সুখহীন, নিশিদিন, স্নানহীন হয়ে..

সুখহীন, নিশিদিন, স্নানহীন হয়ে.. -- অম্লানকুসুম চক্রবর্তী

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী

 

ইংরেজ ঔপন্যাসিক ও কবি অ্যান্থনি বার্জেস আজ বেঁচে থাকলে হয়তো প্রবলভাবে নাক সিঁটকোতেন। বলতেন, আমার দেশের লোকেরা কি স্নান করা ছেড়ে দিল!

স্নান করা নিয়ে বার্জেসের একটি বিখ্যাত কথা আছে। তিনি লিখেছিলেন, বেশি পরিচ্ছন্ন থাকতে দিনে দুবার স্নান করুন। চলনসই পরিচ্ছন্ন থাকতে দিনে একবার। আর নিজেকে সমাজের চোখে দুঃসহ প্রমাণ না করতে চাইলে, সপ্তাহে একবার, স্নান তো করুন।

ব্রিটেনের খ্যাতনামা মার্কেট রিসার্চ ও ডেটা অ্যানালিটিক্স সংস্থা ইউগভ সম্প্রতি সমীক্ষা করে দেখেছে, করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ, বাড়ি থেকে কাজ আর সম্ভবত বাড়ির বাইরে বেরোনোর ক্রমাগত কমে আসার প্রয়োজনের জন্য সেদেশের লোকেরা স্নানের অভ্যেসটাই কমিয়ে দিয়েছেন। ১৭ শতাংশ মানুষ নিজের মুখে স্বীকার করে নিয়েছেন অনিয়মিত স্নানের এই নয়া অভ্যাসের কথা। তবে শুধু কম স্নান করা নয়, আর যা কিছু করলে নিজেকে আরও একটু পরিচ্ছন্ন বলে দাবি করা যেতে পারে, তার অনেককিছুই ব্রিটেনের নাগরিকরা কমিয়ে বেঁচেছেন। স্নান করা তো দূরে থাক, দিনে একবার সামান্য জল দিয়ে চুল ভিজিয়ে নেওয়ার সু-অভ্যেসটাও কমেছে। একদিকে স্নান করছেন না, আবার অন্যদিকে পারফিউম-ডিওডোরেন্ট ব্যবহারও কম করছেন। ২৯ শতাংশ মানুষ পরিচ্ছন্ন পোশাক পরার অভ্যেসকে দুয়ো দিয়েছেন। এত অবধি তাও মানা গেল। সমীক্ষা বলছে, সকালবেলা উঠে যে দাঁত মাজার অভ্যেস, তাতেও রাশ টেনেছেন প্রায় ৬ শতাংশ ব্রিটিশ নাগরিক। ধোয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অন্তর্বাস এবং মোজা ব্যবহার করার ভালো অভ্যেসের চাকাও ইদানীং উল্টো দিকে ঘোরা শুরু করেছে। এ প্রসঙ্গে ৯ শতাংশ নাগরিক হয়তো বলতে চেয়েছেন, এসব ধুয়ে টুয়ে না পরলেই বা কি যায় আসে! আর সমীক্ষা যাঁরা করেছেন, লোকজনের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা বুঝেছেন, এই অপরিচ্ছন্ন থাকার কু-ট্রেন্ড এখনই যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না আপাতত। করোনার আবহসঙ্গীত বাজবে যত দিন, এমন অভ্যেসও হয়তো তাল মিলিয়ে চলবে।

আমাদের এই দুঃখী দেশে এমন সমীক্ষা চালানো বিলাসিতা। চারটে হাসপাতাল থেকে রেড কার্ড পাওয়ার পরে পঞ্চম হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে কাতরাতে থাকেন যে রোগী, সঙ্কটের সময়ে অক্সিজেন পেতে যাঁর এক কোটি টাকার লটারির টিকিট পাওয়ার থেকেও বেশি ভাগ্য লাগে, ভনভন করা তেমন মানুষের দেশে এ ধরনের সমীক্ষা চালানোর বাস্তবিকভাবেই কোনও মানে হয় না। তবে সাদা কলারের কাজ যাঁরা করেন, যাঁদের বাড়িতে বসে ল্যাপটপ খুলে খটখট করলেই মাসের শেষে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ক্রেডিটেড হওয়ার বার্তা আসে নিয়ম করে, তাঁদের ওয়ার্ক ফ্রম হোমের দৌলতে পরিচ্ছন্ন থাকার চিরাচরিত স্বভাব হঠাৎ পাল্টে যাওয়ার তো কোনও কথা ছিল না। প্রশ্ন আসতেই পারে, পরিচ্ছন্ন থাকার অভ্যেসের এমন অবক্ষয়ের কারণ কী? নিজের ভালো থাকাটাও কি তবে লোক দেখানো? কর্পোরেট সংস্কৃতির রাজপথ-গলি-ঘুঁজি নিয়ে চর্চা করেন যাঁরা, তাঁরা বলছেন, নিজেকে ভালো রাখার ব্যাপারটা আরও প্রকট হয় যদি তা চাউর করার কোনও উপায় থাকে। প্রতিদিন স্নান করলে নিজের ভালো লাগার থেকেও যে বিষয়টি আরও প্রকাশ্যে আসে তা হল বাইরের মহল আমাকে ফ্রেশ দেখল কতটা। দুনিয়ার কাছে দেখনদারির সুযোগ যদি সীমিত হয়ে হয়ে যায়, তাহলে কমে যায় সেই অভ্যেস বজায় রাখার ইচ্ছেও।

মনস্তাত্ত্বিকরা বলেন, গভীরে যাও, আরও গভীরে যাও। টেলিভিশনে দেখা ডিওডোরেন্টের বিজ্ঞাপনগুলোর কথা ওঁরা মনে করিয়ে দেন আবার। বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, কোনও সুপুরুষ গায়ে দুবার ডিওডোরেন্ট স্প্রে করলেই মৌমাছির মতো জড়ো হতে শুরু করেন কিছু লাস্যময়ী। প্রাণ ভরে গন্ধ-শ্বাস নিতে নিতে তাঁরা জাপটে ধরেন সেই পুরুষকে। কোনও মহিলা নিজের দেহে স্প্রে করলে চুম্বকের কাছে আলপিন যাওয়ার মতো ঘেঁষতে থাকেন পুরুষ। চিত্রনাট্যের কিন্তু কোনও নড়চড় হয় না। মনোবিদরা বলছেন, দিনের পর দিন এমন বিজ্ঞাপন দেখার পর ডিওডোরেন্টের প্রতিটা স্প্রে-র সঙ্গে আমাদের মনের অবচেতনে কাজ করতে থাকে এমন সুপ্ত ইচ্ছে। বাড়ি থেকে যদি বেরোনোরই প্রয়োজন না থাকে, স্বাভাবিকভাকেই ডিওডোরেন্ট স্প্রে করা ও তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ছবিগুলোর কোলাজও ক্রমশ ফিকে হয়ে আসে। তার জন্যই কি নিজেকে সাজিয়ে উঠতে অনীহা? দুয়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এই সমীকরণ উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বিভিন্ন সংস্থার কর্তারা তো বটেই, অধস্তন কর্মীরাও বাড়ি থেকে কাজ করার পোশাক সগর্বে পোস্ট করছেন ফেসবুকে, ইনস্টাগ্রামের ওয়ালে, ইউটিউবের চ্যানেলে। দেখা যাচ্ছে শরীরের ঊর্ধ্বাংশে শার্ট-স্যুট-টাই হলেও নিম্নাংশের সম্বল শুধু একটা বার্মুডা। স্ক্রিনে নিজেকে প্রকাশ করার জন্য যতটুকু দেখানোর দরকার হয়, ঠিক ততটা মাঞ্জা দেওয়া থাকলেই নব্য কর্ম সংস্কৃতির সঙ্গে দিব্যি মানিয়ে চলা যায় আজকাল। জুম কিংবা গুগল মিটে সহকর্মীদের সামনে দেখানো গ্রাফগুলো আকাশ ছুঁলেই যথেষ্ট। বক্তার মুখ থেকে ব্রাশ না করা বাসি গন্ধ আসছে কি না, তা জানতে পারার মতো প্রযুক্তি তৈরি হয়নি এখনও। অফিস যেহেতু যেতে হচ্ছে না, তাই কোনও কর্মী ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতাবোধ নিয়ে কতটা ওয়াকিবহাল, তা জানার চেষ্টা করতে সংস্থার ঊর্ধ্বতন ম্যানেজমেন্টের আধিকারিকদের বয়েই গিয়েছে। ফলে ভিতরে শ্যাওলা পড়ে গেলেও স্ক্রিনে কোনও মানুষকে ঝকঝকে দেখালেই কোনও প্রশ্ন করার অবকাশ দেখা যাচ্ছে না আপাতত।

ব্রিটেনের ইউগভ-এর সমীক্ষা যদি উপপাদ্য হয়, তার অনুসিদ্ধান্তগুলো যে শুধু সেদেশের সীমানার মধ্যে আটকে নেই সে কথা হলফ করে বলা যায়। পরিচিত বৃত্তে আসি। কয়েকজন বন্ধুর কথা জানি, বাড়ি থেকে কাজ করার দৌলতে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতাবোধ যারা জলাঞ্জলি দিয়েছে ইতিমধ্যেই। জিজ্ঞেস করাতে যে উত্তর উড়ে এসেছিল তা হল, ‘স্নান করে কী হবে?’ বলেছিল, ‘বাথরুমে কুড়ি মিনিট দেওয়ায় সময় কখন আমার?’ সাড়ে নটা থেকে যদি কাজের সময় শুরু হয়, সোয়া নটায় তাদের ঘুম ভাঙে। চোখে মুখে সামান্য জলের ঝাপটা দেওয়ার পরেই ল্যাপটপের যে পর্দা ওঠে, তা বন্ধ হয় না রাত দশটা সাড়ে দশটা অবধি। এক বন্ধু বলেছিল, ‘কোম্পানির হুকুম, কাজের সময়ে, অর্থাৎ ওয়ার্কিং আওয়ারে যদি কেউ ফোন না তোলে, তাহলে তার বিরুদ্ধে সরাসরি শো-কজের চিঠি ধরিয়ে দেওয়া হবে।’ সুতরাং, স্নানের সময় নেই! অনেকে মনে করেন, তুমুল ব্যস্ততার কারণেই তলিয়ে যেতে বসেছে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতাবোধ। তবে এ কথা শুনলেই গলা খাঁকারি দিয়ে বিরোধী শিবিরের মানুষেরা বলবেন, পরিষ্কার থাকার অভ্যেস এক মানসিকতা, যার মালিক পুরোপুরি আপনি নিজে। মিছে কথা বলো কেন হে?

দুনিয়াজুড়ে অপরিচ্ছন্নতাবোধের এমন মুঠো মুঠো উদাহরণ দেখে চিকিৎসকেরা আরও বেশি করে বলতে শুরু করেছেন নিয়মিত স্নান করার কথা। স্নান মানে তো কিছুটা সময়ের জন্য হলেও পবিত্র জলের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করা। অবগাহন। চিকিৎসকরা বারবার বলছেন, সাবানের বিজ্ঞাপনে দেখানো হাজার স্কোয়ার ফিটের বাথরুমে বিরাট বাথটাবে দেখানো স্নান বিলাসিতা হতে পারে, সাধারণ মানুষের স্নান কিন্তু একেবারেই তা নয়। ঠিক সময়ে খাবার খাওয়ার মতোই নিয়মিত স্নান করাটা জরুরি। স্নান শুধু শরীরের ধুলো ময়লাই পরিষ্কার করে না, চামড়ার মৃত কোষকে সরিয়ে দিয়ে ত্বককে প্রাণ যোগায়। শরীরে রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে সাহায্য করে। ভালো রাখে হৃদযন্ত্রকে। বিন্দু বিন্দু অবসাদ যে ক্রমশ সিন্ধুর আকার নিচ্ছে আমাদের মনে, বিশ্বজুড়ে, ঠিকঠাক স্নান সেই অবসাদকে কাটিয়ে দেওয়ার শক্তি রাখে অনেকটাই। শরীরের সঙ্গে মনের স্বাস্থ্য তাজা রাখতে চাইলেও শাওয়ারের তলায় দিনে কয়েক মিনিট দাঁড়ানো জরুরি। আর কে না জানে, স্নান মানে নিজের সঙ্গে একান্ত কিছু সময়ও তো বটে। নিজের সঙ্গে নিজেই কাটানোর সময় আজকের দিনে কোহিনুরের মতো দামি। সেই সুযোগ আমরা হেলায় হারাব কেন? মনোবিদরা বলেন, শারীরিক ক্লান্তির পাশাপাশি মানসিক ক্লান্তিতেও জেরবার প্রজন্মের জন্য স্নান আরও বেশি করে জরুরি। ক্লান্তির চারধারের শক্ত দেওয়ালটা জলের তোড়ে হয়তো ভেসে যায় কিছুটা। আমাদের ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য ক্লান্তির এই ভাঙন, আজকের এই বেরঙিন যুগে, আরও বেশি প্রয়োজনীয়।

কিন্তু কে কার কথা শোনে! অপরিচ্ছন্নতার বৃত্তের পরিধি ক্রমশ বাড়ছে। প্রফেসর ক্যালকুলাস যদি যদি থাকতেন আজও, এমন কোনও জুম মিটিংয়ে ঢুকেই এ যুগের ক্যাপ্টেন হ্যাডকদের উদ্দেশে হয়তো হাঁক পেড়ে বলতেন, ‘গন্ধটা খুব সন্দেহজনক।’ ডায়রির পাতা ভরে উঠত সদ্য আবিষ্কার করা কোনও অ্যাপের খুঁটিনাটি অক্ষরে।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...