নায়িকা সংবাদ

নায়িকা সংবাদ -- যুগান্তর মিত্র

যুগান্তর মিত্র

 

একটা কালো দলছুট পিঁপড়ে উন্মত্তের মতো এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিল। নিশ্চয়ই সঙ্গীদের খুঁজছে! খাটে শুয়ে শুয়ে একমনে দেখছিল মৃত্তিকা। সকালের টিফিন সেরে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল বেলা বারোটা ছাড়িয়ে গেছে! এবার স্নান সেরে নিতে হবে। কথাটা মনে এলেও উঠতে ইচ্ছে করছিল না মৃত্তিকার। সেইসময়ই পিঁপড়ের দিকে চোখ পড়ে তার।

পিঁপড়েটাকে আর দেখা যাচ্ছে না কেন? কোথায় গেল! অদম্য কৌতূহলে খাট ছেড়ে নীচে নামার সময়ই কোমরটা টনটন করে উঠেছিল। গত রাতের ব্যথাটা এখনও রয়ে গেছে! ব্যথা উপেক্ষা করেই ঝুলবারান্দায় এসে দেখতে পেয়েছিল, সারি বেঁধে গোলাকার সিমেন্টের পিলার ধরে নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে পিঁপড়ের দল। ওদের অনুসরণ করে দোতলা থেকে দ্রুত একতলায় নেমে আসে মৃত্তিকা। উঠোনের প্রান্তের ঝোপঝাড়ের দিকে যাচ্ছিল পিঁপড়ের সারি। একা-পিঁপড়েটা কি খুঁজে পেল সঙ্গীদের! কোমরের হালকা ব্যথা আর একাকী পিঁপড়ের বিপন্নতা অনুভব করে প্রদীপ্তর সঙ্গে কাটানো প্রথম দুপুরের কথা মনে পড়েছিল মৃত্তিকার।

–উফ্‍! তুই কি পশু নাকি? এত জোর খাটাস কেন? আমার কোমর ব্যথা হয়ে গেল!
–স্যরি রে। ঠিক বুঝতে পারিনি। অপ্রস্তুত প্রদীপ্ত জবাব দিয়েছিল।
–ড্যাম ইট। বুঝতে পারিনি মানে? আমি যে মানুষ মনে থাকে না?

লজ্জায় মাথা নীচু করে নিয়েছিল প্রদীপ্ত।

–থাক হয়েছে। তুই যে ইচ্ছে করে করিসনি, তা বুঝেছি। আবেগে করে ফেলেছিস। খুব ইয়ে হয়ে যায় না, এই সময়? মুচকি হেসে প্রদীপ্তর চুল ঘেঁটে দিয়েছিল মৃত্তিকা। মুখে লাজুক হাসি ঝুলে থাকলেও প্রদীপ্ত মুখ তুলতে পারেনি তখন।

অনেক স্মৃতিই ফিকে হয়ে যায়। এসব হয় না।

প্রদীপ্তর সঙ্গে পরিচয় কলেজ ফেস্টের সময়। মৃত্তিকার তখন ফার্স্ট ইয়ার আর প্রদীপ্তর থার্ড ইয়ার। দুজনের ভিন্ন স্ট্রিম হলেও বন্ধুত্ব ক্রমশ গাঢ় হয়ে উঠেছিল ফেস্টকে কেন্দ্র করে। ধীরে ধীরে কয়েকজন মিলে একটা দল গড়ে উঠেছিল। সেই দলে ছিল প্রদীপ্ত, মৃত্তিকা, সুবীর, বিপাশা, চয়নিকা, অর্পণ, অভিষেক। আরও কেউ কেউ এসেও জুটত মাঝে মাঝে। যেমন ইরাবতী। তবে তারা ছিল অনিয়মিত। সাতজনের দলটাকে সবাই বলত সপ্তরথী। ক্যান্টিনে হইচই, দলবেঁধে সিনেমা দেখা, কফি হাউসে আড্ডা, হা-হা-হি-হি। কলেজের পর ইউনিভার্সিটি পেরিয়েও তিরতির করে বন্ধুত্ব বয়ে চলেছিল। এভাবেই প্রদীপ্ত আর মৃত্তিকা কখন যেন মনের কাছাকাছি চলে এসেছিল।

প্রদীপ্তর দিদির ক্লাসমেট অকৃতদার অনির্বাণ নিয়োগী। অফিস আর গ্রুপ থিয়েটার নিয়ে মেতে থাকত সারাক্ষণ। প্রদীপ্ত অনির্বাণের ফ্ল্যাটে প্রায়ই যেত। এমনকি অনেক রাতই সেখানে থেকে যেত। দিদির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরই অনিদার সঙ্গে প্রদীপ্তর সম্পর্ক আরও জোরালো হয়ে উঠেছিল। কয়েক বছরের বড় আর দিদির বন্ধু হলে কী হবে, অনিদা ছিল উদার মনের মানুষ। নানা বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করত ওরা। এমনকি প্রদীপ্তকে সিগারেট এগিয়ে দিতেও দেখেছে মৃত্তিকা।

প্রদীপ্তর কাছে ফ্ল্যাটের একটা ডুপ্লিকেট চাবি থাকত সবসময়। অনিদার প্রশ্রয়ে কয়েকদিন সেই ঘরে ওদের সপ্তরথী টিম আড্ডা দিয়েছে। সেই প্রথম মৃত্তিকার সিগারেট টানা আর বিয়ার খাওয়া।

একদিন প্রদীপ্তকে বাড়ির ল্যান্ডফোনে ফোন করেও পায়নি মৃত্তিকা। নিশ্চিত ছিল অনিদার ফ্ল্যাটে পাওয়া যাবে। ঐ সময় সাধারণত ফ্ল্যাটেই থাকত প্রদীপ্ত। কিন্তু ও নেই জেনে হতাশ মৃত্তিকা যখন ফিরে আসছে, তখন অনির্বাণ পিছন থেকে ডেকেছিল।

–অ্যাই মৃত্তিকা, শোন।

মুখ ফিরিয়ে মৃত্তিকা দেখেছিল হাসিমুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে অনিদা। কাছে যেতেই অনির্বাণের প্রশ্ন ভেসে আসে, তুই কি প্রদীপ্তর সঙ্গে প্রেম করিস?

প্রথমে একটু থমকে গেলেও মৃত্তিকা সপ্রতিভ জবাব দিয়েছিল, কেন দাদা, সত্যি হলে খারাপ হবে ব্যাপারটা?

অনির্বাণের হা-হা হাসিতে পায়রা ওড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে। ভালো বলেছিস তো! খারাপ হবে কেন? খুব ভালো হবে। প্রদীপ্ত খুব ভালো ছেলে। ওদের পরিবারটাও ভালো রে। ওকেও জিজ্ঞাসা করেছিলাম, জানিস? ছেলেটা এমন লজ্জা পেল যে, কিছুতেই স্বীকার করল না!

কথাগুলো শুনে জোছনার আলো ছড়িয়ে পড়েছিল মৃত্তিকার চোখেমুখে।

–তুই তো জানিসই পদার কাছে ফ্ল্যাটের একটা ডুপ্লিকেট চাবি থাকে। এখানে বসেও প্রেম করতে পারিস তোরা। তবে শর্ত একটাই। আমি ফ্ল্যাটে থাকলে চলবে না। প্রেমে ব্যাঘাত হবে তো! যখন অফিসে থাকব বা রিহার্সালে, তখন আসিস দুজনে।

এবার মৃদু হাসি। অনির্বাণের মুখের পাশ দিয়ে শরতের সাদা মেঘ উড়ে যেতে দেখেছিল মৃত্তিকা। লাজুক মুখে বাড়ি ফিরে এসেছিল সেদিন।

প্রদীপ্ত আর মৃত্তিকা সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছিল বেশ কয়েকবার। কোমরের যন্ত্রণা সেই স্মৃতি ফিরিয়ে দিয়েছিল এক লহমায়।

উত্তম বরাবরই নিজের আনন্দ মিটিয়ে নেয় দ্রুত। মাত্র কয়েক মিনিটের উদ্দাম খেলা। বেশিরভাগ সময়ই এত শরীরী শক্তি প্রয়োগ করে যে, মৃত্তিকার কষ্ট হয়। অব্যক্ত যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায় সে। সেই যন্ত্রণা যতটা শারীরিক, তার থেকেও অনেক বেশি মানসিক। উত্তমকে বললেও কিছুতেই বুঝতে চায় না বউয়ের কষ্ট। পাশবিক উল্লাসে ফেটে পড়ে। যেন শতসহস্র জন্মের আধিপত্য নিয়ে আছড়ে পড়ছে তার ওপর। প্রায় প্রতিদিনই একইরকম আক্রোশে মৃত্তিকাকে ফালাফালা করে দেয় উত্তম। গতরাতেও তাই করেছিল। তারপর যথারীতি পাশ ফিরে শুয়েও পড়েছিল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তীব্র নাক ডাকার শব্দ। ঘুমোলে ভীষণ জোরে নাক ডাকে উত্তম। কিন্তু মৃত্তিকার কিছুতেই ঘুম আসছিল না। কিছুক্ষণ বাদে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল সে। তখনই প্রথম কোমরের ব্যথাটা টের পেয়েছিল। বাইরে তখন চাঁদের আলো দুধ ঢেলে দিয়েছে চরাচরে। থইথই দুধ-ঢালা আলোয় ভরে উঠেছিল বারান্দাও। কখন যে ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল মৃত্তিকা, মনে করতে পারে না আর।

প্রদীপ্তর কথা মনে পড়লেই বিষাদ ঘিরে ধরে মৃত্তিকাকে। একরাশ ধুলো ওড়ে। সেই ধুলোঝড়ে পৃথিবীর বুকে অন্ধকার নামে। চোখ জ্বালা করে মৃত্তিকার।

ভার্সিটিতে খুব-একটা ভালো রেজাল্ট করতে পারেনি প্রদীপ্ত। বাড়ির আর্থিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত খারাপ। হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছিল তখন। ব্যস্ততা ও হতাশায় মৃত্তিকার সঙ্গেও যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছিল। প্রদীপ্তর রেজাল্ট খারাপ হওয়ার পিছনে ওর ভূমিকা আছে বলে মনে করত মৃত্তিকা। প্রেমের উন্মাদনা ওর পড়াশোনার ক্ষতি করে দিয়েছিল। যদিও প্রদীপ্ত মানতে চাইত না। পাল্টা জবাব বেরিয়ে এসেছিল, ‘তাহলে তোর রেজাল্ট খারাপ হচ্ছে না কেন? দোষ তোর নয়। আমারই। আমিই হয়তো গুরুত্ব দিইনি। পড়াশোনায় ফাঁকি দিয়েছি।’

ওদের সব বন্ধুই একে একে চাকরি পেয়েছে। এমএ পাশ করে মৃত্তিকাও চাকরির চেষ্টা করছিল তখন। এদিকে তার বিয়ের ব্যাপারেও খোঁজখবর শুরু হয়ে গিয়েছিল বাড়িতে। প্রদীপ্তর সঙ্গে সম্পর্কের কথা তখনও বলে উঠতে পারেনি মৃত্তিকা তার রক্ষণশীল বাবা-মাকে। কলেজ বা ভার্সিটি-কেন্দ্রিক তার মেলামেশার আঁচ পায়নি বাড়ির কেউই। জানলে অনেক আগেই পড়াশোনার ইতি হয়ে যেত তার। প্রদীপ্তর জোরাজুরিতেও বাড়িতে কিছুই বলার সাহস পায়নি মৃত্তিকা। সবমিলিয়ে চরম হতাশার অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে একসময় প্রদীপ্তর মাথাটা পুরোপুরি বিগড়ে গেল। অ্যাসাইলামে ভর্তি করাতে হল তাকে। সেইসময়ই মৃত্তিকার বাড়িতে প্রদীপ্তর কথা জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। চাপা অশান্তি ও টেনশনে মৃত্তিকাও ভেঙে পড়েছিল খুব। মানসিক অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে নিজেকে পুরোপুরি গৃহবন্দি করে রেখেছিল মৃত্তিকা। বাড়ির লোকেদের চাপ তো ছিলই। তখনই একরকম ধরেবেঁধে উত্তমের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন মৃত্তিকার বাবা-মা। প্রদীপ্ত তখন হয়তো অ্যাসাইলামের কোনও কুঠুরিতে নিজস্ব অন্ধকার বৃত্তে ডুবে ছিল!

মৃত্তিকার জন্য ঠিক করা পাত্র কোচিতে পোস্টিং। প্রচুর আয়। কলকাতার বাড়ি থেকে বিয়ে এবং দিন পনেরো পরে ফিরে যাবে কর্মস্থলে। এমন পাত্র হাতছাড়া করতে চাননি মৃত্তিকার পরিবার ও আত্মীয়স্বজনেরা। মৃত্তিকাও হয়তো সেই পরিবেশ থেকে পালিয়ে বাঁচার অবকাশ খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু তার বাবা-মায়ের বিয়ে নিয়ে এতটা বাড়াবড়িতে মনে মনে খুব ধাক্কা লেগেছিল মৃত্তিকার।

যন্ত্রণাটা অনেকটাই সয়ে গেছে ততক্ষণে। প্রদীপ্তর ভাবনা মাথায় বিনবিন করে বেজে চলে। মৃত্তিকা স্নান করতে ঢোকে বাথরুমে। আজ দুপুরে নায়িকা মৃত্তিকা তার নায়ককে প্রদীপ্তর গল্প বলবে। কোনওদিনই ওর কথা বলা হয়ে ওঠেনি!

 

(২)

উত্তমের জুলুমে এখন আর বাধা দেয় না মৃত্তিকা। কোনও প্রতিক্রিয়াও জানায় না। নিথর শরীরটা বিছানায় ফেলে রাখে শুধু। তার শরীরে উঠে নিজের মতো খেলা করে যায় উত্তম। একটানা, নানা কৌশলে। রিমোট-টেপা পুতুলের মতো যেমন যেমন বলে উত্তম, তেমনটাই করে যায় সে।

মাস কয়েক আগের এক শনিবার সন্ধ্যায় উত্তম তার জুনিয়র কলিগ রাধা ভেঙ্কটেশকে ঘরে ডেকে এনেছিল। বাঁধন-হারা উল্লাস ছড়িয়ে আছে যেন রাধার শরীরে। হইহই করে বিয়ার খেল দুজনে। তার আনুষঙ্গিক সব জুগিয়ে গিয়েছিল মৃত্তিকা। তারপর একসময় দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল উত্তম। রান্নাঘর থেকে বুঝতে পারলেও একটুও জ্বলন টের পায়নি সে। সেদিনের পর থেকে প্রায়ই আসে রাধা। আগে মৃত্তিকার সঙ্গে মিষ্টি ভাষায় কথা বলে। চমৎকার ইংরেজিতে কুশল জানতে চায়। কখনও বাঙালি রান্নার প্রশংসা করে রেসিপি জেনে নেয়। তারপরই চলে যায় উত্তমের কাছে। একটু বাদেই বেডরুমের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। সব জেনেও চুপ করে থাকে মৃত্তিকা। আবার কখনও অন্য নারীশরীরের উদ্দামতাও পাশের ঘর থেকে শুনতে পায় সে। কারও কারও গোটা শরীরটাই যেন উৎসবের রোশনাই। সেই উৎসবে বারবার মেতে উঠেছে উত্তম। প্রথম দিনে কোনও বাধা না-পেয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ক্রমশ। অথচ মৃত্তিকার কোনও ভাবান্তর হয় না। এসব মেনে নিতে শিখে গেছে সে।

উত্তম প্রতিদিন সকাল আটটায় অফিসে বেরিয়ে যায়। সেখানেই টিফিন ও লাঞ্চের ব্যবস্থা। ফেরার কথা সন্ধ্যা সাতটায়। কিন্তু প্রায়ই ডিনার সেরে রাত করে ফেরে। মৃত্তিকা নীরবতার খোলসে ঢুকে পড়ে রাতের খাবার খেয়ে নেয় একা। খাবার টেবিল থেকে উত্তমের বরাদ্দ খাবার তুলে রাখে ফ্রিজে। অনেকদিন দুপুরে রান্নাও করে না। আগের রাতের খাবারেই তার চলে যায়। ফলে অনেকটা সময় তার হাতের মুঠোয়। তাছাড়া রবিবার বা অন্যান্য ছুটির দিনেও উত্তম বান্ধবীদের নিয়ে মেতে থাকে।

সন্ধের অবসরে ইদানিং বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তার উল্টোদিকের লাইট পোস্টের দিকে তাকিয়ে থাকত মৃত্তিকা। সেখানে মাঝে মাঝেই সিনেমার পোস্টার বদলে যায়। লোহার ফ্রেমে আটকে থাকে সিনেমার বিজ্ঞাপন। পোস্টারের ভাষা বুঝতে পারে না সে। তবু সেদিকেই তার চোখ থাকত। যেন এভাবেই সময় কাটাতে অভ্যস্ত হতে চাইত।

দক্ষিণ ভারতের সিনেমার নায়কদের মৃত্তিকা তেমন করে চেনে না। বহু আগে উত্তমের সঙ্গে কয়েকবার সিনেমা দেখতে গিয়েছিল এখানকার মাল্টিপ্লেক্সে। সেইসময় অনেক নায়ক-নায়িকার নাম জানত। বহুদিনই উত্তম তাকে সিনেমায় নিয়ে যায় না। মৃত্তিকাও এব্যাপারে কোনও ইচ্ছে প্রকাশ করে না। যৌনতায় ব্যবহার করা ছাড়া মৃত্তিকার বাকি সবকিছুর প্রতিই উত্তম নিরাসক্ত। মৃত্তিকাও ফিরিয়ে দেয় শীতলতা। আজকাল এই ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্যে একরকমের তৃপ্তি পায় সে।

অনেকদিন ধরেই লাইট পোস্টের গায়ে একটা সিনেমার পোস্টার ঝুলছিল। পোস্টারের নায়কটা একদম অন্যরকম। ইংরেজি তারিখ দেখে বুঝতে পারে সিনেমাটা তখনও চলছে। কী দারুণ ফিগার নায়কের! ওর পাশে যে নায়িকাকে দেখা যাচ্ছিল, সেও বেশ ভালো দেখতে। তাতে অবশ্য মৃত্তিকার কিছুই যায়-আসেনি। মনে মনে নায়িকার ছবি মুছে দিয়ে নিজের ছবি বসাত সেখানে। পোস্টারের নায়কের পাশে নিজেকে রেখে খুশি হত সে। আলতো চুমু ভাসিয়ে দিত হাওয়ায়। উত্তমও বিয়ের পরে প্রথমদিকে অফিসে যাওয়ার সময় চুমু ভাসিয়ে দিত নীচ থেকে। কিছুদিনের মধ্যেই সেসবও থেমে গিয়েছিল!

বিয়ের কিছুদিন পরে একবার উত্তমকে বলেছিল মৃত্তিকা, তুমি এত তাড়াহুড়ো করো কেন? তখন তার লজ্জা ভেঙে গেছে। উত্তম সঙ্গমের সময় অনেক খারাপ খারাপ শব্দ বলে। তাকেও সেসব উচ্চারণ করতে বলত। মৃত্তিকার বন্ধুদের অনেকেই মজা করে খারাপ শব্দ বলত। প্রদীপ্ত কোনওদিন বলেনি। অভিষেক কখনও-সখনও মুখ ফসকে বলে ফেলত। তবে এমনভাবে বলত, যাতে মেয়েদের কানে না-পৌঁছয়। ফিসফিস করে বললেও হাওয়া আঁকড়ে সেসব তাদের কানে ঢুকে পড়ত। না-শোনার ভান করে চুপ করে থাকত ওরা। অবশ্য ইরাবতী সবসময়ই চার অক্ষরের খিস্তি উচ্চারণ করত। দু-তিন অক্ষর ছিল তার কাছে জলভাত। একবার বিপাশা বলেছিল, আচ্ছা ইরা, তুই যে এইসব বলিস, ভেবে দেখেছিস কখনও, খিস্তিগুলো অলমোস্ট মেয়েদের এগেনস্টে যায়?

–ছাড় তো! গেলে যাক। খিস্তি দিলে ভেতরে কেমন একটা জোশ আসে। বলেই আরও দুটো খিস্তি ছুড়ে দিয়েছিল।
–আবার? তুই কী রে?
–ওহ বিপস! থাম তো। চিরকাল গান্ডুই থেকে গেলি।

আর কথা বাড়ায়নি বিপাশা। মৃত্তিকাও চুপ করে থেকেছিল। ওর কান-মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠেছিল। মজা পেয়ে আরও কয়েকটা খিস্তি হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়েছিল ইরা। আর সেই মৃত্তিকা কিনা খারাপ শব্দ উচ্চারণ করেছিল উত্তমের জোরাজুরিতে! তবে অল্পই বলত। বলতে একটুও ভালো লাগত না। উত্তমকে খুশি করতেই বলা।

উত্তম সেদিন চোখ সরু করে বলে উঠেছিল, তাড়াহুড়ো করি? তাহলে কী করতে হবে? ফোর-প্লে?

–হ্যাঁ তাই। ধীরে ধীরে এগোবে।
–বাপরে! তুমি তো অনেককিছু শিখে গেছ দেখছি! ওপাড়ার মেয়েছেলেদের মতো কথা বলছ! আর কী কী জানো শুনি?

মৃত্তিকার ভেতরে দপ করে লাফিয়ে উঠেছিল এক টুকরো আগুন। কী বলতে চাও তুমি? আমাকে তুমি কী বলতে চাইছ?

–বেশি সতীগিরি মারিও না আমার সঙ্গে মৃত্তি। এসব নেকুপানা ফোর-প্লে করে রাত কাবার করতে পারব না আমি। সারাদিন তোমার মতো ঘরে শুয়েবসে কাটাই না। অনেক চাপ নিতে হয় মাথায়।

ঘেন্নায় মৃত্তিকার গা গুলিয়ে উঠেছিল। ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে গিয়েছিল সে।

–বিয়ের আগের অভিজ্ঞতা আছে নাকি? বলোনি তো! চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়েছিল উত্তম। আমূল কেঁপে উঠেছিল মৃত্তিকা।

বিয়ের আগের অভিজ্ঞতা মানে প্রদীপ্তর সঙ্গে। প্রায়ই সে আর প্রদীপ্ত দুপুরে যেত অনিদার ফ্ল্যাটে। প্রথমদিনই খুব জোর করেছিল সে। তারপর থেকে আর কোনওদিন জোর খাটায়নি। বাধ্য প্রেমিকের মতো, যত্নশীল পুরুষের মতো খেলা করত। কিন্তু সেসব উত্তমকে বলার প্রশ্নই ওঠে না। বলেওনি কোনওদিন। উত্তমের কুৎসিত শব্দের প্রত্যুত্তরে শুধু একবার কটাক্ষ হেনে বলেছিল, ‘ছিঃ।’ এই উচ্চারণটুকুতে অভিনয় ছিল, জানে মৃত্তিকা। তবে নিখুঁত অভিনয় করতে পেরে ভালোও লেগেছিল সেদিন।

প্রতিদিনই পোস্টারটা দেখত মৃত্তিকা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে পোস্টারের নায়ককে দেখত সে। আর মনে মনে স্বপ্ন বুনত। দুপুরে একলা বিছানায় নায়ক তার পাশে শুয়ে থাকত কল্পনায়। নায়কের সমস্ত আঙুল মৃত্তিকার শরীরে খেলা করত। পাশবালিশ চেপে ধরে অবশ শরীর নিয়ে পড়ে থাকত মৃত্তিকা।

কিছুদিন আগে ঝড়বৃষ্টির দাপটে পোস্টারের লোহার খাঁচা ঝুলে পড়েছিল। এতটাই ঝুলে পড়েছিল যে প্রায় মাটির কাছাকাছি তার অবস্থান। মৃত্তিকা মনখারাপ নিয়ে তাকিয়ে থেকেছে তার নায়কের দিকে। কেমন অসহায়ের মতো নায়ক কাত হয়ে আছে! কিন্তু বেশিক্ষণ সেই মনোবেদনা স্থায়ী হয়নি। একটা সাপ হিসহিস শব্দে জেগে উঠেছিল। চেরা জিভ দিয়ে চেটেছিল মৃত্তিকার সর্বাঙ্গ।

সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলে এই রাস্তা দিয়ে খুব বেশি লোকজনের যাতায়াত থাকে না। গাড়ি প্রায় চলেই না। মাঝে মাঝে দু-একটা বাইককে হুস করে চলে যেতে দেখেছে মৃত্তিকা। সন্ধ্যার মায়াবী আলো মুছে দিয়ে রাত যত বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে ওঠে, ততই লোকের চলাচল কমে আসে।

উত্তম প্রতিদিনই বড্ড দেরি করে ঘরে ফেরে। অফিসে নাকি ভীষণ কাজের চাপ! অথচ মৃত্তিকার কানে উড়ে আসে নানা খবর। উত্তমের নাও অন্য কোনও নদীতে ভাসছে। সেই নদীও বদলে বদলে যায়। এতে মৃত্তিকার মনে কোনও রেখাপাত করে না। তার যে এখন নায়ক আছে!

লোকসমাগম থেমে গেলে মৃত্তিকা নেমে এসেছিল দোতলার বারান্দা থেকে। অতি সন্তর্পণে দেখে নিয়েছিল এদিক-ওদিক। একসময় জনশূন্য দেখে খাঁচা থেকে পোস্টার ছিঁড়ে নিয়েছিল। শুধু নায়কের অংশটুকুই নেওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু নায়িকারও সামান্য অংশ ছিঁড়ে আসে। দ্রুত বুকের কাছে পোস্টার-ছেঁড়া অংশটা জড়ো করে উঠে এসেছিল দোতলায়, নিজের আস্তানায়।

প্রায় প্রতিদিনই উত্তমের বুবুক্ষু শরীর তাকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। সঙ্গমশেষে গভীর ঘুমে ডুবে যায় সে। উত্তম ঘুমিয়ে পড়লে স্বস্তি পায় মৃত্তিকা। তার বুকে মেঘের গুরুগুরু ধ্বনি জেগে ওঠে। তোষকের নীচ থেকে নায়কের ভাঁজ-করা পোস্টার বের করে তার ওপর শুয়ে থাকে। অনিবার্যভাবে প্রতিদিনই বৃষ্টি নামে মৃত্তিকার শরীরজুড়ে। উত্তমের অফিস যাওয়ার তাড়া থাকে সকালে। তাই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতেই হয় তাকে। ভোরে ঘুম ভাঙার পর আবার তোষকের নীচে নায়ককে শুইয়ে দেয় পরম মমতায়। ভালোবেসে মৃত্তিকা তার নায়কের নাম দিয়েছে সুদর্শন। একবার ভেবেছিল নাম রাখবে প্রদীপ্ত। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়েছে, প্রদীপ্ত এখন সুদূরের এক অস্তমিত গ্রহ, যার সঙ্গে কোনও যোগাযোগের সূত্রও অবশিষ্ট নেই। তার চেয়ে সুদর্শনই যথার্থ নাম। পোস্টার থেকে নায়িকার অংশটুকু বাদ দিয়ে দিয়েছে আগেই।

দুপুরের অখণ্ড অবসরে নায়কের সঙ্গে একতরফা গল্প করে মৃত্তিকা। নায়ককে সে জানায় তার বরের মানসিক বিকৃতির কথা। উত্তমের খোঁজখবর না-নিয়ে শুধুমাত্র টাকা আছে বলেই একরকম জোর করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন তার বাবা-মা। সেকথাও জানায় নায়ককে। এমনকি উত্তম সম্পর্কে নানাভাবে বলার পরেও তার কথা মানতে চাননি তাঁরা, সেসবও বলে চরম হতাশায়। ‘একটু মানিয়েগুছিয়ে নিতে হয় মা। না-হলে যে সংসার টেঁকে না!’ মা-বাবার এই একটাই কথা! তুমিই বলো সুদর্শন, আমি একাই মানিয়ে চলব? উত্তমের কোনও দায় নেই? তাই তো শামুকের খোলসের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি! এভাবেই অভিমান উজাড় করে দেয় নায়কের কাছে। নায়ক স্থির চোখে তার সমস্ত দুঃখবেদনায় সহমর্মিতা জানায়। এক দুপুরে মুখে খুশির আলো জ্বেলে নায়ককে বলে মৃত্তিকা, ‘আমি একটা ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম কদিন আগে। ওরা প্লিজড। সম্ভবত আগামী মাসেই জয়েনিং আমার। উত্তমকে জানাইনি। কাউকেই জানাব না এখন।’ সে যে উত্তমের এই সংসার ছেড়ে পালিয়ে যাবে নিজস্ব আয়ের সংস্থান করে, সে ব্যাপারে নায়কের সম্মতি পেয়ে তার ভালো লাগে। ‘তোমাকে কিন্তু আমি সঙ্গে করেই নিয়ে যাব সুদর্শন। তুমি আমার কাছেই থাকবে নায়ক হয়ে। আর আমি তোমার নায়িকা।’ কথাটা বলেই সুদর্শনের নাকে নিজের নাক ঘষে দেয় মৃত্তিকা। সারা দুপুর সুদর্শনকে নিয়ে মৃত্তিকা পরম আনন্দে কাটায়।

প্রতি রাতে উত্তম ঘুমিয়ে পড়লে পোস্টারটা বিছিয়ে শুয়ে থাকে সে। নায়কের সঙ্গে মিলনে যে বৃষ্টিধারা বয়ে যায়, তাতে অঝোর ভিজে যায় মৃত্তিকা। সারারাত সে ভেজা শরীরে ঘুমিয়ে থাকে পরম আবেশে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4858 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...