বাকস্বাধীনতায় আরেক আঘাত

রঘুরাম রাজন

 

 

অর্থনীতিবিদ, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন অধিকর্তা

 

 

অশোকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুই অন্যতম প্রধান অধ্যাপকের বিদায় অতি সম্প্রতি কিছু বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ঘটে যাওয়া ঘটনাক্রম ও বিদায়ী অধ্যাপকদের বয়ান থেকে এটা স্পষ্ট যে অধ্যাপক প্রতাপ ভানু মেহতা নিজের বক্তৃতা ও লেখালেখির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের কাজের সমালোচনা করার অপরাধে সরকারের বিরাগভাজন হয়েছিলেন, যার ফলস্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ নেমে আসে ও অবশেষে 'অবাধ্য' অধ্যাপককে পদত্যাগ করতে হয়। যদিও এই লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড প্রকাশিত বিবৃতিতে ঘটনাটিকে লঘু করে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু আমাদের দেশে মুক্তচিন্তা ও শাসক-বিরোধী সমালোচনার পরিসর যে ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যেতে বসেছে সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই। অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়টির ঘটনা নিয়ে অর্থনীতিবিদ রঘুরাম রাজনের প্রতিক্রিয়ায় রয়েছে তারই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। শ্রী রাজনের সহৃদয় অনুমোদনে তাঁর লেখাটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করল চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম। পত্রিকার জন্য অনুবাদ করলেন সত্যব্রত ঘোষ।

 

ভারতে বাকস্বাধীনতার ওপর এক মর্মান্তিক আঘাত এল এই সপ্তাহে। অশোকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অধ্যাপক প্রতাপ মেহতা পদত্যাগ করলেন। অনেকে হয়তো অবগত নন যে আগামী দশকগুলিতে অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেমব্রিজ, হার্ভার্ড এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভাবা হচ্ছিল। দুর্ভাগ্যবশত, এই সপ্তাহে এখানে এক কাণ্ড ঘটল, তাতে সেই সম্ভাবনা অনেকটাই কমে গেল।

পঠনক্রমের মধ্যপথেই অধ্যাপক মেহতা পদত্যাগ করলেন। এবং এতটা আকস্মিকভাবে করলেন যে তিনি তাঁর পদত্যাগপত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানিয়েছেন যে তাঁর গাড়িচালকের জন্য উপযুক্ত বিকল্প ব্যবস্থা না করা হলে বেচারার হাতে কোনও কাজ থাকবে না। অতএব মনে হয় না যে তিনি অনেক আগে থেকে ভেবেচিন্তে তারপর এই পদত্যাগপত্র লিখেছেন।

অধ্যাপক মেহতা-র পদত্যাগের পর অধ্যাপক অরবিন্দ সুব্রামানিয়ম পদত্যাগ করলেন। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ (এবং সর্বসমক্ষে স্বীকার্য, আমার বইয়ের সহ-লেখক) অধ্যাপক সুব্রামানিয়ম ছিলেন ভারত সরকারের প্রাক্তন প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। তাঁর পদত্যাগপত্রের দুটি লাইন প্রণিধানযোগ্য:

এমন কি অশোকাও – তার বেসরকারি পরিচয় নিয়ে এবং বেসরকারি মূলধনের জোরে দাঁড়িয়েও – বিদ্যানুভ্যাস-জনিত অভিব্যক্তি এবং স্বাধীনতার পরিসর যে টিকিয়ে রাখতে পারল না, তা অত্যন্ত অশুভ ইঙ্গিত দেয়। সর্বোপরি, অশোকা-র দর্শনের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়বদ্ধতা এবং তা বাঁচিয়ে রাখাটা যেখানে খোলাখুলিভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন, সেখানে আমার পক্ষে অশোকা-র সঙ্গে যুক্ত থাকাটা কঠিন হয়ে পড়েছে।

বাস্তবটি হল, প্রতিষ্ঠানের বুকে কাঁটাস্বরূপই হয়ে উঠেছিলেন অধ্যাপক মেহতা। তিনি সাধারণ কোনও কণ্টক নন, কারণ নিজের স্পষ্ট লেখা ও চিন্তা-উদ্রেককারী যুক্তিসমূহ দ্বারা সরকার এবং সুপ্রিম কোর্টের ঊর্ধ্বতনদের অনেকের গলায় তিনি বিঁধছিলেন। বিরোধী রাজনীতির প্রতি যে তাঁর যথেষ্ট সহমর্মিতা আছে, এমনটা নয়। একজন প্রকৃত শিক্ষাবিদ হিসেবে তিনি একজন সমদর্শী সমালোচক। এখন এবং আশা রাখি, আগামী দিনেও উনি ভারতে উদারবাদের অন্যতম এক বৌদ্ধিক নেতা হিসেবে থাকবেন।

তবে অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনা মুক্তচিন্তা তথা উদারনীতির ধারণায় আঘাত করেছে। ঠিক কী কারণে যে অশোকা-র প্রতিষ্ঠাতারা উদারতা রক্ষার প্রশংসনীয় ব্যবস্থাটিকে প্রত্যাহার করলেন তা জানা নেই। নিজের পদত্যাগপত্রে অধ্যাপক প্রতাপ মেহতা লিখছেন, “প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবার পর এটি পরিষ্কার বোঝা গেছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটাকে একটি রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে গণ্য করা হতে পারে।” এর সঙ্গে অধ্যাপক সুব্রামানিয়ামের বিবৃতি যোগ করলে এমনটাই ইঙ্গিত দেয় যে অশোকা-র প্রতিষ্ঠাতারা বাইরের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে ঝামেলাবাজ এক সমালোচককে ঘাড় থেকে নামালেন।

প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে কোনও রাজনৈতিক পক্ষ নেওয়া অনুচিত। যদিও চিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের কালভেন কমিটি বলছে, “একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার প্রশ্ন সাহসের অভাবের কারণে অথবা নির্বিকারত্ব এবং অসংবেদনশীলতার কারণে উঠবে না। উঠবে স্বাধীন অনুসন্ধান এবং নানান ধরণের দৃষ্টিভঙ্গির বৈচিত্র্যকে পোষণ করবার জন্যে। এবং নিরপেক্ষতার এই প্রতিষ্ঠানের তুষ্টি তখনই ঘটে যখন তার শিক্ষকমণ্ডলী এবং ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তি হিসেবে রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং সামাজিক প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করবার স্বাধীনতা থাকে।” অন্যভাবে বললে, যে কোনও মহান বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ভূমিকাটি হল তার শিক্ষাবিদ এবং ছাত্রছাত্রীরা যাতে মুক্তমনে সাধারণ বিতর্কে অবতীর্ণ হতে পারে, তার জন্য সুরক্ষিত এক পরিসর প্রদান করা। ভারতে নালান্দা এবং তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমনটা ছিল।

এবং সেই স্বাধীনতা জরুরি, কারণ কালভেন কমিটি জোর দিয়ে বলেছে, “গঠন এবং প্রভাবের দিক থেকে (একটি বিশ্ববিদ্যালয়) এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা অস্থিমান সামাজিক ব্যবস্থার প্রতি অসন্তোষ জানিয়ে নতুন ব্যবস্থার প্রস্তাবনা রাখে। সংক্ষেপে, ভাল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হল সক্রেতিস-এর মতো নাড়া দেওয়া।” উন্নত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয় যেখানে চিন্তনের প্রগতি ঘটে এবং পরিবর্তনের সূচনা হয়। অচলায়তন সমালোচনাকে স্তব্ধ করে সমাজকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়, যা শেষ অবধি কতৃত্ববাদ এবং সংকীর্ণ গোষ্ঠীচিন্তার ভারে ডুবে মরে।

অশোকা-র প্রতিষ্ঠাতাদের বোঝা উচিত ছিল যে রাজনৈতিক পক্ষাবলম্বন করাটা নিশ্চিতভাবে তাঁদের লক্ষ্য নয়। বরং অধ্যাপক মেহতার মতো মানুষদের বলবার অধিকারটি তাঁদের রক্ষা করে যাওয়াটাই শ্রেয়কর হত। এমনটা করে অশোকা-কে তাঁরা ভারতের সুস্থতা রক্ষার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ অবদান রেখে যেতে সক্ষম করতেন – কোথায় ভুল হচ্ছে এবং সেই ভুল শুধরানোর জন্যে আমাদের সবাইকে উৎসাহিত করতেন। অশোকা-র প্রতিষ্ঠাতারা যদি ভেবে থাকেন ক্ষমতাসীনদের হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মিলিয়ে ওঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থরক্ষা করলেন, তাহলে তাঁরা ভুল ভেবেছেন। মহান কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের আত্মাই হল তার বাকস্বাধীনতা। সেখানে আপোষ করে প্রতিষ্ঠাতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আত্মারই হাতবদল করেছেন। যদি আপনি নিজের আত্মারই হাতবদল করাতে রাজি হয়ে যান, তাহলে চাপ সরে যাওয়ার কি কোনও উপায় থাকে? ভারতের ক্ষেত্রে এই নতুন ঘটনাটি যথেষ্ট দুঃখজনক।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...