গেরুয়া ইতিহাস, গেরুয়া ভূগোল, গেরুয়া বিজ্ঞান আর গেরুয়া চিৎকারে বদলে যাচ্ছে আমার দেশ

শুভাশিস মৈত্র

 


সাংবাদিক, গদ্যকার, প্রাবন্ধিক

 

 

 

এই বছরটা, ২০২০ শেষ হল উত্তাল কৃষক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। বছরটা শুরুও হয়েছিল শাহিনবাগের সত্যাগ্রহ দিয়ে। যেখানে এই কৃষকদের মতোই, সংবিধান রক্ষায় হাজার হাজার মানুষ, যাদের বড় অংশ ছিল মহিলা এবং তরুণ, রাত জেগেছিলেন খোলা আকাশের নীচে, অধিকাররক্ষায়। শাহিনবাগ ব্যর্থ হয়নি। বরং, নতুন শিক্ষা দিয়েছে। শিখিয়েছে প্রতিবাদের ধরনের আধুনিকতা। আন্না হাজারের আন্দোলনের সঙ্গে এই আন্দোলনের বাহ্যিক মিল আছে, কিন্তু অন্তর্বস্তুর দিক থেকে অমিলই বেশি। কারণ সেই আন্দোলন ছিল মানুষের প্রতিবাদের মানসিকতাকে সুচতুরভাবে ক্ষমতার রাজনীতির স্বার্থে আড়াল থেকে ব্যবহার করা। শাহিনবাগ বা কৃষকদের প্রতিবাদ একেবারেই তা নয়। তার গায়ে নানা ছাপ দেগে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা সে কাজে সফল এখনও হয়নি।

২০২০-র সব চেয়ে খারাপ, সব চেয়ে লজ্জার ঘটনাগুলির যদি তালিকা তৈরি করতে হয়, প্রথমেই থাকবে হাথরসের ঘটনা এবং নাথুরাম গডসের নামে হিন্দুত্ববাদীদের জয়ধ্বনি। দলিত লেখক কাঞ্চা ইলাইহা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ লিখেছেন, যেহেতু গণধর্ষণে অভিযুক্তরা এবং উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী একই ‘কাস্ট’, তাই পুলিশ দোষীদের বাঁচাতে উন্মাদের মতো আচরণ করেছে। বাড়ির লোককে না-জানিয়ে গভীর রাতে ১৯ বছরের ওই দলিত তরুণীর মৃতদেহ পুড়িয়ে দিয়েছিল পুলিশ, যা কার্যত প্রমাণ লোপাটের চেষ্টার সামিল।

নতুন করে গডসের উত্থানও হয়েছে এই ২০২০তেই। গত ২ অক্টোবর, গান্ধিজয়ন্তীতে টুইটার ট্রেন্ডিংয়ে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির সঙ্গে এক সারিতে উঠে এসেছিল তাঁর হত্যাকারী, নাথুরাম গডসের নাম। টুইটারে নাথুরামের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে টুইটের বন্যা শুরু হয়। ভোর ৫টা থেকে নাথুরাম গডসে জিন্দাবাদ হ্যাশট্যাগে ক্রমাগত টুইট শুরু। দুপুরের মধ্যেই টুইটের সংখ্যা আশি হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ না-দেওয়ার কারণে এবং গান্ধিহত্যার পর দেশব্যাপী কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল হিন্দুত্ববাদীরা। এতদিন এই দেশে গডসে জিন্দাবাদ বলতে ভয় পেত হিন্দুত্ববাদীরা। এখন লোকসভা ভোটে তাদের আসন বেড়েছে, ফলে সাহস বেড়েছে। এ সব কথা তাঁরা প্রকাশ্যে বলার সাহস পাচ্ছেন। ভারতে এখন মোট ভোটার ৮৯ কোটি ৭৮ লক্ষ। এর ভেতর বিজেপি গত লোকসভা নির্বাচনে মোট ভোট পেয়েছে ২২ কোটি ৯০ লক্ষ। মোট ভোটারের ২৫ শতাংশ আর মোট বৈধ ভোটের হিসেবে ৩৬ শতাংশ। তাতেই এই দাপট। যেদিন এই সংখ্যাটা ৫০ শতাংশে পৌঁছবে, সেদিন এঁরা হয়তো রাস্তার মোড়ে মোড়ে গডসের মূর্তি বসাবেন, নতুন নতুন জায়গার নাম হবে গডসে নগর, গডসে পার্ক, গডসে ময়দান, গডসেসদন। বাড়িতে শিশুর জন্ম হলে বাপমায়েরা আদর করে নাম রাখবেন নাথুরাম। ১৯৪৮ সাল থেকে হিন্দুত্ববাদীরা ক্রমাগত ওই হাঁটুর ওপর কাপড় পরা লাঠি হাতে লোকটাকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। কারণ তারা চায়, রামের নামে হিংসা হোক কিন্তু কেউ যেন ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’ আর না-গায়। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের বিজেপি-প্রার্থী, সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মে অভিযুক্ত, সাধ্বী প্রজ্ঞা গডসেকে দেশপ্রেমিক বলায়, কোনও দিন তাঁকে মন থেকে ক্ষমা করতে পারবেন না, বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পরবর্তীকালে দেখা গেল বিজেপিতে, সংসদে প্রজ্ঞার গুরুত্ব বাড়ল। প্রজ্ঞাকে কোনও শাস্তিও দেওয়া হয়নি, তিনি এখনও হিন্দুত্ববাদীদের নয়নের মণি। অথচ গান্ধিকে সারা পৃথিবী কী চোখে দেখে, তার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল ঘোষ ১৯৫৩ সালে একবার প্রিন্সটনে গিয়েছিলেন বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করতে। আত্মজীবনীতে প্রফুল্ল ঘোষ লিখেছেন, “তাঁর ঘরে দেখলাম মহাত্মাজির ছবি। আইনস্টাইন আমাকে বললেন, তিনি (গান্ধি) এ যুগের শ্রেষ্ঠ মানুষ।”

এই যে প্রশ্নমুক্ত হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক বাহিনী, এদের সম্পর্কে আমাদের বহু দিন আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন বাবাসাহেব অম্বেডকর। আমরা গুরুত্ব দিইনি। কী বলেছিলেন বাবাসাহেব? ‘কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি’, যার অধীনে রচিত হয়েছিল আমাদের সংবিধান, সেই কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির শেষ দিনে, ১৯৪৯ সালের ২৫ নভেম্বর বাবাসাহেব বলেছিলেন, ‘একটা চিন্তা আমার মনে আসছে! ভারতের এই গণতান্ত্রিক সংবিধানের ভবিষ্যৎ কী হবে? দেশ কি পারবে তাকে রক্ষা করতে, না কি সে পেয়েও তাকে হারিয়ে ফেলবে? অতীতেও বার বার দেখা গিয়েছে ভারতের ভিতরের কোনও শক্তির সহায়তায়ই বাইরের শক্তি ভারতের স্বাধীনতা হরণ করেছে। অম্বেডকর যা বলেছিলেন, তার অর্থ হল, তিনি ভয় পাচ্ছেন, ভারতেও এত রকমের রাজনৈতিক সংগঠন আছে, যাদের বিশ্বাস, ধারণা গণতন্ত্রের ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। এই যে গণতন্ত্রের বিপরীতমুখী বিশ্বাস, বা তাদের ধর্মবিশ্বাস, সেগুলোকে তারা দেশের আগে স্থান দেবে, না দেশ পরে, তাদের বিশ্বাস আগে হবে? যদি ভবিষ্যতে কোনও পরিস্থিতিতে দেশের আগে তারা তাদের বিশ্বাসকে স্থান দেয়, তাহলে তারা একনায়কতন্ত্রকেই রাস্তা করে দেবে। ভারতের সংবিধান হেরে যাবে।

অম্বেডকর সেদিন বলেছিলেন, কোনও তথাকথিত মহান নেতার পায়ের কাছে যেন কেউ নিজের স্বাধীনতাবোধকে সমর্পণ না-করে। মহান নেতার প্রতি অনুগত হও, কিন্তু সেই আনুগত্যের সীমা যেন থাকে। এরপর অম্বেডকর বলেছিলেন, ভারতে ভক্তি, বীরপূজার একটা সংস্কৃতি আছে। ধর্মে ভক্তি নিয়ে কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু রাজনীতিতে ভক্তি, বীরপূজা একনায়কতন্ত্রকে ডেকে আনে। বাবাসাহেব যে আশঙ্কা করেছিলেন, আমরা কি সেদিকেই এগোচ্ছি?

২০২০-র আরেকটি কলঙ্ক দিল্লির দাঙ্গা। দিল্লিতে যারা দাঙ্গা করিয়েছে তারা কারা, আমরা জানি। কিন্তু যারা দাঙ্গা করল? খুনোখুনি করল, পেট্রোল বোমা ছুড়ল, ছুরি-চাকু-তরোয়াল চালাল, আগুন লাগাল তারা কারা? তাদেরও আমরা চিনি। আমাদেরই মতো লোকজনের পরিবার থেকে এসেছে তারা। দিল্লির এক সাংবাদিক বন্ধু বললেন, যতটুকু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই ঘাতক বাহিনীর বড় অংশই বেশ গরিব ঘরের ছেলে। লেখাপড়া বেশি দূর হয়নি। যদিও বা হয়েছে, শিক্ষা বলতে যা বোঝায় তা পায়নি। বেশ কিছু শিক্ষা-সংক্রান্ত রিপোর্ট বলছে, দেশের  স্কুলকলেজের একটা বড় অংশের মান ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে। ৯০ শতাংশের বেশি কলেজের শিক্ষার হাল নিম্নমানের। পড়ুয়ারা কিছু শিখছে না। ক্লাস ওয়ানে ১০ জন ভর্তি হলে ৩-৪ জন গিয়ে পৌঁছচ্ছে মাধ্যমিক স্তরে। কোটি কোটি ড্রপআউট তৈরি হচ্ছে প্রতি বছর। চাকরির বাজার খারাপ। কোনও স্কিল নেই। কোথায় যাবে এই কোটি কোটি কমবয়সীরা? চাকরি নেই। যে যেখানে সুযোগ পাচ্ছে, রাজনৈতিক দলের বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে। কারণ রাজনৈতিক দলগুলিই সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়ে উঠেছে এখন। যে রাজনৈতিক দল যেমন, তারা এই বিরাট শক্তিকে তাদের নিজেদের মতো করে ব্যবহার করছে। ক্ষমতায় থাকার সুযোগে হিন্দুত্ববাদীরাই এই কাজে সবার চেয়ে এগিয়ে। আর তাদের বাহিনী মূলত হোয়াটসঅ্যাপ থেকেই জানতে পারছে গেরুয়া ইতিহাস, গেরুয়া ভূগোল, গেরুয়া বিজ্ঞান আর সংখ্যলঘু-বিদ্বেষ। সকাল থেকে রাত অবধি এই ক্লাস চলে। শেখানো হয় খুনের পক্ষে যুক্তি। এখানেই অতীতের দাঙ্গার সঙ্গে আজকের দাঙ্গার ফারাক। আজকের দাঙ্গা অনেক বেশি সুপরিকল্পিত।

তাহলে কি সবই অন্ধকার? না, তা কিন্তু নয়। অসংখ্য মণি-মুক্তোও উঠে এসেছে পুড়ে যাওয়া আহত দিল্লির বুক থেকে। শুধু বিদ্বেষের গল্প নয়। দাঙ্গা থেকে একে অন্যেকে বাঁচাতে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কীভাবে কে কোথায় কাজ করেছেন, কীভাবে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখে কেউ দাঙ্গাকারীদের হাত থেকে প্রতিবেশী, বন্ধু, অপরিচিত অতিথিকে সুরক্ষিত রেখে প্রাণ বাঁচিয়েছেন, তার অসংখ্য কাহিনী পরে আমরা শুনেছি। রবি পরাশর। এই নামের একজন লোক ভারতের যে কোনও রাজ্যে যে কোনও গ্রামে বা শহরে থাকতে পারে, এমনই সাধারণ একটা নাম। ২৫ ফেব্রুয়ারি দিল্লির কারওয়াল নগরে দাঙ্গাকারীরা একটি প্রাচীন মসজিদের উপর হনুমানের মূর্তি রেখে গেরুয়া পতাকা তুলে দিয়েছিল। যেভাবে এলকে আদবানি, মুরলি মনোহর জোশিদের উপস্থিতিতে ১৯৯২ সালে ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদের উপর ভাঙার আগে গেরুয়া পতাকা তুলে দেওয়া হয়েছিল। আদবানি-জোশিরা অবশ্য সেই পতাকা নামানোর চেষ্টা না-করে ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। সে যাই হোক। কথা হচ্ছিল রবি পরাশরকে নিয়ে। রবি পরাশরের বয়স ৩০। দুই সন্তানের পিতা। ঘড়ির ব্যবসা করেন। দাঙ্গাবিধ্বস্ত দিল্লির কারওয়াল নগরের মুসলিম মহল্লায় ‘হিন্দু’ রবি গিয়েছিলেন ভাইয়ের খোঁজ নিতে। সেখানে দেখলেন, এক বৃদ্ধ মৌলবি হাত জোড় করে সবাইকে বলছেন তাঁকে একটু সাহায্য করতে, যাতে তিনি মসজিদের মাথা থেকে হনুমানের মূর্তি আর গেরুয়া পতাকা নামাতে পারেন। স্থানীয় কেউই, সম্ভবত ভয়ে, তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসছে না দেখে এগিয়ে গেলেন রবি পরাশর। নামিয়ে দিলেন হনুমান মূর্তি এবং গেরুয়া পতাকা। তার পর চলেও গেলেন ঘটনাস্থল থেকে। না, কোনও ফোননম্বরও রেখে যাননি। সাংবাদিকদের এই কথা জানিয়েছেন আল্লাওয়ালি মসজিদিন নামের ওই মসজিদের সঙ্গে যুক্ত এক মৌলবি। মহাভারতের আদিপর্বে এক মহাপণ্ডিত পরাশরের কথা আছে। যিনি ছিলেন মহর্ষি বশিষ্ঠের পৌত্র। তিনি একবার রাক্ষসবংশ ধ্বংসের জন্য রাক্ষস-সত্র যজ্ঞ করেছিলেন। রবি পরাশরের কথা জেনে মনে পড়ে গেল সেই মুনি পরাশরের কথা। রবি পরাশরও তো যা করলেন তা আসলে আজকের রাক্ষসদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই।

২০২০ আমাদের মনে থাকবে আর একটি কারণে। সেটা হল স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য বুদ্ধিজীবীদের গ্রেফতার। জরুরি অবস্থার পর এমন ঘটনা আর কখনও ঘটেনি। এনআইএ এখন বিরোধী মত স্তব্ধ করার প্রধান হাতিয়ার। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিরুদ্ধমত চাপা দিতে আনা হচ্ছে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ। ২০২০ আরও যে কারণে ইতিহাসে থেকে যাবে, সেটা হল, দেশের সর্বোচ্চ আদালত এত বেশি প্রকাশ্য সমালোচনার মুখে অতীতে কখনও পড়েনি। সুপ্রিম কোর্টকে এইভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো, ২০২০তেই ভারতবাসী প্রথম দেখল।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত ২২ ডিসেম্বর আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির শতবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভিডিও বক্তৃতায় বলেছেন, ভারত যে পথে এগোচ্ছে, সেই উন্নয়নের পথে সবাই একসঙ্গে এগোবে, ধর্মের কারণে একজনও পিছনে পড়ে থাকবে না। বোঝাই যাচ্ছে তিনি মুসলিমদের উদ্দেশে কথাটা বলেছেন। এবং খুবই আশাব্যঞ্জক কথা। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএএ নিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ডাঃ কাফিল খানকে এনআইএ আইনে গ্রেফতার করা হয়, যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী স্বাস্থ্য-শিক্ষার চেয়েও লাভজিহাদকে দেশের বড় সমস্যা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী নিজে এবং তাঁর দল যখন শুধুমাত্র সংখ্যার জোরে দেশের কয়েক কোটি কৃষকের আদালতে মামলা করার ‘ফান্ডামেন্টাল রাইট’ কেড়ে নিয়ে কার্যত গায়ের জোরে রাজ্যসভায় কৃষিবিল পাস করিয়ে নেন, এইরকম এক সময়ে, উত্তরপ্রদেশের শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্যশালী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে, প্রধানমন্ত্রীর এইসব কথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আদর্শ নিয়ে মতভেদ থাকাটা স্বাভাবিক, কিন্তু যখন জাতীয় লক্ষ্যপূরণের প্রশ্ন সামনে আসবে, তখন সব মতভেদ দূরে সরিয়ে রাখা বাঞ্ছনীয়। তিনি বলেন, একটি দেশের উন্নয়নকে রাজনীতির রং দিয়ে বিচার করা উচিত নয়। এখানে অবশ্য স্পষ্ট নয় প্রধানমন্ত্রী সিএএ-কেও উন্নয়ন বলে ভাবছেন কি না! বা তিনি যখন বলেন, আন্দোলনকারীদের পোশাক দেখে চিনতে, তখন সেই মন্তব্যকে কোন উন্নয়নের আলোয় দেখতে হবে তা-ও স্পষ্ট নয় এই কথায়।

কিন্তু আরও কিছু কথা আছে এই নিয়ে। ঠিক সাড়ে ছ বছর আগে নরেন্দ্র মোদি, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর ১৫ আগস্টের ভাষণে লালকেল্লা থেকে প্রায় এমনই একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। কী বলেছিলেন? শুনুন। ২০১৪ সালের ১৫ অগস্ট লালকেল্লা থেকে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ‘আমার প্রিয় ভাই-বোনেরা, নানা কারণে দীর্ঘ বছের ধরে আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পরিবেশ রয়েছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পরেও জাত-পাতের বিষ, সাম্প্রদায়িকতার বিষ থেকে আমরা মুক্তি পাইনি। কিন্তু সময় এসেছে এখন প্রশ্ন করার, এই জিনিস আর কত দিন চলবে? এর থেকে কার উপকার হয়? অনেক হয়েছে। অনেক প্রাণ ভেসে গেছে। প্রিয় দেশবাসী, পিছনে ফিরে একবার তাকিয়ে দেখুন, এর থেকে কারও ভালো হয়নি। শুধু আমাদের প্রিয় জন্মভূমির মুখে কালি লেগেছে। এত দিন এসব বন্ধ করার জন্য আমরা কিছুই করিনি। তাই আজ এই স্বাধীনতা দিবসে আমি দেশবাসীর কাছে করজোড়ে আবেদন করছি, জাত-পাতের বিষ, সাম্প্রদায়িকতার বিষ, আঞ্চলিকতার বিদ্বেষ, সামাজিক, অর্থনৈতিক বিভাজন, যা আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রধান বাধা, আসুন আজ আমরা অন্তর থেকে বলে উঠি, আগামী ১০ বছরের জন্য আমরা এসব ভুলে যাই, এইভাবেই আমরা একসঙ্গে এগিয়ে যেতে চাই এক নতুন সমাজ গড়ার দিকে। তখনই আপনারা দেখবেন, শান্তি, সদিচ্ছা, ঐক্যের কী প্রচণ্ড শক্তি। প্রিয় দেশবাসী, আমার কথায় আস্থা রাখুন। আমি কথা দিচ্ছি, এতদিন যে পাপ হয়েছে, সব ভুলে গিয়ে, মুছে ফেলে এগিয়ে চলুন। সদিচ্ছা আর ঐক্যের শক্তিতে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব। আমি বিশ্বাস করি আমরা পারব।’

তার পর কী হল? এক বছর না-পেরোতেই শুরু হল দেশের বিভিন্ন জায়গায় মব লিঞ্চিং, সংখ্যালঘুদের খুন করা। এই সব খুনের ঘটনায় বার বার বিজেপি সমর্থক হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নাম উঠে এসেছে। ২০১৫র ২৮ সেপ্টেম্বরে উত্তরপ্রদেশে বাড়ি থেকে বের করে দল বেঁধে পিটিয়ে খুন করল মহম্মদ আখলাককে। যারা মারল তারা নাকি গোরক্ষক বাহিনী। আখলাকের দোষ, ওর বাড়িতে নাকি গরুর মাংস রাখা আছে ফ্রিজে। যদিও তা প্রমাণ করা যায়নি। প্রধানমন্ত্রী, যিনি ১০ বছরের জন্য সবাইকে হিংসা থেকে দূরে থাকতে বললেন ২০১৪-র ১৫ অগস্ট। তাঁর সমর্থকদের এই কাজে তিনি কিন্তু নীরব থাকলেন। এই ঘটনার প্রায় এক বছর পরে আখলাক খুনে গ্রেফতার হওয়া ১৮ জনের মধ্যে রবি সিসোদিয়া নামে এক অভিযুক্ত জেলের ভিতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে ভর্তি করার পর তিনি মারা যান। সেই সময়ে নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভার সদস্য বিজেপি মন্ত্রী মহেশ শর্মা সেখানে যান, হত্যায় অভিযুক্ত ওই ব্যক্তির মরদেহে ফুল দিয়ে প্রণাম করেন। এই সংক্রান্ত ছবি দিয়ে একটি টুইটও করেন বিজেপির ওই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। মহেশ শর্মাকে আখলাক খুনে নিন্দা করে কোনও মন্তব্য করতে দেখা যায়নি। কিন্তু খুনে অভিযুক্তের পাশে তাঁকে দেখা গেল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তা নিয়েও নীরব থাকলেন। খুনে অভিযুক্ত ওই রবি সিসোদিয়ার মরদেহ জাতীয় পতাকায় ঢেকে তাকে সম্মান জানানো হল। শহিদ বলা হল তাকে। সেই খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হল। নরেন্দ্র মোদি তা নিয়েও কোনও মন্তব্য করলেন না। গোরক্ষক নামের ওই ‘লিঞ্চিং-মব’ সাহস পেয়ে গেল। এর পর টানা কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে একের পর এক ঘটতে থাকল পিটিয়ে সংখ্যালঘু হত্যার ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী যে আবেদন ২০১৪ সালের ১৫ অগস্ট করেছিলেন, সেই আবেদন আরও একবার করলে হয়তো কিছু মৃত্যু ঠেকানো যেত। কিন্তু তা তিনি করেননি। প্রধানমন্ত্রীর ছবি দিয়ে নানা সাফল্যের কথা লিখে সারা দেশের প্রায় সব সংবাদপত্রে, টেলিভিশনে নিয়মিত বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর ওই আবেদন বিজ্ঞাপন হিসেবে দিলেও মানুষকে ফের মনে করিয়ে দেওয়া হত সে কথাগুলো। সে কাজও প্রধানমন্ত্রীর দফতর করেনি।

দিল্লিতে দাঙ্গা হল। দিল্লি সরকারের সংখ্যালঘু কমিশনের তথ্যানুসন্ধান রিপোর্টে বলা হল, ফেব্রুয়ারি মাসে দিল্লির দাঙ্গায় সংখ্যালঘুদের উপর পরিকল্পিত আক্রমণে পুলিশ কার্যত আক্রমণকারী দুষ্কৃতীদের সঙ্গীর ভূমিকা পালন করেছিল। সেই রিপোর্টে আরও বলা হল, গত ২৩ ফেব্রুয়ারি, বিকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ উত্তর-পূর্ব দিল্লির মৌজপুর এলাকায়, জনৈক বিজেপি নেতার প্ররোচনামূলক বক্তব্যের পরেই পুরো এলাকা জুড়ে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর ওপর হামলা ছড়িয়ে পড়ে। এই তাণ্ডব ২৩ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলেছিল। এই ঘটনাতেও প্রধানমন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাননি। তিনি তাঁর ২০১৪ সালের আবেদনের কথা দেশবাসীকে মনে করিয়ে দেননি।

ফলে আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির শতবর্ষে প্রধানমন্ত্রীর ভাযণের পরেওপুরোনো আভিজ্ঞতার ভয় আমাদের পিছু ছাড়ছে না। আমরা সতর্ক থাকব। মিলিয়ে নেব, প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দল কোন রাজনীতিহীন উন্নয়নের দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে তুলে ধরেন আগামী দিনে!

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...