ইন্দ্রজিৎ ঘোষ
মাইকেল কৃষ্ণকান্ত খান
মাইকেল কৃষ্ণকান্ত খান, সংক্ষেপে মাখা, একজন মানুষ। সপ্তাহের দুদিন তিনি হিন্দু হয়ে কাটান, দুদিন মুসলমান ও দুদিন খ্রিস্টান হয়ে থাকেন। একদিন ছুটি থাকে। ঐ দিন বুঝতে পারেন না কী করবেন। সেদিন তিনি আরাম করে ঘুমোন। ঘুমের মধ্যে কখনও থুতনিতে হিন্দুভাব জেগে ওঠে, কখনও কনুইটা মুসলমান হব মুসলমান হব করে, কখনও ঘাড়টা খ্রিস্টধর্মের দিকে বেঁকে যায়। মাখা সেসব গায়ে মাখেন না। তিনি ঘুমোন।
মাখার এক পূর্বপুরুষ গোরা। জন্মসূত্রে তিনি খ্রিস্টান ছিলেন। কিন্তু নিজেকে হিন্দু মনে করতেন। ঠিক এই কারণে গোরার ছেলেমেয়েরাও হিন্দু হয়ে জন্মান। গোরার ছোট ছেলে কালু ভালোবেসে একটি মুসলমান মেয়ের সঙ্গে বিয়ের সম্পর্ক করেন। মুসলমানি লালু ও তাঁর হিন্দু স্বামী কালুর নাতনির ছেলে মাখা।
জন্মসূত্রে খ্রিস্টান হলেও কেন নিজেকে হিন্দু মনে করতেন গোরা সে ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ বিশদে লিখে গেছেন। গোরা রবীন্দ্রনাথের কাছের বন্ধু ছিলেন, নাকি নিছকই পরিচিত ছিলেন সে ব্যাপারে কিছু জানা যায় না। তবে দুজনের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল সেটা বোঝা যায়। রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ছিলেন এবং গোরার বিষয়ে লিখে গেছেন। তাই কৃতজ্ঞতাবশত মাঝেমাঝে ব্রাহ্ম হয়ে যান মাখা।
ব্রাহ্মধর্ম নিয়ে কেউ মাথা ঘামান না। স্বাধীন ভারতে ব্রাহ্ম সংখ্যালঘু ধর্মের স্বীকৃতি পেয়েছে কিনা সেটাও কেউ ঠিকমত জানেন না। মাখার ব্রাহ্ম হওয়া নিয়ে কারও যায় আসে না।
মাখার যেত আসত। তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করতেন। নয় বছর বয়সে তিনি ঠিক করেন, কবিতা লিখে তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন। মাখা শুনেছিলেন, ন বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথম কবিতা লেখেন। সেখান থেকেই এ সিদ্ধান্ত। মাখা কবিতা লিখতে বসেন। কবিতার কথা ভাবতে থাকেন। কবিতার কথা ভাবতে ভাবতে একসময় তাঁর পায়খানা চেপে যায়।
এমনিতে, পায়খানা করার সময় মাখা সমাহিত হয়ে যান। ধর্মহীন ঘুমোনোর মতো। যাবতীয় পরিচয় ভুলে যান। নিবিষ্ট মনে কেবল পায়খানা করেন। তখন তিনি ধ্যানমগ্ন হাগুড়ে।
যেদিনকার কথা বলছি সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। ভেতরে মাখা, বাইরে বজ্রবিদ্যুৎ, মাঝখানে পায়খানাঘরের জানালা। বাজ পড়ে; বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মাখা মারা যান।
পুড়ে যাওয়া দেহের তিন টুকরো করা হয়। তিনটে ধর্মমতে তাদের সংস্কার করা হয়। একটা অংশ পোড়ানো হয়। অন্য দুটি অংশ যথাক্রমে খ্রিস্টান ও ইসলামিক মতে মাটিতে পোঁতা হয়।
মাইকেল কৃষ্ণকান্ত খান, সংক্ষেপে মাখা, আমাকে ওঁর গল্প লিখতে বলেছিল। কিন্তু কী লিখব। উনি তো মারাই গেলেন। কৃতজ্ঞ অনুভূতির সারাৎসার নিয়ে কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন। পারলেন না। এটা খুব দুঃখের।
এ-ঘর ও-ঘর সে-ঘর
বইয়ের ঘর থেকে রান্নাঘরে জল খেতে এসে পথ হারালাম। পথহারানো বলা ভুল হল। বলা ভাল, স্মৃতিভ্রম হল। কোন ঘর থেকে বেরোলাম মনে করতে পারলাম না। জল খেয়েছি কিনা তাও মনে করতে পারলাম না।
অবাক হলাম। ঘরের দেওয়ালগুলো অচেনা মনে হল।হাঁটতে হাঁটতে শোবার ঘরের দিকে গেলাম। সেখানে আমার স্ত্রীর থাকার কথা। দেখি সেখানে কেউ নেই। ছেলের ঘরে গিয়ে দেখি সে-ঘরও খালি। ওর খেলনাগুলো মেঝেয় পড়ে আছে। খেলনাগুলো ভেঙে গেছে। পুরনো হয়ে গেছে।
পকেটে ফোন ছিল। বউকে ফোন করলাম। ওপাশ থেকে উত্তর এল— আপনি যাঁকে ফোন করেছেন তিনি আর এখানে থাকেন না। ছেলেকে ফোন করলাম। উত্তর এল— আপনার ছেলে আপনার বাড়ি ছেড়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছেন। বাবাকে ফোন করলাম। মাকে ফোন করলাম। কোনও উত্তর এল না।
বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, চেনা-পরিচিতদের ফোন করলাম। উত্তর এল— তারা আর আগের জায়গায় নেই। আগের জায়গায় নেই কিন্তু এখন কোথায় পাব তাদের, সে-ব্যাপারে কিছু বলল না।
এমন সময় আবছামত মনে হল, পড়ার ঘর থেকে এসেছিলাম। ভাবলাম, ওখানে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। নাহলে সব এমন হয়ে যাবে কেন।
কিন্তু পড়ার ঘরের রাস্তা খুঁজে পেলাম না। ভুল করে শোবার ঘরে এসে পড়লাম। ছেলের ঘরে এসে পড়লাম। রান্নাঘরে এসে পড়লাম। একের পর এক ঘর ঘুরেফিরে আসতে লাগল। পড়ার ঘর পেলাম না।
এমনি করে বৈঠকখানার জানলার সামনে এসে পড়লাম। বাইরে তাকিয়ে দেখি, আকাশে সূর্য উঠেছে। তার পাশে স্পষ্ট উঠেছে চাঁদ। আবার বৃষ্টিও হচ্ছে। মাঝেমাঝে রামধনু দেখা যাচ্ছে।
এই দেখে আমার খুব কান্না পেল। চোখের জল পায়ের উপর পড়তেই মনে পড়ে গেল, পড়ার ঘরে বসে কবিতা লিখছিলাম। জল তেষ্টা পেয়েছিল। জল খেতে রান্নাঘরে এসেছিলাম।
পড়ার ঘরের দিকে এগোলাম। এবার খুঁজে পেলাম। পড়ার ঘরে ঢুকে দেখি, সমস্ত বইপত্র মলিন হয়ে আছে। জবুথবু হয়ে আছে। আমার দিকে করুণভাবে তাকিয়ে আছে। লেখার টেবিলের দিকে তাড়াতাড়ি এগোলাম।
টেবিলের উপর খাতা। খাতার পাতায় কবিতা লেখা। খাতাটা পুরনো হয়ে গেছে। কবিতাটা পড়া যাচ্ছে। পড়লামও— আমারই লেখা— কিন্তু মানে বুঝতে পারলাম না।
বণিক বংশ
সাজাহান বণিকের মেজ ছেলে ঔরংজেব ওরফে ওরু বণিক বাবাকে প্রায় খুন করে সম্পত্তি দখল করে। বাবা ও অন্যান্য ভাইয়েরা কাঁদতে কাঁদতে ও ভুগতে ভুগতে শেষ জীবন কাটায়।
ওরু বণিকের নাতির ছেলে মহামতি বণিক ১৯৯৫ সালে সেই একই কাজ করে। মেয়েদের সম্পত্তিতে অধিকার নেই এই মর্মে মহামতি দুই বোনকে ভাগ দেয় না। এক ভাইকে চোর বদনাম দিয়ে পাড়াছাড়া করে। অন্য ভাইয়ের খাবারে বিষ মিশিয়ে তাকে পাগল করে দেয়।
১৯৯০ সালে মহামতি বণিকের একমাত্র সন্তান তরু বণিকের জন্ম হয়।
২০২০ সালে পৃথিবীর বহু দেশে করোনা রোগ ছড়িয়ে পড়ে। মহামতি বণিকের শরীরেও ভাইরাস বাসা বাঁধে।
রোগ থাকাকালীন মহামতি মাঝেমাঝেই ঘুমে ঢুলত। ঢুলতে ঢুলতে প্রায়শই দেখত ওরু বণিক দাঁড়িয়ে আছে। একদিন মহামতি ওরু বণিককে বলল,
–হে প্রগাঢ় প্রপিতামহ! আপনি! চমৎকার! করা যাক দু-একটা প্রণাম এবার।
দু-একটা প্রণাম সেরে বলল
–ভাইরাস আবহে আপনি? কীভাবে? ভাইরাস বাহিত হয়ে?
–আমি ওরু নই, তরু।
–তরু! আমার ছেলে! ভাইরাস আবহে তুই কীভাবে?
–ভাইরাস বাহিত হয়ে। তবে মহামতি, আমি তোর ছেলে তরু নই। আমি ওরু বণিকের দাদুর দাদু তরু বণিক।
–প্রণাম আদি গুরুজন! আমার করোনা রোগ হয়েছে, আদিগু! আমাকে সাহায্য করো। করোনাকে করে দাও বেনোজলে পার। আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে দেব পৃথিবীর করোনা ভাঁড়ার, আদিগু!
–হুম। একটা কথা মহামতি।
–বলুন আদিগু।
–আমি তরু বণিক— ওরু বণিকের দাদুর দাদু— একথা ঠিক। কিন্তু এ জন্মে আমি তোর ছেলে হয়েই জন্মেছি।
–মানে?
–আমি তরু, তোমার ছেলে, বাবা!
–বেয়াদপ বাঞ্চোত, বাবার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছিস। তোরা আজকালকার ছেলে তোদের কোনও নীতিবোধ নেই। বড়দের সম্মান করতে জানিস না।
–ভাইরাস বাহিত হয়ে এসেছি বাবা।
–কী চাস তুই?
–টাকা।
আপনি বরাবর আমাকে উৎসাহ দিয়ে এসেছেন, আশীস বাবু। আপনেকে অনেক ধন্যবাদ!
মেনি থ্যাংকস রিয়া, পড়ার ও শোনার জন্য।
সৈকত (রিতুল আচার্য), দারুণ ও অপ্রত্যাশিত আলোচনা। খুব ভালো লাগল।
মেদহীন, অসাধারণ গতিশীল গল্প। ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ সুদীপ! গতির কথা প্রথম কেউ বলল।
খুব ভালো। একদম অন্যরকম
ভাল লাগল, দীপ্র, তুমি পড়ে মন্তব্য করলে!
আপনারা মতামত পেয়ে ভাল লাগল, ভূদেব দা।
Jadio ami anugalpo khub akta pari na, kintu 3 te galpoi darun laglo…sahaj, sabolil representation r khub dynamic flow ache galpo gulote…khub valo laglo..
dynamic flow কথাটা মনে ধরল।
প্রতিটা গল্পই ভালো . তবে শেষ গল্পটা খুব ভালো লাগলো .
অনেক ধন্যবাদ।