‘নো-নর্ম্যাটিভিটি’র জাতপাত: “স্লপি কিসেস”-এর দলিত পাঠ

অমৃতা সরকার

 

ইংরেজি সাহিত্যের সহকারী-অধ্যাপক। গদ্যকার ও অনুবাদক।

 

 

 

 

সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া “ আজীব দাস্তানস” চারটি  আলাদা আলাদা গল্প নিয়ে তৈরি। চারটি গল্পের যোগসূত্র হল তথাকথিত ‘স্বাভাবিক’ পরিসরের বাইরের ভঙ্গুর সম্পর্কের রসায়ন। এই পরিসর কখনও হোমোসেক্সুয়ালিটি, কখনও প্রান্তিক মানুষের রাগের বীভৎস বহিঃপ্রকাশ, কখনও লেসবিয়ান সম্পর্কে দলিত-ব্রাহ্মণ রসায়ন, আবার কখনও শারীরিক ‘প্রতিবন্ধকতা’কেই সেতু করে জুড়ে যায় দুটি নিশ্চুপ মন। 

আমি ফিল্ম ক্রিটিক নই। এই লেখাটি তাই সিনেমা নিয়ে কোনও আলোচনা নয়। আমার আইডেন্টিটি ও পজিশনালিটি একজন দলিতের। এই কারণেই আমার আগ্রহ শুধুমাত্র তৃতীয় গল্পটি নিয়ে। এই লেখা তাই দলিত রাজনীতিরই অংশ। শর্ট ফিল্মটির নাম “গিলি পুচি” (“স্লপি কিসেস”), পরিচালক নীরজ ঘাওয়ান।

দুইজন নারীর গল্প বুনেছেন পরিচালক। ভারতী মণ্ডল ও প্রিয়া শর্মা—- এই দুই নারী প্রায় একই আর্থ-সামাজিক শ্রেণির মানুষ। ভারতী মণ্ডল একটি কারখানায় পুরুষদের সাথে কায়িক শ্রমের কাজ করেন , পুরুষদের চেয়েও দক্ষ ভাবে। গোটা কারখানায় একমাত্র নারীকর্মী ভারতী। পুরুষদের সাথে একই টয়লেট ব্যবহার করতে হয় তাকে। তার পাখির চোখ কারখানার ‘ডেটা অপারেটর’-এর পদটি। যে পদটির জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা তার আছে, কিন্তু সেই পদের জন্য তাকে বারবার নাকচ করা হয় ট্যালি ও এক্সেলের কোনও ‘পেশাদার’ অভিজ্ঞতা না থাকায়। সেই পোস্টটিতেই নিয়োগ করা হয় প্রিয়া শর্মাকে। ভারতীকে তার বস জানান যে প্রিয়া খুব ভালো ট্যালি ও এক্সেল জানে। গল্প এগোলে আমরা জানতে পারি প্রিয়া চাকরিটি পেয়েছে সেই শহরের হবু মোহান্তের পুত্রবধূ হিসেবে যে ট্যালি বা এক্সেল না জানলেও হাত দেখতে জানে । প্রাথমিকভাবে ভারতী বুঝতে পারে না যে তাকে কেন ‘ডেটা অপারেটর’ হিসেবে নেওয়া হয় না। ভারতীর সহকর্মী দশরথ ভারতীকে মনে করিয়ে দেয় যে এইটা বেসরকারি জায়গা, এখানে বসের ‘জাতে’র উপর নির্ভর করে ‘হোয়াইট কলার’ পোস্টটিতে কোনও শর্মা প্রথম পছন্দের হয় কোনও মন্ডলের চেয়ে। দশরথ আরও জানায় যে ভারতীর পদবি ‘ব্যানার্জি’ হলে এতদিনে ভারতীর ওই পোস্টে নিয়োগ হয়ে যেত। স্বাভাবিক ভাবেই ভারতীর সমস্ত ক্ষোভ গিয়ে পড়ে প্রিয়া শর্মার উপর। এক টেবিলে খেতে বসে প্রিয়া বন্ধুত্বের হাত বাড়ালে ভারতী তার কাছে নিজের ‘মন্ডল’পরিচয় লুকিয়ে ‘ব্যানার্জি’ হয়ে যায়। এরপর গড়ে ওঠে এক সহজ সখ্যতা। সেই সখ্যতা পরতের পর পরত খুলতে থাকে এই দুই নারীর যৌনরুচিতে। ভারতী ও প্রিয়া দুজনেই লেসবিয়ান। দুজনেরই অতীতে সঙ্গিনী বিচ্ছেদ হয়েছে। ভারতী নিজের লেসবিয়ান-সত্তাকে মর্যাদা দিয়ে দরকারে একলা থাকার সাহস রাখে। অন্যদিকে প্রিয়া সামাজিক নিরাপত্তায় থাকতে চেয়ে বেছে নিয়ে একটি অসুখী যৌনজীবন। প্রিয়ার দাম্পত্য কিন্তু সবদিক থেকে অসুখী নয়। তার স্বামী শিব একজন সংবেদনশীল, ঘরের কাজে সাহায্য করা পুরুষ। এই ‘প্রোটেকটিভ’ প্যাট্রিয়ার্কি তাকে স্বস্তিতে রাখলেও, জীবনের চূড়ান্ত উদযাপন থেকে দূরে সরায়। প্রিয়া ফিরে পেতে চায় তার কলেজ জীবনের স্কুটির বাঁধন ছেঁড়া উচ্ছল লেসবিয়ান যাপন। বিয়ের পর ভারতীই তার সেই যাপনের সঙ্গিনী হয়ে ওঠার দিকে এগোতে থাকে। চুমু, মুর্গির মাংস, দই-বড়া ইত্যাদিতে খুঁজে পেতে শুরু করে নিয়ম ভাঙার আনন্দ।  ঠিক এই সময়েই প্রিয়া শর্মার প্রেমে পড়া ‘ভারতী ব্যানার্জি’ জানায় তার দলিত-পরিচয়। এবং কাস্ট ম্যাটারস। তাই প্রিয়ার স্বতঃস্ফূর্ততা উবে যায়। সে ভারতীকে বুঝিয়ে দেয় ব্রাহ্মণ ও দলিতের সেই দূরত্ব যা লেসবিয়ান হয়েও অতিক্রম করা সম্ভব হয় না তার ক্ষেত্রে। প্রেম না থাকলেও সে বুঝতে পারে যে ভারতী তার পক্ষে বেশ কাজের। কাজের জায়গাই হোক, কি ব্যক্তিগত জীবন সে ভারতীকে ব্যবহার করতে চায়। এই হিপোক্রিসি টের পাওয়া মাত্র ভারতী আরও সুচতুরভাবে ব্যবহার করে প্রিয়া শর্মার ‘ব্রাহ্মণ’ নারী হওয়ার লক্ষ্মণরেখাগুলি। তাকে মা হওয়ার জন্য উৎসাহিত করে, এমনকি নিজের বাড়িও ব্যবহার করতে দেয় প্রিয়া ও শিবকে নিরিবিলিতে সঙ্গমের জন্য। প্রিয়াকে শিখিয়ে মা হওয়ার আগুপিছু শর্ত। পরিশেষে দেখা যায় প্রিয়া মা হয়ে আরও বেশি মানসিক জটিলতায় ডুবতে থাকে এবং তার শাশুড়ির ব্রাহ্মণ্যবাদী মানসিকতাকে ব্যবহার করে ভারতী প্রিয়ার চাকরিতে পুনরায় যোগদান আটকে দেয়। ততদিনে প্রিয়ার পোস্টে প্রিয়ার চেয়ে অনেক দক্ষ ভাবে কাজ করে ভারতী তার বসকে পরোক্ষভাবে বাধ্য করে ‘ডেটা অপারেটর’-এর কাজটিতে তাকে বহাল করতে।  

‘সিরিয়াস মেন’-এর পর কাস্ট ইস্যু নিয়ে এমন আ্যপ্রোচ দেখা গেল এই শর্ট ফিল্মটিতে। ছবিটির গল্পের রাজনীতি নিয়ে দু-একটি বিষয় ভাবায়।

 

১। ব্রাহ্মণ্যবাদী ভাইবেরাদরি চাকরির ক্ষেত্রে একজন দক্ষ দলিতের চেয়ে এগিয়ে রাখছে একজন অদক্ষ ব্রাহ্মণকে। এটা ব্রাহ্মণ্যবাদের নিজস্ব সাইলেন্ট রিজার্ভেশন। আম্বেদকর প্রণীত রিজার্ভেশন আইনের বহু যুগ আগে থেকেই প্রচলিত। 

২। লেসবিয়ান ( যে হেটেরো-সেক্সুয়ালিটি প্র‍্যাকটিস করতে বাধ্য হচ্ছে) ব্রাহ্মণ মেয়েটি ও দলিত মেয়েটি একই ‘ক্লাস’ থেকে বিলং করে। তাই ব্রাহ্মণ মেয়েটি প্রেমে পড়তে অসাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। কিন্তু ‘ব্যানার্জি’ যখন ‘মণ্ডল’ বার হয় তখন অসাচ্ছন্দ্য আসে। তার ব্যবহার দলিত মেয়েটির ক্ষেত্রে বদলে যায়। দূরত্ব রেখেই ব্রাহ্মণ মেয়েটি দলিত মেয়েটিকে কাজের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে।(কিছু প্রেম ভাব, কৃতজ্ঞতা ইত্যাদি বজায় রেখে)। 

৩। দলিত মেয়েটির কর্মক্ষেত্রে ডবল মার্জিনালাইজড অবস্থা্ন। দলিত পুরুষেরাও তাকে হেনস্থা করে, যারা তার চেয়ে অদক্ষ। কর্মক্ষেত্রে তার একটি মহিলাদের জন্য বরাদ্দ টয়লেট পাওয়ার অধিকার নেই। একজন অপ্রেসর কাস্ট-এর মহিলা কাজে যোগ দিলে, মহিলাদের পৃথক টয়লেটের প্রয়োজনীয়তা সিদ্ধ হয়।

৪। যে মুহূর্তে দলিত মেয়েটি বোঝে যে সে ব্রাহ্মণ মেয়েটির ‘প্রেম’ নয়, সে স্রেফ ‘সারোগেট’ একজন; সে তার যাবতীয় প্রেমজনিত দুর্বলতাকে ঝেড়ে ফেলে একজন ‘হিপোক্রিট’ ‘সাবমিসিভ’ লেসবিয়ানকে হেটেরো-সেক্সুয়ালিটির ‘নর্মাটিভ’ খাঁচায় বন্দী করতে ঘুঁটি সাজায়।

৫। সবশেষে বলি, প্রখ্যাত ফেমিনিস্ট উমা চক্রবর্তী তার “Gendering Caste: Through Feminist Lense” বইতে জানিয়েছেন যে, কিছু দলিত চিন্তাবিদ যুক্তি দিয়েছেন, অপ্রেসর কাস্টের মহিলাদের থেকে দলিত মহিলারা কম অপ্রেসড হন। কারণ তাদের ‘codes of Izzat- honour, respect, shame’ এসবের ধার ধারতে হয় না।(বিষয়টি তর্ক সাপেক্ষ, অন্যত্র আলোচনা করা যাবে’খন)। সমাজের সমস্ত এক্সপেকটেশন একজন দলিত নারীকে (যেমন আদর্শ স্ত্রী বা মা হওয়া ইত্যাদি) পূরণ করতে হয় না। এই সূত্রে বলা যায়, দলিত মেয়েটি ব্রাহ্মণ্যবাদের এই code of conduct কে হাতিয়ার করেছে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে এবং এক্ষেত্রে তার মা, ঠাকুমার পেশা (দাই-মা) থেকে অর্জিত জ্ঞানকেও কাজে লাগিয়েছে সুচতুর ও সুচিন্তিতভাবে।

ভারতীয় মূলধারার সিনেমা দলিত-রাজনীতি নিয়ে ক্রমশ সাবালক হয়ে উঠছে, দলিত ‘প্রোটোটাইপ’ ভাঙছে। এটাই আশার ও আনন্দের কথা। 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...