বাইনারির নির্বাচন ও বামশক্তি

প্রতিভা সরকার

 



প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অধ্যাপক, সমাজকর্মী

 

 

 

 

২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গ বিজয় বিজেপির অধরাই রয়ে গেল। নির্বাচনের দু দফার শেষেই রাজ্য বিজেপির কাছে  অডিট করে যা বাড়তি টাকা আছে তা ফেরত দেওয়ার চিঠি এসে গেছে হেড অফিস থেকে— এই মর্মে টেলিগ্রাফ কাগজে একটি খবর পড়েই মনে হয়েছিল, যাক, এ যাত্রা আর বাংলা দখল হচ্ছে না।

তবু ভয় ছিল। উত্তরবংগ এবং দুই মেদিনীপুর থেকে বন্ধুরা জানাচ্ছিলেন হাওয়া ভালো নয়। তাদের আশঙ্কাকে মিথ্যে করে দিয়ে বিজেপি হারল, কিন্তু রক্তবীজের মতোই জন্ম দিয়ে গেল একগুচ্ছ বাইনারির।

কাদম্বিনীর মত বিজেপি হেরেও প্রমাণ করল সে হারেনি। নো ভোট মানে একটিও ভোট নয়। এ তো দেখছি ৩টের জায়গায় ৭৩টা হল। এবার বিধানসভায় শুধু তৃণমূল আর বিজেপি, যেন তোমায় আমায় মুখোমুখি আজ/ চিনি লব দোঁহে ছাড়ি ভয় লাজ। মাঝে বাম বা কংগ্রেসের বালাই রইল না।

বাম এবং কংগ্রেসশূন্য বিধানসভা পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে এই প্রথম। হয়ত এই শেষ নয়। কারণ বিজেপি হচ্ছে সেই জঘন্য আগাছা যারা বংশবিস্তার করে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে এবং নিঃশব্দে। গ্রাস করে নেয় সবুজের শেষ চিহ্ন। অনুকূল প্রতিবেশ পেলে তো কথাই নেই। ফলে পুরনো চেনাচিনি নতুন কী সমীকরণের জন্ম দেবে ঠিক জানি না, তবে কোনও বামশক্তিকে সহ্য না করার পয়েন্টে দু তরফই দারুণ একমত। আরএসএস ঘনিষ্ঠ যিনি যাদবপুর সিটটা পেলেন তিনি এবং তার মতোরাই, আশা করি, মধ্যস্থতা করবেন। তবে আপাতত যে বামেরা সুন্দরবনে লিফলেট বিলি করে মোর্চাকে ভোট দিতে বারণ করেছে, মুখে ধারণ করেছে নিরপেক্ষতার মুখোশ, কিন্তু অন্তরে ঢলে রয়েছে সংগঠিত বামশক্তিকে ধ্বংস করার দিকে, তারা অজমাতার তৃতীয় সন্তানের মত লাফালাফি বন্ধ করলেই ভালো। অন্তরে আমি যাইই হই না কেন, বাইরের লাল রংটাও ফ্যাসিস্টদের কাছে অসহ্য। তাদের লাঠির বাড়ি বামের রকমফের বিচার করবে না। তৃণমূলের ছায়াটুকু মাথার ওপর থেকে সরে গেলে এরাও রেহাই পাবে না। তখন, একমাত্র তখনই বোঝা যাবে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে হলে সংগঠিত বামশক্তির উপস্থিতি কতটা জরুরি। কিছু পর্যবেক্ষকের মতে নো ভোট টু বিজেপি মঞ্চ থেকেই ভবিষ্যত নেতৃত্ব উঠে আসবে। পাঁচমিশালি মতকে, নাগরিক মঞ্চের সোশাল মিডিয়াকেন্দ্রিক আন্দোলনকে একত্র এনে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়ার তাকত অর্জন করা যদি রাজনীতিতে এতই সহজ হয়, তবে তাকে বরণ করতে এক মুহূর্তও দেরি করব না।

আর একটি সম্ভাবনা বৃহত্তর বাম ঐক্যের। ঠেলার নাম বাবাজি। যদি দায়ে পড়েও সে ঐক্য সাধিত হয়, তাহলেও অতি চমৎকার। অন্তত পরস্পরের পিঠে এই ছুরিকাঘাত তো বন্ধ হবে।

ফলে দেখাই যাচ্ছে, যে রাজ্যে তৃণমূল (সে আসল হোক বা ছুপা) এবং বিজেপি ছাড়া রাজনৈতিক দল নেই, সে রাজ্য অবশ্যই রাজনৈতিক বাইনারির দখলে। গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যের পক্ষে তা ভালো কিনা তা বিচার করার মতো পরিণতমনস্ক আমরা সবাই। আমাদের কুল থাকবে না শ্যাম সেটা ভবিষ্যতই বলে দেবে।

নো ভোটের আনন্দে যে বিরোধাভাস তার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তবে বাইনারি আরও আছে। তার মধ্যে এক প্রবল বাইনারিকে হারিয়ে দিয়েছে এই নির্বাচন। সেই আনন্দ প্রথমে উদযাপন করতে চাই। তা হল ধর্মীয় বিভাজন। সংখ্যালঘুরা ভোট একত্রিত করেছেন বিজেপির বিরুদ্ধে। সেটা স্বাভাবিক। তাদের বে-ঘর বে-রোজগার করবার চক্রান্ত চলছিল। জানে মেরে দেওয়া হচ্ছিল। তারা তো খাল কেটে কুমীর আনতে পারেন না।

কিন্তু এটাও তো ঠিক যে বহু সংখ্যাগুরু মানুষ বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। ধর্মের ভিত্তিতে ভোট ভাগ তাহলে বাঙালি আটকাতে পারে! এটা একটা বিশাল অর্জন।

আনন্দ হচ্ছে কৃষক আন্দোলনের জন্যও। পশ্চিমবাংলায় কী হয় তার ওপর তাঁরা যেন জীবন বাজি রেখে বসেছিলেন। তাঁরা যুযুধান তৃণমূল বা সিপিএম কাউকে তোল্লাই দেবেন না বলে এখানে নো ভোট টু বিজেপির আবেদন জানিয়েছিলেন। তাঁদের সেই ডাকে সাড়া দেওয়া আমাদের কর্তব্য ছিল। তাঁরা যে জয়ের উদযাপন করছেন তা হল বিজেপির পরাজয়। সেটাই ছিল তাঁদের কাছে পাখির চোখ। আন্দোলনের একেবারে শুরু থেকে কোনও রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকা তাদের না-পসন্দ। তাই মনে করাবার দরকার নেই যে এই কৃষক আন্দোলনের অন্যতম মূল হোতা বামশক্তিগুলিই। তাঁরাই অন্যদের সঙ্গে সংগঠনের দেখভাল করেন, তাঁরাই রাকেশ টিকায়েতদের সঙ্গে বসে ভবিষ্যত কর্মপদ্ধতি ঠিক করেন। বিশাল বিশাল পদযাত্রাগুলির দায়ভার মূলত তাঁদের ছিল। তবুও এগুলো ফলাও করে বলা হয় না, কারণ কৃষকেরা অরাজনৈতিক থাকতে চেয়েছেন বা বলা ভালো, তাঁদের বিভিন্ন মতবাদ থাকায় ঐক্যের খাতিরে তাঁরা বিশেষ কোনও রাজনৈতিক দলকে লাইম লাইটে আনতে চাননি। কৃষক আন্দোলনকে যখনতখন যে কোনও সেলিব্রেশনে টেনে আনার আগে এই কথা কটি মাথায় রেখে দেওয়া ভালো। নাহলে কোথায় যেন তাঁদের বিরুদ্ধাচরণ করা হয়।

তৃণমূল বা মমতা বন্দ্যপাধ্যায়ের এই অভাবনীয় সাফল্যেও বাইনারি লুকিয়ে আছে। যত নিকৃষ্ট পদার্থ, সব মুখ্যমন্ত্রীর জোরেই রমরমিয়ে জিতে যাচ্ছে, আর সবাই সততার প্রতিমূর্তি বলে যাকে জানে, তিনি নিজে অল্প কিছু ভোটের ব্যবধানে হেরে গেলেন! আর হারলেন কোথায়? যে নন্দীগ্রাম ছিল তাঁর উত্থানের শেকড়, সেইখানে। মনে করতে পারছি না ভূভারতে কোথাও এইরকম বিপুল জয়ের জোয়ারে সেই জয়ের কাণ্ডারির পায়ে এমন কাঁটা ফুটেছে কিনা। যেন এক বালতি দুধে এক ফোঁটা চোনা।

আরও বাইনারি, যারা নন্দীগ্রামের ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস রাখাটা বামের পতনের মূল বলে ঠাউরান, তারা নিশ্বাস ফেলার আগেই বলে দিচ্ছেন নন্দীগ্রামের ভোটের রেজাল্ট বিজেপির নির্বাচন কমিশনের সহযোগিতায় সান্ত্বনা পুরস্কার পাওয়া। সব রেজাল্টকেই মানুষের রায় বলে ধরে নেব, শুধু নন্দীগ্রাম ছাড়া? নন্দীগ্রামের মানুষের মান-অপমান বোধ নেই নাকি! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও নন্দীগ্রামের মানুষকে এইরকম দোষারোপ করেননি। শুধু দলীয় জয় নয়, এই কারণেও তাকে অভিনন্দন জানাতে হয়।

যাই হোক আশা করতে তো দোষ নেই যে বিজেপির বাহুবলীরা বিধানসভায় ভাঙচুর না চালিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে এ রাজ্যের উন্নয়নে সামিল হবে। জনকল্যাণমূলক পরিকল্পনা ছড়িয়ে যাবে, বেকারত্ব ঘুচবে, মানুষের পেটে ভাত জুটবে। চাষি ও শ্রমিক তাদের ন্যায্য পাওনা পাবে। অতিমারিতে মানুষকে অসহায়ভাবে মরতে হবে না। কর্পোরেটের রমরমা ঘুচবে আর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত, মানুষে মানুষে বিভাজন কমবে।

তবে শুরুটায় কোনও পরিবর্তনের ঝলক নেই। নির্বাচনী ফলাফল বেরোনো শেষ হয়নি, তখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে লাঠিসোটা নিয়ে বিরোধীদের মারধর, ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা। সেই এগারো সালের মতোই। সাধারণ সমর্থক তো বটেই, ইলেকশনে দাঁড়ানোর অপরাধে ডায়মন্ড হারবারে প্রতিকুর রহমানের পরিবারের জীবিকার উৎস তাদের দোকানঘর ভেঙে দেওয়া হয়েছে। অন্যত্র মালিকের সঙ্গে তার পোষা কুকুরটিকেও পিটিয়ে মারা হয়েছে। এরকম তো আগেও হয়েছে বলে হোয়াটঅ্যাবাউটারি করা হলেও যা অন্যায় তা অন্যায়ই থাকবে। ন্যায়ের রং সময় বুঝে লাল কিম্বা সবুজ হয় না।

আর বামেদের জন্য এইটা বলার যে সামগ্রিক চিত্রটা তাদের পক্ষে মোটেই খারাপ নয়। তামিলনাড়ু, অসমে নতুন সিট পাওয়া, কেরলে বিজেপিকে ঘাড়ধাক্কা দেওয়া এসব কি এই পরিস্থিতিতে চাট্টিখানি কথা! বামই যখন প্রধান শত্রু বলে চিহ্নিত?

স্বীকার করে নেওয়া ভালো, বাম রাজনীতির ভরকেন্দ্র এখন আর পশ্চিমবঙ্গে নেই। তবু তো লড়াইয়ের ময়দান ছাড়া চলবে না।

পশ্চিমবঙ্গেও এই ভোট সংযুক্ত মোর্চার বিরুদ্ধে ততটা নয়, যতটা বিজেপির বিরুদ্ধে দেওয়াল তৈরির। বামের ব্যর্থতা এটাই যে বিজেপির ভয়ঙ্কর রাজনীতির বিরুদ্ধে যে লড়াই সেটা বামশক্তি ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়, এটা মানুষকে বোঝাতে না পারা। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে আপসহীন যোদ্ধা এরাই, কারণ ফ্যাসিবাদের উত্থানের পেছনে পলিটিক্যাল ইকোনমি বা রাজনৈতিক অর্থনীতি বামেরই আয়ত্তাধীন। অন্য বুর্জোয়া দলগুলির প্রত্যেকটিরই নিওলিবারেলিজম সম্পর্কে কিছু না কিছু দুর্বলতা, তার সঙ্গে কোনও না কোনও সম্পর্ক রয়েই গেছে।

পুরনো কাসুন্দি ঘাটতে বসে দেখি গোটা দেশের প্রেক্ষিতে বামেদের অতীত ভুল দুটো। এক, জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে না দেওয়া, আর সনিয়া গান্ধি ও প্রণব মুখোপাধ্যায়ের অনেক চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে আমেরিকার সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি সই করবার কারণে মনমোহন সিং মন্ত্রিসভা বর্জন করা। তারপর সময় অনেক পাল্টেছে। এখনকার বামশক্তি আগের মতো পুরো লেফট প্রোগ্রামকেই বাস্তবায়িত করবার জেদ ধরে বসে থাকতে পারে না। কারণ গণতান্ত্রিক কাঠামোয় পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব খুব জরুরি। তার জন্য ফ্যাসিবাদ বিরোধী যৌথ নেতৃত্ব, কিছুটা হলেও সমমনা শক্তির সঙ্গে বোঝাপড়া খুব জরুরি। বর্তমান বামশক্তি এই যৌথতায় বিশ্বাসী সেটা কৃষক আন্দোলন, বিভিন্ন শ্রমিক আন্দোলনে জোট বাঁধার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হচ্ছে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জোট করে ভোটে লড়াতেও এই বিশ্বাসের প্রতিফলন।

পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও সংযুক্ত মোর্চা নির্বাচনে জিতবে, নিজেরাও এইরকম ভাবেনি বলেই বিশ্বাস। তার বদলে বরং বুথ লেভেলে জনমুখিনতা তৈরিতেই তাকে উৎসাহী মনে হয়েছে। রুটিন আন্দোলন এবং নির্বাচনমুখী সংগঠনের বদলে সংগ্রামই এখন বীজমন্ত্র। আর তা সঠিকভাবে পালনের জন্য ময়দানে হাজির এক গুচ্ছ তরুণ-তরুণী। রেড ভলান্টিয়ার বা কমিউনিটি কিচেনের প্রাণ এরাই। হার নিশ্চিত জেনেও এরা প্রাণ বাজি রাখতে জানে। বামশক্তি ঠিক পথেই চলছে, তার কর্মসূচিতে অনুযোগ অথবা হতাশার কোনও স্থান থাকা উচিত নয়।

এনজিও-র সঙ্গে তুলনা করে যে ঠাট্টাটা বেশ চাউর হয়েছে তা জেনে মনে পড়ে গেল গ্রিক পুরাণের অ্যান্টিউসের কথা। যতক্ষণ সে মাটিতে সংলগ্ন থাকবে ততক্ষণ সে অবধ্য, এই ছিল দেবতাদের বর। যদি কখনও হতোদ্যম হয় সে, তাহলে মাটির ছোঁয়া পেলেই তার সমস্ত শক্তির পুনরুজ্জীবন ঘটবে। তাই তাকে হত্যার জন্য অনেক পরিকল্পনা, অনেক ষড়যন্ত্রের প্রয়োজন হয়েছিল।

মাটির ছোঁয়ায় সংলগ্ন থাকলে সকল দেশেই বামশক্তি অবধ্য। তাই শূন্য হয়ে গেলেও তাকে বিশ্বস্ত থাকতে হবে ঐ মাটির প্রতিই।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. ভাল লেখা। একমত হতে কোনো বাধা নেই। তবে বামেদের দরকার পার্টি প্রোগ্রামে যুগোপযোগী পরিবর্তন। পুঁজির চরিত্র পাল্টেছে, সমাজতন্ত্রের চেহারা বদলেছে, ব্যক্তি পরিসরে নজরদারি আর চোখরাঙানি বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের মারণ-ক্রিয়া ভয়ংকর হয়ে উঠছে। কিন্তু সাধারণ খেঁটে খাওয়া মানুষের যাঁরা ভ্যাংগার্ড হতে চান, তাঁরা এসব বিষয়ে নিরব কেন? মতাদর্শগত সংগ্রাম কোথায়? দেশের সামনে কোন বিকল্প তুলে ধরছেন? পার্টি-তে পড়াশোনার যে চল ছিল, তার কতটা আজ অবশিষ্ট? এই সব ভেবে আমার মতো বহু লোক খুব কষ্ট পায়। মনে পরে সেই অমোঘ প্রশ্ন: কমরেড, তুমি নবযুগ আনবেনা ?

আপনার মতামত...