন-সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্র জমা দিতে বলে পঞ্জাব স্টেট টিউবওয়েল কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে তাঁকে দপ্তরে আসতে বলা হয়। ১৪ই ডিসেম্বর, পুত্র গুরপ্রীতকে সুখদেব জানান যে তিনি পঞ্জাবে ফিরছেন, দপ্তরের কাজ সেরে তিনি আবার সিংঘু-র আন্দোলনে ফিরে আসবেন। পঞ্জাবে ফেরার পথেই ট্রাক দুর্ঘটনায় নিহত হন সুখদেব সিং, কৃষক আন্দোলনের শহীদ। যাঁরা এই কৃষক আন্দোলনকে ‘পিজ্জা খাওয়া কৃষক’দের আন্দোলন বলে ‘কটাক্ষ’ করছেন (পড়ুন ‘অপমান’ করছেন), তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাই, সুখদেব সিংয়ের সঙ্গে একই ট্রাকের যাত্রী ছিলেন কৃষক দীপ সিং (৬০)। ইনিও সরকারি ওয়াটার রিসোর্সেস এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের অধীনে টিউবওয়েল অপারেটর হিসেবে কাজ করেছেন, ২০১৪ সালে ইনি অবসর গ্রহণ করেন। কৃষক বলতে ইনি ‘প্রান্তিক’— মাত্রই ১ একর পরিমাণ জমির মালিক। কিন্তু ইনিও সিংঘু-র কৃষক আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। কাজের সূত্রে কিছুদিনের জন্য সুখদেবের মতোই তিনিও বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলেন। পথ-দুর্ঘটনায় ইনিও নিহত হয়েছেন। কি প্রয়োজন ছিল অবসরপ্রাপ্ত এই বৃদ্ধদের, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জমির মালিক এই সমস্ত ‘কৃষক’দের এই আন্দোলনের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর? নিজেদের জীবনকে বিপন্ন করার? সর্বভারতীয় কিষাণ সভার অন্যতম মুখ রবিন্দর পাল (৭০) স্ত্রীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও অসুস্থ শরীরে কৃষকদের লংমার্চে পা মেলান। স্ত্রী-পুত্রের সমস্ত বারণকে উপেক্ষা করে, তিনি দুদিনের মাত্র প্রয়োজনীয় ওষুধ (হ্যাঁ, নানা বয়সজনিত কারণে তাঁকে নিয়মিত ওষুধ খেতে হত) ও সামান্য কিছু জামাকাপড় সঙ্গে নিয়ে কৃষকদের লংমার্চের সঙ্গে দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করেন। প্রবল ঠান্ডার মধ্যে ১লা ডিসেম্বর, সিংঘু-র আন্দোলনস্থল থেকেই রবিন্দর তাঁর পুত্রকে ফোন করে জানান যে তিনি জ্বরে পড়েছেন। তবুও, তিনি তাঁর পুত্রকে নির্দেশ দেন নিয়মিতভাবে বাড়ি থেকে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে তাঁদের কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে কি কি খবর প্রচারিত হচ্ছে সেই বিষয়ে তাঁকে ওয়াকিবহাল রাখতে। অবস্থার অবনতি হলে পরে রবিন্দরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৪ঠা ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এটা জেনে রাখা প্রয়োজন যে, ‘দেশদ্রোহী’, ‘খলিস্তানি’ রবিন্দরের বড় ভাই সাম্প্রতিক অতীতে, ভারত সরকারের ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ডস বা জাতীয় সুরক্ষা দলের কম্যান্ডো হিসেবে অবসরগ্রহণ করেছেন। রবিন্দরের পুত্রের তাই খারাপ লাগে, যখন তাঁর পরিবারকে কেউ ‘দেশবিরোধী’ অথবা ‘উগ্রপন্থী’ বলে দাগিয়ে দেবার চেষ্টা করে। আমরা তাঁর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।
অথবা, আমরা যদি এখন, এখানেই না থেমে— বলবিন্দর সিংয়ের কথা বলি? বলবিন্দর সিং (৬৮) পাঞ্জাব সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব ফরেস্টস এ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ প্রিজার্ভেশন দপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত রেঞ্জ অফিসার। ২৭শে নভেম্বর ২০২০ তারিখে সিংঘু-সীমান্তে হিংস্র পুলিশের হিমশীতল জলকামানের আক্রমণের সামনে তিনি বুক পেতে দিয়েছিলেন। সেই রাতেই তিনি জ্বরে পড়েন। ২রা ডিসেম্বর সেই জ্বরের প্রকোপে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি প্রয়াত হন। তাঁর ট্র্যাক্টরটি এখনও সিংঘু সীমান্তে সাজানো রয়েছে। বলবিন্দরের পুত্র এখন তার স্টিয়ারিংয়ে বসেন। শহীদদের তালিকা বাড়ছে। নিঃশব্দ এই সমস্ত শহীদেরাই সিংঘু সীমান্তে ভারতীয় গণতন্ত্রের শেষ প্রদীপটিকে জ্বালিয়ে রেখেছেন। মৃত্যুর অন্ধকারের চেয়েও উজ্জ্বল সেই আলোয় সমস্ত অপপ্রচার একদিন পরাভূত হবে। এই বিশ্বাস অটুট।
সরলীকরণ বা ডাইল্যুশন! ‘সরকারবাহাদুর বলিতেছেন’ এই আইন বা আইনগুলির ফলে কৃষকদের মঙ্গল হবে। সহজ প্রশ্ন যেটা প্রথমেই আসবে আমাদের মনে, যদি এই তিনটি আইন এতটাই মঙ্গলকর হয়— তাহলে পরে এত সংখ্যক কৃষককে কি এত সহজেই ভুল বোঝানো গেল যে তাঁরা এই শীতে, এই ভয়াবহ কোভিড-পরিস্থিতিতে দিনের পর দিন খোলা হাইওয়ের বুকে রাত কাটাতে রাজি হয়ে গেলেন? যদি এই তিনটি আইন এতটাই মঙ্গলকর হয়— তাহলে কেন, জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে, ভয়াবহ কোভিড-সময়ে (যে সময়ে কোভিড-সংক্রমণ ও মৃত্যুহার দেশে সর্বোচ্চ ছিল) সেই সময়েই অর্ডিন্যান্স বা অধ্যাদেশের মাধ্যমে এই আইনগুলিকে বলবৎ করতে হল? যদি এই তিনটি আইন এতটাই মঙ্গলকর হয়— তাহলে কেন, সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখে রাজ্যসভার অধিবেশনে মার্শাল ডেকে বিরোধী সাংসদদের গায়ের জোরে সভার বাইরে বের করে দিয়ে (তারপরেও!) ধ্বনিভোটের মাধ্যমে সেই অধ্যাদেশগুলিকে পাশ করিয়ে আইন হিসেবে নিয়ে আসতে হল? সামান্য ভোটাভুটিটুকুও করতে দিতে কেন সরকার ভয় পেলেন? আজ এই তিনটি আইনের মধ্যে দ্বিতীয় আইনটিতে (ফার্মারস (এম্পাওয়ারমেন্ট এ্যান্ড প্রোটেকশন) এগ্রিমেন্ট অন প্রাইস এ্যাসিওরেন্স এ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস এ্যাক্ট, ২০২০) সরকার কর্পোরেটদের মাধ্যমে চুক্তি-চাষের কথা বলছেন, এবং সেই আইনের একটি ধারায় বলে দেওয়া হচ্ছে যে এই আইনের মাধ্যমে চুক্তি-চাষে অংশগ্রহণকারী কৃষক ও কর্পোরেটদের মধ্যে কোনও বিবাদ হলে সেই বিবাদের বিচারের ক্ষমতা ভারতীয় বিচারব্যবস্থার আওতায় পড়বে না। স্থানীয় এসডিও অথবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একটি এ্যাপেলেট কমিটির মাধ্যমে বিবাদের নিষ্পত্তি করা হবে। এই আইন বলে, চুক্তি-চাষের ফাঁদে পড়া কৃষকদের কর্পোরেট সংস্থার বিরুদ্ধে কোর্টে যাওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া হল। এছাড়াও, এই তিনটি আইনের মধ্যে তৃতীয় আইনটিতে (এসেনশিয়াল কোমোডিটিস (এ্যামেন্ডমেন্ট) এ্যাক্ট, ২০২০) চাল, ডাল, তেল, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি যা কিছু দৈনন্দিন জীবনযাত্রার পক্ষে অপরিহার্য সেই সমস্ত দ্রব্যকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ‘ডিজিটাল’ ভারতের স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকা মধ্যবিত্তকে মনে করিয়ে দিচ্ছি, এই আইনবলে কার্যত চাল, ডাল, তেল, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের কালোবাজারিকে খাতায়-কলমে, সরকারিভাবে আইনি সিলমোহর দেওয়া হল। আজ সিংঘুর কৃষকেরা আপনাদের জন্য রাত জাগছেন। আপনার তাঁদের ‘কটাক্ষ’ করুন, কারণ তাঁরা আপনাদের হেঁশেলকে বাঁচাতে চাইছেন। নয়া ভারতের ‘ডিজিটাল’ স্বপ্ন দেখিয়ে বেড়ানো, সেই আশ্চর্য হ্যামলিনের (পড়ুন গুজরাতের) বাঁশিওয়ালাও আজ তাঁদেরকে ‘সু’পথে আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। মধ্যবিত্তের আবার অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের কী দরকার! কফি-কাজু-নেটফ্লিক্সেই তো আপনাদের ‘পাঁচতারা’ ব্যাঙ্ক ব্যালান্স। ফিক্সড ডিপোজিটের সুদ বরং আরও কিছুটা কমুক। সিংঘুর লড়াই জারি থাকুক।
র্যামন-ম্যাগসেসে পুরষ্কার বিজয়ী, কৃষি-সাংবাদিক পি সাইনাথের লেখা ‘এভরিবডি লভস এ গুড ড্রট’ বইটির প্রথম অধ্যায়েই ওডিশার কালাহান্ডির কথা বর্ণিত হয়েছে। অনাহারের কালাহান্ডি, কিন্তু অনাহারের আগে কেমন ছিল কালাহান্ডির ইতিহাস? সেখানকার সরকারও ভূমিপুত্রদের ‘উন্নতি’ চেয়ে কিছু প্রকল্প নিয়ে এসেছিল। ভূমিপুত্রদের বোঝানো হয়েছিল যে সরকার যা চাইছে, তার চেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারে না। কালাহান্ডির মানুষ সরকারকে বিশ্বাস করেছিলেন। প্রকল্পটি চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়। আর তারই ফলস্বরূপ অনাহারের মানচিত্রে শীর্ষস্থানে উঠে আসে ওডিশার কালাহান্ডি। প্রকল্পটির বিশদ বর্ণনায় যাব না, কারণ এই প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে তা অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু এর উল্লেখ টানলাম এই কারণেই যে, সরকার চাইলেই তা সবসময় কৃষক বা ভূমিপুত্রদের জন্য মঙ্গলকর হয় না। খোদ পঞ্জাবের কৃষকেরাই এর আগে ‘সবুজ বিপ্লব’-এর মারাত্মক ফলাফলকে চোখের সামনে দেখেছেন। কর্পোরেট-সর্বস্ব এবং মুনাফা-সর্বস্ব নীতির যে কি ভয়ানক প্রতিফল হতে পারে— ভারতবর্ষের কৃষক সম্প্রদায় তা বারেবারে প্রত্যক্ষ করেছে। এতবার করে যাদের ঘর পুড়েছে, তাদের সমস্ত অধিকারকে (সমস্ত অর্থনীতিটাকেই) এমন নির্লজ্জভাবে কর্পোরেট পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থাস্বরূপ এই তিনটি আইন তাই আজ আপামর কৃষকসম্প্রদায়কে এক করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। লড়াইটা এখন একের বিরুদ্ধে একের লড়াই।
আসল কারণ যে সেই সরলীকরণ বা ডাইল্যুশন! সরকারবাহাদুরেরা বারেবারেই যা বলেন, যে তাঁরা নাকি কৃষকদের, ভূমিপুত্রদের কাজগুলিকে, কাজ করবার ক্ষেত্রগুলিকে সরল করে দিচ্ছেন, সহজ করে দিচ্ছেন। তাঁদের আয়ের পথকে সুগম করছেন। আসলে যে সরকারের অভিধানে সরলীকরণের অর্থ ডাইল্যুশন। দায় ঝেড়ে ফেলে, কর্পোরেট-হাঙরদের হাতে দেশের ভবিষ্যতকে তুলে দিতে পারলেই তাঁদের স্বস্তি। তাঁরা দায়িত্বকে ঝেড়ে ফেলতে পছন্দ করেন।
সুখদেব সিং (৬৩), দীপ সিং (৬০), রবিন্দর পাল (৭০) অথবা বলবিন্দর সিং (৬৮)— কয়েকটা নামহীন অবয়ব। কয়েকটা অবয়বহীন নাম। নামের তালিকা। যে তালিকাকে ইতিহাস মনে রাখবে না। পদাতিক সেনাদের ইতিহাস মনে রাখে না। নিকটজনেরা কেবল তাঁদের বুকের ব্যথা বয়ে নিয়ে বেড়ান। বলবিন্দর সিংয়ের ট্র্যাক্টরটা এখনও সিংঘু সীমান্তে সাজানো রয়েছে। বলবিন্দরের পুত্র এখন তার স্টিয়ারিংয়ে বসেন। নিঃশব্দ এই সমস্ত শহীদেরাই সিংঘু সীমান্তে ভারতীয় গণতন্ত্রের শেষ প্রদীপটিকে জ্বালিয়ে রেখেছেন। আমরা যারা শহরের মানুষ, দূরের মানুষ, কাগজ-কলম-বক্তৃতার মানুষ— আমরা কেবল আমাদের অক্ষরের উষ্ণতাটুকুকে তাঁদের কাছে পৌঁছিয়ে দিতে চেষ্টা করি।
… কিন্তু আমরা জানি যে তা বড় সামান্য, তা বড়ই অকিঞ্চিৎকর। সেই যে কোনও এক কবিয়াল তাঁর কবিগানে বলে গেছেন, “বল ফুলমণি সামান্য গান কতটুকুই বা পারে, চোরকাঁটাও তো হয় না এ গান তোমার পথের ধারে …” আমরা যে চোরকাঁটা হয়ে উঠবারও যোগ্যতা রাখি না। কেবল আশ্চর্য হয়ে দেখি, সিংঘু থেকে প্রকাশিত কৃষকদের নিজস্ব কাগজ ট্রলি টাইমসের উপরে বড় বড় হরফে ছাপা রয়েছে,
“বোমা-পিস্তল দিয়ে বিপ্লব আসে না— বিপ্লবের তরবারিতে শান দাও চিন্তনের চর্চায়।” –ভগৎ সিং
এই শহীদদের সামান্য তর্পণের অধিকারটুকুও কি আমাদের নেই? বিবেককে কি আমরা এতটাই বনবাসে পাঠিয়েছি?