মিথ্যে স্বর্গে বাঁচতে চাইলে আমরা বাঁচতেই পারি, সে বাঁচা আটকায় কে?

পারভেজ খান

 

কিছুদিন আগে একটি সংবাদ চ্যানেলের বিতর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে বিজেপির রাজ্য সভাপতি মাননীয় দিলীপ ঘোষ মহাশয় বলে দিয়েছেন নারী, পুরুষ, দলিত, অধিবাসী, সংখ্যলঘু আবার কি জিনিস, সবাই নাগরিক, সবাইকে নাগরিক হিসেবে দেখুন আর তাতেই আমার বন্ধুমহলের বহু মানুষ এত্ত খুশি যে তারা নিশ্চই এগুলো কখনো চোখে দেখেনি বা পড়েনি যে এদেশে থানায় অভিযোগ নেওয়া হয়না কোন অপরাধে না সে দলিত! এবং তা এতটাই অপরাধ যে থানার সামনে উলঙ্গ করে পেটানো যায়! নিশ্চই পড়েনি যে গো মাংস ফ্রিজে রাখার অপরাধে শুধু সন্দেহর বসে কাউকে খুন হতে হয়!নিশ্চই তারা এটা না জেনেই বলছে ব্রাহ্মণের মেয়ে মুসলিম বন্ধুর সাথে টিউশন থেকে একসাথে ফিরছিল বলে নিগ্রহ করা হয়! বাসে ভিন ধর্মের যাত্রী একসাথে সফর করছিল বলে কুপিয়ে দেওয়া হয়েছে! নিশ্চই জানেনা মেয়েরা প্রতিবাদ করলে আর তা বিরুদ্ধে গেলেই সবার প্রথমে গণধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়! নিশ্চই জানেনা। গান্ধীজি বলেছিলেন “বুরা মত দেখো, বুরা মত শুনো, বুরা মত বোলো..’ তাই হয়তো এনারা দেখতে, শুনতে পাননা এগুলো, না হলে নিশ্চই বলতেন। যাই হোক, এক বন্ধুর লেখা পড়ছিলাম ফেসবুকেই, সে লিখছে সে একসময় সাংবাদিকতার কাজ করেছে কিছু বছর, এবং প্রতিদিন প্রায় ৫০ টির বেশি খবর দপ্তরে আসতো যেখানে মানুষ কে মানে ওই নাগরিকদের নিগ্রহের শিকার হতে হতো কি অপরাধে না তারা দলিত!!

কয়েকটা তথ্যে আসি পরে আবার একটু আবেগ সর্বস্ব হওয়া যাবে। ২০১০ এর NHRC এর রিপোর্ট ইন্ডিয়া টুডের ডিজিটালে ছাপা হয়েছিল, কি পাওয়া যাচ্ছে? প্রতি ১৮ মিনিটে একটা করে দলিত নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা ঘটে দেশে, প্রতিদিন গড়ে দুজন দলিতের ঘর পুড়ে যায়, তিন জন দলিত মহিলা রেপড হন, দুজনকে খুন হতে হয়! সব এমনি এমনিই হয়ে যায়!২০১৪ ও ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী দলিত নিগ্রহ সবচেয়ে বেশি হয় উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান বছরে প্রায় ৮০০০ আর সবচেয়ে কম বা ১০০০ এর নিচে আমাদের সাত বোন, পশ্চিমবঙ্গে ও ঝাড়খন্ডে। আর একটি তথ্য বলছে ২০০৯ থেকে ২০১৮ এর মধ্যে দলিত নিগ্রহের সংখ্যা ৬ শতাংশ বেড়ে গেছে।টাইম ম্যাগাজিনে ছাপা বিবিসির প্রতিবেদক রানা আয়ুবের প্রতিবেদন বলছেন নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় টার্মে সংখ্যালঘুর উপর অত্যাচার, জাতিহিংসা বেড়েছে। মহিলা নিগ্রহ ধর্ষণের ঘটনার কথা আর নাই বা বললাম কারণ সে বলতে গেলে আবার ধর্ষকের সমর্থনেও যে মিছিল বার করা যায় সে প্রসঙ্গও আসবে। যাই হোক আর একটি ছোটো তথ্য, অপ্রিয় কিন্তু কি আর করা যাবে স্ট্যাটিস্টা জানাচ্ছে ২০১৫ থেকে ২০১৯ এর মধ্যে শুধুমাত্র আইডিন্টিটি বা পরিচয়ের জন্য যারা নিগৃহীত হয়েছেন, তাদের সংখ্যা প্রায় ৯০০, হ্যা রিপোর্টেড,যেগুলো জাতি,ধর্ম,অনার কিলিং, লাভ জিহাদের নামে। যার মধ্যে দলিত ৬১৯, মুসলিম ১৯৬, অন্যান্য ৩৫, অধিবাসী ৩১, তৃতীয় লিঙ্গ ২৯, খ্রিস্টান ১৮। আর আপনি আমি উভয়ই জানি রিপোর্টের বাইরের ভারত কি বিশাল।

আমরা সবাই সমান এবং এতটাই সুনাগরিক তার প্রমাণ প্রতিদিন পাওয়া যায়, দৈনিক পত্রিকার পাত্র-পাত্রী কলাম গুলো খেয়াল করলেই চোখে পড়ে কোন ধর্ম, কোন জাত, কোন কুল এর সাথে কার মনের মিল সম্ভব! ভুরি ভুরি কেসের উদাহরণ পাওয়া যাবে যেখানে সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে ধরা তো হয়, সে খবর প্রথম পাতায় জ্বলজ্বল ও করে, অত্যন্ত সু ও সহনাগরিক হয়ে একটি বিশেষ সম্প্রদায় কে দেগে দেওয়া হতে থাকে, সেই ধর্মের মানুষদের ঘর বাড়ি ভাড়া পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই বহুকাল ট্রায়লের পর নির্দোষ প্রমাণ হলে সে খবর গুলো চ্যানেলের স্ক্রলবারে চলে বা খবরের কাগজের ভিতরের পাতায় ছোট্ট করে! আমরা এতটাই সুনাগরিক এবং সহনাগরিক হিসেবে সমান সমান যে ধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে একটা স্বর আসলেই সে যিনি বলছেন তার মায়ের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেন, শুধু প্রশ্ন তুলেই ক্ষান্ত হননা, জন্ম বৃত্তান্ত যে ঠিকঠাক নয় তা সুমিষ্ট ভাষণে জানিয়েও দেন। জয় শ্রীরাম বলতে না চাইলে অপদস্ত হতে হয়, গণপিটুনির শিকার ও হতে হয়। উদো বা বুদোর বয়স কমতে পারে কিন্তু উদাহরণ এর কমতি নেই।

যাই হোক এবার একটা সংবিধানের প্রশ্ন, ” The State shall promote with special care the educational and economic interests of the weaker section of the people, and in particular, of the Scheduled Castes and the Scheduled Tribes, and shall protect them from social injustice and all forms of exploitation.” এটা সংবিধানের আর্টিকেল ৪৮ বলছে কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা সেই তিমিরে, দিলীপ ঘোষ বললেন বটে কিন্তু সংবিধান কি তার কথার মান্যতা দিচ্ছে? বরং তো এটাই মনে হচ্ছে তিনি সংবিধানের বিরুদ্ধে বলছেন।

যদি সেই সহনাগরিক দের নিগৃহীত হওয়ার কারণ হয়ে ওঠে তাদের ওই পরিচয় গুলো, তাহলে সেগুলো থাকবেই, না চাইলেও থাকবে, প্রাসঙ্গিকও হবে।পরিচয় যদি আক্রান্ত হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন নিশ্চই সবাই রাজা নই, এটা মেনে নেওয়াই ভালো ও বাস্তব সম্মত। আর মিথ্যে স্বর্গে বাঁচতে চাইলে আমরা বাঁচতেই পারি, সে বাঁচা আটকায় কে!


তথ্যসূত্র:

  1. https://www.indiatoday.in/magazine/the-big-story/story/20160215-dalits-untouchable-rohith-vemula-caste-discrimination-828418-2016-02-03
  2. https://time.com/5617161/india-religious-hate-crimes-modi/
  3. https://www.statista.com/statistics/980033/identity-of-hate-crime-victims-india/

Be the first to comment

আপনার মতামত...