রাজাকারনামার পঞ্চাশ বছর

রুখসানা কাজল

 



গল্পকার, গদ্যকার, ঢাকা তেজগাঁও মহিলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান

 

 

 

ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। শিক্ষার্থীপ্রিয় শিক্ষক বিষয়বস্তু উহ্য রেখে জানিয়ে দিলেন, এ সপ্তাহের শেষ ক্লাসটি অত্যন্ত ইমপর্টেন্ট। সেদিন উপস্থিতি নব্বই পার্সেন্ট থাকলে তিনি খুশি হবেন।

নির্ধারিত দিনে কানায় কানায় ভরপুর ক্লাস। চকচক করছে শিক্ষার্থীদের চোখ। স্বয়ংক্রিয় উদ্যোগে নিজেরাই কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক নির্বাচিত করে তাদের নামকরণ করেছে, পলাশীর যুদ্ধ, সিপাহী বিদ্রোহ, সাতচল্লিশ সাল, একুশে ফেব্রুয়ারি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। অবাক হতে গিয়েও তিনি অবাক হতে পারেন না। এ তারই শিক্ষাদানের পদ্ধতি। প্রায় একশোজন শিক্ষার্থীর ক্লাসে দলগত পদ্ধতিতে বিষয় নির্বাচন করে তিনি মতামত জানতে চান। ক্লাস জুড়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে। কখনও কখনও তার রেশ গড়িয়ে আসে পরবর্তী ক্লাসে। অতি বোবা শিক্ষার্থীও শেষপর্যন্ত তার মুখ খোলে। তিনি এনজয় করেন। কেননা, তার শিক্ষাদানের বিষয়বস্তু হচ্ছে, The history of the emergence of an independent Bangladesh বা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস।

গলার রগ ফুলিয়ে কোনও কোনও শিক্ষার্থী জানিয়ে দেয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনও কুড়িয়ে ব্যাপার নয়, অনেক রক্তের বিনিময়ে পাওয়া। কেউ একজন কঠিন গলায় যুক্তি দেয়, কেউ তো অস্বীকার করছে না। কিন্তু ন মাস নয়। যুদ্ধটা চলা দরকার ছিল নয় বছর। তাহলে এ রক্তের দাম বোঝা যেত। কিছু কিছু শিক্ষার্থী কিছুই বলে না। দুদিকেই মাথা নেড়ে যায়। তিনি তাদের দিয়ে কথা বলাতে চেষ্টা করেন। এরা যখন কথা বলে তখন হালকা আওয়াজ ওঠে, ছুপাতি! ছুপাতি। এ বিষয়টি পড়াতে গিয়ে কিছু শব্দের সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন, আম্মিলি, বিম্পি, জামাতি, বামাতি, ছুপাতি। তার আগ্রহ এই ছুপাতিদের উপর। এরা একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী আর রাজাকার বাহিনীর তৃতীয় প্রজন্ম।

নির্দিষ্ট দিনে তিনি বোর্ডে লিখে দিলেন আজকের বিষয়: রাজাকারনামা— মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘরের শত্রু। ক্লাস জুড়ে যেন ঘূর্ণিবাত্যা বয়ে গেল। পেঁয়াজের খোসার মত ভেসে এল ঝাঁঝালো বাতাস। গভীর উত্তেজনা ছুঁয়ে গেল কয়েকজন শিক্ষার্থীকে। ক্লাসরুমের ডিগনিটি বজায় রেখে, কেউ কেউ বলে উঠল, একটা একটা রাজাকার ধরো, সকাল বিকাল নাস্তা করো।

তিনি হাত তুলে স্টপ সাইন দেখালেন। প্রায় দেড়শো চোখ উন্মুখ হয়ে আছে। দুই হাজার কুড়ির মহা মার্চ মাস। চিন দেশে প্যান্ডোরার বাক্স ভেঙে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে কোভিড ১৯ নামের এক অশুভ প্যানডেমিক। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে লকডাউনে। খা খা করছে মনুষ্যবিহীন দেশগুলো। বাংলাদেশও সাধারণ ছুটির নামে একপ্রকার লকডাউনে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। এর মধ্যে যতটা সম্ভব তিনি পড়াশুনা করিয়ে নিতে চাইছেন।

প্রতি বছর অনার্স প্রথম বর্ষের ক্লাসে এই বিষয়টি পড়াতে গিয়ে তাকে কিছুটা নাটকীয় কৌশল অবলম্বন করতে হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের এ প্রজন্মের জন্ম হয়েছে দুই হাজার সালের পর। এরা রাজাকার দেখেনি। তাদের অপকম্ম দেখেনি। কিন্তু ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন দেখেছে। দেখেছে বিশ্বাসঘাতক রাজাকারদের বিচার, দণ্ড ও ফাঁসি। অন্তত এটুকু জেনেছে, এরাই রাজাকার। গদ্দার। দেশমাতৃকার স্বগর্ভে লালিত বিশ্বাসঘাতক সন্তান।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের মে মাসে, খুলনার খানজাহান আলী রোডের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন জামায়াত ই ইসলামি কর্মীকে নিয়ে গঠন করা হয়েছিল রাজাকার বা রেজাকার বাহিনী। আরবিতে যার অর্থ হচ্ছে, স্বেচ্ছাসেবক। নেতৃত্বে ছিলেন, জামায়াত নেতা একেএম ইউসুফ। টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের চোর ডাকাত সমাজবিরোধীদেরও বাধ্যতামূলকভাবে এ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। (‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’, ডঃ মোহাম্মাদ হান্নান)। ১লা জুন, রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৪ জুলাই, কুষ্টিয়ায় এদের প্রথম ট্রেনিং (১৫ দিনের) হয়।

উল্লেখযোগ্য কয়েকজন রাজাকার হচ্ছেন, গোলাম আযম, আব্বাস আলী খান, মতিউর রহমান নিজামি, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদী, মুহাম্মাদ কামরুজ্জামান, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, আবদুল কাদের মোল্লা, ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং তার ছেলে সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরী, মীর কাশেম আলী।

রাজাকারদের বেতন ছিল ১৫০ রুপি। সঙ্গে রেশন এবং লুটে আনা জিনিসপত্র, প্রাণভয়ে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামি লিগ নেতাকর্মী, স্বাধীনতা স্বপক্ষের মানুষ, মুক্তিযোদ্ধা পরিবার এবং হিন্দুদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তির দখলদারি।

তিনি বুঝলেন, ক্লাসটি ক্রমশ ভারি হয়ে উঠছে। কেউ কেউ উত্তেজনা চাপিয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে ঘাড় উঁচু করে লেকচার শুনছে। কেউ কেউ নিমজ্জিত নৌকার পালের মত নুয়ে পড়েছে। মনে মনে তিনি হাসলেন। এটাই স্বাভাবিক। প্রতি বছর এরকমটি হয়। কেননা শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ থাকে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের। তার সঙ্গে আছে মুক্তিযুদ্ধ সমর্থক পরিবারের সন্তানেরা। আর কিছু শিক্ষার্থী আছে যাদের পরিবারের সঙ্গে লেপটে আছে রাজাকারনামার কলুষিত কলঙ্ক। তিনি ক্লাস শেষ করে শিক্ষার্থীদের হোমওয়ার্ক দিলেন, হয়ত দীর্ঘ ছুটিতে যেতে হতে পারে। তোমরা পড়াশুনার পাশাপাশি যার যার নিজের জেলা বা শহর গ্রামে একাত্তরে রাজাকারদের ভূমিকা কী ছিল সত্যিটা জেনে নোট লিখে রেখো। বেঁচে থাকলে দেখা হবে।

লাইব্রেরি রুমে পাঠরত শিক্ষকের সামনে দুলে ওঠে কতগুলো ছায়া। খুলনার বন্ধ পাটকারখানার আন্দোলনরত শ্রমিকের ছেলে আয়াজ ওর বন্ধুদের নিয়ে এসেছে।

২০ মে ১৯৭১। বরিশাল, ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ সহ বিভিন্ন জায়গার হিন্দু মুসলিম প্রায় কয়েক হাজার শরণার্থী খুলনার চুকনগরে জড়ো হয়েছিল। কাছাকাছি সীমান্ত। একবার পেরুতে পারলেই ভারত। অথচ সকাল দশটার দিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা এসে রক্তাক্ত করে দিয়েছিল চুকনগরের মাটি। জানা যায় প্রায় দশ থেকে বারো হাজার নারী পুরুষ শিশু নিহত হয়েছিল। ভদ্রা নদীর পানি তিনদিন লাল ছিল। এ প্রত্যন্ত গ্রামের খবর কারা পৌঁছে দিয়ে ডেকে এনেছিল পাকিস্তানি বাহিনীকে? কারা?

রাতের আঁধারে ট্রাক বোঝাই করে বাঙালিদের এনে গুলি করে ফেলে দেওয়া হত খুলনার গল্লা খালে। এ মানুষগুলোর আর্তনাদে বাতাস ভারি হয়ে উঠলেও সাহস পেত না কেউ জানালা খুলে দেখার। একবার একজন জানালা খুলেছিল সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানিরা তো এদেশের রাস্তাঘাট চিনত না। কারা তাদের চিনিয়ে নিয়ে এসেছিল? কারা?

ধর্ষিতা হয়েও যে গুপ্তচর হিসেবে কাজ করে প্রায় চল্লিশ পঁয়তাল্লিশজন পাকিস্তানি সৈন্য আর রাজাকার নিধনের সুযোগ করে দিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সেই ভাগীরথীকে কে বা কারা ধরিয়ে দিয়েছিল হানাদার বাহিনীর হাতে? কারা উল্লসিত হয়ে উঠেছিল যখন শত অত্যাচারে মৃত্যু না হওয়ায় দুই জিপের সঙ্গে ভাগীরথীর দুই পা বেঁধে চিরে মেরে ফেলা হয়? ফিরোজপুরের মাটি সে ইতিহাস ভুলে যায়নি। ভোলা কি যায়?

বাঙালি কি ভুলে যাবে একাত্তরের নররাক্ষস চট্টগ্রামের সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে? ভোলা যায় তার নিজস্ব বাড়ি ‘গুডস হিল’-এ ধরে আনা বাঙালিদের উপর পেরেক মেরে, তক্তাচাপা দিয়ে, প্রস্রাব খাইয়ে, মুগুর মেরে পিটিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় করা নির্যাতনের কাহিনি!

ভোলা যায় ফরিদপুরের রাজাকার আলি আহসান মোঃ মুজাহিদের অত্যাচারের কাহিনি? ফরিদপুরের বিভিন্ন গ্রাম থেকে বাঙালিদের ধরে এনে নারীদের পাঠিয়ে দিত মিলিটারি ক্যাম্পে। পুরুষদের হত্যা করত। যারা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে তাদের অভিজ্ঞতা শুনলে ভয়ে শিউরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এই পঞ্চাশ বছর পরেও ক্রোধ জমা হয় বাঙালির রক্তে।

বিহারি অধ্যুষিত সৈয়দপুর বাঙালিদের কাছে কারাবালা হয়ে উঠেছিল। সেখানকার বিহারিদের সঙ্গে রাজাকাররা সাধারণ বাঙালিদের ছুরি দিয়ে কুচি কুচি করে স্তুপ বানিয়ে রেখে যেত ঘরের মেঝে, বিছানার উপর। ভোলা যায়?

গোপালগঞ্জ শান্তি কমিটির চেয়াম্যানের আক্রোশ থেকে রেহাই পায়নি তার বন্ধুপুত্র এবং ছাত্র। গুলি করে আধমরা ছাত্রটিকে মাটিচাপা দিয়ে তার উপর রাতারাতি ইটের পাঁজা সাজিয়ে দিয়েছিল। গার্লস ইশকুলের ক্রীড়াশিক্ষককে তালগাছের সঙ্গে হাতপায়ে পেরেক মেরে জীবন্ত ঝুলিয়ে রেখেছিল। পিঁপড়ে, উল্লা, মাজুলি পোকারা খুবলে খেয়েছিল স্যারকে। এখন যে জয়বাংলা পুকুর হয়েছে সেটি একাত্তরে নিহত মানুষদের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছিল। এদের কি ভুলে যাবে বাঙালি?

পরাজয় নিশ্চিত জেনে শেষ কামড় বসিয়েছিল বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের খুন করে। শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, ইঞ্জিনিয়ার, সাংস্কৃতিকর্মীদের লিস্টি করে খুন করতে চিনিয়ে দিয়েছিল যারা তারা তো বাঙালিই ছিল। বাঙালি কি ভুলে যাবে রায়েরবাজার বধ্যভূমির কথা?

লাইব্রেরি ঘর যেন লক্ষ লক্ষ শহীদের উপস্থিতিতে ভরে উঠেছে। আয়াজ, ফরিদ, সাবরিনা, নুজহাত, সাগর, নীপাদের বয়েস উনিশ কুড়ি বড়জোর একুশ। ওরা ভুলে যায়নি। অথচ জাতীয় ক্ষেত্রে, ব্যক্তিগত লাভ-অলাভের হিসেব কষে অনেকেই ভুলে গেছে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে রাজাকারদের ভূমিকাকে। ঘরের শত্রু মীরজাফরদের। ক্ষমা পেতেও যোগ্যতা লাগে স্যার।

আয়াজ ফরিদরা চলে গেলে তিনি চিনের করোনা-আক্রান্তদের খবর পড়ছিলেন। তার এক ছোটভাই পড়াশুনার জন্যে ওদেশে আছে। চরম টেনশন কাজ করছে মনে। করোনায় মৃত অসংখ্য লাশ নাকি পুড়িয়ে দিচ্ছে চিনা সরকার। পার্সোনালি তিনি রাজি ছিলেন না ওদেশে পাঠাতে। মুক্তিযুদ্ধে চিনের ভূমিকাকে তিনি মেনে নিতে পারেন না। এই ভূমিকাই একাত্তরে চিনপন্থী দলগুলোকে বিতর্কিত এবং বিভক্ত করে দিয়েছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধকে তাদের একাংশ ‘দুই কুকুরের লড়াই’ বলে কোন পথে গিয়েছিল ইতিহাসে তা অস্পষ্ট নয়। কিন্তু তার ভাইটা গোঁ ধরল, কবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চিনা সরকার পাকিস্তানের দোসর ছিল সেসব ভাবলে কী এখন চলে! পাকিস্তানের অনেকেই তো এখন ক্ষমা চাইতে আগ্রহী। তাছাড়া বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির মুখ্য বার্তাই হল, সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব। কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। তবে?

আলোর বিপরীতে কতগুলো ছায়া পড়ে পত্রিকার উপর। তিনি চোখ তুলে দেখেন ঈমান সিকদার সহ অনেকেই মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এদের নাম তিনিই দিয়েছেন, ছুপাতি। ওরা যে আসবে অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানতেন। ওদের পূর্বপুরুষদের দেওয়া শত বাঁধা সত্ত্বেও স্বাধীনতার যে মহাসড়ক চলমান তাতে ওরা এসে দাঁড়াবেই। তাছাড়া এ দেশ তো ওদেরও। পরিবেশ হালকা করতে তিনি তৃষ্ণার্তের ভাব দেখিয়ে হাসেন, চা খেলে কেমন হয়?

ঈমান সিকদারের হাত কাঁপে। বাষ্পরুদ্ধ গলা, বলতে পারেন স্যার কী করলে রাজাকারের কলঙ্ক মোছা যায়? মুনিরা প্রায় কেঁদে ফেলে। ঝগড়া হলে আব্বুকে ওর আম্মু রাজাকারের বাচ্চা বলে গালি দেয়। আত্মীয়স্বজনরা কানাকানি করে। হারিস কবিতা লেখে। ওর মুখ বিষণ্ণ। যতবার একটি কবিতা লেখা শেষ হয়, ততবার ওর মনে হয় বাংলাদেশও একটি কবিতা। ও নিজেকে লুকিয়ে রাখে। ওর মায়ের আব্বা দেড় বছরের সাজাপ্রাপ্ত একজন রাজাকার ছিল। যদিও কয়েকটি হিন্দু পরিবারকে সে সময় উত্তরবঙ্গের সীমান্ত দিয়ে পার করে দিয়েছিল। তবু রাজাকার তো রাজাকারই।

ক্ষুব্ধ জাকারিয়া রাগ উগরে দেয়, ভারতের দেওয়া স্বাধীনতা নিয়ে কী হল স্যার? দেশে কি শান্তি আছে? মেয়েদের ইজ্জত আছে? চোর ছ্যাঁচোড় নাস্তিকে ভরে গেছে দেশ। কেউ আর মুসলমান নেই।

তিনি জাকারিয়া সম্পর্কে জেনে নিয়েছিলেন। জামাতপন্থী পরিবার ওদের। খুঁজে খুঁজে একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী প্রবাসীদের সঙ্গে ওদের পরিবারের আত্মীয়তা হয়। অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত পরিবার ওদের। বিদেশে ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে কাজ করে ওর আত্মীয়রা। প্রচণ্ড ভারতবিদ্বেষী।

সাতচল্লিশের দেশভাগ পড়ানোর সময় এই জাকারিয়া প্রমাণ তুলে ধরেছিল। দেশভাগ প্রসঙ্গে নির্বাচনের ফলাফল। হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে দেশভাগের পক্ষে ভোট পড়েছিল। মুসলিম এলাকা ছিল দেশভাগের বিপক্ষে। দাঙ্গা কোথায় হয় না! ইন্ডিয়াতে মুসলমানরা মার খায় না? খুন হয় না? আসলে ওরা কখনও এদেশটাকে নিজের মনে করে না। কী করেছে এ দেশের জন্যে? বাংলাদেশের প্রশাসন থেকে কোথায় নেই হিন্দুরা? অথচ কেবল চলে যাওয়া আর শিল্প সাহিত্য স্মরণিকায় দেশ নিয়ে মায়াকান্না কাঁদা!

জাকারিয়া চলে যেতেই মুশতাক, ইউনুস, হাফিজ সহ আরও কয়েকজন আসে। নিঃশব্দে কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে ওরা। এরা এদের পূর্বপুরুষদের অকৃতজ্ঞতার মাশুল গুনছে। সাতচল্লিশে্র দেশভাগের ধাক্কায় যারা জন্মভূমি ভারত ছেড়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল। বাংলার নুন খেয়ে এদের পূর্বপুরুষরাই তাদের নেতাদের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে একাত্তরের পাকিস্তান বাহিনীকে সাহায্য সহযোগিতা করেছে। এদের কেউ কেউ এখনও পাকিস্তানকে স্বদেশ ভেবে চানতারা পতাকা উড়িয়ে জেনেভা ক্যাম্পে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। বাঙালির কাছে যারা অবিশ্বাসী বিহারি নামে পরিচিত।

তিনি মুশতাকের হাতে গভীর আলিঙ্গন রাখেন। ওর গলায় সুর খেলে যায় গায়ক আবদুল জব্বারের মত। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে, যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই, যদি রাজপথে আবার মিছিল হত, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই, মুক্তি চাই, মুক্তি চাইইইই— শুনে অডিয়েন্স উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল। সাফিনাজ নামের মেয়েটি একটি নাট্যদলে অভিনয় করে। পরিবারের ঠিক করা দিল্লিবাসী এক গুজরাটি ছেলেকে বিয়ে না করে লেপ্টে গেছে এক হাওর বাওরের চাষাপরিবারের ছেলের সঙ্গে।

এদের নিঃশ্বাস, স্পর্শ, পদক্ষেপ, উচ্চারণে ক্ষমাইচ্ছুক প্রায়শ্চিত্তের অভিব্যক্তি।

ইদানীং পত্রপত্রিকায় পাকিস্তানের বর্তমান রাষ্ট্রনায়ক ইমরান খানও বাঙালিদের উপর করা একাত্তরের ন্যক্কারজনক অন্যায় আক্রমণের জন্য ক্ষমা ইচ্ছুক। তার মনে পড়ছে পাকিস্তানের পাঞ্জাবি কবি আহমদ সেলিমের কথা। যিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশকে সমর্থন করে ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং দুই হাজার টাকা অনাদায়ে আরও তিনমাসের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেছেন খুনি ইয়াহিয়ার হাতে। তিনিই জাহানারা ইমামের লেখা “একাত্তোরের দিনগুলো” বইটির উর্দু অনুবাদ করেছেন। পাকিস্তানের সাহিত্য জগতে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে বাংলাদেশ এবং বাঙালির ন্যায্য লড়াইয়ের সম্মান। সেখানে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্ষমাগীত। এ তথ্যগুলোও জেনেছি আহমদ সেলিমের প্রবন্ধের বই, ‘উই ওউ অ্যান অ্যাপলজি টু বাংলাদেশ’ (সাহিত্য প্রকাশ) থেকে। প্রবন্ধকার শেহজাদ আমজাদ লিখেছেন, ‘উই ওউ অ্যান অ্যাপলজি’, হাফিজুর রহমান লিখেছেন, ‘ক্যান দা বেঙ্গলি ফরগিভ আস?’

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তারা খোলাখুলি জানিয়ে দিয়েছে, ক্ষমা একটি মহৎ গুণ। তাদেরও আছে। কিন্তু এদের ক্ষমা করতে বুক কাঁপে। কি করে নিশ্চিন্ত হব যে ওরা আবার বিশ্বাস ভেঙে ঘাতক হয়ে উঠবে না?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ শিক্ষক, লেখক, প্রবন্ধকার এবং সম্পাদক জানিয়েছেন, ক্ষমা করতে পারলে তিনি খুশি হতেন কিন্তু রাজাকার এবং পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে সমর্থনকারী রাজাকারদের বিশ্বাস করতে তার ভয় হয়।

একজন জেলখাটা রাজাকারের প্রবাসী কন্যা, শিক্ষক এবং লেখক, জানিয়েছে তার আব্বা ভাবতে পারেনি পাকিস্তানি হানাদাররা এতখানি নৃশংস হবে। যেহেতু ধর্মভীরু ও মুসলিম লিগ করতেন তাই নাম ছিল রাজাকার বাহিনীতে। আমরা তাঁর শাস্তি পেয়েছি। তবে বাংলাদেশের জন্যে আমরা গর্বিত।

কিন্তু রাজাকার বাহিনীর তৃতীয় প্রজন্মের সবাই কি অনুতপ্ত এবং ক্ষমাপ্রার্থী?

এটা সত্য নয়। তিনি জানেন, আজকের বাংলাদেশে ধর্মোন্মদনা সৃষ্টি করছে যারা তাদের অনেকেরই ইতিহাস রাজাকারময়। এমনকি অনেক বাম দলের ডাই হার্ড নেতা-কর্মীদের শিকড়েও রয়েছে একাত্তরের স্বাধীনতার বিরুদ্ধতা। অনেকে আওয়ামি লিগে মিশে গেছে। দেশে উত্থান ঘটেছে নব্য রাজাকারদের। যে জঙ্গিরা নাশকতা করে পালিয়ে যাচ্ছে বা ধরা পড়ছে অথবা নিহত হচ্ছে তাদের বিভ্রান্ত করছে কোন শক্তি?

বিএনপি তো গঠিত হয়েছিল স্বাধীনতাবিরোধী এবং আওয়ামি লিগ-বিরোধীদের নিয়ে। রাজাকার শিরোমণি, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের  নীলনকশাকারী এবং স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যড়যন্ত্রকারী গোলাম আজমকে বিএনপি-র প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা মেজর জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেছিলেন। মন্ত্রিত্বে ছিল ফরিদপুরের ত্রাস মুজাহিদ সহ অনেক রাজাকার নেতা।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে এখন ভুলভুলাইয়া অবস্থা। গণতন্ত্রের সূত্র মেনে শক্তিশালী তো দূরের কথা ল্যাবাচ্যাবা টাইপের কোনও বিরোধী রাজনৈতিক দলেরও অস্তিত্ব নেই। রোম রোম মে আওয়ামি লিগ দেখালেও মন মন মে আওয়ামি আদর্শের নেতাকর্মীদের দেখা যাচ্ছে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে এটাই হচ্ছে মহাবিপদের বার্তা। একটি দেশের সবাই সরকারি দলের সমর্থক, সদস্য, কর্মী, নেতা হয়ে গেলে গোখরা সাপের উদ্যত ফণাকে দোলায়মান পদ্মকুঁড়ি বলেই মনে হয়। সামনে আসছে লড়াই। অর্থনৈতিক সুস্থিরতার পারদ ছুঁতে পারলেও চলছে ব্যাঙ্ক লুট, গুম খুন, ধর্ষণ, ঘুষ, পুশ, দাঙ্গা, দখল, পুলিশ ফুলিশ আর বিচারহীনতার ছলনডলন। এ সুযোগে বেরিয়ে আসছে ধর্মের শকুনরা।

এক সময় এরাই শহীদ মিনারে ফুল দেওয়াকে মনে করত পৌত্তলিকতা, নারী মানেই কেবল স্তন যোনি, পহেলা বৈশাখ হিন্দুদের। এরাই এখন স্ট্যাচু ভেঙে ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে। এদের অধিকাংশই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তিতে শক্তিমান।

ক্ষমা দেওয়া কি এত সহজ?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. না। ক্ষমা দেওয়া সম্ভব না। তাছাড়া তুমি,আমি আমরা ক্ষমা করার কেউ নই! ত্রিশলাখ শহীদের কাছে ক্ষমা চাওয়া হোক, আড়াই লাখ মা-বোনের কাছে ক্ষমা চাওয়া হোক; লক্ষ শহীদ পরিবারের কাছে ক্ষমা চাওয়া হোক- দেড় কোটি শরণার্থীর কাছে ক্ষমা চাওয়া হোক– তাঁদের ক্ষমা পেলে তবেই ক্ষমার প্রশ্ন….

আপনার মতামত...