মানুষ কি পা দিয়ে ভোট দিচ্ছেন?

শঙ্কর রায়

 




সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

মা’কে

যত বিষ দেবে
তত কুণ্ঠাবোধ নীলকণ্ঠে
জড়াব
যেমন শৈশবের আম,
ঠাকুরমার পুরোনো তেঁতুল—
জানি তোমার অবহেলার
ভাঁড়ার
নিঃসঙ্গ অতুল।
বিষ ঢালো সুধাবতী
নিষ্কাশিত হৈমন্তী নির্যাস
কণ্ঠনলীর থেকে নির্গত হোক
তবে
পুরনো বিষাদ
ঔষধি জর্জরিত প্রেম
তবু জানি তুমি যে আমার…
চারপাশ অরণ্যসঙ্কুল শীতলকুঁচির থেকে আরও মিহি
ভয়
প্রতি রাতে আমাকে কাঁদায়
প্রতি রাতে জেগে থাকি আমি
অতন্দ্র প্রহরায়,
কণ্ঠনলীর থেকে খসে যাক
খুলে যাক
সূক্ষ্ম অসুখ।

ঢালো বিষ
নিয়তির নিষিক্ত অবহেলা
আমি হব নীলকণ্ঠ
তুমি তবে হতভাগী বেহুলা!

–পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পেয়ারের লোক কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনার রাজস্থান ক্যাডারের আইএএস সুনীল অরোরা (ভারতীয় জনতা পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী ভৈঁরো সিং শেখাওয়াতের অতি প্রিয়পাত্র আমলা) তাঁর কার্যকালের মেয়াদ শেষের দুদিন আগে এক ঐতিহাসিক নজির সৃষ্টি করে গেলেন। পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া শীতলকুচি বিধানসভা-অন্তর্গত প্রত্যন্ত জোড়পাটকি অঞ্চলের ১২৬ নং বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনি চারজন গ্রামবাসীকে হত্যা করেছে। নির্বাচন কমিশনের পুলিশ পর্যবেক্ষক বিবেক দুবে ২৪ ঘণ্টার কম সময়ে ‘তদন্ত’ করে জানিয়েছেন যে আত্মরক্ষার্থে জওয়ানরা গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছিল। পুলিশের হয়ে প্রাক্তন আইপিএস যে অরোরাবাবুর মন রেখে এমন সাজানো রিপোর্ট পাঠাবেন, তা জানাই ছিল। এমনও নাকি লেখা হয়েছে যে ‘দুষ্কৃতি’রা জওয়ানদের বন্দুক ছিনতাই করতে চেয়েছিল। তা যদি হয়, নির্বাচন কমিশন কেন ভিডিও ফুটেজ সাংবাদিকদের দেখাচ্ছে না? ভিডিওগ্রাফি তো প্রত্যেক বুথে হচ্ছিল।

ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। মনে পড়ছে প্রথম যুদ্ধশেষে অভুক্ত, অর্ধভুক্ত ও রণক্লান্ত রুশ সেনাদের প্রতি লেনিনের উক্তি। তাঁরা পূর্ব সীমান্তে যুদ্ধ করতে অস্বীকার করেছিলেন। লেনিন তাঁদের বলেছিলেন ‘ডুমা’ (সংসদ)-য় ক্ষমতাসীন দল ক্যাডেট ও ত্রুদোভিকদের পা দিয়ে ভোট দিতে। হাত দিয়ে নয়। নির্বাচনী প্রচারে মোদিজি, তাঁর প্রধান লেফটেন্যান্ট ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ও ৩০ জন বিজেপি সাংসদ গোটা রাজ্য চষে বেড়ালেও কেমন যেন হতাশ। বেশ কয়েকদিন অমিত শাহ বলছেন না বিজেপি ২০০-র বেশি আসন নিয়ে জিতে সরকার গড়বে। তাহলে কি প্রমাদ গুনছেন?

সেজন্যেই কি মোদি-শাহর বশংবদ নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রীয় বাহিনিকে বিজেপির হয়ে কাজ করার গোপন নির্দেশ দিয়েছে? দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার সোনারপুর বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী লাভলি মৈত্র (অরুন্ধতী) বুথ পরিদর্শনে গিয়ে সিআরপিএফের উদ্ধত আচরণে হতবাক। তারা নাকি বলেছে “বুথের বাইরে ভীড় করলেই গুলি চালিয়ে দেব।” তিনি অভিযোগ করেছেন, ভোটারদের সরাসরি পদ্মফুল প্রতীকে ভোট দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছে কেন্দ্রীয় বাহিনি।

কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাক্তন সংস্কৃতি সচিব ও প্রসার ভারতীর প্রাক্তন সিইও জহর সরকার প্রশ্ন তুলে লিখেছেন:

চারজন ভোটার মারা গিয়েছেন কেন্দ্রীয় বাহিনির গুলিতে। চারজনই স্থানীয় বাসিন্দা। যারা মেরেছে তারা সিআইএসএফ। গুলিচালনার পিছনে কেউ কোনওভাবে প্ররোচনা দিয়েছিল কি না, সেই খবরটা এখনও কেউ বের করতে পারেনি। পুলিস বলছে, বাহিনিকে আক্রমণ করা হয়েছে। বন্দুক ছিনতাই করার চেষ্টাও চলেছে। কিন্তু এই দাবির সপক্ষে একটা প্রমাণ তো দিতে হবে! আজকাল সবার হাতেই মোবাইল ক্যামেরা। কোনও ঘটনা ঘটলেই লোকে ছবি, ভিডিও তুলতে আরম্ভ করে। সেখানে ২৪ ঘণ্টা হয়ে গেল, কিন্তু এখনও কোনও ফুটেজ পাওয়া যায়নি। কেউ ভিডিও তোলেনি, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? কেন্দ্রীয় বাহিনি জানে, গুলি চালালে তার তদন্ত হয়। ফলে তদন্তের প্রস্তুতি হিসেবেই হোক অথবা উদ্ভুত বিতর্কের সমাধান— কিছু একটা প্রমাণ দেখাতেই হবে।

কোচবিহার তৃণমূলের জেলা সভাপতি ও শীতলকুচি বিধানসভা কেন্দ্রের টিএমসি প্রার্থী পার্থপ্রতিম রায় বলেছেন “ক্ষুব্ধ মানুষের জমায়েত ও বিশৃঙ্খলা ঠেকানোর কিছু পর্যায়ক্রম রয়েছে। প্রথমে লাঠিপেটা, তাতে কাজ না হলে কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটানো। তারপর শূন্যে গুলি। কিন্তু শীতলকুচিতে সরাসরি ভোটারদের বুক ও পিঠ লক্ষ করে গুলি চলেছে। এমনকী, পায়েও গুলি চালানোর চেষ্টা করা হয়নি!”

ওই এলাকা অতি-দরিদ্র মানুষের বাস, শতকরা ৮০ জনই মুসলমান, ৩০০র বেশি আদিবাসী পরিবার বাস করে। স্বভাবতই বিজেপির ঐ এলাকায় ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা কম। যে ভোটাররা লাইনে ছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন যে জওয়ানরা মদে চুর ছিল।

শ্রী সরকার আরও লিখেছেন:

এই ঘটনার আরও একটা দিক রয়েছে। সিআইএসএফ কোনওদিন আইনশৃঙ্খলা সামলায়নি। কিছু ক্ষেত্রে সিআরপিএফ এমন পরিস্থিতি সামলেছে। সীমান্তে মোতায়েন থাকা বিএসএফ জওয়ানদেরও মানুষের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে তার কিছু ট্রেনিং দেওয়া হয়। সিআইএসএফ মূলত এয়ারপোর্ট, দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্ট এসব পাহারা দেয়। তাদের দিয়ে ভোটে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করাটা ঠিক কি না, সেই প্রশ্নও থাকছে। যে বাহিনি স্থানীয় ভাষা বা মানুষের সঙ্গে কীভাবে ব্যবহার করতে হয় জানে না, তাদের মোতায়েন করলে ভুলবোঝাবুঝি হতে পারে। এসব চিন্তা করে বাহিনিকে কাজে লাগানো উচিত ছিল।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শুধু কেন্দ্রীয় বাহিনি পাঠাব এবং বেশি সংখ্যায় পাঠাব, এটা পরিকল্পনা করার আগে কিন্তু অনেক চিন্তাভাবনা করতে হয়। আমার শক্তি আছে বলে অঢেল ফোর্স পাঠিয়ে দিলাম, এটা গণতান্ত্রিক অভ্যাস নয়। ২০ বছর আগে আমি দুটি নির্বাচনের দায়িত্বে ছিলাম। ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ সালের লোকসভা নির্বাচন। আমার মনে আছে, তখনও সিআইএসএফ আনার ব্যাপারে সম্মতি দিইনি। উত্তরপ্রদেশ পুলিশের বিরুদ্ধেও বলেছিলাম, এই ফোর্সের অনেক বদনাম আছে। এবং এরা বাংলায় এলে এখানকার সংস্কৃতি কিছুই বুঝবে না।

শীতলকুচির হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রধানমন্ত্রী দুঃখপ্রকাশ করলেও বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বিন্দুমাত্র দুঃখপ্রকাশ করেননি। বলেছেন, “বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনি থাকবে। কেউ লাল চোখ দেখাতে পারবে না। আমরা আছি। আর যদি বাড়াবাড়ি করে, শীতলকুচিতে দেখেছেন কী হয়েছে। জায়গায় জায়গায় শীতলকুচি হবে।”

অবশ্য মোদিজির তীর কেবল ‘দিদি’র দিকে। সার্কাসের ক্লাউনের মত বারবার বলছেন, দিদি, ও দিদি। ১০ এপ্রিল শিলিগুড়িতে ৪৪ মিনিট আর কৃষ্ণনগরে ৩৪ মিনিট ভাষণে মোট ১২৬ বার ‘দিদি’ ডাক শোনা গেল মোদির গলায়। শিলিগুড়িতে ৪৪ মিনিটে ৬৮বার আর কৃষ্ণনগরে ৩৪ মিনিটে ৫৮বার। কাজেই ফ্যাসিস্ট বিজেপির আশু লক্ষ্য মমতা–অপসারণ।

এত করেও শেষ রক্ষা হবে? প্রশান্ত কিশোরের আইপ্যাক (যার সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের চুক্তি ৩১ মার্চ ২০২১-এ শেষ হয়েছে) ১১ এপ্রিল ‘ইন্ডিয়া টুডে’ টিভি চ্যানেলের রাজদীপ সরদেশাইকে সাক্ষাৎকারে আবার বলেছেন, বিজেপি ২৯৪ আসনের মধ্যে ১০০ আসন পেলে তিনি আইপ্যাক আর এইসব (অর্থাৎ তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে যে ধরনের কাজ করেছেন) কাজ করবেন না। এও বললেন বিজেপির প্রচার প্রধান অমিত মালব্য তাঁর সাক্ষাৎকার কেটে-ছেঁটে বিকৃত করে অপপ্রচার করছে যে তিনি বলেছেব পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোটে বিজেপি জিতবে।

তবে সঙ্ঘীরা এখন মরিয়া। আমাদের আশঙ্কা বাকি চার দফা ভোটে সন্ত্রাস ও খুনোখুনি ঘটার সম্ভাবনা বিদ্যমান। কেন্দ্রীয় বাহিনির বিক্ষিপ্তভাবে বিজেপির পক্ষাবলম্বনও সম্ভব।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4859 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...