চেনা-অচেনা

চেনা-অচেনা -- কৃষ্ণা মালিক

কৃষ্ণা মালিক

 

মহাদেব জোর ধমকে উঠল। চোপ শালা! বেঁচে থাকতে পইপই করে বলেছিলাম, ছোটকত্তা, নামটা করো, ঠাকুরের নাম নাও! রোজ নামটা করো! আমার কথায় কান করেছিলে? এখন এসেছ গান শুনতে? ভাগ, এখান থেকে!

রাত তখন একেবারে গনগনে। বাইরে উঠেছিল জগা। রোজ এই সময় তাকে পেচ্ছাপ করতে উঠতে হয়, বরাবরের অভ্যাস। বাড়িটা তার শ্মশানের কাছে বলে ওই সময় কোনও কোনওদিন ও মহাদেব সাঁতরার গলা শুনতে পায়। সেদিনও অমন তর্জনগর্জন শুনে কোনওক্রমে নিজের কাজটুকু সেরেই রাম রাম করতে করতে ঘরে ঢুকে পড়ল।

পরের দিন সকালে জগা ওর বাড়ির সামনে খামারে একটা নিমডাল ভেঙে দাঁতন করছিল। খামারের পরেই একটা জমি। তারপর রাস্তা। রাস্তার ওপারে পুকুরপাড়ে শ্মশান। ওরই একপাশে মহাদেবের আস্তানা। নিমডাল চিবিয়ে চিবিয়ে ছিবড়ে করবার সময় মহাদেবকে দেখতে পেল। একটু এগিয়ে গিয়ে ডাকল, ও মহাদেবদা! কাল রাতে কাকে অত গালাগাল দিচ্ছিলে?”

মহাদেব উত্তর দেয় না। শুধু হাত নেড়ে একটু হাসে।

মহাদেব সাঁতরা প্রকৃতই শ্মশানবাসী। মৃত্যুর পর আত্মা পিণ্ডগ্রহণের আগে পর্যন্ত নাকি শ্মশানে থাকে। সেইসময় সে সদ্য যারা আত্মারূপ লাভ করেছে তাদের সঙ্গে কথা বলে। তারা তাদের গত জীবনের তৃপ্তি ও অতৃপ্তির কথা মহাদেবকে অকপটে বলে যায়। কত খেদ নিয়ে এক-একজন চলে যায়। কেউ কেউ বড় পূণ্যাত্মা। তারা হাসিমুখে দেহের খোলস থেকে বেরিয়ে এসেছে। সব হদিশই মহাদেবের কাছে।

সে নিজে ঠাকুরের দীক্ষাপ্রাপ্ত। সকাল-সন্ধ্যা ঠাকুরের নামগান করে। কারও বাড়িতে ঠাকুরের নামগান ও আলোচনার অনুষ্ঠান থাকলে আমন্ত্রিত হয়ে যায়। বড় চমৎকার কথা বলে সে। তার চেয়েও চমৎকার তার গান। তার ভাবের কথা ও গান শুনে উপস্থিত গুরুভাই ও গুরুবোনদের অনেকেরই চোখে জল চলে আসে। তাকে দেখেই কত কঠিন অবিশ্বাসীও ঠাকুরের দীক্ষা নিয়েছে।

রাধামোহন কুণ্ডু, কুণ্ডুদের ছোট ভাই, তাকে বহু চেষ্টা করেও জপাতে পারেনি মহাদেব। পাত্তাই পেল না! একেবারে ব্যাটের ডগায় ছক্কা মেরে স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছে মহাদেবের প্রস্তাব। সে ঘাঘু সিপিএম করা লোক। জীবদ্দশায় কোনওদিন কোনও মূর্তি-টূর্তির সামনে মাথা নোয়ায়নি, বরঞ্চ এন্তার খেস্যা করে গেছে ঠাকুর-দেবতা সম্বন্ধে।

তখনও রাজনীতিতে ততটা দড় নয়। সন্ধ্যের দিকে কুণ্ডুবাড়ির বাইরের বারান্দায় শৈলেন, তারক, রাধাকান্ত আর সে বিন্তি আর টোয়েন্টি নাইন  খেলত। মহাদেব তো তখনই ঠাকুরের দীক্ষিত। খেলার মাঝে মাঝে ফুরসত মতো ঠাকুরের কথা, দীক্ষার প্রয়োজন আর নামগানের মাহাত্ম্য বোঝানোর চেষ্টা করত। ছোটকত্তার যত লাগাতার ঠাট্টাতামাশা, তারও তত অটল ধৈর্য। কিন্তু ধৈর্যের বাঁধ ভাঙত কিনা তার পরীক্ষা হওয়ার আগেই তো কত্তামশাই পগার পার।

রাজনীতিতে এলাকায় বেশ প্রভাব প্রতিপত্তি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু একটা স্ট্রোক তাকে শয্যাশায়ী করে ফেলল। তখনও পইপই করে বলেছে সে “ছোটকত্তা! দীক্ষা না নাও, অন্তত নামগানটা করো!”

সৎ উপদেশ শুনল না। কী কষ্ট পেয়েই না মারা গেল! তারপর কী হল? সেই তো গঙ্গাযাত্রার প্রথম রাতেই কেঁউ কেঁউ করে কেঁদে পড়ল। শ্মশানযাত্রীরা দাহকাজ সেরে চলে গেল বিকেল নাগাদ। রাতের প্রথম প্রহর চলে গেল। দ্বিতীয় প্রহরের শুরুতেই ছোটকত্তা ঢুকল নাকিকান্না কেঁদে।

–ও মহাদেব! একবার নামগান শোনা না, ভাই! একটু গান কর…!

সমানে কাকুতিমিনতি, কান্নাকাটি। নাকিকান্না আর সহ্য হচ্ছিল না। শালা, চোপ! বেঁচে থাকতে বলিনি, ছোটকত্তা! দীক্ষাটা নাও, নামগানটা করো! কিছুই তো সঙ্গে যাবে না, ওই নামগানটুকুই, ঠাকুরের নামটুকুই। এখন গান শুনতে এসেছ!

–ওরে ভুল করেছি রে, ভুল করেছি! তার ফল তো পাচ্ছি। কী কষ্ট, কী জ্বালা! গান শোনা ভাই, গান শোনা!

যতই ধমকাক, গান শুনতে চাইলে তো আর ফেরানো যায় না। তবু যদি ওর কিছু পূণ্য হয়। তাই যে কটাদিন ছিল নামগান শুনিয়েছিল।

এভাবেই চলছে তার বছর চারেক। গ্রামেই বাড়ি হলেও আাড়িতে সে থাকে না। বৌ আর ছোট ছেলে মিলে সংসার যেমন পারে চালায়। তার খরচখরচা ওরাই দেয়। এছাড়া দীক্ষা-টীক্ষা দেওয়ার কাজটাও করে। একাকিত্ব বলতে কী বোঝায় তা তার জানা নেই। সকালে উঠে চান ও ঠাকুরকে ফুলজল দেওয়া হলে নিজের হাতে চা বানায়। চায়ের সঙ্গে দুটো মুড়ি হলেই তার চলে যায়। সকাল থেকেই তার চারপাশে কুকুর-বেড়াল ঘুরঘুর করে। কাগা-বগাও আসে। ও সবাইকে কিছু না কিছু খেতে দেবে। সে পুজোর প্রসাদ হোক, বা চা-মুড়ি বা ভাত, যখন তার যেমন খাওয়া তেমনই সে অন্যদের দেয়। তাদের সবার সঙ্গেই তার কথাবার্তা চলে। একজন যাচ্ছে, তো একজন আসছে। ও যেমন নির্দেশ দেয়, ওরা তাই করে। কেউই সাধারণ কুকুর বেড়াল বা অন্য প্রাণী নয়। তারা আসলে দেহান্তরী আত্মা।

সেদিন কোনও একটা বিশেষ পুজো ছিল। সাঁইপাড়ার সনাতনের বৌ বাপের বাড়ি থেকে ফিরছে। বাস স্টপেজে কোনও টোটো বা ভ্যান-ট্যান না পেয়ে হাঁটতে লাগল। বেশি রাস্তা তো নয়!

পুজো সবে শেষ হয়েছে। শ্মশানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুনতে পেল মহাদেব চেঁচাচ্ছে। খুব যে রেগে গেছে বোঝা যায়। কথাগুলোও শোনা যাচ্ছে।

–শালা! তোকে তখন থেকে বলছি, ধৈর্য ধর। পুজোটা শেষ হোক, প্রসাদ দোবো। তা নয়, প্রসাদ দাও প্রসাদ দাও করে অস্থির করে দেয়?

দাঁড়িয়ে পড়ে সনাতনের বৌ। কাকে বকাবকি করছে রে বাবা! সামনে তো একটা কুকুর! ওর কৌতূহল হল। ডাকল, “কাকাবাবু?”

ঘুরে তাকায় মহাদেব। বলো বৌমা!

–আপনি কার সঙ্গে কথা বলছেন? সামনে তো কেউ নেই! তাছাড়া কুকুরে কি প্রসাদ খায়?
–দেখবে? বলে মহাদেব কুকুরটার দিকে তাকিয়ে আঙুল তুলে দূরে গিয়ে বসতে বলে। ওমা! কুকুরটাও সঙ্গে সঙ্গে ওর দেখানো জায়গার দিকে এগিয়ে গিয়ে বসে পড়ে! মহাদেব তার সামনে প্রসাদের থালা থেকে দু-কুচি শশা রাখে। কুকুরটা অমনি সেটা খেয়ে নেয়।

সনাতনের বৌ কাণ্ডকারখানা দেখছিল। মহাদেব ফিরে এসে বলল, “ও তোমাদের পাড়ার অরুণ গো, বৌমা! অপঘাতে মরেছে তো, তাই এখনও মানুষজন্ম পায়নি।”

‘বৌমা’র চোখেমুখে অবিশ্বাস লক্ষ করে মহাদেব বলে, “আর একটা প্রমাণ দিচ্ছি, দ্যাখো।” কুকুরটা একভাবে বসে এদিকেই তাকিয়ে আছে। তাকে মহাদেব আদেশের সুরে বলল, “মোষগোড় পেরিয়ে চলে যাবি, একবারও এদিকে তাকাবি না।”

বৌমা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে। ঈশ্বর অরুণ সাঁই কুকুরের বেশে চলে যাচ্ছে মোষগোড় পেরিয়ে। একবারও পিছন ফিরে তাকাল না। এরপর আর কী করে কাকাবাবুকে অবিশ্বাস করে?

 

দুই

কুণ্ডুদের বাড়িতে আজ শোকের পরিবেশ। বড়কত্তা তিনদিন আগে ঊষাকালে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। দু-চারজন আত্মীয়, বড়কত্তার তিন মেয়ে আর নাগপুরে থাকা একমাত্র পুত্র ও পুত্রবধূ উপস্থিত রয়েছে। এক সময় এই একান্নবর্তী পরিবারটা লোকজনে গমগম করত। এখন কর্তারা সব গত। ছেলেমেয়েরা দূরে দূরে। কেউ জীবিকার সূত্রে, কেউ বা বৈবাহিক। একটা অঘটনের কারণে হলেও অনেকদিন পর বাড়িটা কিছুটা পুরনো চেহারায়।

আজ মেয়েদের পিতৃদায়ের প্রথম দিনের নিয়ম পালন— ঘাটে ওঠা। শ্বশুরবাড়িতে বাবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান না করে তিন বোন একসঙ্গে এখানেই করবে বলে স্থির করেছে। বামুনবাড়ি থেকে ফিরে বড়কত্তার ছেলে অনিমেষ বোনেদের জানাল যে ঠিক এগারোটায় নাপিত ও পুরোহিত চলে আসবে।

তখন সবে আটটা বাজছে। মাকে ঘিরে মেয়েরা ও আত্মীয়রা বসে কত্তারই আলোচনা চলছে। থেকে থেকেই কেউ না কেউ কেঁদে উঠছে। বড় গিন্নি সদ্য স্বামীকে হারিয়ে বিহ্বল। তার শোক প্রশমিত হওয়া সহজ নয়। কত্তার সঙ্গে তার সম্পর্কের বাঁধনটা আর পাঁচজনের থেকে বেশিরকমেই মজবুত ছিল। সেকথা গাঁয়ের এমন কোনও লোক নেই যে জানে না। সহজ সরল বড়গিন্নি স্বামীর ওপর নির্ভরশীল ছিল পুরোপুরি। কত্তাও স্ত্রীর উপর। বড্ড সেবাপরায়না এই মহিলা। একে অপরের খেয়াল রাখতেই তাদের দিন গুজরান হয়ে যেত। স্বামীকে হারিয়ে তাই তিনি সত্যিসত্যিই একেবারে আতান্তরে পড়েছেন। বুড়ো বয়সে স্বামীর জন্য শোকের বহর দেখে কেউ যদি ঠাট্টা করে আদিখ্যেতা বলে, তবে সেটা অন্যায় হবে। মহিলামহলের এসব বাক্যালাপের মাঝে মহাদেবকে দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখা গেল।

তাকে দেখে বড়গিন্নির আর এক প্রস্থ সকরুণ বিলাপ। মহাদেব খানিকক্ষণ  মাথা নীচু করে গম্ভীরমূর্তিতে চুপচাপ। বড়কত্তারা স্বামী-স্ত্রী তার গুরুভাই ও গুরুভগিনী। বেঁচে থাকতে কত্তার সঙ্গে তার বেশ হৃদ্যতা ও আন্তরিক টানের সম্পর্ক ছিল।

মহাদেব গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, “বৌদি! কাঁদবে না। সে ভালোই আছে। কেঁদে তার যাওয়াটাকে কঠিন করে দিও না!” এই কথার রেশ ধরে আরও কিছু বলে। একটু থামে। শুরু হয় মহাদেবের কথার জাদু।

–আমাকে কাল রাতে বলল, সকালে একবার যাস। দেখে আসিস। তাই এলাম।
–আর কী বলল বাবা? ছোট মেয়ে জিগ্যেস করে। তার সবে গত বছর বিয়ে হয়েছে। বাপ-মার প্রতি টানটা এখনও বেশ টাটকা। চোখমুখও শুকিয়ে গেছে।

তার দিকে তাকিয়ে বলে, “আর কী বলবে, বল তো? তোরা ভালো থাক, এই আশীর্বাদ করেছে। তিনদিনে ভিটেতে আসে। সে তো এখানেই রয়েছে। আমি দেখতে পাচ্ছি।”

বলতে বলতেই বড়কত্তার ছেড়ে যাওয়া শোবার ঘরের জানলা দিয়ে ইঙ্গিত করে। সবাই একসঙ্গে সেদিকে হেদিয়ে পড়ে। একটা সাদা গো-বক গরাদে বসে জানলা দিয়ে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছে। সে দৃশ্য দেখে সবাই এমন কলরব করে উঠল যে বকরূপী বড়কত্তা ডানা ঝাপটে উড়ে পালাতে পথ পায় না। তখন আবার সমবেত আফশোস।

–শেষবারের মতো বিছানাটায় শুত, বুঝলে বৌদি!

বৌদি চমৎকৃত। কেঁদে উঠল না। যদিও চোখের কোল বেয়ে জল গড়াচ্ছে। তবু কেঁদে তার যাওয়ার পথ পিছল করবে না। কাঁদলে, ডাকলে তারও যে মায়া আসবে, যেতে পা উঠবে না। এটা ঠিক নয়। মহাদেব ঠাকুরপো বলেছে। তার কথার গুরুত্ব দেয় তারা।

কথায় কথায় বলে চলে, বড়কত্তা হাসতে হাসতে গেছে। তার জন্য তোমরা কষ্ট পেও না। রাতে দুদিন তার সঙ্গে ঠাকুরের কথা হল, একসঙ্গে নামগান করলাম।

চারপাশে ভিড়টা বাড়ল। অনেকেই ঘনিয়ে এল তার কথার টানে। অনেক তত্ত্বকথাও আওড়াচ্ছে। মাঝে দু-চার কলি গেয়ে উঠছে। তার চোখ সবার মুখের উপর ঘুরতে থাকে। কারও কারও চোখে অবিশ্বাসের ছায়া। তেমনি একজন অনিমেষ। ওর তাতে ভাবান্তর নেই। ও কথা বলে চলেছে। কেউ প্রশ্ন করলে উত্তর দিচ্ছে।

হঠাৎ অনিমেষের ওপর তার দৃষ্টি স্থির হয়। বলতে থাকে, “ছোট কত্তা কিন্তু কাঁদতে কাঁদতে গিয়েছিল। অবিশ্বাসীর যেমন হয়! বেঁচে থাকতে পইপই করে বলেছিনু, ঠাকুরের নাম নাও, ছোটকত্তা! আমার কথা শোনেনি। যখন মরে তার মুখখানা মনে আছে কারও?”— যেন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে।

নিজেই উত্তর দেয়, মুখটায় যন্ত্রণায় বেঁকে গিয়েছিল। আমি মৃতের মুখ দেখি না। আমরা মনে করি মানুষ মরে না, শুধু খোলসটা ছেড়ে যায়। আত্মা বেঁচে থাকে। তারপর নতুন গর্ভে জন্ম নেয়। যাইহোক, তোমরা যারা দেখেছ, দুই কত্তার কার কেমন মুখের অবস্থা ছিল মনে করো দেখি!

গুঞ্জন ওঠে। ঠিকই তো! মারা যাওয়ার পর দেখা গেল কাকার মুখটা বেঁকে গেছে। কিন্তু বাবাকে দেখে মনে হল যেন, বাবা বড় আরামের ঘুম ঘুমোচ্ছে। কথাটা ধরে নেয় মহাদেব। তারপর সামনে পিছনে একবার দুলে হাঁটুতে আস্তে একটা চাপড় মেরে গলায় একধাপ জোর বাড়িয়ে বলে, “সেই ছোটকত্তা মারা যাবার পর রাতে আমার কাছে আসে আর কাঁদে। কাকুতি মিনতি করে, মহাদেব, একবার ঠাকুরের গান শোনা, একবার শোনা না!

“চোপ শালা! আমি ত্যাঁদোর লোকেদের খুব গালাগাল দিই। শেষের দিনের কথা ভাবে না তো তারা! তাকেও আচ্ছা করে তাই দিলাম ধমকে। বেরও করে দিয়েছিনু, বেরো শালা এখান থেকে! সকালবেলা জগা আমাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘কাকে এত ধমকাচ্ছিলে গো, মহাদেবদা!’ সে যাই হোক, তো বাইরে গিয়েও জানলার পাশে দাঁড়িয়ে তার সেই এক কথা, গান শোনা, গান শোনা! মায়াও হল, তারপর যে কটাদিন ছিল এই জগতে, গান শোনালাম। তাতেই খানিকটা শান্তি হয়েছিল তার।”

মহাদেবের হাবভাবে মালুম হচ্ছে তার কথা বোধহয় শেষ হল। এবার সে উঠবে। এমন সময় অনিমেষ বলে বসল, কাকা! তোমার ছেলের খবর বলো। সে কেমন আছে? সে তো ঠাকুরের নামগান করত, খুব নাকি ভক্তি ছিল তার। তোমার মতই ছিল গানের গলা।

অনিমেষের কথায় সচকিতে তাকাল একবার। তারপর মাথাটা নেমে গেল। কিন্তু দু-এক মুহূর্তের জন্য। তারপর ধীরে ধীরে বললো, “সে বাঞ্চোত ভালো নেই। আত্মহত্যা মহাপাপ, ভাইপো! তার মুক্তি হতে এখনও বহুত দেরি।” মুখটা তার বিকৃত হয়ে গেল।

“প্রায়শ্চিত্ত সম্পূর্ণ হওয়ার পথে কতবার তাকে জন্মাতে হবে তার ঠিক আছে? মানুষ জন্ম তবে হবে। তার আগে কুকুর, বেড়াল, কাক, শকুন— কত রকমের জীবন নিয়ে ঘুরতে হবে সে শালাকে! এখন তার কুকুর জন্ম। জন্মাচ্ছে, আর মরছে। একবারে পুরো রাস্তা যতদিন না সে পেরোতে পারছে ততদিন তার ক্ষণজন্ম। ততদিন তার মুক্তি নেই।“

একটু থেমে শূন্য চোখে তাকাল মহাদেব। যেন নিজেকেই শোনায়, “মানুষ জন্মে বড় সুখ। তার দায়ও অনেক। মৃত্যুর পরের অবস্থাটা জানতে খুব ইচ্ছা হত। ইচ্ছাটা বেশি হল সে চলে যাওয়ার পর। সে হারমজাদাই তো আমাকে শ্মশানবাসী করে ছাড়লে, ভাইপো।”

চলে যাওয়ার পর অনিমেষের মনে হল, লোকটা যেন হেঁয়ালির মতো। চেনা চেনা লাগল, তবু ঠিক চেনা গেল না!

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...