রামায়ণী কথার ফাঁকে লুকিয়ে যে কথা

মাধবী মেনন

 


সাংবাদিক ও রাজ্যসভার সদস্য এম জে আকবরের বিরুদ্ধে প্রিয়া রামানি-র যৌন হয়রানির মামলায় বিচারপতি তাঁর রায়ে রামায়ণের কাহিনি উল্লেখ করেছেন। সেই নিয়েই ‘স্ক্রোল’ নিউজ পোর্টালে গত ২১ ফেব্রুয়ারি মাধবী মেননের এই নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়। বাংলায় অনুবাদ করেছেন সত্যব্রত ঘোষ।

 

 

 

মোবাসর জাভেদ আকবর বনাম প্রিয়া রামানি মামলায় যে রায় দেওয়া হয়েছে আইনগত দিক থেকে তা সঙ্গত এবং প্রগতিশীলও বটে। যৌন হয়রানি নিয়ে জনসমক্ষে কথা বলা নিয়ে মহিলাদের পক্ষে রুলিং দিয়ে আদালত স্পষ্ট বার্তা পাঠিয়েছে যে আমরা মহিলাদের প্রতি অযাচিত যৌন আকর্ষণ সহ্য করব না।

আরও বলা হয়েছে যে এই বিষয়ে সামাজিক মাধ্যমগুলিতে যে পাবলিক পোস্ট করা হয়, তা যেন জনসাধারণের মঙ্গলকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অর্থাৎ, যৌন হয়রানি সংক্রান্ত প্রশ্নগুলিকে আদালত জনসমক্ষে আলোচনার যোগ্য মনে করেছে। এবং সামাজিক প্রতিপত্তি থাকলেই যে আরোপিত ব্যক্তির শাস্তি হবে না— এমন একটি ধারণা খণ্ডন করে আদালত স্বীকার করে নিয়েছে যে যৌন শিকারীরা আপাত খ্যাতির আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে। খুব ভালো কথা।

তবে আইনগত সঙ্গতি এবং সমাজ বিষয়ে সচেতনতা থাকলেও রায়টি কিন্তু যৌনতা এবং রাজনৈতিক দিক থেকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। আরও স্পষ্টভাবে বললে, যৌনতা এবং রাষ্ট্রীয়বাদ বিষয়ে রায়টিতে যে মানসিকতা ফুটে উঠেছে, তা আমাদের চিন্তা বাড়ায় বই কি।

 

সীতার বিচার

৯১ পাতার এই রায়ে মূলত বাদী ও বিবাদী পক্ষের যুক্তি ও পাল্টা যুক্তিগুলিকে তুলে ধরা হয়েছে। বিচারপতি রবীন্দ্র কুমার পাণ্ডের রায়টি শেষের মাত্র সাড়ে ছয়টি পৃষ্ঠায় লেখা। এই পৃষ্ঠাগুলিতে উনি মূলত দুটি বিষয়ে বলেছেন। এক, যৌন হয়রানির শিকার হলে মহিলাদের লজ্জিত হওয়া নিয়ে (রায়ে যা ‘লজ্জা’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে) এবং দুই, ইতিহাসে ভারত মহিলাদের কী চোখে দেখেছে।

দুটি বিষয়েরই অবতারণা করা হয়েছে এই বাক্যটি দিয়ে: “ইহা অতীব লজ্জাজনক যে নারীদিগের বিরুদ্ধে অপরাধ এবং হিংস্রতার ঘটনা সমগ্র দেশে ঘটিয়া চলিতেছে যেখানে মহাভারত ও রামায়ণের মতো বৃহৎ মহাকাব্য দুইটি রচিত হইয়াছে যা নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বিষয়ে কেন্দ্রীভূত।”

মাননীয় বিচারপতি যে ‘নারীর প্রতি সম্মান’-কে রামায়ণের একটি অন্যতম কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তা চমকপ্রদ। তিনি কি ভুলে গেলেন যে এই মহাকাব্যেই সীতাকে পরিত্যাগ করা হয়েছিল— এই রায় অনুযায়ী ‘লজ্জা’ ধারণ করবার অপরাধে? এই মহাকাব্যেই কি সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে প্রমাণ করতে হয়নি যে সে ‘সতী’? এই মহাকাব্যেই কি অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পরেও সীতাকে পরিত্যাগ করা হয়নি, যার দ্বারা অযোধ্যার মানুষদের তাকে নিয়ে ভয়ার্ত কল্পনাগুলিকে নিবৃত্ত করা যায়? অথচ রায়টিতে এই মহাকাব্যেরই জয়ধ্বনি তোলা হয়েছে ‘নারীর প্রতি সম্মান’ প্রদর্শন করার জন্য? কোন দুনিয়ায় বাস করছি আমরা!

হায়রে, আমরা বাস করছি এই দুনিয়াতেই। রামায়ণের যে দুটি গল্প বিচারপতি তাঁর রায়ে উল্লেখ করেছেন তার একটি বাল্মীকি রামায়ণে বর্ণিত সীতার প্রতি লক্ষণের মনোভাব নিয়ে। লক্ষণকে যখন সীতার রূপ নিয়ে প্রশ্ন করা হয় তখন সে জানায় ভ্রাতৃবধূর পদযুগলের উপরে তার নজর কখনও যায়নি। এই সেই কাহিনি যেখানে নারীর যৌনতাকে বৈবাহিক বিষমকামিতার শক্ত চকচকে বৃত্তে আটকে রাখা হয়, যা অতিক্রম করলেই সমাজ থেকে তাকে নির্বাসিত করা হবে এবং সম্ভাব্য মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হবে। আর এই কাহিনিকেই বিচারপতি পাণ্ডে নারীর প্রতি ভারতীয়দের সম্মানের ঐতিহাসিক নজির হিসেবে তুলে ধরেছেন।

এই ধরনের সাংস্কৃতিক বংশপরম্পরা দুটি কাজ করতে পারে। প্রথমত, বৈবাহিক বিষমকামিতার বাইরে যৌনতাকে অথবা যৌন আকাঙ্খার প্রতি ভ্রূকুটিতে বাধ্য করা হয়— লক্ষণ ও সীতার ক্ষেত্রে যা হয়েছে। ভয়ার্ত এই মানসিকতার ভার অসম পরিমাণে বেশি নারীদেরই বহন করতে হয়। তার জন্যেই আমরা এই ‘লজ্জা’ বিষয়ে অভিজ্ঞ হয়ে উঠি।

সীতার পদযুগলের উপরে লক্ষণের নজর ওঠে না। বিচারপতির রায় অনুযায়ী, এই আচরণকে আমরা ‘নারীর প্রতি সম্মান’-এর চিহ্ন হিসেবে দেখতে হবে। কিন্তু লক্ষণই যে আবার সীতার চারপাশে গণ্ডি টেনে সীতাকে পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণে আটকে রাখতে চায়। আমাদের অধিকাংশের কাছেই এই গণ্ডিটি যৌনতা, বিশেষ করে নারীদের প্রতি আইনের পিতৃসুলভ মানসিকতাই বর্ণনা করে। নারীদের কী চাওয়া উচিৎ আর কী নয় সেই বিষয়ে এবার থেকে পুরুষদের পরামর্শ দেওয়া বন্ধ করার সময় হয়েছে।

 

নিরাপত্তার শীতলতা

রামায়ণে যে পিতৃতান্ত্রিক ছাঁচে সীতার গল্প রচিত হয়েছে সেই ছাঁচ আজকের ভারতীয় নারীদের শুধু নিরাপত্তার শীতলতাটুকুই দেয়। মামলার এই রায়ে ক্ষমতাবান এক পুরুষকে নিবৃত্ত করা হচ্ছে যেন সে এক নারীকে হুমকি না দেয়। অন্তত তাই, এই মামলার রায়টিকে উদযাপন করা উচিত। কিন্তু পরিবর্তে বিচারপতি তাঁর রায় দেওয়ার জন্যে ভারতীয় পুরাণের অন্যতম একটি যৌন-সম্বন্ধীয় বিষাক্ত ঘটনার উল্লেখ করেছেন। আইন-বিশেষজ্ঞ রত্না কাপুরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী সাধারণভাবে যৌন হয়রানি সংক্রান্ত আইনগুলিতে যে গোঁড়া ছাঁচটি বজায় রাখা হয়, তাতে অবধারিতভাবে যৌনতা যত বেশি উন্মোচিত হয়, হয়রানি ততটা হয় না। অন্যভাবে বললে, এই আইনগুলিতে অপব্যবহারের দিকগুলিকে না আটকিয়ে মাধ্যমে আকাঙ্খার প্রতি অসম নজরদারি চালানো হয়।

দ্বিতীয়ত, বিচারপতি পাণ্ডে তাঁর রায়ে মহাকাব্য থেকে যে উদাহরণগুলি ব্যবহার করেছেন, সেগুলি একটি একচেটিয়া হিন্দু রাষ্ট্রের চিহ্নায়ণ। এবং যেখানে হিন্দুত্বের দ্বারা শুদ্ধিকৃত কোনও কাজই অন্যায় নয়। তাঁর এই মহাকাব্যের পাঠের মধ্যে দিয়ে এমনকি নারীবিদ্বেষও পরম মহিমায় রূপান্তরিত হয়। তাই আমরা বাধ্য হয়ে প্রশ্ন করি, মামলার এই রায়ে কি নারীবাদের জয় সাব্যস্ত হয়েছে, নাকি সাম্পদায়িকতার দিকে আরও এক পা এগিয়ে যাওয়া গেছে? উল্লেখ্য, বাদী তো এখানে মুসলমান এক পুরুষই।

আমার এক বন্ধু তো মন্তব্যই করল, প্রিয়া রামানি কি এই কারণে জিতলেন যে তাঁর দাবি ন্যায্য ছিল, নাকি এই কারণে যে তাঁকে একজন মুসলমানের সঙ্গে লড়তে হয়েছে? যতই হোক, মুসলমান পুরুষদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করবার দায়বদ্ধতা তো রাষ্ট্র বারবার দেখিয়েছে। অপরাধীকরণের দুইটি উদাহরণ হিসেবে সরকারের আনা ২০১৯-এর মুসলমান নারী (বিবাহ সংক্রান্ত অধিকার রক্ষা) আইন এবং ‘লাভ জেহাদ’ নিয়ে তৎপরতার কথা বলাই যায়।

সেক্স ফোবিয়া বা যৌনভীতির প্রতি পিতৃতান্ত্রিকতার যে ছাঁচ এই মামলার রায়ে বর্তমান, তা সাম্প্রদায়িকও। দক্ষিণ-পন্থী ভারতের এটি পরিচিত প্রবণতা, যেখানে পিতৃতন্ত্র এবং সাম্প্রদায়িকতাকে বিস্তৃত উপায়ে উৎসাহ দেওয়া হয়। তবে এটা কি পরিহাস নয় যে, এই মামলার বাদী বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভার একজন সদস্য ছিলেন?

শেষে একটা কথাই বলার আছে। এই রায়ে অনেক কিছু ঘটাবার পাশাপাশি আরেকটি ব্যাপারও ঘটেছে। সামাজিক এবং পেশাদারি সম্মানের সঙ্গে যৌন আচরণের সমীকরণ ঘটিয়ে সমস্যাকে আরও ঘোঁট পাকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনটা নয় যে শুধুমাত্র দরিদ্র পুরুষরাই যৌন শিকার খোঁজে। বাস্তব তো সম্পূর্ণ তার বিপরীত। এবং ‘নাক্ষত্রিক খ্যাতি’ কোনও ভাবেই কোনও কিছুর গ্যারান্টি হতে পারে না। সেদিক থেকে এই রায় এমন একটি দেশ ও আইন জগতে স্বাগত, যেখানে শ্রেণিবিন্যাসকে তীব্রভাবে মেনে চলার ফলে নানান স্তর জমাট বেঁধেছে এবং অবধারিতভাবেই নারীদের স্থান সেই স্তরগুলির একেবারে নীচে।

প্রিয়া রামানির পক্ষে রায়দানের মাত্র দুই দিন পরেই প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে আনা যৌন হয়রানির অভিযোগের তদন্ত স্থগিত করবার নির্দেশ দেয় ভারতের শীর্ষ আদালত। সেই সময়ে প্রধান বিচারপতি স্বয়ং নিজের শুনানিতে সভাপতিত্ব করছেন, অভিযোগকারিণীকে সেই শুনানিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি এবং তিনি নিজেকে নির্দোষ সাব্যস্ত করছেন। এই ঘটনাটিকে আমরা কেমনভাবে ব্যাখা করব? এখন তিনি ভারতীয় জনতা পার্টির থেকে নির্বাচিত রাজ্যসভার এক সদস্য। স্পষ্টতই, এই দেশে কিছু সমিতি এবং নীতিসমূহ অন্যগুলির তুলনায় বেশিই পরিহার্য হয়ে যায়।

নারীবাদী হিসেবে আমরা রামানি মামলার রায়কে স্বাগত জানাই। কিন্তু রাষ্ট্রের পিতৃতান্ত্রিক এবং সাম্প্রদায়িক অ্যাজেন্ডার সাঁড়াশিতে আটকা পড়া মানুষরা যখন ছটফট করছে, তখন আমাদেরও যথেষ্ট সতর্ক থাকাটাই শ্রেয়।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...