বাঘডুম

বাঘডুম -- রোমেল রহমান

রোমেল রহমান

 

গ্রামে বাঘ এল বলে গ্রামের লোকেরা সব দরজায় তালা এঁটে বসে থাকল! বাঘ তাড়াবার জন্য কাউকে পাওয়া গেল না! কেননা, আড্ডাখোর ফাউল ছেলেপেদের ঠেঙিয়ে ঘরে থাকার শিক্ষায় শিক্ষিত করেছে পুলিশ, ফলে সবাই সুবোধ শিশু হয়ে ঘরে উঠে গেছে! কেউ সাহস দেখাতে এল না। সমস্যায় পড়ে গেল যারা হাটবাজার, স্কুলকলেজ, ক্ষেতখামার যায় কিংবা যাদের রোজ চাকরিতে যেতে হয়, তারা! প্রথম দুদিন আমোদেই কাটল দরজা এঁটে! বিপাকের দেখা দিল তৃতীয়দিন থেকে, কেননা সবার বাজার ফুরিয়ে আসছিল! তাছাড়া চাকরিতে না গেলে চাকরি চলে যাওয়ার সুযোগ আছে! ফলে বিপাকগ্রস্ত মানুষেরা এই বন্দিত্ব থেকে মুক্তির রাস্তা খুঁজতে লাগল! এবং প্রতিবেশীর সঙ্গে আলোচনা করতে তারা জানালা খুলল! ফলে জানালায় জানালায় আলাপ হতে লাগল বাঘ তাড়াবার জন্য…

জানালা আলাপ ০১

–বাঘটারে কি তুমি দেখিছ?
–নাহ! শুনলাম লোকে দেখিছে!
–সে কিডা যে দেখিছে?
–জানি না! তয় লোকে কলো যে তারা দেখিছে!
–হুম! আমিও দেখিনি তয় শুনিছি লোকে দেখিছে!
–হয়! গরু নিয়ে গেছে কয়ডা! সেদিন রাইতি এমন হালুম দেল যে আমার নাতিডা মুইতে দেল!
–এহন করবা কী? শুনলাম মেম্বারের ছাগল নিছে দুইডে?
–না! দুইডে না চাইরডে!
–আন্দাজে কইয়ে না দিনি বাঁড়া, আমি নির্ঘাত জানি দুইডে!
–ওরে বাঁড়া সে তো চেয়ারমেনের দুইডে, মেম্বারের ছাগল নিছে চাইরডে!
–ধুর বাঁড়া তুমি বাল্ডাও জানো না! চেয়ারম্যানের ছাগল নেবে কোন সাহসে? চেয়ারম্যান তো গরু পোষে
–ওরে বাবা ছাগলও আছে উনার!
–তোমারে কইছে!
–তা এই বাঘডা ধরবা কেম্নে?
–আমি ধরব ক্যা? কিছু হলি সবার আগে আমি নামি! এবার দেহি কিডা কিডা নামে রাস্তায়!
–ধুর বাঁড়া! তোমার সাথে কথা কওয়া আর খাম্বার নামে মামলা করা একই কথা!
–সাইয়ো আইছ কী করতি জানলা খুইলে কথা চুদাতি? সারা বছর তো কোনও খোঁজ থাহে না!

[খটাস শব্দে জানালা বন্ধ করে দেয়!]

জানালা আলাপ ০২

–আছ কিরাম?
–জিরাম আছ তুমি!
–ছুয়াল্ডা বাড়ি না খুলনায়?
–তোমার মাইয়েডা কুয়ানে?
–শোনলাম মাইয়ে বিয়ে দিচ্চ?
–তোমার ছুয়াল কি বিয়ে এরিছে?
–বাঘের খবর পাইছ?
–হয়! তুমি পালা কারথে?
–শুনলাম!
–আমিও শুনিছি! ডোরাকাটা!
–হয় ডোরাকাটা!
–এ সাইয়োডা যাবে কবে?
–তোমার মনে কী হয়?
–জানি না!
–আমিও না!
–আচ্ছা গেলাম!
–যাই!

জানালা আলাপ ০৩

–করবা কী?
–মেম্বার চেয়ারম্যান রে জানাইছিলাম মুবাইলে তারা কিছু কয় না!
–হ! তারা কয় সব ভুলভাল! বাঘ আসে নাই!
–না আসলি চুদনা বিটারা ঘরের মদ্দি সাইন্দে রইসে ক্যান?
–তাই তো!
–পুলিসি খবর দিছিলাম, তারা কয় কোনও বাঘ গ্রামে ঢোকে নাই! তাগের কাছে কোনও তথ্য নাই!
–বনবিভাগে খবর দিছিলাম তারা কয় বাঘ অজ্ঞান করা বন্দুক তাগের নাই!
–তালি এহন হবেনে কী?
–বাঘের হাতে মরব আমরা সবাই!
–ধুর বাঁড়া! ভয় দেচ্চ ক্যান!
–তালি করবডা কী?
–আর কয়দিন ইরাম ঘরে আটকা থাকলি না খায়ে মরা লাগবে!
–হু! কারখানার চাক্রিডাও চইলে যাবে!
–এট্টা পিলান করা দরকার বাঘ তাড়ানোর!
–করবে কেডা?
–আমি তো না!
–আমিও না!
–তাইলে যাও দিনি বাঁড়া!
–তুমিও যাও সাইয়ো!

[খটাস খটাস শব্দে জানালা বন্ধ হয়ে যায়!]

জানালা আলাপ ০৪

–অবস্থা কী মনে হয় তুমার?
–ভেল্কি!
–মানে?
–আরে বাঁড়া বাঘ আস্পে কুয়ান্থে?
–ক্যান সুন্দরবনের থে?
–বাঘ আছে নিকি? সব মাইরে ভূত! যেই কয়ডা আছে তা বর্ডার পার হয়ে চইলে গেইছে!
–ভিসা লাগিনি?
–ধুর বাঁড়া ইয়ার্কি মারাইয়ে না দিনি!
–এহন করবা কী?
–এট্টা কমিটি বানাতি হবে!
–বাঘ মারা কমিটি?
–উঁহু, বাঘ বিতাড়ন কমিটি!
–বিতাড়ন?
–হয়! বাঘ মারা কমিটি লিখলি বাঘ বাঁচাও আন্দোলনের লোকেরা ধরবেনে!
–তালি এট্টা মিটিং ডাকো!
–মিটিং আবার কী?
–তা ঠিক! মিটিঙে বস্‌তি হলি তো বাইরে বের হতি হবে! তা তো সম্ভব না! আর শহরে হলি এট্টা কথা ছিল। সবাই ইন্টারনেটে ভিডুও মিটিঙে বসত! আমাগের তো সে কায়দা নেই!
–ওসব বাদ দেও দিনি! মিটিং লাগে না আইজকাল!
–তালি করবা কী?
–বাঘ বিতাড়ন কমিটির সভাপতি হলাম আমি, আর তুমি সেক্রেটারি! ব্যস! এই খবরটা তোমার পাশের জানালায় দিয়ে দেও! তারে কবা তার পরের বাড়ির জানালায় জানায় দিতি! গ্রামের অন্য সবাই কমিটির সদস্য!
–চেয়ারম্যান মেম্বার ছুঁচো দুইডেরে করবা কী?
–তারাও সদস্য! তাগেরে হেড বানানো যাবে না! এই আইটেম হিট করায়ে আমরা হিট হব! তারপর আমি চেয়ারম্যান আর তুমি মেম্বার ইলেকশন করব!
–তাইলে খবরটা দিয়ে দি?
–দেও!

[জানালা বন্ধ হয়]

জানালা আলাপ ০৫

–শুনলাম তুমি নাকি বাঘ দেখিছ?
–হয়!
–কুয়ানে?
–আমার বাড়ির পিছনের কচুক্ষেতের মধ্যি দিয়ে হাইটে যাচ্ছিল!
–আস্ত বাঘ?
–না! লেজ দেখিছি!
–বাঘ দেখোনি?
–আরে বাঁড়া বাঘের লেজ দেখা আর বাঘ দেখা তো একই কথা!
–তা কিরাম কইরে হয়!
–হবে না ক্যান? বাঘের লেজ বাঘ না?
–কুথায় বাঘ আর কুথায় লেজ!
–ধুর বাঁড়া! নিজে তো দেখতি চান্স পাওনি, কপালেও নেই, তাই হিংসে কত্তিছ!
–আমরা দেখলি বাঘই দেখতাম! ঐ লেজ ফেজ না! পুরো বডি!
–হয় তুমরা দেখলি বাঘের হোল দেখতা!

[জানালা বন্ধ হয়ে যায় খটাস খটাস]

জানালা আলাপ ০৬

–শুনলাম বাঘ বিতাড়ন নামে এট্টা কমিটি হইসে?
–হ আমিও শুনিছি!
–আমরা সবাই সদস্য!
–কাজ কী এগের?
–তা জানি না!
–তালি বাঘ বিদায় হবে কেম্নে?
–বরাদ্দ আস্পে মনে হয়!
–কী জন্নি?
–বন্দুক কেনার জন্যি, জাল কেনার জন্যি!
–বের হবে কিডা? ঘরে বইসে বন্দুক কি গোয়ায় দেবে?
–তালি বন্দুক দিয়ে করবেডা কি?
–ঘরের মদ্দি বইসে ফুটোবে জানালা দিয়ে!
–খ্যাঁক খ্যাঁক খ্যাঁক! ভালো কইছ!
–তা বন্দুক কেন্তেছে কিডা?
–তুমি না কইলে বন্দুকের জন্যি বরাদ্দ আস্তিছে!
–আমি কুয়ানে কলাম! লোকে কচ্ছে!
–তা কল কিডা?
–ধুর বাঁড়া! খামাখা!
–কথাবার্তা ঠিক করো! ঝাড়ই মারায়ে না সাইয়ো!
–তুমি ঠিক করো বাঁড়া!

[জানালা বন্ধ হয়ে যায় খটাস খটাস]

জানালা আলাপ ০৭

–বুঝতে পারছ তো এটা সরকারে একটা কৌশল! জনগকে ঘরে আটকে রাখবার!
–রাহো দিনি ওসব! উঠোনে বাঘ আর তুমি বাঁড়া সরকার সরকার করতিছ! আগে বাঘ তাড়াও!
–না না, তাড়ালেই হবে না। প্রথমে বুঝতে হবে বাঘের অস্তিত্ব আছে কিনা! নাকি এটা মনের বাঘ!
–কলেজে পইড়ে তুমাইগের নতুন বাল গজাইছে! যা চোখি দেহা যায় তার বাইরে না দেখা জিনিসের ভয়ে অস্থির হয়ে থাহো!
–আমি বলছিলাম যে সবাই একজোট হয়ে পথে নামতে হবে! লড়াইটা আমাদের!
–সে কথা তো তুমি গত দশদিন ধইরে কচ্ছ! অথচ একবার নিজের উঠোনে নামোনি! শুনলাম মুত্তিছও জানালা দিয়ে!
–না না এভাবে ভাবা ঠিক হচ্ছে না! আমি প্রস্তুতি নিচ্ছি! লড়াইয়ের আগে কৌশল ঠিক করা প্রয়োজন!

ঠিক এই সময়ে দুই ঘরের জানালার একটু দূরে একটা বাঘকে মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়! ফলে হালুম দেওয়ার আগেই কৌশল এবং প্রস্তুতি নেয়া লোকটা অচেতন হয়ে পড়ে এবং দ্বিতীয় লোকটা থাল বাজাতে শুরু করে তুমুল জোরে!

জানালা আলাপ ০৮

–এডা কীরাম হল?
–হয় আমিও তাই ভাবতিছি!
–আমরা হলাম গিরামের চেয়ারম্যান মেম্বার! আমাগেরে সভাপতি সেক্রেটারি না বানায়ে ছিমড়ারা নিজেরা নিজেরা হইসে!
–সরকার নাকি ঢাকার থে কমিটি বানায় দেছে!
–তা কীরাম কইরে সম্ভব?
–এই পরিস্থিতিতে কেউ আস্পে নানে ইদিকে! তাই ফোনে জানায় দিছে!
–তুমি কি ভুদাই না ছাগল? ফোন দিলি তো আমাগেরে দেবে প্রথম! উরা কারা?
–তাই তো?
–ভাবো! ভালো কইরে ভাবো!
–তালি করব কী এহন?
–পথে নামতি হবে! ওগেরে ধইরে বলতি হবে আমাগেরে সভাপতি সেক্রেটারি বানাতি! তারপর বাঘ বিতাড়ন!
–তালি আসেন ওগের বাড়ি যাই!
–আমি যাব ক্যা? তুমি যাও!
–আপনারে দেখলি বাঘ ভয় পাতি পারে! আমি চুনোপুঁটি মেম্বার আমারে ঘাড় মটকায় ধরবেনে!
–তালি তুমি যাচ্ছ না?
–আপনি না গেলি আমি যাই কেম্নে? একই পার্টি করি তো!
–তাইলে ওগেরে ডাকাও!
–ওরা আস্পে না!
–ক্যান?
–বাঘ নাকি আপনার বাড়ির পুকুরে সাঁতার কাটে! যহন তহন উইঠে আসতি পারে!
–কও কী? এসব কইছে খিডা?
–লোকে কচ্ছে!
–তুমি শুনলা কুয়ান থে?
–লোকের কাছ থে!
–কোন লোক?
–তা কব ক্যান?
–কবা না ক্যান?
–ধুর বাঁড়া! আপনার সাথে কথা বলাও বিপদের! বাঘ টের পালি জানালা দিয়ে হালুম দিতি পারে!
–কচ্ছ কী এইসব?

[জানালা বন্ধ করে মেম্বার চলে যায়]

এর পরদিন সকালে দেখা যায় গ্রামের কুঁজো বুড়ি বাড়ি বাড়ি এসে ভিক্ষে চাইতে থাকে! তার ঘরে এক দানা খাবার নেই! জানালা দিয়ে লোকেরা তাকে বাঘের ভয়ের কথা বলে! বুড়ি বলে, বাঘ আমারে ধরতি আসলি আমি তার পিঠে চইড়ে বস্পো! ফলে কেউ কেউ বলে, ও বুড়ি ডাইনি, তাক্‌-তুক্‌ জানে! বাঘের ঘাড়ে উইঠে পড়তিই পারে! ফলে কেউ দরজা খোলে না! সবাই জানালা দিয়ে বুড়ির সঙ্গে আলাপ করে! বুড়ি চলে যাওয়ার পর কারও কারও মনে হয় বুড়ি রে কি বাঘ ধরবে না? কেউ কেউ ভাবে, বুড়ির গরিব হাড়জিরজিরে শরীরের মাংস খেতে বাঘের আগ্রহ নেই বলে বুড়িকে সে কিছু বলে না! অন্যরা ভাবে, বুড়ি নানান মন্ত্র জানে বলেই বাঘ তাকে ছোঁয় না! ফলে পরদিন সকালেও যখন বুড়িকে দেখা যায় এবং তার পরদিন সকালেও দেখা যায় তখন সবাই সবার সিদ্ধান্তে পোক্ত হয় যে, বুড়িকে বাঘ কিছু করবে না বা বুড়ির সঙ্গে বাঘের আপস হয়েছে!

এরপর একদিন সকালে গ্রামের সবাই শুনতে পায় কেউ একজন ঢোল বাজাচ্ছে! ফলে ঢোলের শব্দে সবাই জানালায় গিয়ে দেখতে পায় একজন কালোমতন ঢুলির পিছন পিছন তিনটে ডোরাকাটা বাঘ দুইপেয়ে মানুষের মতন নেচে নেচে হেঁটে যাচ্ছে! ফলে কয়েক মুহূর্ত সবাই ভির্মি খেয়ে থাকে এবং তারা বিড়বিড় করে বলতে থাকে, সঙের বাঘ নিকি?… বহুরূপী?… বজ্জাতগুলান কারা?… বাঘ দুই পায়ে হাটে?… ঢুলি কি মানুষ না জাদুকর?… কাহিনি কী? ক্রমে তিন বাঘ সহ ঢুলি জংলার দিকে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার কিছু পর দেখা যায় কুঁজো বুড়ি ভিক্ষে করতে আসে! সবাই তাকে জিজ্ঞেস করে জানালা দিয়ে, বাঘ কি বিদেয় হইছে? বুড়ি তখন গর্বের সুরে বলে, বিদেয় কইরে দিয়াইছি! এমন ভয় দিছি যে চাইর পায়ের বাঘ দুই পায়ে হাইটে পলাইছে! ফলে সবাই এই গল্প শুনে দ্বিধায় ঘুল্লি খায়! তখন তারা জিজ্ঞাস করে ঢুলি লোকটা কে? সে তো এই গাঁয়ের কেউ না! বুড়ি তখন মুচকি হেসে বলে, মটকির মদ্দি এট্টা জ্বিন আটকায় থুইলাম আমি! আমার পোষা জ্বিন! এডা হচ্ছে সে! তারে দিয়ে পাঠায় দিলাম বাঘ তিন্ডেরে জঙ্গলে দিয়াসথি! গাঁয়ের লোকেরা সবাই বুড়ির ব্যাপারে নতুন করে চিন্তাভাবনা করে! ফলে সেই বাঘ বিতাড়ন কমিটির সভাপতি সেক্রেটারি ভাবতে থাকে, কুঁজো বুড়ির আশ্রম বা মাজার নামক একটা কমিটি করা যেতেই পারে, নইলে এই মহৎপ্রাণ গুণিন বুড়ির দেখভাল করবে কারা!?

 

১১ সেপ্টেম্বর ২০২০

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...