অসভ্যতা, ধর্মান্ধতার পথে এ এক দুঃসহ যাত্রা আমাদের

দুর্জয় আশরাফুল ইসলাম

 




কবি

 

 

 

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ পূর্বপুরুষের স্মৃতিচারণ অর্থে কুকীদের কথা বলেছিলেন, যারা সভ্যতার থেকে বেশ পেছনে। কিন্তু তিনি কি জানতেন এর চেয়েও বড় অসভ্যতা তারই জন্মভূমিতে, তার স্মৃতিগুলোর সঙ্গে ঘটতে থাকবে তার প্রয়াণেরও অর্ধশতাব্দী পরে। যে লোকটি একটা জনপদকে বৈশ্বিক পরিচয় এনে দিলেন তার নামাঙ্কিত গানের স্কুল আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হবে বারবার!

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানার শিবপুরে জন্মেছিলেন যখন তখন সেটা ত্রিপুরা, সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ এমন প্রবলভাবে জন্মায়নি। না হয় তাঁরই স্মৃতিতে, শিবমন্দিরে গাভীর ওলান থেকে প্রথম দুধ নিয়ে কি হিন্দু কি মুসলমান, পাশাপাশি বসত করছে যারা, তাদের যাপন নিয়ে শত প্রশ্নের আগে গ্রামের নাম নিয়েও কি আপত্তি উঠত না! যেমনটা চলে আজ ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে, ব্রাহ্মণ হিন্দুয়ানি শব্দ, এর সংক্ষিপ্ত রূপ তাই বি, একটা সাম্প্রদায়িক প্রয়াস, কিন্তু স্পষ্টভাবে এর বিরুদ্ধে দাঁড়াবে কজন! প্রশাসনিকভাবে নাকি ব্রাহ্মণবাড়িয়া নাম টিকিয়ে রাখবার প্রয়াস আছে, সে শোনা অর্থেই, সরকারি কত প্রতিষ্ঠান যে বদলকে জড়িয়ে নিয়েছে গায়ে। এখন তো আরও অদ্ভুত, উচ্চারণে ব থাকে না এমন নাম নিয়েও প্রয়াস চলছে। এসবই আসলে রাজনীতি। উত্তরভারতে যা বাংলাদেশেও তা। যে লোককে দেখি অন্য দেশের নামবদল নিয়ে চিন্তিত হতে তাকেই দেখি নিজের পাড়ার নাম ঠাকুরপাড়া থেকে বদলে ইমামপাড়া করবার প্রয়াস নিতে। কী হয় এতে! পুণ্য, নাকি শুধুই বিদ্বেষ থেকে এসব!

এর আগে যখন পোড়ানো হয়েছিল তারপর নবনির্মাণের প্রস্তর দেখা যাচ্ছে ছবিতে। ছবি সৌজন্য: সুমন রায়
ভগ্নাবশেষ। ছবি সৌজন্য: সুমন রায়
দেয়ালে বাধানো ছবি, পুড়েছে এসবও। ছবি সৌজন্য: সুমন রায়

পুণ্যই হয় হয়তো, না হয় এমন চুপচাপ সয়ে যাওয়া জনতার মিছিলে আমরা থাকিই বা কী করে। যেখানে ইতিহাস আক্রান্ত, সংস্কৃতি আক্রান্ত, স্মৃতিপট মুছে যায় কালো অক্ষরে। ২০১৬ সালে অকারণে আগুন দেওয়া হয়েছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রগুলি। সকলেই দেখেছে কারা আগুন লাগিয়ে দিল, পত্রিকার পাতায় পাতায় ছাইয়ের ছবি, কিন্তু বিচার হল না, নিদেনপক্ষে দোষী সাব্যস্ত, সেটা আর জানা যায়নি কোনও মাধ্যমেই। এরপরও সঙ্গীতাঙ্গনটিকে জিইয়ে রাখার বাসনায় কিছু স্মারকচিত্র, ছবি, ওস্তাদের ব্যবহৃত আরও কিছু বাদ্যযন্ত্র এনে জড়ো করা হয়েছিল। তারপর আর পাঁচ বছর পেরোয়নি। আবারও পুড়িয়ে দেওয়া হল। এখন আর কিছু নেই, ছাই আর পোড়াগন্ধ, আর অন্ধকার প্রলেপ। যে অন্ধকার সভ্যতাকে মুছে দিতে চায়, যে অন্ধকার ইতিহাসকে বদলে দিতে চায়। আমরা জানি এবারও দোষী কাউকে পাওয়া যাবে না, ঠিক যেন বলিউডি সিনেমা ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’ নামাঙ্কণের সাদৃশ্য। কিছু ক্ষতিপূরণ, একটা কাঠামো, আবারও পুড়িয়ে দেওয়ার আগে। এর বেশি কিছু চাইবার কী আছে ওস্তাদ আলাউদ্দিন প্রিয় যাদের!

যে সঙ্গীতাঙ্গনটি পুড়িয়ে দেওয়া হল, সাম্প্রতিক সময়ে পরপর, সে কি শুধুই তার নামাঙ্কনের জন্য? জানা যাচ্ছে এ ওস্তাদের নিজেরই সম্পত্তি, কৃষ্ণনগরের জমিদারি থেকে কেনা এ বাড়িতে নিজের শেষ জীবনটা কাটাতে চেয়েছিলেন। ষাটের দশকে ফিরে এসেছিলেন যখন তখন এ শহর সংস্কৃতিচর্চায় ঈর্ষণীয় অবস্থানে ছিল, তবুও শেষাবধি উনি থাকেননি, না থাকতে পারেননি সে অন্য প্রশ্ন। উনি চলে যাওয়ার পর তারই ছোট ভাই আয়াত আলী খাঁ প্রতিষ্ঠা করেন আলাউদ্দিন খাঁ মিউজিক্যাল কলেজ। সেটি নাম বদলে ছিল দ্য আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন। চর্চার যা ছিল, তার অধিক ছিল স্মৃতির, গৌরবের দিকে চেয়ে থাকার। সেটি আর রইল না। কিন্তু প্রতিষ্ঠান মুছে দিলেই কি আলাউদ্দিন হারিয়ে যাবেন? এক ব্রাহ্মণবাড়িয়া তাঁর স্মৃতি সংরক্ষিত না রাখতে পারলেও পুরো পৃথিবীর সঙ্গীতপ্রেমীরা জানেন তিনি কী ছিলেন। তিনি অক্ষত থেকে যাবেন সঙ্গীতলোকে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4877 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...