কিম কি দুক: কোরিয়ান নব তরঙ্গের যাযাবর

কিম কি দুক | চলচ্চিত্রনির্মাতা

অনিন্দ্য আরিফ

 



সাংবাদিক, চলচ্চিত্র বিশ্লেষক, রাজনৈতিক কর্মী

 

 

 

 

মানুষ আমাকে যদি প্রশ্ন করে আমি একজন নৈতিক ব্যক্তি কি না, তাহলে আমি সাধারণত প্রত্যুত্তরে বলি যে আমি তা নই। কিন্তু আমি একজন ব্যক্তি যে কোরিয়ান সমাজের অন্ধকার এবং দারিদ্যের চিত্রায়ণ করতে ভয় পাই না। এটাই আমার নৈতিকতার জায়গা। আমি আমার আগের সিনেমাগুলোর চাইতে আরও পরিচ্ছন্ন ধরনের চলচ্চিত্র বানাতে পারতাম, কিন্তু এই ধরনের সাধারণ কাজ করতে আমি ভয় পাই। একইসঙ্গে আমি আমার অতীত এবং বিতর্কিত বিষয়গুলোর জন্য ভবিষ্যতেও মূলধারার চলচ্চিত্র বানাতে ভয় পাই।

[কোরিয়ান সিনেমা টুডে, অক্টোবর, ২০১২: ভলিউম: ১৪]

দক্ষিণ কোরিয়ান চলচ্চিত্রনির্মাতা কিম কি দুক লাটভিয়ার একটি হাসপাতালে গত ১১ ডিসেম্বর কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জটিলতার কারণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর জটিলতার মতো জীবনও জটিলতায় পূর্ণ ছিল। তাঁর চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলোর দিকে লক্ষ করলেও দেখা যাবে যে সেগুলো ছিল নষ্ট, উত্তেজিত, বিদ্রোহী এবং সর্বোপরি, আমরা যাদের ইতর বলে গালি দেই, সেই ইতরবিশেষ। আসলে তাঁর জীবনের এ ধরনের অতীতই তাঁকে সারা জীবন তাড়া করে বেড়িয়েছে এবং সিনেমায় তিনি সে চরিত্রগুলোই ফুটিয়ে তুলেছেন।

কিম কি দুক ১৯৬০ সালের ২০ ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার বোংঘোয়ায় জন্ম নেন। তাঁর বয়সী অন্য সব শিশুর চাইতে তাঁর শৈশব অনেকটা ভিন্ন ছিল। স্কুলের মধ্যম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি ড্রপড আউট হন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি কারখানার শ্রমিক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। ২০ বছর বয়সে যোগ দেন মেরিনের চাকরিতে। কিন্তু সে চাকরিও তাঁকে বেশিদিন আটকে রাখতে পারেনি। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি ফ্রান্সে বসাবাস করেন। এ সময়ে তিনি নানা পেশায় থেকে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এর মধ্যে রাস্তায় দাঁড়ানো ভবঘুরে চিত্রশিল্পীর কাজও করেছিলেন কিছুদিন। একদিন প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখার পর এই মাধ্যমের পোকা ঢোকে তাঁর মাথায়। ১৯৯৩ সালে দেশে ফিরে শুরু করেন চিত্রনাট্য লেখার কাজ। ১৯৯৫ সালে কোরিয়ান ফিল্ম কাউন্সিল কর্তৃক আয়োজিত এক প্রতিযোগিতায় চিত্রনাট্যকার হিসেবে পুরস্কার পান। এটিই চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট কিমের প্রথম পুরস্কার। তাঁর প্রথম ছবি ‘ক্রোকোডাইল’ মুক্তি পায় ১৯৯৬ সালে। স্বল্প বাজেটের ছবিটি দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। এরপরে কিম ২০টির মতো কাহিনিচিত্র নির্মাণ করেছেন। এমনকি তাঁর সঙ্গে যাঁরা সহকারী পরিচালক হিসাবে চলচ্চিত্র নির্মাণে হাতেখড়ি ঘটিয়েছেন, তাঁদের অনেকের প্রথম চলচ্চিত্রের প্রযোজনার দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। কিম তাঁর সারা জীবনের চড়াই-উৎরাইয়ের অভিজ্ঞতা থেকে নিজের নির্মাণগুলো সৃষ্টি করেছেন। তাঁর অনেক নির্মাণ আবার কোরিয়ান দর্শকরা তেমনভাবে নিতে না পারলেও তার তোয়াক্কা না করেই তিনি সৃষ্টি করে গিয়েছেন একের পর এক অবিস্মরণীয় চলচ্চিত্র। আর এসব নির্মাণই তাঁকে দেশীয় স্তর থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রনির্মাতায় পরিণত করেছে।

তাঁর সৃষ্ট চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলো কোরিয়ান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ব্রাত্য হতে পারে। কিন্তু তারপরেও কিম অনবরত এসব চরিত্র দিয়েই কোরিয়ান সমাজের অনবরত সমালোচনা করে গিয়েছেন, তাঁর হাত থেকে নিস্তার পায়নি কোরিয়ান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিও। কিম নিজেও বুঝতেন যে বিশ্বের কেউ কেউ তাঁর সিনেমাগুলোকে বিদ্যমান সংস্কৃতি এবং সামাজিক রীতির ধারালো সমালোচনা হিসাবে বুঝতে পারলেও কোরিয়ান দর্শকদের অনেকেই তাঁর কাজগুলোকে ঘৃণ্য, নারীবিদ্বেষী এবং অগ্রহণযোগ্য হিসাবেই বিবেচনা করবেন। কিন্তু তিনি তাঁর কাজের এই ধারা কখনওই বদলাননি, প্রচলিত সমাজের সঙ্গে সমাঝোতায় যাননি। তবে তাঁর এই একগুয়েমি কিংবা হার না মানা মনোভাবই তাঁকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। আর তার জোরেই তিনি তাঁর পথ চলা অব্যাহত রেখেছিলেন।

তাঁর চলচ্চিত্রগুলো কেন এত বিতর্কিত? আবার আমাদের কাছে তাঁর আবেদন কেন এত বেশি?

তাঁর চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলো কখনওই সুশীল নাগরিক নয়। আর এটা তিনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই নির্মাণ করেছেন। তাঁর চরিত্রগুলো সমাজের চোখে গ্রহণযোগ্য কোনও মর্যাদাপূর্ণ পেশায় যুক্ত নয়। তারা মূলত অবৈধ, অনৈতিক এবং বিবেকহীন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকে। তাদের অনেকেই সমাজচ্যুত, যাযাবর, গৃহহীন এবং নানা দুঃখ কষ্টের মধ্য দিয়ে যাপিত জীবনের অধিকারী। তারা সবাই লৌকিকতাবর্জিত এবং ঘৃণ্য জীবনের মধ্য থেকে জীবন-সংগ্রামে লিপ্ত। দর্শকদের এসব চরিত্রের গতিধারা চিহ্নিত করতে বেশ সময় লেগে যাবে, কিন্তু তারা কিমের আকর্ষণীয় গল্প বলার ঢঙে বিমোহিত হবেন। বিশেষ করে তাঁর ব্যাকগ্রাউন্ড ভিজ্যুয়ালাইজেশন তাঁকে একজন সামর্থ্যবান ভিজ্যুয়াল গল্পবলিয়ে হিসাবে উপস্থাপন করে। এই বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর শ্যুটিং লোকেশন নির্বাচনের অসাধারণ দক্ষতা। তিনি তাঁর জীবনে নিজের ঢাক নিজেই খুব একটা বাজাননি, কিন্তু তাঁর শক্তিশালী চলচ্চিত্রগুলো তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছে।

সিনেমার মতোই কিমের ব্যক্তিগত জীবনও বেশ খানিকটা বিতর্কিত ছিল। মি-টু আন্দোলনের সময় তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠে। এর মধ্যে কোরিয়ান তিনজন অভিনেতার কিমের বিরদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগের বিষয়টি বেশ ঝড় তুলেছিল। এর জন্য তাঁকে জরিমানাও গুণতে হয়। ঠিক একই সময়ে আধুনিক কোরিয়ান সিনেমার অনবদ্য নির্মাণ ‘স্প্রিং, সামার, অটোমন, উইন্টার…. অ্যান্ড স্প্রিং’ (২০০৩) তৈরি করে তিনি গোটা বিশ্বকেই তাক লাগিয়ে দেন। এই চলচ্চিত্রে তিনি একজন জ্যেষ্ঠ ভিক্ষুর অধীনে থাকা তরুণ ভিক্ষুর জীবনের বিভিন্ন ঋতুর গল্প তুলে ধরেন। কাহিনিতে এই তরুণের পরিপূর্ণ আলোকায়নের পথে অভিযাত্রার শাশ্বত চক্রকে মূর্ত করে তোলেন। পৃথিবীতে এরকম সার্থক আধ্যাত্মিক চলচ্চিত্র খুব বেশি একটা নির্মিত হয়নি। অবশ্য কিম কি দুক তার অন্য সিনেমাগুলোতে আধ্যাত্মিকতার ভিন্ন মাত্রাও দেখিয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি চলচ্চিত্র হল ‘পিয়েতা’ (২০১২), যে সিনেমাটি আবার ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার অর্জন করে। এ সিনেমায় একজন দুর্বৃত্ত চরিত্রের মুবস্টার সেইসব ব্যক্তিদের দেনা পুনরুদ্ধারের জন্য শিকার বানায়, যাদেরকে সে নিজেই ইচ্ছাকৃত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ববরণে বাধ্য করে এবং দুর্ঘটনায় তাদের ইন্স্যুরেন্সের টাকা নিজের পকেটস্থ করে। কিন্তু এরকম শিকারে পরিণত করতে গিয়ে সে এমন একজন নারীকে খুঁজে পায়, যে তার অনেক আগে হারিয়ে যাওয়া মাতা। এই নারী তাকে আতুর অবস্থায় পরিত্যাগ করে চলে যায়। এরই পরিণিতিতে আজ সে এরকম অসৎ পথে যেতে বাধ্য হয়েছে। এই সিনেমার মধ্য দিয়ে কিমের করুণাপূর্ণতার প্রতি মুগ্ধতার সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত প্রদর্শিত হয়। তার তিনটি সহিংস চলচ্চিত্র ‘দ্য আইসল’ (২০০০), ‘বাড গাই’ (২০০১) এবং ‘থ্রি আয়রন’ (২০০৪)-এর মধ্য দিয়ে কিম একটা ঘরানাকে অনুসরণ করেছেন। তিনি তাঁর সমসাময়িক মহান কোরিয়ান নির্মাতা পার্ক চ্যান-উকের মতোই তিনি জানতেন সহিংসতাকে কীভাবে ফুটিয়ে তুলতে হয়। আবার আরেকজন সমসাময়িক লি চ্যাঙ-ডংয়ের মতোই তিনি ক্রিশ্চিয়ানিটি এবং জীবনের আধ্যাত্মিকতার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। কিন্তু কিমের সিনেমাগুলো মূলত ক্ষয়িষ্ণু বৌদ্ধ মতবাদের একটি বিশেষ ধারার অদম্য বহিঃপ্রকাশ। এখানেই নিহিত কিমের স্বকীয়তা এবং অনন্যতা।

কিম কি দুকের সিনেমা সবসময়ই আপত্তিকর সম্পর্কের উপাখ্যান, তার ন্যারেটিভের বিশিষ্টতার প্রধান দিকই এটি। তাঁর সিনেমার গল্প দর্শককে অস্বস্তিতে ফেলবে, দর্শক তার সিনেমা দেখে মনে করবে চলমান বিশ্বের আসল জিনিসগুলোকে এমন একটা ছদ্ম-আবরণের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করবে, যাতে তাদের মনে হবে বিশ্বকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। কিন্তু খুব গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখলে বোঝা যাবে এ কাহিনিগুলো আসলে দ্রুত গতির বিশ্বায়িত পৃথিবীরই চিত্রায়ণ। সেই চিত্রায়ণগুলো অদম্য, কঠোর এবং যন্ত্রণাদায়ক বিশ্বেরই প্রতিমূর্তি।

কিমের সিনেমায় সবসময়ই উত্তেজক সম্পর্কগুলো প্রধান হয়ে উঠছে এবং যেন বীণায় তোলা এক চরম আবেগের রাগের ঝঙ্কার। তিনি তাদেরকেই প্রধান চরিত্র বানান, যারা প্রচলিত সমাজের আইন ভাঙতে অভ্যস্ত। তারা কখনও আদৃশ্য, কখনও আবার গ্যাংস্টার আবার কখনও পতিতা হওয়ার চেষ্টারত। তারা জীবন থেকে পালাতে যায়, কিন্তু সবসময়ে ফাঁদে আটকা পড়ে। এগুলো যেন কিম কি দুকের নিজের জীবনেরই গল্প। একদিকে কোরিয়াতে যেমন রোম-কম সিনেমা নির্মিত হচ্ছে, আবার অন্যদিকে অনেক কোরিয়ান থ্রিলার অথবা আ্যাকশন সিনেমা রয়েছে, বেশ কিছু বিতর্ক এড়ানো নির্বিষ আর্ট ফিল্মও রয়েছে। এসব ঘরানার মধ্যে কিম কি দুক তার নিজের একটি স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তার নিজস্ব ন্যারেটিভের মাধ্যমে একটি বাইনারি সৃষ্টি করেছিলেন। একদিকে তিনি তার বেশ কিছু সিনেমায় একই ধরনের একটি থিম তুলে ধরেছেন, যা দুইজন বিচ্ছিন্ন সম্পর্কের স্বতন্ত্র মানুষের কাছাকাছি আসার গল্পের বয়ান তৈরি করে। আরেকদিকে তারা নিজেরা নিজেদের প্রবোধ দিতে থাকে এবং তাদের এই সম্পর্কগুলো আবার নানা ধরনের অবমাননাকর জীবনের প্রতিচ্ছবি, যেটি বুঝতে এবং গ্রহণ করতে অনেক দর্শকের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে।

তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘ক্রোকোডাইল’ (১৯৯৬)-এ দেখা যায় একজন পুরুষ একজন আত্মহত্যার প্রচেষ্টারত নারীকে রক্ষা করে এবং তারা এক ধরনের অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। আবার ‘আইসল’ (২০০০)-এ বাকশক্তিহীন হি জিন এবং পলাতক হুয়ান শিকের মধ্যকার নিষিদ্ধ সম্পর্ক প্রত্যক্ষ করা যায়, পলাতক পুরুষ চরিত্রটি আবার বেশ চড়া মূল্য দিয়ে নারী চরিত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে। ‘বাড গাই’তেও একই ধারার কাহিনি, যেখানে একজন গ্যাংস্টার এক সুন্দরী তরুণীকে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করে, এতকিছুর পরেও সেই তরুণী সবকিছু সহ্য করে তার ওপর নির্যাতনকারী তরুণের সঙ্গে স্টকহোম সিনড্রমের (যার দ্বারা অপহৃত, তার সঙ্গেই বিশ্বাসের সম্পর্কে জড়ানো) মতো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। বো (২০০৬)-এ একই ধারার গল্প দেখা যায়। এ সিনেমায় কিম কি দুক বুদ্ধ মতবাদের ‘লোলিটা-এস্কো’র গল্প বিনির্মাণের চেষ্টা করেন এবং সেই প্রতীকি মূর্তিরই প্রতিফলন ঘটান।

আবার কিম কি দুকই এক ধরনের নির্মল এবং সুন্দর কাহিনির বয়ান তৈরি করেছেন (এখানে সহিংসতা খুবই কম দেখানো হয়েছে, তবে সেগুলো ব্যবহার করা হয়েছে আমাদের অপার্থিব চরিত্রের প্রতি সতর্ক করতে) ‘স্প্রিং, সামার, অটোমন, উইন্টার… অ্যান্ড স্প্রিং’-এর মতো সিনেমায়। এই চলচ্চিত্রে কিম নিজেও অভিনয় করেছেন। তাঁর সিনেমাগুলোকে তিনটি মোটা দাগের মাধ্যমে বিভক্ত করা যায়— অবৈধ বা নিষিদ্ধ কিংবা অসম সম্পর্ক, সহিংসতা এবং আধ্যাত্মিকতা।

সিয়ং-ইল জাংয়ের মতো একজন কোরিয়ান চলচ্চিত্রব্যক্তিত্ব কিমকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তিনি কেন উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে চলমান মতাদর্শগত বিতর্কের জটিলতাগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে তার চরিত্রগুলোকে উপস্থাপন করেন। কিম উত্তর দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি আসলে আধুনিক কোরিয়ান সমাজের মূল সমস্যাগুলো নিয়েই কাজ করতে চাই।’ পরে জাং নিজেই লিখেছেন যে অনেক তথাকথিত চলচ্চিত্র সমালোচক যারা নিজেদের বড় বুদ্ধিজীবী ভাবেন, কিন্তু তারা ভাবতে চান না যে কিমের ‘বাড গাই’ আসলে কোরিয়ান সমাজেরই এক ধরনের রূপক। তাই তো মাইউইঙ্গ-জ্যা কিমের মতো কোরিয়ান চলচ্চিত্রবোদ্ধারা কিম কি দুকের চলচ্চিত্রে কোরিয়ান সমাজের আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে জর্জরিত হওয়ার বিষয়টিকেই প্রধান করেছেন। আসলে কিম তার প্রায় সব চলচ্চিত্রেই কোরিয়ান সমাজের এই আত্মপরিচয়ের সমস্যাকেই উপজীব্য করতে চেয়েছেন।

কিম কি দুক শেষ জীবনের দিকে নানা বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে এবং তিনি ইন্ডাস্ট্রিতে এক ধরনের ব্রাত্যজনে পরিণত হয়েছিলেন। তার সৃষ্টিশীল নির্মাণও অনেক কমে আসছিল। তিনি তার চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলোর মতোই যাযাবরে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি কাজাখস্তানে বসে তার শেষ সিনেমা ‘ডিজলভ’ (২০১৯) নির্মাণ করেছিলেন। এরপরে লাটভিয়ায় বসাবাস করছিলেন এবং সেখানে স্থায়ী বসতি গড়ার জন্য ‘বিচ হাউস’ কেনার পরিকল্পনা করছিলেন। কিন্তু এরমধ্যে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয় তাকে।

এই অশান্ত বছরে আমরা অনেক মহান চরিত্রের অদম্য ব্যক্তিদের হারিয়েছি। কিম কি দুকের মৃত্যুতে কোরিয়ান সিনেমার এক অপূরণীয় ক্ষতি যেমন হয়েছে, তেমনি বিশ্বচলচ্চিত্র এ সময়ের একজন সৃষ্টিশীল নির্মাতাকে হারাল। তিনি কখনওই প্রচলিত নিয়মের তোয়াক্কা করতেন না, নিজেই নিজের নিয়মে চলতেন। তিনি সহিংসতাকে গীতিধর্মী করে তুলেছিলেন, তাঁর মতে প্রকৃত সম্পর্কগুলো আসলে অপ্রকৃত এবং তাঁর আধ্যাত্মিকতা সমস্ত ধরনের ডগমাটিক অ্যাপ্রোচকে আক্রমণ করেছিল। কিন্তু তিনি ত্রুটির ঊর্ধ্বে ছিলেন না। তাঁর কিছু যেমন ধারণ করাও যাবে, তেমনি কিছু আবার বর্জনও করা যাবে। আমাদের তাঁর এসব অর্জন এবং বর্জনকে নিয়েই বাঁচতে হবে।

 

তথ্যসূত্র:

  1. https://www.theguardian.com/film/2020/dec/11/kim-ki-duk-shock-violence-beauty-south-korea-director
  2. https://www.freepressjournal.in/entertainment/remembering-the-korean-maverick-kim-ki-duk
  3. http://www.tasteofcinema.com/2015/filmmaker-retrospective-the-contemptuous-cinema-of-kim-ki-duk/
  4. https://www.academia.edu/16310877/Identity_and_Otherness_in_the_Films_of_Kim_Kiduk
  5. https://www.academia.edu/29628675/Korean_post_new_wave_film_director_series_Kim_Ki_Duk
  6. https://www.sensesofcinema.com/2002/feature-articles/kim_ki-duk/
  7. https://www.france24.com/en/live-news/20201211-kim-ki-duk-controversial-master-of-cinematic-violence

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...