গ্রন্থদাহের ইতিহাস

গ্রন্থদাহের ইতিহাস -- প্রহেলী ধর চৌধুরী

প্রহেলী ধর চৌধুরী

 

গ্রিক দার্শনিক সিসেরো বলেছিলেন: “বইবিহীন গৃহ, আত্মাবিহীন শরীরের সমতুল।”

বই যে সত্যিই মানুষের অন্তরাত্মার জীয়নকাঠি, মুক্তচিন্তার আকর, প্রতিবাদের অক্ষরসূচি; সেকথা তারও অনেক আগেই বুঝেছিলেন কিন সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ও অবিভক্ত চিনের প্রথম সম্রাট কিন-শি-হুয়াং। একে তো এই বিরাট সাম্রাজ্য চালনা করা মুখের কথা নয়; তার ওপর প্রজারা “যত বেশি জানে, তত কম মানে”। সুতরাং আজ্ঞাবহ ও অনুগামী প্রজাকুল তৈরির প্রথম শর্তই হল জানার পথটি পাকাপাকিভাবে বন্ধ করে দেওয়া। তাই ২১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শি-হুয়াং দেশের ৪৬০ জন পণ্ডিতকে জ্যান্ত কবর দিলেন। এক বছর পর তিনি তাঁর সাম্রাজ্যের সকল বই জ্বালিয়ে দেন। এ নির্মমতার ইতিহাস সম্পূর্ণরূপে সত্য কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে, থাকবেও। কারণ এই ধ্বংসলীলার কাহিনি সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করার মত কোনও ব্যক্তিই ওই সময় আর বেঁচে ছিলেন না।

আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত গ্রন্থাগারটিকে আবার ধ্বংস করা হল পর্যায়ক্রমে। ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের গৃহযুদ্ধে জুলিয়াস সিজারের সৈন্যরা শত্রু-জাহাজঘাঁটি জ্বালাতে গিয়ে গ্রন্থাগারটিকেই জ্বালিয়ে ফেলল। ৪০,০০০ বই নিমেষে পুড়ে ছাই। অবশিষ্টটুকুও ধারাবাহিকভাবে জ্বালিয়ে দেওয়া হল খ্রিস্টীয় পঞ্চম ও সপ্তম শতকে।

বইবিনাশের ইতিহাস তাই যুগে যুগেই সত্য। কখনও প্রতিবাদের ভাষা দমনে, কখনও ইতিহাসের দলিল মুছতে আবার কখনওবা বিদ্যমান বিশ্বাস সমূলে উৎক্ষেপ করে নতুন রাজতন্ত্রের জন্ম দিতে। মধ্যযুগে, বাগদাদের গ্রন্থাগারটিকে যেমন ধ্বংস করা হয় এই সবকটির সম্মিলিত কারণে। আসলে গ্রন্থাগারটি এতই সুবৃহৎ ছিল, তাতে দেশ-বিদেশের এতরকম চিন্তাভাবনার বই ছিল, যে সেটি এই সবকটি সমস্যার-ই উৎস হতে পারত। এহেন শত্রুর শেষ রাখতে নেই! তাই ১২৫৮ সনের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাগদাদের দখল নিয়েই মঙ্গোল সম্রাট হুলাগু খান সেখানকার গ্রন্থাগারটিকে ধ্বংসের কাজে মন দিলেন। পাঁচশত বছরেরও বেশি পুরনো প্রকাণ্ড “জ্ঞান-গৃহ” (the house of wisdom) থেকে সমস্ত বই, পাণ্ডুলিপি ছুঁড়ে ফেলা হল টাইগ্রিস নদীর জলে। কোটি কোটি বইয়ের কালিতে টাইগ্রিসের নীলজল আঁধার হল।

মানবসভ্যতার ইতিহাসে বইবিনাশের ধারাবাহিকতাটি কিন্তু এরপরেও অক্ষুণ্ণ থেকে গেছে। ১৪৩০ সালে টেনশটিটলানের (বর্তমান মেক্সিকো শহরের অন্তর্গত) চতুর্থ রাজা ইজকোয়ালও পূর্বজ-প্রদর্শিত পথেই হাঁটলেন— সাম্রাজ্যের সমস্ত ঐতিহাসিক বই পুড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন।

কিন্তু, শুধুমাত্র ব্যক্তিনির্দেশেই নয়, ইতিহাসের পাতা ওল্টালে সমষ্টিগত পুস্তকনিধনযজ্ঞেরও হদিস মেলে। ১৪৯৭ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে ‘অনুষ্ঠিত’ হল Bonfire of Vanities— আত্মগরিমার অগ্ন্যুৎসব। বই, স্থাপত্য, শিল্পকলা, বাদ্যযন্ত্র সহ মানুষের যা-কিছু ব্যতিক্রমী সৃষ্টি, তাকে ধ্বংস করাই ছিল এই উৎসবের উপজীব্য। আর এই যজ্ঞের পুরোহিত কিন্তু ছিলেন সাধারণ মানুষ। ধর্মের গোঁড়ামির বশবর্তী হয়ে যারা বিশ্বাস করেছিলেন যে বই-ই মানুষের অপরাধপ্রবৃত্তির মূল।

ধর্মীয় আধারে বইবিনাশ এরপরেও ঘটেছে অহরহ। যেমন ১৫৪৯ সালে স্প্যানিশ বিশপ ডিয়েগো-ডে–লান্ডার ওপর ভার পড়ল মায়া সভ্যতায় রোমান ক্যাথলিক ধর্ম প্রচারের। কাজটা সহজ নয়; কারণ মায়া জনজাতির নিজস্ব বিশ্বাস ছিল, ছিল নিজস্ব ঈশ্বর। তারা সেই ঈশ্বরের মূর্তিপূজা করত। তাদের বই,পাণ্ডুলিপি— সর্বত্র সেই ঈশ্বরের অধিষ্ঠান। ডিয়েগো বুঝলেন এমত অবস্থায় নতুন ধর্মবিশ্বাস গড়ে তোলা কঠিন। কারণ মানুষের বিশ্বাস তার মনে। মন সম্পৃক্ত হয় জ্ঞানে আর সেই জ্ঞান আসে বই থেকে। অতএব বই-ই হল সমস্যা, বইবিনাশেই সমাধান। তাই ১২ জুলাই, ১৫৬২, মায়াসভ্যতার সমস্ত বিদ্যমান বই, পাণ্ডুলিপি, চিত্রণ তিনি দিলেন পুড়িয়ে। ইতিহাসের একটি অধ্যায় নিশ্চিহ্ন হল।

অপেক্ষাকৃত সমসাময়িক সময়রেখায় আসি। কারণ বইনিধনের ইতিহাস, ইতিহাসেই থমকে থাকেনি। আজ থেকে মাত্র দেড়শো বছর আগে, ১৮৭৩ সালে আমেরিকার পোস্টাল ইন্সপেক্টর অ্যান্থনি কমস্টক একটি সমিতি তৈরি করলেন। নাম দিলেন— নিউ ইয়র্কের অনৈতিকতা দমন সমিতি (New York Society for the Suppression of Vice)। সমিতির প্রতীক চিহ্নটি হল দেখার মত— একদিকে, এক কারারক্ষী এক তরুণকে কারাগারে বন্দি করছেন; আর অন্যদিকে আরেক রক্ষী রাশি রাশি বই আগুনে নিক্ষেপ করছেন। কমস্টক ও তার অনুগামীরা আক্ষরিক অর্থেই প্রতীক চিহ্নটির মর্যাদা রক্ষা করলেন। মাত্র সাতাত্তর বছরের স্থায়িত্বকালে, সমিতিটি ১৫ টন বই, প্রায় ৩ লক্ষ মুদ্রণ প্লেট এবং ৪০ লক্ষ ছবি, “আপত্তিজনক”, “স্থূল” বা “অশ্লীল” তকমা এঁটে ধ্বংস করল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে, নাৎসি বইনিধন যজ্ঞের কথা আমরা সবাই জানি। সময়টা ছিল ১৯৩০। জার্মান ছাত্র সংগঠন, জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার সমস্ত নাৎসি-ভাবধারা বিরোধী বই, ধর্মগ্রন্থ, সকল সমাজতান্ত্রিক, উদারনৈতিক, কমিউনিস্ট, মার্কসবাদী, সাম্যবাদী বই ধারাবাহিকভাবে ধ্বংস করতে শুরু করে। আইনস্টাইন, ফ্রয়েড, ম্যাক্সিম গোর্কি, হেলেন কেলার, সহ প্রায় সকল বিখ্যাত বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সাহিত্যিক ও নাট্যকারের বই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। গ্রন্থাগার ও বইয়ের দোকানগুলিতে শুধুমাত্র নাৎসি-জার্মানি ও হিটলারের মতাদর্শী বই-ই স্থান পায়। এমনকি দৈনন্দিন সংবাদপত্র, বেতার বার্তার বিষয়বস্তুও নির্ধারন করে দেওয়া হয়। সাম্রাজ্যবাদী সম্রাট, নৈরাজ্যবাদী রাজা, মতলবী দলনায়ক আর ধর্মান্ধ ব্যক্তিবর্গের পর বই-এর চূড়ান্ত অবমাননা ঘটল পড়ুয়াদের হাতেই!

আর যাঁরা পড়ান? শিক্ষক যাঁরা? ইতিহাস দেখাল তাঁরাও বই পোড়াতে পারেন। কীরকম? ১৯৪৮ সালে স্বনামধন্য জার্মান মনোচিকিৎসক ফ্রেডরিক ওয়েরথাম বললেন, কমিক বই শিশুদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়িয়ে তোলে। এখানে বলে রাখা দরকার যে কমিক বই নিয়ে এর আগেও নানা সময়ে নানা দেশে আপত্তি উঠেছিল; কিন্তু কোনওটাই এত ব্যাপক আকার নেয়নি। আসলে ডক্টর ওয়েরথাম এতই জনপ্রিয় ছিলেন এবং বিষয়টিকে তিনি এতটাই প্রচারের আলোয় নিয়ে এসেছিলেন, যে তাঁর এই তত্ত্বটি নিমেষে জনমানসে প্রভাব ফেলল। প্রায় একমাস ধরে শিশুরা যে যেখান থেকে পারল হাজার হাজার কমিক বই সংগ্রহ করল। এরপর ১৯৪৮ সালের ২৬ অক্টোবর পশ্চিম ভার্জিনিয়া ও নিউ ইয়র্ক শহরের স্কুলপ্রাঙ্গণেই; শিক্ষক, ধর্মযাজক ও বাবা-মায়েদের তত্ত্বাবধানে কয়েকশো শিশু ছ-ফুট উঁচু কমিক-বইয়ের স্তূপ তৈরি করল। আজকের দিনেও যে জনপ্রিয় কমিক চরিত্র সুপারম্যান, তারই বই-মলাটে প্রথম আগুন ধরানো হল; ছুঁড়ে দেওয়া হল বইয়ের স্তূপে। অতি অল্পসময়েই, এই ঘটনা যেন একটা নিদর্শন হয়ে উঠল। আমেরিকার বহু শহরে— নিউ জার্সি, মিসৌরী, শিকাগো ছাড়িয়ে কানাডাতেও একইভাবে হাজার হাজার কমিক বই পোড়ানো হতে লাগল।

প্রথম সুপারম্যান বইটি অবশ্য একসময় জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন সুপারম্যানের সৃষ্টিকর্তা জো স্যুসটর নিজেই! তবে তার কারণ ছিল ভিন্ন। আসলে যে সময় স্যুসটর তাঁর বাল্যবন্ধু সিগেলের সাথে সুপারম্যান চরিত্রটি তৈরি করেন, সে সময় তাঁদের আর্থিক সঙ্কট চরমে। সদ্য ইউরোপ থেকে আমেরিকায় অভিবাসী হয়ে এসেছেন দুজনেই; ভেবেছিলেন সুপারম্যান চরিত্রটি বই হিসাবে প্রকাশ পেলে খানিক আর্থিক সুরাহা হবে। কিন্তু প্রকাশক পাওয়া যখন নিতান্ত অসাধ্য হয়ে উঠল, আবেগপ্রবণ স্যুসটর আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না; গোটা বইটিকেই দিলেন জ্বালিয়ে।

অবশ্য শুধু স্যুসটর নন, নিজের হাতে নিজের সৃষ্টিকে জ্বালিয়ে দিয়েছেন বহু লেখক। কখনও নিজের প্রাণ বাঁচাতে, কখনও আবেগের বশে আবার কখনও বা ব্যক্তিগত কারণে। যেমন ১৫৮৮ খ্রিস্টাব্দে, ক্যাথলিক ধর্মযাজক উইলিয়াম অ্যালেন, মহারানি এলিজাবেথ (১)-কে তীব্র আক্রমণ শানিয়ে একটি বই লিখলেন— An Admonition to the Nobility and People of England and Ireland। সমসাময়িক যুদ্ধ, জনসাধারণের ওপর নিপীড়ন ইত্যাদির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে গর্জে তোলার উদ্দেশ্যেই এই বই। তখন স্প্যানিশ সেনা ইংল্যান্ড আক্রমণ করছে। অ্যালেন ভেবেছিলেন, শুধু জয়টুকুই অপেক্ষা। তারপর ইংল্যান্ডের পতন ঘটলেই বইটি প্রকাশ করবেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটল উল্টো। স্প্যানিশ সেনা পরাজিত হলে উইলিয়াম অ্যালেন নিজহাতে তাঁর প্রতিবাদী বইটি পুড়িয়ে দিলেন।

পরবর্তীকালে স্বনামধন্য লেখক চার্লস ডিকেন্স তো একদা রীতিমত বনফায়ার করে নিজের সমস্ত ব্যক্তিগত চিঠি, হাতে লেখা খসরা জ্বালিয়ে দেন। এমনকি বিভিন্ন সময়ে তিনি বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতদের যে চিঠি লিখেছিলেন, সেগুলিকেও ফেরত নিয়ে পুড়িয়ে দেন। শোনা যায়, অভিনেত্রী এলেন টারনানের সঙ্গে প্রণয়সম্পর্কের প্রমাণ বিলোপ করতেই লেখকের এই উদ্যোগ।

স্রষ্টার হাতেই সৃষ্টি ধ্বংসের আরও অনেক উদাহরণ আছে। কিন্তু সেগুলি স্বল্প-আয়োজনের ও মূলত ব্যক্তিগত স্তরেই সীমাবদ্ধ থাকায়, মানব-ইতিহাসের অধ্যায় বিলুপ্ত করতে পারেনি। যেমনটা পেরেছিল, আজ থেকে মাত্র চল্লিশ বছর আগে, শ্রীলঙ্কার জাফনা পাবলিক লাইব্রেরির ধ্বংস। ১৯৩৩ সালে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় স্থাপিত ক্ষুদ্র এই গ্রন্থাগারটি ধীরে ধীরে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগারের আকার নিয়েছিল। দেশবিদেশের নানা দুষ্প্রাপ্য বই, প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, হাজার বছরের পুরানো তালপাতায় লেখা ইতিহাস গ্রন্থাগারটিকে শ্রীলঙ্কার জনসাধারণের গর্ব ও দেশবিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণকেন্দ্র করে তুলেছিল। কিন্তু ৩১শে মে, ১৯৮১ সালে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধে এ-হেন প্রতিস্থানটিকেও পুড়িয়ে দেওয়া হল। দুদিন ব্যাপী সেই আগুনে পুড়ে গেল সাতানব্বই হাজার বই। প্রশাসন, পুলিশ, জনসাধারণ, কেউ নেভাতে এল না!

আসলে মানবসভ্যতার ইতিহাস যত প্রাচীন, প্রায় ততটাই প্রাচীন মানুষের বইধ্বংসের ইতিহাস। তাই একটিমাত্র নিবন্ধে সর্বাঙ্গীণ আলোকপাত সম্ভব নয়। ইতিহাস বিলোপের ইচ্ছা, রাজনৈতিক টানাপোড়েন, ধর্মবিশ্বাস, মগজধোলাই, আকস্মিক উন্মাদনা— কারণ যাই হোক না কেন, বইবিনাশের ইতিহাস বইপ্রেমী মানুষের কাছে সতত বেদনাদায়ক। সে বেদনার ক্ষতে নিত্য প্রলেপ লাগায়, নাৎসি-জার্মান ছাত্রদেরকে লেখা হেলেন কেলারের চিঠির সেই বিখ্যাত উক্তি— “তোমরা আমার বই পোড়াতে পারো। ইউরোপের সকল লেখকের সব বই জ্বালিয়ে দিতে পারো। কিন্তু সে-বইয়ের ভাবনা পুড়িয়ে ফেলবে, এমন সাধ্যি তোমাদের নেই। সে-ভাবনা অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মত দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে, পড়বে।”

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...