শর্ত যখন অসম্মান: কীভাবে কাজ করছে মেয়ে সাংবাদিকরা

শর্ত যখন অসম্মান: কীভাবে কাজ করছে মেয়ে সাংবাদিকরা -- স্বাতী ভট্টাচার্য

স্বাতী ভট্টাচার্য

 



সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

পোশাকের উপর দিয়ে স্তনে হাত দিলে ত্বক স্পর্শ করা হয় না, তাই তাকে যৌন হয়রানি বলা চলে না। বম্বে হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চের এক বিচারপতি সম্প্রতি এই রায় দিয়েছেন। শুনে বাক্যহারা দেশবাসী। সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি এমনভাবেই একবার দেশকে হতবাক করে বলেছিলেন, থানার মধ্যে ষোল বছরের কিশোরীর সঙ্গে দুই পুলিশকর্মীর যৌনসংসর্গ ‘ধর্ষণ’ নয়, কারণ মেয়েটির বুকে-পিঠে ক্ষতচিহ্ন মেলেনি, চেঁচামেচি করতেও কেউ শোনেনি। ‘মথুরা রেপ কেস’-এ সুপ্রিম কোর্ট  যখন এই রায় দিয়েছিল (১৯৭৯), তখন আমার বয়স ছিল দশ বছর। আজ আমার বয়স বাহান্ন। মাঝে আমার জীবনের বিয়াল্লিশ বছর কেটে গেল, কিন্তু আমার দেশ বুঝে উঠতে পারল না যৌন হয়রানি কাকে বলে, আর কী করলে তা প্রমাণ হয়। সেইজন্য এই রিপোর্ট তৈরি করেছি আমরা। যাতে দেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়, কত পরিকল্পিতভাবে অন্যায় হয়ে চলেছে মেয়েদের সঙ্গে। আর মেয়েরাও বোঝে যে কেবল তারাই বিশ্রী অভিজ্ঞতার শিকার হয়নি, তাদের হয়রানি, অসম্মান, এক বৃহৎ নকশার অংশ, যা মিডিয়া-সহ নানা কর্মক্ষেত্রে ছড়িয়ে রয়েছে। কেবল মেয়ে হওয়ার জন্য কর্মক্ষেত্রে আমাদের কী ধরনের অসম্মান সইতে হয়, কত ভীতিপ্রদর্শন আর বঞ্চনাকে অতিক্রম করে কাজ করতে হয়, এই রিপোর্ট তার একটা খণ্ডচিত্র। কর্মক্ষেত্রে মহিলা সাংবাদিকদের সম্মান ও নিরাপত্তার মূল্যায়ণ করেছে এই রিপোর্ট। পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্র, টিভি এবং ওয়েব-মিডিয়াতে কর্মরত সাংবাদিকদের থেকে সংগৃহীত হয়েছে এই রিপোর্টের তথ্য।

মহিলা সাংবাদিকদের সংগঠন ‘সাউথ এশিয়ান উইমেন ইন মিডিয়া (ইন্ডিয়া)’ এই রিপোর্ট তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় ২০১৮ সালে। হাত মিলিয়েছে অসরকারি সংস্থা ‘সংহিতা’, যা দীর্ঘদিন কাজ করছে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য। এই দুই সংস্থা যৌথভাবে এই রিপোর্টটি তৈরি করেছে। ২০১৯-২০ সালে তথ্য সংগৃহীত হয় কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে। ৯০ জন পুরুষ ও মহিলা সাংবাদিকের মধ্যে সমীক্ষা হয়, ৩৬ জন মহিলা সাংবাদিকের বিশদ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এ ছাড়াও তিনটি আলোচনার আয়োজন করা হয়, প্রথমটি পুরুষ সাংবাদিকদের, দ্বিতীয়টি মহিলা ফোটো জার্নালিস্টদের এবং তৃতীয়টি জেলার মহিলা সাংবাদিকদের (এঁরা অস্থায়ী কর্মী, রিপোর্ট-পিছু টাকা পান)। মহিলা সাংবাদিকদের অনেকে নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব সরিয়ে রেখে, বহু ঝুঁকি অগ্রাহ্য করে আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। অনেকেই দফতরের বাইরে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, যাতে এমন একটি বিষয়ে কথা বলার জন্য কর্মক্ষেত্রে সমস্যা না হয়। সমীক্ষা (সার্ভে) করার জন্য কেবল ‘হ্যাঁ’-‘না’ উত্তরের প্রয়োজন থাকলেও, অনেক সাংবাদিক সেখানে থামতে পারেননি। মনের কথা উজাড় করে দিয়েছেন। কলকাতা ও জেলার পুরুষ সাংবাদিকদের অনেকে অত্যন্ত সংবেদনশীলতার সঙ্গে কথা বলেছেন। কর্মক্ষেত্রে অন্যায়-অবিচারের প্রচ্ছন্ন নকশাটি কীভাবে কাজ করে, সে কথা আমাদের কাছে প্রাঞ্জল করেছেন তাঁরা। এ ছাড়াও আমরা কথা বলেছি আটটি মিডিয়া সংস্থার মানবসম্পদ বিভাগের আধিকারিকদের সঙ্গে। প্রতিষ্ঠান কী চোখে যৌন হয়রানির সমস্যাকে দেখে, সেটাও ধরা হয়েছে এই রিপোর্টে।

যৌন নির্যাতন যেন সমাজের গুপ্তরোগ। তার প্রকাশ সর্বত্র, কিন্তু রোগটা যে আছে সেটা ভদ্র সমাজে উচ্চারণ করা চলে না। কেউ করলেও অন্যরা ভুরু কুঁচকোয়, যেন যে রোগের কথা বলছে সে-ই বেয়াদব। বাঁকা চোখে তাকায়— তার মানে ওরই নিশ্চয়ই…! তবে যৌন হয়রানি আরও মারাত্মক, কারণ ভ্রান্ত, বিকৃত, আধিপত্যবাদী মানসিকতা বাসা বাঁধে একজনের মনে, আর তার যন্ত্রণা সইতে অন্যদের। আমাদের পূর্বপ্রজন্মের মেয়েদের বহু চেষ্টার পরে সুপ্রিম কোর্ট কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নিবারণে একটি রায় দেয় (বিশাখা গাইডলাইন, ১৯৯৭), তার ষোল বছর পরে আইন হয় (২০১৩)। আমার ২৫ বছরের কর্মজীবনের ২২ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে এক এমন দেশে, যে দেশ কর্মরত মেয়েদের প্রতি সহকর্মী বা ঊর্ধ্বতন কর্তার অশ্লীল ইঙ্গিত, কুপ্রস্তাব, বদ স্পর্শ, ধর্ষণকে ‘অপরাধ’ বলে মনে করে। আইন মনে করে, একটি মেয়েকে সুরক্ষা দিতে, ন্যায়বিচার দিতে তার কর্মক্ষেত্র আইনত দায়বদ্ধ। অথচ, আমার গোটা কর্মজীবনই কেটে গেল অপমানের ভয়ে সিঁটিয়ে-থাকা মেয়ে, অপমানকে হেসে উড়িয়ে-দেওয়া মেয়ে, আর অপমানকে বুকে চেপে গুমরোতে থাকা মেয়ে দেখতে দেখতে। পুরুষের বাক্যে-ব্যবহারে  অসম্মানিত হয়নি, এমন মেয়ে সাংবাদিক চোখে পড়েনি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়েও না।

 

কত বড় এই সমস্যা?

সমাজ-সংসারে যে কোনও অন্যায়, অপরাধের যা ব্যাপকতা, সমীক্ষায় তার একটি অংশমাত্র উঠে আসে। সমাজবিজ্ঞানী মাত্রই তা জানেন। এর একটা কারণ, অন্যায়কে ‘স্বাভাবিক’ মনে করার অভ্যাস। শৈশব থেকেই কটুবাক্য কিংবা অবহেলায় যে অভ্যস্ত, সে গালাগাল বা উপেক্ষা নিয়ে নালিশ করে না, এমনকী নিজের প্রাপ্য বলেই মনে করে। গার্হস্থ্য হিংসা নিয়ে সমীক্ষায় যেমন মেয়েদের এমন মত পাওয়া যায় যে, বরের মুখে মুখে তর্ক করলে, রান্না খারাপ হলে, বর তো দু ঘা দেবেই[1]। তা নিয়ে আবার নালিশ কীসের! ঘরে যেমন, বাইরেও তেমন। মেয়েরা কৈশোর না পেরোতে বুঝে যায়, বাসে-ট্রেনে যাতায়াত করতে হলে, কলেজে-কারখানায়, অফিসে-আদালতে কাজ করতে চাইলে মন্দ স্পর্শ, অশ্লীল উক্তি এড়ানো অসম্ভব। তাকে মেয়েদের ‘ভাগ্য’ বলেই ধরে নেয় মেয়েরা, ‘অন্যায়’ বলে প্রতিবাদ করার ইচ্ছেটা আর খুঁজে পায় না। আরও একটা কারণ, অপমানের প্রতিবাদ না করতে পারলে মনে এমন একটা আত্মগ্লানি হয়, যে বহু মেয়ে নিজের কাছেও তা স্বীকার করতে চায় না। তাই সমীক্ষার প্রশ্নে ‘জানি না’ বলে এড়িয়ে যায়। এর দৃষ্টান্ত ইতিহাসে প্রচুর। দেশভাগের সময়ে পঞ্জাব বা বাংলার মেয়েদের যে সাংঘাতিক নির্যাতন-অপমান সহ্য করতে হয়েছিল, তা নিয়ে একটা সামূহিক নীরবতা কাজ করেছিল। উর্বশী বুটালিয়ার মতো সাংবাদিক, গবেষকদের কাজ[2] সেই নীরবতার পর্দা সরিয়ে ভয়ানক সব অভিজ্ঞতাকে বার করে নিয়ে আসে বহু দশক পরে। স্বাধীন ভারতে সংসারে কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের উপর নির্যাতন নিয়ে যত সমীক্ষা হয়েছে, তার প্রতিটাই দেখিয়েছে যে, স্বাধীন ভারতে এক অঘোষিত যুদ্ধ চলেছে মেয়েদের উপর। মেঘের আড়াল থেকে ইন্দ্রজিতের শরবর্ষণের মতো, সাম্য ও সক্ষমতার বাণী সামনে রেখে, তার পিছন থেকে কখনও বর্শা, কখনও গ্রেনেড— গর্ভস্থ কন্যার হত্যা থেকে কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা— ছুটে আসে মেয়েদের দিকে। এমন নারীবিদ্বেষের পাঁকে ডুবে সংসার করা, কাজ করা মানবসত্তার এক চরম অবমাননা। মেয়েরা তাই সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলাকেই সম্মানরক্ষার উপায় মনে করে। কেউ সে প্রসঙ্গ তুললে বিরক্তি দিয়ে বিপন্নতা ঢাকে।

সমীক্ষা ও সাক্ষাৎকারের প্রশ্নগুলো নীরবতার এই আচ্ছাদনকে ছিন্ন করে অন্তরের সত্যকে বার করে আনার একটা উপায়। আমাদের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, কলকাতা ও জেলা মিলিয়ে যে ৯০ জন পুরুষ ও মহিলা সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলা হয়েছিল, তাঁদের ৪৭ শতাংশ জানিয়েছেন, মহিলা সাংবাদিকের হয়রানির কোনও না কোনও ঘটনা তাঁরা জানেন। মেয়ে সাংবাদিকদের অর্ধেক জানিয়েছেন, তিনি নিজে যৌন হয়রানির শিকার। এটা ব্যতিক্রম নয়। মহিলা সাংবাদিকদের অপর একটি সংগঠন (নেটওয়ার্ক অব উইমেন ইন মিডিয়া, ইন্ডিয়া) ২০১৮ সালে একটি সমীক্ষা শুরু করে, যা নানা রাজ্যের ৪৫৬ জন সাংবাদিকের থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। সেই সমীক্ষাতেও দেখা গিয়েছে, নিজে যৌন হয়রানির মুখোমুখি হয়েছে বলে জানিয়েছে ৩৬ শতাংশ মেয়ে সাংবাদিক। পড়শি দেশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সমীক্ষাতেও প্রায় একই ছবি পাওয়া গিয়েছে। ভারতের অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের হয়রানির চিত্রও এর চাইতে খুব আলাদা নয়। এই রিপোর্টে অতীতের গবেষণাগুলির একটি চুম্বক (‘লিটারেচার রিভিউ’) রাখা হয়েছে পাঠকদের কাছে যৌন হয়রানির ব্যাপকতার ছবিটা তুলে ধরতে। তিনজনে একজন, অথবা দুজনে একজন মেয়ে যদি বলেন তাঁরা যৌন হয়রানি সহ্য করেছেন, তা হলে এ সমস্যা তাচ্ছিল্য করার মতো নয়।

 

কেন সমাধান এত কঠিন?

এই সমীক্ষা এ-ও দেখাচ্ছে যে, যত মহিলার যৌন নির্যাতনের অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাঁদের ৮০ শতাংশ তা নিয়ে অভিযোগ করেননি[3]। এর কারণগুলি খোলসা হয়েছে সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার থেকে। প্রতিবাদ করলে মেয়েটিকেই অন্য বিভাগে বদলি করে দেওয়া হয়, না হলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে কাজ ছেড়ে দিতে হয় তাদের। আমাদের সাক্ষাৎকারগুলি থেকে উঠে আসা তথ্য বলছে, যত মেয়ে অভিযোগ করেছে তাদের অধিকাংশই কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। আইন বলছে, যৌন হয়রানির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে কমিটি (‘ইন্টারনাল কমপ্লেনস কমিটি’) তৈরি করতে হবে সব সংস্থাকে। পশ্চিমবঙ্গে সব মিডিয়া সংস্থা তা এখনও তৈরি করেনি, ধরা পড়েছে সমীক্ষায়। যেখানে কমিটি আছে, সেখানেও তার স্বাতন্ত্র্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বারবার। পুরুষ ও মহিলা সাংবাদিকদের অনেকেই মনে করেন, বহু ক্ষেত্রে সংস্থার শীর্ষ কর্তাদের অঙ্গুলিহেলনে কমিটি কাজ করেছে। কখনও অভিযুক্ত পুরুষ ‘আমি কোনও অন্যায় করিনি, তবে কেউ দুঃখ পেয়ে থাকলে দুঃখিত’ গোছের অসার কথা বলে পার পেয়েছে। কখনও ‘শাস্তির’ নাম করে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অতি সামান্য কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কমিটি মেয়েটিকে বলেছে, তারা যথেষ্ট ‘প্রমাণ’ দাখিল করতে পারেনি। সিনিয়র সহকর্মীকে (চিফ রিপোর্টার, নিউজ় এডিটর) বলে সুরাহা করতে গিয়েও লাভ হয়নি। ‘আরে অমন হয়েই থাকে’ বলে হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন তাঁরা, মেয়েটি বুঝেছে, সহকর্মীর (অধিকাংশ সময়ে সিনিয়র সহকর্মীর) অভব্য আচরণ মেনে নিতে রাজি না থাকলে কাজ করা যাবে না। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করে যে মেয়েরা কাজ ছেড়ে দেয়, তাদের নামে নানা কথা ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যার ফলে তাদের আবার কাজ পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। যারা ওই সংস্থাতেই কাজ চালিয়ে যায়, তাদের প্রায়ই এক রকম কোণঠাসা করে রাখা হয় ভাল কাজের সুযোগ না দিয়ে, খারাপ পারফর্ম্যান্সের অভিযোগ আনা হয়।

কে কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করল, কী হল প্রতিক্রিয়া, এসব গল্প মিডিয়ার দফতরে, প্রেস ক্লাবে, সমাজমাধ্যমে হাওয়ায় ভাসে। সমীক্ষায় যখন সেই গল্পগুলি গ্রথিত হয়, তখন বোঝা যায় যে এটা দু-চারজন বদস্বভাবের পুরুষ আর দু-চারটি বেপরোয়া মেয়ের গল্প নয়। কে, কাকে, কীভাবে নিশানা করে, তার একটা সুনির্দিষ্ট ছক রয়েছে। কোনও মেয়ে সেই ছককে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলতে পারে না।

এই ‘প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধ’ যেমন ব্যক্তির কাছে কখনও কখনও অসহ্য হয়ে ওঠে, তেমন সমাজের কাছেও। ২০১৮ সালে ভারতের মিডিয়াতে আছড়ে পড়ে ‘আমিও’ (মিটু) আন্দোলন। একের পর এক মহিলা সাংবাদিক, যাঁরা অনেকেই এখন নিজ ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত, প্রকাশ করতে থাকেন তাঁদের উপরে যৌন নিগ্রহের ইতিহাস। ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ এবং ‘এশিয়ান এজ’ কাগজের প্রাক্তন সম্পাদক এম জে আকবরের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করেন সাংবাদিক প্রিয়া রামানি। আকবর তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করলে প্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হন আরও আঠারোজন মহিলা, যাঁরা সাংবাদিক জীবনে আকবরের দ্বারা নিগৃহীত হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ‘সাউথ এশিয়ান উইমেন ইন মিডিয়া’-র এক সদস্যও আছেন। জনমতের চাপে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন আকবর। এই মামলাটি ভারতে ‘আমিও’ আন্দোলনের ঢেউয়ের চূড়া বলা চলে। মানহানির এই মামলায় দিল্লির আদালত প্রিয়া রামানিকে নির্দোষ সব্যস্ত করেছে। ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ঘোষিত এই রায়ে আদালত বলেছে, যে কোনও মঞ্চ ব্যবহার করে মেয়েরা তাঁদের প্রতি অমর্যাদার প্রতিবাদ করতে পারে। একে আইনের চোখে ভারতে #আমিও আন্দোলনের স্বীকৃতি বলে দেখা চলে।

এর আগে-পরে আরও অনেক মহিলা সাংবাদিক তাঁদের নিগ্রহের কথা জানিয়ে অভিযুক্তের নাম প্রকাশ করেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, এক ব্যক্তির নামে নিগ্রহের অভিযোগ আনলে আরও অনেক মেয়ে জানাচ্ছেন, তাঁরা সেই ব্যক্তির দ্বারাই নিগৃহীত হয়েছেন। বোঝা যাচ্ছে যে, মেয়েরা নিগৃহীত হয়েও কথা বলবে না, আর বললেও কেউ শুনবে না, এই সাহসে কিছু পুরুষ ধারাবাহিকভাবে নিগ্রহ চালিয়ে যাচ্ছে। এই অসহ্য ব্যবস্থাকে উন্মুক্ত করতে সমাজমাধ্যমকে ব্যবহার করে মেয়েরা সংগঠিত হল, সমাজ-সংসারের ছিছিক্কারের তোয়াক্কা না করে নিজের নিগ্রহের কথা প্রকাশ করার সাহস দেখাল। তাঁদের সম্মিলিত শক্তিকে অগ্রাহ্য করতে পারল না সমাজ, সংবাদপ্রতিষ্ঠান। এই পর্যায়ে মেয়েদের আনা অভিযোগের জেরে বেশ কিছু অভিযুক্ত সাসপেন্ড হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। কেউ কেউ বদলি হয়েছেন, বরখাস্তও হয়েছেন কয়েকজন। অনেকেই প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন। #আমিও আন্দোলনে সামিল মেয়ে সাংবাদিকরা নিজেদের যৌন হয়রানির কথা প্রকাশ করে একই সঙ্গে পুরুষতন্ত্রের ভণ্ডামির মুখোশ ছিঁড়ে ফেলল, আর সেই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমেরও। সমাজের ‘চোখে আঙুল দাদা’-র কাজ করে সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলি। হরদম নারী-পুরুষ সাম্যের পক্ষে সওয়াল করে। তারা যে নিজেরাই এক একটা পুরুষতন্ত্রের আখড়া, তা স্পষ্ট করল #আমিও আন্দোলন।

 

কী করে সমাধান সম্ভব?

#আমিও আন্দোলনের অভিঘাতে সমাজ যেমন বেসামাল হল, তেমনই আন্দোলনের মধ্যেও বিতর্কের ঘূর্ণি উঠল। অন্যায়ের প্রতিবাদ, ন্যায়বিচার পাওয়ার ইচ্ছা যে কোনও আন্দোলনের চালিকাশক্তি। কিন্তু সমাজমাধ্যমে একজনের বিরুদ্ধ অভিযোগ আনা, তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই তাকে দোষী প্রতিপন্ন করা, এও কি অন্যায় নয়? #আমিও আন্দোলনের বিরোধিতা করে অনেকে (তার মধ্যে মেয়েরাও আছেন) বললেন, হতে পারে, অনেক পুরুষ বাস্তবিকই অপরাধী। কিন্তু নিরপরাধের নামেও যে অভিযোগ উঠছে না, তা কি বলা যায়? অন্যায়ের প্রতিকার পাওয়ার রাস্তা তো রয়েছে। সে পথে না গিয়ে এমন ‘শর্ট কাট’ খোঁজা কেন? আঠেরো-কুড়ি বছর আগের ঘটনায় কারওকে অভিযুক্ত করলে সে কী করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবে?

এর বিপরীতে, #আমিও আন্দোলনের সমর্থকরা বলেন, দফতরের ইন্টার্নাল কমপ্লেনস কমিটি, পুলিশ বা আদালত যৌন হয়রানির অভিযোগকে কী চোখে দেখে, আর কী বিচার দেয়, তা কি আমরা দেখিনি? সেখানে নিরপেক্ষতা তো দূরস্থান, মেয়েদের উপর অপরাধের জন্য মেয়েদেরই দায়ী করার সাবেকি প্রবণতা পূর্ণমাত্রায় বর্তমান। প্রতিকারের আর সব পথ বন্ধ বলেই এমন সরাসরি ‘নাম নাও, লজ্জা দাও’ পদ্ধতি নিতে হয় মেয়েদের। যতদিন না ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠানগুলি যথাযথভাবে কাজ করবে, ততদিন এমন আইন-বহির্ভূত উপায় কাজে লাগাতে হবে মেয়েদের।

এ কথাকে মান্যতা দেয় আমাদের সংগঠন, সাউথ এশিয়ান উইমেন ইন মিডিয়া। তবে সেই সঙ্গে ‘আমিও’ আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও আমরা সচেতন। সেই সীমাবদ্ধতা এই যে, যে কোনও অভিযোগ প্রথমেই দু পক্ষের একটা সংঘাত তৈরি করে, যার ফলে কোনও বিচার-বিবেচনার আগেই কোনও একটা পক্ষ নিতে হয় অন্যদের। যাঁরা সংবাদপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরের সমস্যা নিয়ে ওয়াকিবহাল, সংস্কারের প্রয়োজন বোঝেন, তাঁরাও সেই সংঘাতের আবর্তে পড়েন, এবং অমুক দিন আসলে কী ঘটেছিল, তমুকের কী গোপন মতলব ছিল, এই সব প্রশ্নে ঘুরপাক খেতে থাকেন। যা আসল কাজ, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার পরিবর্তন, সেটা যথেষ্ট মনোযোগ পায় না।

সেই জন্যই এই ধরনের সমীক্ষার প্রয়োজন। অপরাধ যে প্রতিনিয়ত ঘটছে, এবং তা ঘটছে সংবাদমাধ্যমে পুরুষ-আধিপত্যের সুযোগ নিয়ে, সে কথাটা সামনে আনা দরকার বারবার। তাতে নিগ্রহকারীর নাম প্রকাশ হোক আর না হোক, নিগ্রহের সত্যতা প্রতিষ্ঠা করা যায়। তাই ২০১৮ সালের #আমিও আন্দোলনের অব্যবহিত পরে ভারতের দুটি প্রধান নারী সাংবাদিক সংগঠন স্বতন্ত্রভাবে মহিলা সাংবাদিকদের যৌন হয়রানি নিয়ে সমীক্ষা শুরু করেছিল, এবং বছর দুয়েকের মাথায় তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট প্রকাশ করল। উদ্দেশ্য, মেয়েদের জন্য হিংসাশূন্য, সাম্যময়, সম্মানজনক কাজের পরিবেশ তৈরি করা।

 

যৌন নিগ্রহ: একটি সমস্যার সালতামামি

এর আগের সমীক্ষাগুলির মতো, এই সমীক্ষার রিপোর্টও দেখাচ্ছে, সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলির নিয়মকানুনে বড়সড় ফাঁক থেকে যাচ্ছে। যার ফলে একদিকে মেয়েদের সমান সুযোগ থেকে বঞ্চনা করা সহজ হচ্ছে, আর অন্যদিকে যৌন নিগ্রহ করে অনায়াসে পার পেয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে। সুযোগ থেকে বঞ্চনা, আর যৌন হয়রানি— এ দুটি লিঙ্গবৈষম্যের এ-পিঠ আর ও-পিঠ। যৌন হয়রানি ঘটতে পারে, এই আশঙ্কায় কিছু সংবাদপ্রতিষ্ঠান এখনও কেবল কিছু ফিচার পাতায় মহিলাদের কাজ দেয়। অনেক প্রতিষ্ঠান মেয়েদের নাইট ডিউটি করতে দেয় না। প্রায় কোনও কাগজ বা চ্যানেলই জেলায় মহিলা রিপোর্টার নিতে চায় না। পুরুষের হিংসা, এবং হিংসার আশঙ্কা, মেয়েদের কাজের সুযোগকে সঙ্কুচিত করে। যে সংবাদমাধ্যম ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহের বিচার দাবি করে আকাশ ফাটায়, সে-ও মহিলা সাংবাদিকদের প্রতি একই অবিচার করে। আমাদের সমীক্ষায় ৪৯ শতাংশ মেয়ে, এবং ৪০ শতাংশ পুরুষ জানিয়েছেন, তাঁদের সংবাদপ্রতিষ্ঠানকে তাঁরা ‘সমান সুযোগ কর্মক্ষেত্র’ (ইকোয়াল অপরচুনিটি ওয়ার্কপ্লেস) বলে মনে করেন না।

এখনও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে আইন মোতাবেক যৌন হয়রানি প্রতিকারের কমিটি তৈরি হয়নি। আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে কোনও কোনও সংস্থার আধিকারিকরা জানিয়েছেন, কমিটি তৈরির প্রয়োজন আছে বলেও তাঁরা মানেন না। যৌন নিগ্রহ তাঁদের প্রতিষ্ঠানে ঘটে না, এমনও দাবি করেছেন অনেকে। যে কটি প্রতিষ্ঠান কমিটি তৈরি করেছে, তারাও তা তৈরি করেই হাত ধুয়ে ফেলেছে। আইনে রয়েছে, যৌন হয়রানি কী, বিচারের প্রক্রিয়া কী, তার শাস্তি কী, সে সব তথ্য কর্মীদের জানাতে হবে। কিন্তু সে কাজগুলো উপেক্ষিত হয়, তাই সমীক্ষায় ৩১ শতাংশ সাংবাদিক বলেছেন, কমপ্লেনস কমিটি আছে বলে তাঁরা জানেন না, ২৯ শতাংশ বলেছেন, কমিটি নেই। সাক্ষাৎকারে অধিকাংশ মেয়ে সাংবাদিক জানিয়েছেন, তাঁদের কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির অভিযোগের প্রতি হয় উপেক্ষা, নয় বিরূপ মনোভাবই তাঁরা দেখেছেন। একজন জানিয়েছেন, জেলার এক মহিলা সাংবাদিক তার সিনিয়র সহকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করার পরে তা প্রত্যাহার করার জন্য চাপ দেওয়া হয় তাকে। অভিযোগ ফিরিয়ে না নিয়ে সে কাজ ছেড়ে দেয়। আর একটি মেয়ে অভিযোগ করলে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, ‘তুমি জোরে হাসো কেন?’ মেয়েটি কোনওভাবে ছেলেটিকে প্রশ্রয় দিয়েছে ঘনিষ্ঠ হতে, এই অভিযোগ যেন পালটা আক্রমণের হাতিয়ার। মেয়েটিকে বিব্রত করতে তা যথেষ্ট কার্যকর, কারণ কোনও সহকর্মীর সঙ্গে সাধারণ কথাবার্তা, হাসিঠাট্টা, একসঙ্গে চা-কফি খাওয়া যে ‘ঘনিষ্ঠ হওয়ার আহ্বান’ নয়, তা বোঝানো কঠিন। এমন নয় যে, কিছু মেয়ে যৌনতার খেলায় যোগ দেয় না, আমাদের বলেছেন সাংবাদিকরা। কাজে টিকে থাকার, এগিয়ে যাওয়ার শর্ত সিনিয়র সহকর্মীর একটা ‘বিশেষ’ সম্পর্ক তৈরির প্রস্তাবে সায় দেওয়া— সেটা বুঝে, বা আন্দাজ করে, তারা সিনিয়র সহকর্মীকে কিছুটা প্রশ্রয় দেয়। পরে অতিষ্ঠ হয়ে নিষ্কৃতি যখন চায়, তখন তাকে ‘ধান্দাবাজ’ প্রতিপন্ন করা হয়। ওই সিনিয়র সহকর্মী কেন নিজের ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে একটা সম্পর্ক তৈরি করলেন, সে প্রশ্নটা তেমনভাবে ওঠে না। যৌন হয়রানির প্রসঙ্গ তুললেই প্রথম প্রতিক্রিয়া শোনা যায়, ‘মেয়েটারও দোষ আছে।’ সমস্যা হয় যখন প্রতিষ্ঠানও এই মানসিকতায় চলে। এর ফলে একটি মেয়ে অভিযোগ করলে দফতরে তাকে যেমন আচরণ এবং মন্তব্য তাকে সইতে হয়, তা আর এক প্রস্থ নির্যাতনের সামিল। আবার বহু ক্ষেত্রে সংবাদ দফতরের প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামোটি ঢিলেঢালা, প্রায় অংসগঠিত ক্ষেত্রের মতো। অনেক সময়ে বড় সংবাদপ্রতিষ্ঠানের ছোটখাট ব্যুরোতে এমন একটি ‘ইনফর্মাল’ পরিবেশ থাকে, জানাচ্ছেন সাংবাদিকরা। সেখানে সুবিচার পাওয়ার কোনও প্রক্রিয়া নেই বলে বহু মেয়ে সাংবাদিক আরও বিপন্ন হয়ে পড়ে। বিপন্নতা এড়াতে তারা নানা কৌশল নেয়। একজন সাংবাদিক আমাদের বলেছেন, তিনি এক মেয়ে সহকর্মীকে দেখতেন যে অফিসে পরে আসে ঢিলেঢালা পোশাকে, কিন্তু বাইরে পরে ফ্যাশনদুরস্ত পোশাক। কারণ জিজ্ঞাসা করতে সে বলেছিল, বস-এর কুনজর এড়াতে চায় সে। “এমনই সতর্ক হয়ে কাজ করে মেয়েরা,” সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন ওই মহিলা সাংবাদিক।

এক সিনিয়র মহিলা সাংবাদিক বলছেন, “যখন যৌন হয়রানির ঘটনা সামনে আসে, গোটা মিডিয়া হাউজ় চুপ করে যায়। পুরুষটির বিরুদ্ধে একটি কথাও কেউ বলে না। পুরুষ রিপোর্টারদের সংযোগ থাকে নেতাদের সঙ্গে, যারা ওই অভিযুক্তের হয়ে কথা বলে। নেতারা সব সময়ে পুরুষদের সমর্থন করে, কারণ তারা জানে যে পুরুষরাই টিকবে, মেয়েরা টিকবে না। আমি একটি দৈনিকের কথা জানি যেখানে একটি পুরুষের নামে অনেক মেয়ে অভিযোগ করার পর তার চাকরি চলে যায়, কিন্তু সে সঙ্গে সঙ্গে অন্য একটি মিডিয়া হাউজ়ে কাজ পেয়ে যায়। অন্যদিকে, একটি মেয়ে হয়রানির অভিযোগ করে থাকলে তার অন্যত্র কাজ পাওয়া কঠিন।” হয়রানির প্রতিবাদে কাজ ছেড়ে অন্যত্র আরও নিচু পদে, কম টাকায় কাজ করতে বাধ্য হয়েছে, এমন দৃ্ষ্টান্ত মিলেছে। আবার, যৌন হয়রানি সহ্য করে কাজ করছেন অন্য কাজ না পাওয়ার আশঙ্কায়, এমন সাক্ষ্যও মিলেছে সাক্ষাৎকারে।

যৌন হয়রানির মূলে যে রয়েছে ক্ষমতার প্রকাশ, কেবল যৌনতা নয়, এ কথা এই সমীক্ষাতেও ফের প্রকাশ পেয়েছে। কোনও মেয়ে অফিসের গাড়ির ড্রাইভারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে সে বরখাস্ত হবে, কিন্তু বসের বিরুদ্ধে করলে মেয়েটিকেই চাকরি ছাড়তে হবে, জানা যাচ্ছে সাংবাদিকদের কথা থেকে। পুরুষ সাংবাদিকদের আলোচনাচক্রে একজন সিনিয়র পুরুষ সাংবাদিক বলছেন, “সহকর্মীদের দুর্ব্যবহার মেয়েরা সাধারণত সামলে নেয়, আসল অপরাধী হল যারা ক্ষমতার জায়গা দখল করে আছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা কঠিন। আর আইন যা-ই থাক, কেউ অভিযোগ করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অভিযোগের খবর, আর তাকে ঘিরে ভয়ানক সব গুজব ছড়িয়ে যাবে গোটা সংবাদমহলে।” এই সাংবাদিকের মতে, কীভাবে মেয়েরা যৌন হয়রানির মোকাবিলা করবে, তা শেষ অবধি মেয়েদের দক্ষতার উপর নির্ভর করে।

 

সামনের পথ

অর্থাৎ ‘আমিও’ আন্দোলনের ঢেউ বয়ে যাওয়ার পরেও যৌন নিগ্রহের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে রয়েছে আগের মতোই। পঁচিশ বছর আগে যখন আমি যোগ দিয়েছিলাম সংবাদমাধ্যমে, তখন যে ধরনের ব্যবহার পেয়েছি, আজ আমার নবীনতম সহকর্মী মেয়েটি যে তা পাবে না, সে যে অধিক সুরক্ষিত, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। যদিও সাংবাদিকতায় অনেক বেশি মেয়ে এসেছে, তারা অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করছে, তাদের অনেকে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের ঘরে ঘরে পরিচিত নাম, তবু তাদের অসম্মানের সঙ্গে মোকাবিলা করে কাজ করে টিকে থাকতে হবে, এমন আদ্যন্ত অন্যায় শর্তটা রয়েই যাচ্ছে।

এই সমীক্ষা তার প্রতিবাদ। এর ফলগুলি একই সঙ্গে অন্যায়কে প্রকাশ করছে, এবং তার সমাধানের পথ দেখাচ্ছে। আমরা চাই, প্রতিটি সংবাদপ্রতিষ্ঠান যৌন হয়রানিকে একটি সমস্যা বলে স্বীকার করুক। কেবল আক্ষরিক অর্থে নয়, আইনের কথাগুলির অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যকে সম্মান করে যৌন নিগ্রহের প্রতিকারের ব্যবস্থা নির্মাণ করুক। ইনটার্নাল কমপ্লেনস কমিটির কাছে কত অভিযোগ এল, কী নিরসন হল, তার অডিট সর্বসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে (অবশ্যই সব পক্ষের পরিচয় গোপন রেখে), যাতে কমিটি তার কাজে কতটা স্বচ্ছ ও তৎপর, তা সবাই বুঝতে পারে। যেহেতু বর্তমানে ফ্রিলান্সার বা রিটেনার সাংবাদিকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, তাই তাদের দায়ের করা অভিযোগ, বা তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগও গ্রহণ করতে হবে।

যেহেতু বহু ছোট-মাঝারি সংবাদপ্রতিষ্ঠানে প্রশাসনিক পরিকাঠামো নেই, কিংবা তা অতি দুর্বল, তাই প্রেস ক্লাব, সাংবাদিক ইউনিয়ন, বিবিধ মহিলা সংগঠন, কর্মী ইউনিয়নকে দায়িত্ব নিতে হবে কর্মক্ষেত্রে যৌন নিগ্রহ বিষয়ে প্রচার চালানোর ও প্রতিবিধানের ব্যবস্থা করার। আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করেছি, কলকাতা প্রেস ক্লাব #আমিও আন্দোলনের সময়ে যৌন নিগ্রহের বিষয়ে তাদের কর্তব্যকে কেবল ক্লাবের পরিসরে ঘটে থাকা নিগ্রহের প্রতিকার করবার আশ্বাসে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। আমরা এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নই। আমরা মনে করি, প্রেস ক্লাবের দায়িত্ব কেবল তার ভৌগোলিক সীমা দিয়ে নির্ধারিত হয় না। তার সকল সদস্য, বিশেষত কোনও মহিলা সদস্য অন্যায়ের প্রতিকার না পেলে, তাঁর পাশে দাঁড়ানো প্রেস ক্লাব, সাংবাদিক ইউনিয়ন-সহ যে কোনও কর্মী সংগঠন বা সামাজিক সংগঠনের কর্তব্য। ক্লাব, ইউনিয়নগুলিও যদি পুরুষতন্ত্রের ঘাঁটি হয়ে থাকে, যৌন হয়রানিতে অভিযুক্ত পুরুষদের প্রশ্রয়ের চোখে দেখে, তবে তা কাজের পরিবেশকে দূষিত করে।

আমরা আশা করছি, সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলি, সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন, সর্বস্তরের সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী, এবং সেই সঙ্গে শ্রমিক সংগঠন, মহিলা সংগঠন, মানবাধিকার নিয়ে কর্মরত সংস্থাগুলি এই সমীক্ষা-ভিত্তিক প্রতিবেদনটিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করবে।

আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই সেই সব সাংবাদিকদের, যাঁরা এই সমীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। যে সব সংবাদ প্রতিষ্ঠানের আধিকারিকরা সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হয়েছেন, তাঁদেরও ধন্যবাদ জানাই। সাউথ এশিয়ান উইমেন ইন মিডিয়ার পক্ষ থেকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানাই ‘সংহিতা’-র কর্ণধার সোমা সেনগুপ্ত এবং তাঁর তরুণী গবেষকদের প্রাণবন্ত দলটিকে। এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে সমীক্ষা-সাক্ষাৎকার গ্রহণের কঠিন কাজটিকে আন্তরিকতা, ধৈর্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁরা সম্পন্ন করেছেন। বাংলা তথা ভারতের প্রতিটি মেয়ের জন্য নির্ভয়, আনন্দপূর্ণ, সাম্যময় কর্মক্ষেত্রের স্বপ্নকে সত্য করার লক্ষ্যে আমরা যৌথ ভাবে এই প্রতিবেদন পেশ করছি।

সাধারণ সচিব, সাউথ এশিয়ান উইমেন ইন মিডিয়া
নারী দিবস, ২০২১


[1] ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে ৪, ২০১৫-১৬। ৫২ শতাংশ মেয়ে এবং ৪২ শতাংশ পুরুষ বলেছিল, সাতটি কারণের কোনও একটির জন্য স্ত্রীকে মারধর করা যেতে পারে— স্বামীকে না জানিয়ে বাইরে যাওয়া, সংসার বা ছেলেমেয়েকে যথেষ্ট মনোযোগ না দেওয়া, বরের সঙ্গে তর্ক করা, বরের সঙ্গে যৌনসম্পর্কে রাজি না হওয়া, ঠিকমতো রান্না না করা, অপর পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কের সন্দেহ, শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি অসম্মান প্রদর্শন।

[2] উর্বশী বুটালিয়া, দ্য আদার সাইড অব সাইলেন্স। পেঙ্গুইন, ১৯৯৮

[3] অপর মহিলা সাংবাদিক সংগঠনটির সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যৌন হয়রানির পরে মেয়েদের ৫৩ শতাংশ তা কাউকে জানায়নি। যারা কোনও অভিযোগ দায়ের করেনি, তাদের ৪৭ শতাংশ জানিয়েছে, এর কারণ তাদের প্রতিকারের প্রক্রিয়ার উপর আস্থা নেই। ‘ক্রিয়েটিং সেফ ওয়ার্কপ্লেসেস: প্রিভেনশন অ্যান্ড রিড্রেসাল অব সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট ইন মিডিয়া হাউজ়েস ইন ইন্ডিয়া।’ প্রকাশক: নেটওয়ার্ক অব উইমেন ইন মিডিয়া এবং জেন্ডার অ্যাট ওয়ার্ক।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...