স্বাধীনতা ৭৫: কোথায় শিক্ষা?

শুভোদয় দাশগুপ্ত

 



ইংরাজি ভাষা সাহিত্যের অধ্যাপক, ওয়েবকুটা-র রাজ্য সভাপতি

 

 

স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বর্ষপূর্তিতে শিক্ষাব্যবস্থার বিবর্তনের চর্চা করতে গেলে বর্তমান অবস্থাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। করোনা অতিমারিতে দেড় বছরের বেশি স্তব্ধ দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক থেকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি। শুধু এদেশে নয়, সারা পৃথিবী জুড়ে। সারা বিশ্বে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর যে আঘাত নেমে এল সেই ক্ষত মেরামত করতে কত বছর সময় লাগবে, আদৌ তা আগের অবস্থায় ফিরে আসবে কিনা, সেসব আমরা জানি না কেউ। আর সেই ‘ক্ষতি’ ভারতবর্ষের মতো গ্লোবাল ইনডেক্সে অনেক অনেক পিছিয়ে থাকা দেশে কী চেহারা নিতে পারে তা বলাই বাহুল্য। এখানে শুধু শিক্ষার কথা আলোচিত হচ্ছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে একেকটা দেশ বা রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়। ভূমিকম্প বা সুপার সাইক্লোন খুব অল্পসময়ের মধ্যে ধ্বংসলীলা চালিয়ে অন্তর্হিত হয়। সম্প্রতি আমরা আমাদের রাজ্যে আম্ফান বা ইয়াস-এর তাণ্ডব দেখেছি। যখন ধ্বংসলীলা চলে আমরা অনুমান করতে পারি না ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। এই পরিমাপ সম্ভব হয় ধ্বংসলীলা থামলে। কোভিড অতিমারি দেড় বছর পেরিয়ে আজও থেমে যায়নি। আমরা আজও বিশ্বব্যাপী ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ করতে পারছি না। এই ক্ষতি সর্বস্তরে। শুধু শিক্ষা নয়— সভ্যতার বিকাশ, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, বেকারত্ব, দারিদ্র, স্বাস্থ্য, আরও কতকিছু।

আমাদের দেশের কথাতেই ফিরে আসি। কোভিড এল, লকডাউন হল দফায় দফায়। আনলক হল দফায় দফায়। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, শপিং মল, পানশালা, জিম কখনও খুলল, কখনও বন্ধ হল। প্রায় অবিচ্ছেদ্যভাবে বন্ধ রইল শুধু শিক্ষাঙ্গন। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা— সর্বস্তরে কঠোর সর্তকতা। এমন আতঙ্কের বাতাবরণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে তৈরি করা হল— যেন শিক্ষাঙ্গন বন্ধ থাকলেই সুরক্ষিত থাকবে ছাত্রছাত্রীরা। তাদের পরিবারের যারা রুটি-রুজির জন্য, বাড়ির বাজার-হাট করবার জন্য, ব্যাঙ্ক-পোস্ট অফিস-ওষুধের দোকান যাওয়ার মতো অপরিহার্য কাজ করে প্রতিদিন বাড়ি ফিরে মধ্যবিত্ত পরিসরে ফিজিক্যাল ডিসটেন্স রক্ষা না করে মাসের-পর-মাস বউ-বাচ্চা বাবা-মায়ের সঙ্গে একত্রে থাকল, তারা যেন সুপার স্প্রেডার নয়! ফলে দফায় দফায় দোকান, বাজার, শপিং মল, স্পা, পানশালা, রেস্তোরার অর্থনীতি চাঙ্গা করার সুযোগ মিলল— কিন্তু ধারাবাহিকভাবে তলিয়ে গেল শিক্ষাব্যবস্থা। ভারতবর্ষের মতো দেশে এই নীতি খুবই গুরুতর। স্বাধীনতার পর থেকে নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে দিয়ে কায়ক্লেশে অস্তিত্ব বজায় রাখা শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে এই পরিস্থিতি সত্যিই ভাবনার বিষয়। অতিমারি কালে শিক্ষা নিয়েই সবচেয়ে বেশি ছেলেখেলা হল। কোথাও কোনও পর্বে কোনও বিধি রচনা করে শিক্ষাব্যবস্থাকে সচল করা যায় কিনা তা নিয়ে ছাত্র, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, অভিভাবক এই সব অংশের প্রতিনিধি অথবা সংগঠনগুলি— কারও কোনও অভিমত নেওয়া হল না। অজুহাত দেওয়া হল— ছাত্ররা সমাজের সবচেয়ে স্পর্শকাতর অংশ। আনলকের বিভিন্ন পর্বে প্রায় সব অংশকেই ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয়েছে। গণ-পরিবহন ব্যবহারে কমবেশি জরুরি পরিষেবা বলে ছাড় পেয়েছে অনেক ক্ষেত্রই। আনলক পর্বগুলিতে নিয়ন্ত্রিত গণ-পরিবহন (মেট্রো, লোকাল ট্রেন)-এ উঠতে তাদের বিশেষ অনুমতি মিলত— কিন্তু শিক্ষাজগতের লোকেরা নৈব নৈব চ। অনলাইন ক্লাস, পরীক্ষা, মূল্যায়নের জন্য প্রায়শই শিক্ষকদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে হয়েছে। অফলাইনে জমা পড়া খাতা সংগ্রহ করতে, পরীক্ষার মূল্যায়ন করতে, মার্কস আপলোড করতে তাঁদের সেমেস্টারের একটা পর্বে নিয়মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে হয়েছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত গণ-পরিবহনে চড়ার ক্ষেত্রে শিক্ষক বা শিক্ষাকর্মীদের ছাড় দেওয়ার কোনও ঘোষণা কোনও সরকার করেনি। মিড ডে মিল বণ্টনের জন্যও বিদ্যালয়শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের নিয়মিত স্কুলে যেতে হয়েছে।

মহামারি আইন আমাদের অনেক কিছু শেখাল। শিক্ষা যে মহামারি আইনে সবচেয়ে উপেক্ষিত সেক্টর তা আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাম। প্রবচন আছে শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। কথিত আছে ছাত্ররাই দেশের মেরুদণ্ড, দেশের ভবিষ্যৎ। কিন্তু আমাদের দেশে এসব কথার গভীরতা কত স্থূল কত অন্তঃসারশূন্য তা আমরা বুঝলাম অতিমারিকালে। প্রচারমাধ্যমে দিনের-পর-দিন কিছু প্যানেলিস্ট— তাদের মধ্যে রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, মনোবিদ— সবাই ঠাঁই পেলেন, অতিমারি নিয়ে চর্চা করলেন। কিন্তু শিক্ষাঙ্গনের সঙ্কট নিয়ে, ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ, মানসিক স্বাস্থ্য, অবসাদ, আত্মহত্যা, বিদ্যালয়/কলেজছুট হওয়া নিয়ে ধারাবাহিক কোনও উদ্বেগ ও পদক্ষেপের হদিশ পাওয়া যায়নি। শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষাঙ্গন, ছাত্র, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের সঙ্কট যেন প্রশাসনের কাছে টেকেন ফর গ্রান্টেড। প্রচারমাধ্যমে হোমরা-চোমরা মন্ত্রী, আমলা ও চিকিৎসকেরা বেশিটাই করোনা নিয়ে, সোশ্যাল ডিসটেন্সিং নিয়ে ত্রাসের বাতাবরণ জারি রেখেছেন। কিন্তু আনলক পর্বে তাঁদের কোনও সাবধানবাণী সেই অর্থে সংক্রমণ রোধ করার সহায়ক হয়নি। রুটি-রুজির তাগিদে, বেঁচে থাকার তাগিদে, মানসিক অবসাদ থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদে মানুষ ছাড় পাওয়া সময়কালে সব বিধি ভেঙেছে। সেই সঙ্গে দফায় দফায় মেট্রো, লোকাল ট্রেন বন্ধ করে সড়ক পরিবহনে সমস্ত চাপ কেন্দ্রীভূত করে সরকার কোভিড-বিধি পালনে কোন বিবেচনার সাক্ষ্য রেখেছে সময় তা বলবে। সেই সঙ্গে নাইট কারফিউ! তার সার্থকতা হয়তো আছে— কিন্তু রাত নটার পর কিছু হাতেগোনা উচ্ছন্নে যাওয়া ফুর্তিবাজ অবিবেচক মানুষ আর কতটা সংক্রমণ ছড়াতে পারে জানা নেই। অথচ ওই নৈশকালে যাঁরা সত্যিই বিপন্ন— দূরের কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়ি ফিরতে, রেলস্টেশন এয়ারপোর্ট থেকে সুদূর বাসস্থানে ফিরতে, অথবা বাড়িতে অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসা এবং ওষুধের জোগান দিতে— তাঁরা আরও বিপন্ন হয়েছেন রাতের পর রাত। কিছু অসাধু অটো অথবা ট্যাক্সিচালক এবং কিছু নজরদারির কাজে নিযুক্ত উর্দিধারী প্রশাসক দু-হাতে পয়সা রোজগার করে গেছে। এতসব আয়োজনে সংক্রমণ কিন্তু থেমে থাকেনি। বাড়িতে ছাত্রছাত্রীরা নানাবিধ সংক্রমণে উন্মুক্ত হয়েছে মাসের-পর-মাস। শুধু বন্ধ থেকে গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি।

এই নীতির একটা তদন্ত প্রয়োজন। করোনাভাইরাস, তার সংক্রমণ, তার বিপজ্জনক পরিণতি, বিশ্ব জুড়ে তার দাপট— এর কোনওটাই মিথ্যা নয়। কিন্তু এই অতিমারিতে শিক্ষাব্যবস্থাকে এত তুচ্ছ করা হল কেন? শিক্ষার্থীদের এভাবে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী করে রাখা হল কেন? এসব প্রশ্নের জবাব নেবে আজকের প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীরা— যাদের ভবিষ্যৎ অতল অন্ধকারে তলিয়ে গেল। জবাব নেবে এই প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় এ দেশের এবং রাজ্যের সরকারগুলি কী ভূমিকা পালন করেছিল। আমাদের দুর্ভাগা দেশে এক বড় অংশের ছাত্রছাত্রী অত্যন্ত দরিদ্র প্রান্তিক পরিবার থেকে আসা— প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী— তাদেরও একটা বড় অংশ ড্রপ-আউট হয়ে গেল অতিমারিকালে, আর কোনও দিন তারা ফিরে আসতে পারবে না শিক্ষার মূল স্রোতে, ফেরা সম্ভব নয়, কারণ তাদের বাড়িতে উপার্জনরত অভিভাবকের কাজ চলে গেছে লকডাউনে। সমাজবিজ্ঞানীরা দেড় বছরে কোনও দিশা কি দেখাতে পেরেছেন তাদের? এইসব শিক্ষাঙ্গন থেকে ছিটকে যাওয়া ছাত্রছাত্রীরা— যাদের স্মার্টফোন নেই, ডেটা নেই, অনলাইন ক্লাস-অনলাইন পরীক্ষায় সামিল হওয়ার সামর্থ্য নেই—তারা জানতে চাইবে গত দেড় বছরে কোভিডে আক্রান্ত কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, আর ফ্লু-ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়াতেই কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। জানতে চাইনে অন্যান্য মহামারি, অন্যান্য সংক্রমণে কবে কখন কোথায় দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির তালা খোলা হয়নি? এত কথার অবতারণা এই কারণে নয় যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি অনেক আগেই খুলে দেওয়া উচিত ছিল। প্রশ্ন এটাই— প্যানডেমিক পরিস্থিতিতে সমাজে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের অবস্থান কোথায়? প্ররথিবীর কিছু অনন্য কালজয়ী মহাকাব্যে অতিমারি একটি আবহ। সেইসব মহাকাব্যের কোথাও এমনটাও দেখা গেছে যে প্রতীকিভাবে অতিমারি বিদায় নিতে সম্মত হয়েছে নিপীড়ক শাসক সিংহাসন ছেড়ে দেবে এই প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর। শিক্ষাব্যবস্থার এই চরম বিপর্যয়ে, ছাত্রছাত্রী-শিক্ষকদের এই চরম অবহেলার প্রেক্ষিতে তুলনাটি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল রূপক হিসেবে।

এই দীর্ঘস্থায়ী অতিমারি আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে কোন অতল অন্ধকারে নিক্ষেপ করতে চলেছে তা আমাদের ধারণার বাইরে। বিশ্বব্যাপী শিক্ষাব্যবস্থাও অবশ্য এক চরম সঙ্কটে নিমজ্জিত— কিন্তু আমাদের মতো দেশে যেখানে শিক্ষা জাতির জন্মলগ্ন থেকেই বঞ্চিত, সেখানে এই অতিমারি এক ঘোর সর্বনাশ ডেকে আনল। বর্তমান সঙ্কটের বাতাবরণ থেকে ফিরে দেখে আমরা যদি স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে কত পঁচাত্তর বছরে শিক্ষাব্যবস্থার শোচনীয় অতীতের দিকে তাকাই তো বর্তমান অবস্থাটা সম্যক উপলব্ধি করতে পারব। স্বাধীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার উন্মেষে দীর্ঘ সময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব থাকা অস্বাভাবিক বিষয় নয়। ব্রিটিশ শাসনকালেই ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থার নতুন রূপরেখা রচনায় ১৮৩৫-এ প্রকাশিত মেকলের সুপারিশ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। তারও আগে ১৮১৩ সালে উইলিয়াম অ্যাডাম ইংল্যান্ড থেকে এদেশে এসেছিলেন ভারতবর্ষের তদানীন্তন শিক্ষাব্যবস্থা, যা চালু হয়েছিল ক্রিশ্চিয়ান মিশনারিদের হাতে, তার মূল্যায়ন করতে। ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থা এরও আগে প্রভাবিত ছিল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্বারা। মন্দির ও মসজিদের সন্নিহিত পঠন-পাঠন কেন্দ্রে পড়াশোনার চর্চা কেন্দ্রীভূত ছিল। একটা পার্থক্যের জায়গা ছিল এই যে ছাপা বই শিক্ষালাভের মাধ্যম হিসেবে পাশ্চাত্যে ষোড়শ শতকে প্রচলিত হলেও ভারতবর্ষে সেই প্রচলন ঘটে ১৮২০ বা তারও পরে। প্রাচীন ভারতে ধর্ম, গণিতশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র বিষয়ে পাঠদানের প্রচলন ছিল তক্ষশীলা ও নালন্দার মতো বিশ্বশ্রুত মহাবিদ্যালয়ে।

প্রাচীন ভারতে আর্য সভ্যতায় শিক্ষাব্যবস্থায় এক উল্লেখযোগ্য নবজাগরণ ঘটেছিল। নারীশিক্ষার প্রসারেও এক অগ্রণী ভূমিকা ছিল আর্য সভ্যতার। মধ্যযুগে এদেশের ইসলামীয় শিক্ষা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। কিন্তু প্রাচীন ভারতে শিক্ষাব্যবস্থার এই বহুবিধ ধারার সন্নিবেশের মধ্যেই জ্ঞানচর্চার এক উৎকর্ষের ঐতিহ্য নির্মিত হয়েছিল। সংস্কৃত ভাষার কৃষ্টির সর্বজনীন গ্রাহ্যতা এই উৎকর্ষের সূচক হতে পারে। প্রশ্ন হল প্রাচীন ভারতের আর্থসামাজিক পরিকাঠামো কি তবে ভবিষ্যতের ভারতীয় সমাজব্যবস্থার চেয়ে অনেক উন্নয়ন-সহায়ক ছিল শিক্ষার প্রশ্নে? কোন বিবর্তনের প্রেক্ষিতে শিক্ষার উৎকর্ষের সঙ্কট সূচিত হল তবে?

ভারতবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষা তথা উচ্চশিক্ষার যথার্থ প্রসার ঘটল উনিশ শতকে ব্রিটিশ শাসনে। ভারতবর্ষে ইউরোপীয়দের আগমনের সঙ্গে এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের পটভূমি রচিত হয়েছিল। ঔপনিবেশিক শাসনে ভারতে জেসুইটদের অবদান এদেশে ইউরোপীয় ধাঁচে কলেজশিক্ষার প্রবর্তন। ১৫৪২ সালে গোয়াতে সেন্ট পলস কলেজের পত্তন একটি মাইলস্টোন। উনিশ শতকে ইংরেজ শাসনে শিক্ষাব্যবস্থায় আরও সংস্কার সাধিত হয়। এযাবত দেশে আরবিক এবং সংস্কৃত স্কুল যথাক্রমে ইসলামিক ও হিন্দু পবিত্র গ্রন্থের পাঠদান করত আর পার্সি বিদ্যালয়গুলি পার্সি সাহিত্যের পাঠদান করত। স্বদেশীয় বিদ্যালয়গুলিতে প্রচলন ছিল মূলত স্থানীয় ভাষা ও গণিত শিক্ষার।

এই বৈচিত্রময় পরিবেশের মধ্যে দিয়ে এদেশে ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার ঘটতে শুরু করে ১৮২০ সালের পর। মিশনারি স্কুলগুলিরও প্রসার ঘটতে থাকে এই সময়কালেই।

বেন্থাম ও মিল-এর ইউটিলিটেরিয়ান ভাবধারায় মেকলের সুপারিশ অনুযায়ী ‘কার্যকরী শিক্ষা’ বা ‘ইউজফুল লার্নিং’-এর রূপরেখা রচিত হয়। পার্সির পরিবর্তে ইংরাজি ভাষা শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে মান্যতা পেতে শুরু করে।

শিক্ষাবিষয়ক মেকলের সুপারিশের সূত্র ধরেই ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থায় এক নতুন অধ্যায় রচিত হয়েছিল। যার ফলশ্রুতি ১৮৩৫ সালের ইংলিশ এডুকেশন অ্যাক্ট এবং পরবর্তীকালে ১৮৫৪ সালে উড-এর ডেসপ্যাচ-এ শিক্ষাবিষয়ক সংস্কারের রূপরেখা রচনা। এই উড’স ডেসপ্যাচের সুপারিশগুলিরও সীমাবদ্ধতার মূল্যায়ন করে উইলিয়াম হান্টারের ইন্ডিয়ান এডুকেশন কমিশন রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ১৮৮৩ সালে।

আপাত দৃষ্টিতে স্বাধীন ভারতের সংবিধান শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনও তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন সূচিত করেনি এই অর্থে যে, ঔপনিবেশিক শাসনের মতোই স্বাধীন ভারতেও শিক্ষা কেন্দ্রীয় তথা রাজ্য সরকারগুলির অন্যতম প্রধান দায়িত্ব বলে বিবেচিত হল। উচ্চশিক্ষার প্রসারে শিক্ষাসংক্রান্ত সুযোগ প্রদানে সংযোগ স্থাপন, উচ্চশিক্ষার মান রক্ষণাবেক্ষণের সমূহ দায়িত্ব পালন, বিজ্ঞান শিক্ষা, প্রযুক্তি শিক্ষা, গবেষণাও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হল। স্বাধীন দেশে ভারত সরকার প্ল্যানিং কমিশনের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করল শিক্ষা সহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেকটরের উন্নয়নের একটা রূপরেখা রচনার। এই সুপারিশের ভিত্তিতেই উদ্ভব পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার।

শিক্ষাক্ষেত্রে এই সূত্র ধরেই ১৯৪৮ সালে ইউনিভার্সিটি এডুকেশন কমিটি গঠিত হয় সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের নেতৃত্বে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষার তদানীন্তন অবস্থায় প্রয়োজনীয় প্রসারণ এবং উন্নয়নের দিকগুলি খতিয়ে দেখতে।

অনুরূপে ১৯৫২-৫৩ সালে মুদালিয়র কমিটি মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থার তদানীন্তন পরিস্থিতি ও সম্ভাব্য সংস্কারের পন্থাপ্রকরণ রচনার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়।

আমরা জানি মুদালিয়র কমিটির পর কোঠারি কমিটি গঠিত হয় ১৯৬৪-৬৬ কার্যকালে। কোঠারি কমিটিতে এসে দায়িত্বের পরিসর প্রসারিত হল সামগ্রিক ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাতে।

শিক্ষা কমিশনগুলি গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল— নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার প্রচলন, বিজ্ঞান, ন্যায়শাস্ত্র সহ বৃত্তিগত শিক্ষার প্রসার, এবং প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা সর্বস্তরে শিক্ষার আধুনিকীকরণ তথা মানোন্নয়ন।

স্বাধীনতার পর এই শিক্ষা কমিশনগুলির রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই জাতীয় শিক্ষার এক নীতি প্রণয়ন করে ভারত সরকার ১৯৬৮ সালে। কুড়ি বছর পরে এই ন্যাশনাল পলিসি ফর এডুকেশন-এর পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ রচিত হয়। এই নতুন সংস্করণে সারাদেশ ব্যাপী অভিন্ন একটি পাঠক্রমের সুপারিশ করা হয় সমগ্র দেশে একটি ছন্দোবদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে। সেই সঙ্গে ১৯৮৬ সালের নতুন পলিসিতে গুরুত্ব আরোপ করা হয় জাতীয় সংহতি, ন্যায়শাস্ত্র এবং এডুকেশনাল টেকনোলজি প্রসারের ওপর। কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের অংশ হিসেবেই স্বাধীন ভারতে দ্য ন্যাশনাল ডিপার্টমেন্ট অফ এডুকেশন-এর উদ্ভব ঘটেছিল। এই কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের মুখ্য উপদেষ্টা থাকবেন একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। শিক্ষাজগতে একটা কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা বোর্ড রাজ্য সরকারগুলিকে এবং সেইসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারকে শিক্ষা বিষয়ক সুপারিশ ও পরামর্শ দান করবে।

এই ডিপার্টমেন্ট অফ এডুকেশনের সঙ্গে যুক্ত হল অনেকগুলি রাষ্ট্রায়ত্ত এজেন্সি। ১৯৪৫ সালে গঠিত হল অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল অফ টেকনিক্যাল এডুকেশন গ্রান্টস কমিশন (এআইসিটিই); ১৯৫৩ সালে গঠিত হল ইউজিসি (ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন); আর দি ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং গঠিত হল ১৯৬১ সালে।

১৯৪৫ সালে এআইসিটিই গঠিত হয় হায়ার এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের একটি পরামর্শদাতা সংস্থা হিসেবে। ১৯৮৭ সালে সংসদে বিল পাশ করে এআইসিটিই-কে একটি বিধিসম্মত মান্যতা দেওয়া হয়। দেশে কারিগরি, প্রযুক্তি শিক্ষা, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ, ফার্মাসিউটিক্যাল এডুকেশন, আর্কিটেকচার এবং ইনফরমেশন টেকনোলজি সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিকল্পনা ও রূপায়ণের দায়িত্ব দেওয়া হয় এই সংস্থাকে।

অন্যদিকে ১৯৫৩ সালে গঠিত ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন দেশে বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষার প্রসার, পঠন-পাঠনের মান ধরে রাখা, পরীক্ষাব্যবস্থা ও মূল্যায়নের নজরদারি তথা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পরিকাঠামো তৈরি করা— এইসব বিবিধ বিষয়ে সমন্বয় সাধনে মুখ্য ভূমিকা নেয়। ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অর্থব্যয়ের পদ্ধতি ও অর্থ জোগানের ক্ষেত্রেও প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে।

বিদ্যালয়শিক্ষার রূপরেখা রচনায় অগ্রণী ভূমিকা প্রাপ্ত হয় ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি) যা কিনা ১৯৬১ সালে স্থাপিত হয় ভারত সরকারের অধীনে একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে। শুরুতে এই সংস্থার অন্যতম লক্ষ্য ছিল দেশব্যাপী বিদ্যালয়শিক্ষাকে একটি সাধারণ প্যাটার্নের আওতায় আনা। একটি জাতীয় চরিত্র থাকতে হবে, কিন্তু আবার এই বিপুল দেশের বিবিধ ভাষা, সংস্কৃতি, পোশাক ও ধর্মাচরণের বৈচিত্রের প্রতি তা যেন সুবিচার করতে পারে। এনসিইআরটি তার প্রথম সুপারিশ বিবৃত করে ১৯৬৮ সালে। এই সুপারিশের মূল ভিত্তি অবশ্য ১৯৬৪-৬৬ সালে গঠিত এডুকেশন কমিশনের সুপারিশ।

স্বাধীন ভারতে এভাবেই শিক্ষায় পরিকল্পনাগুলি প্রণয়নের পর ধীরে ধীরে সেগুলির প্রসার ঘটাবার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে কোঠারি কমিশনের সুপারিশগুলি ১৯৬৮ সালে ন্যাশনাল পলিসি অন এডুকেশনে বিবৃত করা হয় প্রায়োগিক উদ্যোগ গ্রহণের জন্য। এই পলিসিতে প্রধান অভিমুখগুলি ছিল— সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার দায়ভার গ্রহণ, ত্রিভাষা ফর্মুলা, আঞ্চলিক ভাষায় উচ্চশিক্ষার স্বীকৃতি, বয়স্ক শিক্ষা, কৃষি ও শিল্প সংক্রান্ত শিক্ষার প্রসার। সর্বোপরি, এই প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল শিক্ষায় একটি নতুন এবং আধুনিক আঙ্গিকের প্রবর্তন।

এই প্রেক্ষাপটেই ১৯৮৬ সালে সরকার জাতীয় শিক্ষানীতির ঘোষণা করে। দেশের পরিবর্তনশীল আর্থসামাজিক চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলাই ছিল এই শিক্ষানীতির অন্যতম লক্ষ্য। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি সমধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয় কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর।

এই সময়কালে টেকনিক্যাল এডুকেশনের ওপর প্রাধান্য দেওয়া দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের পক্ষে অতি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ছিল। দেশজুড়ে আইআইটি, আইআইএম-এর এগ্রিকালচার এডুকেশন সহ পর্যাপ্ত সংখ্যক মেডিক্যাল কলেজ খোলা হয়। বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও নারীশিক্ষারও বিকাশ ঘটে।

এত ইতিবাচক একটা বাতাবরণের নিরিখে আমরা যদি অতীতের দিকে ফিরে তাকাই তাহলে ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থায় নীতি প্রণয়নের প্রশ্নে গভীর ভাবনা ও সদিচ্ছার অভাব না থাকা সত্ত্বেও সার্বিক দুর্দশার কারণটা অনুধাবন করতে পারব সহজেই। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা পর্বে সামগ্রিক বরাদ্দের নিরিখে শিক্ষার জন্য বরাদ্দের গতিপ্রকৃতি থেকেই তা স্পষ্ট হবে। প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এই বরাদ্দ শতকরা হিসেবে ছিল যথাক্রমে মোট বরাদ্দের ৭.৯, ৫.৮ এবং ৬.৯ শতাংশ। নবম পরিকল্পনায় তা দাঁড়ায় ৩.৫ শতাংশে।

সংবিধানে ছয় থেকে চোদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও কার্যত সেই অধিকার উপেক্ষিত থেকেছে। রাইট অফ চিলড্রেন টু ফ্রি অ্যান্ড কম্পালসারি এডুকেশন অ্যাক্ট ২০০৯-এ কার্যকর হলেও পাবলিক ও প্রাইভেট স্কুলের অনুপাত দাঁড়ায় ৭:৫। ১৯৭৬ সালে সংবিধানের সংশোধনী মোতাবেক শিক্ষা কেন্দ্র-রাজ্যের যৌথ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। ব্যয়বরাদ্দ এবং প্রশাসনিক কাঠামোয় শিক্ষার আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব এই সময় থেকে ভাগ হয়ে যায় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে।

২০১৮ সাল থেকে শিক্ষাব্যবস্থায় এক নতুন পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যায়। ভারত সরকার ঘোষণা করে ৬২ বছরের পুরনো ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশনের পরিবর্তে গঠিত হবে হায়ার এডুকেশন কমিশন অফ ইন্ডিয়া বা এইচইএসআই। এই পদক্ষেপ সারা দেশে ইউজিসির নিয়ন্ত্রণে থাকা ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৪০০০০ কলেজের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তোলে। এর আগেই তদানীন্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি সংসদে ২০১৬-১৭ সালের ইউনিয়ন বাজেট পেশ করেন। বাজেট-বক্তৃতায় তিনি উচ্চশিক্ষা বিষয়ক দুটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সিদ্ধান্তের কথা জানান। একটি হল দেশের প্রথম সারির ১০টি সরকারি ১০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বমানের শিক্ষা এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘এনেবলিং রেগুলেটরি আর্কিটেকচার’ প্রদান করা; আর দ্বিতীয়টি হল একটি হায়ার এডুকেশন ফান্ডিং এজেন্সি গঠনের প্রস্তাব। এই এইচইএফএ প্রাথমিকভাবে ১০০০ কোটি টাকার একটি সরকারি মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করে খোলা বাজার থেকে অনুদান গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নিরত থাকবে। শুধু তাই নয়, কর্পোরেট সোশাল রেসপনসিবিলিটি এই তহবিলে দান করতে পারবে যা কিনা উচ্চশিক্ষার পরিকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় করা হবে।

অতীতেও অনেক সরকার পাবলিক-ফান্ডেড এডুকেশনে পরিকাঠামো উন্নয়নের সদিচ্ছা না দেখিয়ে শিক্ষার বেসরকারিকরণের রাস্তা উন্মুক্ত করেছে। এনডিএ সরকারের অব্যবহিত আগে ইউপিএ সরকারের আমলেও শিক্ষা নিয়ে এই পাপ করা হয়েছে। তবে ২০১৪ সালের পর বর্তমান সরকার শিক্ষার বেসরকারিকরণের যাবতীয় পথ নির্লজ্জভাবে সুগম করেছে। এইচইএফএ, এইচইসিআই গঠনের পদক্ষেপ তারই সাক্ষ্য বহন করে। এইচইএফএ বস্তুত এদেশে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের প্রবেশদ্বার হয়ে উঠল। কর্পোরেট ফিলানথ্রপি যে শিক্ষার বিপুল লাভজনক বাজারে হিংস্র নেকড়ে হয়ে উঠবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউজিসি গ্রেডেড অটোনমি রেগুলেশনস-এর বিজ্ঞপ্তি জারি করে। মার্চ মাসেই ২১টি স্টেট ইউনিভার্সিটি, ২৪টি ডিমড ইউনিভার্সিটি, ৫টি সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি সহ দুটি প্রাইভেত ইউনিভার্সিটিকে উচ্চতর অটোনমি প্রদান করা হয়। দেখা যায়, উচ্চতর অটোনমি=প্রাপ্ত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে এই অধিকার দেওয়া হল যে তারা ইচ্ছেমতো বেসরকারি অনুদান গ্রহণ এবং ব্যয় করতে পারবে। এমনকি ছাত্রছাত্রীদের ফি বৃদ্ধির অবাধ অধিকারও তাদের থাকবে। উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর বেসরকারি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের হস্তক্ষেপের ওপর নিষেধাজ্ঞাগুলি এভাবেই শিথিল করা শুরু হল।

এদেশে স্বাধীনতার পর থেকে একদিকে যেমন বিভিন্ন গঠনমূলক চিন্তাভাবনার চর্চা হয়েছে, অনেক পরিকল্পনার রূপরেখা রচনা হয়েছে, অন্যদিকে তেমন মানবসম্পদ সৃষ্টিতে উপযুক্ত উদ্যোগের অভাব, উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরিতে ন্যূনতম রাষ্ট্রীয় অনুদানের অপ্রতুলতা আজ পঁচাত্তরতম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের মুহূর্তেও এক শোচনীয় অবস্থায় থেকে গেছে। সর্বজনীন শিক্ষার প্রসারে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নিঃসন্দেহে অনেক অনেক ছাত্রছাত্রীকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার আঙিনায় নিয়ে এসেছে, কিন্তু পাবলিক ফান্ডের এডুকেশনের ব্যর্থতাই আবার অগণিত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠতে সুযোগ করে দিয়েছে। শিক্ষা মহার্ঘ্য হয়ে উঠেছে এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে— অন্যদিকে আবার এত সময়, শ্রম ও অর্থব্যয়ের পর শিক্ষিত চাকুরিপ্রার্থীদের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়নি।

অনুরূপে প্রাথমিক শিক্ষাতেও খাতায়-কলমে গ্রস এনরোলমেন্ট রেশিও উত্তরোত্তর সন্তোষজনক চেহারা নিয়েছে, কিন্তু কোটি কোটি দারিদ্র্যসীমার নিচ থেকে আসা অপুষ্টিতে ভোগা ছাত্রছাত্রীকে বিদ্যালয়ছুট হওয়া থেকে নিবৃত্ত করতে মিড ডে মিলের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। সেই সঙ্গে আবার মিড ডে মিলে যথেচ্ছ দুর্নীতি এইসব ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাঙ্গন থেকে ছিটকে দিয়েছে অনবরত।

গ্রেডেড অটোনমির প্রশ্নে ফিরে গিয়ে আর একটা বিষয়ে আলোকপাত করে দেখা যাবে যে, এদেশে বিগত কয়েক দশক ধরে শাসকদল কীভাবে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের ক্ষেত্র প্রস্তুতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে। গ্রেডেড অটোনমিতে প্রদত্ত স্বাধিকার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ এড়িয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির খবরদারি তথা নিয়ন্ত্রণের ছাড়পত্র প্রদান করেছে।

এইভাবে বিগত কয়েক দশকে এদেশে শিক্ষাব্যবস্থায় এক দুর্বিষহ পরিবেশ তৈরি হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাধিকার খর্ব হয়েছে। বাণিজ্যিকীকরণের পথ সুগম করা হয়েছে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে ছাত্রছাত্রীদের ভাষা, ধর্ম, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, পোশাক-আশাক, খাদ্যাভ্যাস এবং স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারের ওপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি কার্যকর করা হয়েছে। প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীরা শহীদ হয়েছে, কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছে।

এই আবহেই ২০১৯ সালের সূচনাতেই বিশ্বজুড়ে অতিমারির তাণ্ডব শুরু হল। সারা পৃথিবীর মতো এ দেশেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি স্তব্ধ হয়ে গেল অনির্দিষ্টকালের জন্য। আমাদের দেশে আজও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ হয়ে আছে। কোভিড-১৯ ভাইরাস গোটা পৃথিবীটাকেই ছিন্নভিন্ন করে দিল। প্রশাসন থেকে শুরু করে, বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞানী, দার্শনিক, সমাজসেবী সবাই দিশেহারা। তার মধ্যেই ভাইরাস ছড়াল, অনেক মানুষ প্রাণ হারালেন। কোভিডের ঢেউ এল গেল। কোনওটা মৃদু, কোনওটা তীব্র। কিন্তু কোনও দিশা মিলল না। শিক্ষার্থীরা লকডাউনে, নিয়ন্ত্রণে অবরুদ্ধ হল যার যার পরিবারের পরিসরে। কারও বাড়ি স্বচ্ছল, বাবা-মার রোজগার অটুট। আবার কোনও ছাত্র-ছাত্রীর রোজগেরে অভিভাবক কোভিডে প্রয়াত হলেন বা বেঁচে থেকেও চাকরি খোয়ালেন। সরকার নিদান দিয়ে গেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যাবে না। দুর্বিষহ এক পরিস্থিতি!

দুনিয়াজুড়ে অনলাইন শিক্ষার বাড়বাড়ন্ত হল। অনেকে সীমিত ক্ষমতাতেও মূলস্রোতে টিঁকে থাকতে সামিল হল অনলাইন ক্লাসে, অনলাইন পরীক্ষায়। অনেকে হারিয়ে গেল চিরতরে উচ্চশিক্ষার আঙিনা থেকে।

ভারতবর্ষের মতো দরিদ্র অভাগা দেশে পরিস্থিতি শোচনীয় হল উত্তরোত্তর। কিন্তু শিক্ষায় বেসরকারিকরণের সুচারু প্রয়াসে সংসদে কোনও আলোচনার পরিসর না দিয়েই এই বিশ্বব্যাপী অতিমারির সঙ্কটের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ এদেশে শিক্ষায় বেসরকারি ক্ষেত্রের অংশগ্রহণের সুযোগ অনেকটাই বাড়িয়ে তুলল। ২০১৬ সাল থেকে শিক্ষা বিষয়ক যে পদক্ষেপগুলির কথা এতক্ষণ আলোচিত হচ্ছিল, সেই গ্রেডেড অটোনমি, এইচইএফএ এবং এইচইসিআই সবই ছিল এই নতুন শিক্ষানীতির ভূমিকা। শিক্ষাকে একটি লাভজনক ক্ষেত্রে পরিণত করা এবং কর্পোরেট ক্ষেত্রকে এই লাভজনক ক্ষেত্র থেকে মুনাফা অর্জনের সুযোগ করে দেওয়াই জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-র মূল অভিমুখ। গত এক বছর ধরে শিক্ষাবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা এই শিক্ষানীতিকে হিন্দুত্ব অ্যাজেন্ডা এবং বিশ্বব্যাঙ্ক মডেলের শিক্ষাব্যবস্থার একটি বিপজ্জনক সংমিশ্রণ হিসেবে অভিহিত করেছেন। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার সর্বস্তরে এই নীতি কর্পোরেট সহায়ক এবং বাণিজ্যিকীকরণের অভিসন্ধি-দুষ্ট। শিক্ষাবিদরা এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে এই শিক্ষানীতিতে স্কুলশিক্ষায় আর্থসামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে একই কমন স্কুল সিস্টেম গঠন করার কোনও পরিসর রাখেনি যা শিশুদের মধ্যে বৈষম্য দূর করবে। পাশাপাশি রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্ট ২০০৯-কে সংশোধন করে ৩ থেকে ৬ এবং ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সি ছাত্র-ছাত্রীদের দায়িত্ব গ্রহণের কোনও প্রতিশ্রুতি নয়া শিক্ষানীতি দিচ্ছে না। শিক্ষার পণ্যায়ন এবং শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের ওপর কোনও নিষেধাজ্ঞা নয়া শিক্ষানীতি জারি করেনি। কন্ট্রাক্টচুয়াল এবং অ্যাড-হক শিক্ষকদের অসম্মানজনক চাকরির শর্ত দূর করে আরও বেশি সংখ্যায় পূর্ণ-শিক্ষক নিয়োগের কোনও দিশাও এই শিক্ষানীতিতে নেই। সর্বোপরি স্কুলশিক্ষায় বিশ্বব্যাঙ্কের এবং উচ্চশিক্ষায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কর্তৃত্ব থেকে বেরিয়ে আসার কোনও রূপরেখা স্বাধীনতার পঁচাত্তর বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে ঘোষিত এই জাতীয় শিক্ষানীতিতে নেই।

অতিমারিকালে ঘোষিত এই নয়া শিক্ষানীতিতে অনলাইন শিক্ষার প্রসারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রতিফলিত হয়। আমাদের মতো দেশে অনলাইন শিক্ষার পরিণতি কী হতে পারে তা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম গত দেড় বছরে। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষায় অগণিত ছাত্র-ছাত্রীর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকেই আর কোনওদিন মূল স্রোতে ফিরে আসতে পারবে না। গত বছর পয়লা মে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর অনলাইন শিক্ষা বিষয়ক ঘোষণার অব্যবহিত পর গুগলের সিইও মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাপক বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অতিমারি শেষেও কেন্দ্রীয় সরকার অনলাইন ব্যবস্থা জারি রাখবে এই মর্মে সম্প্রতি একটি মিটিংয়ে ইউজিসি স্থায়ীভাবে ৬০-৪০ পার্সেন্ট ব্লেন্ডেড মোড অফ লার্নিং চালু করবার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি মাল্টিডিসিপ্লিনারি পঠন-পাঠন চালু করার লক্ষ্যে নয়া শিক্ষানীতিতে প্রস্তাবিত অ্যাকাডেমিক ব্যাঙ্ক অফ ক্রেডিট পদ্ধতি কার্যকর করার ছাড়পত্রও সম্প্রতি দেওয়া হয়েছে। এসবই শিক্ষাব্যবস্থায় এক ঘোর সঙ্কট তৈরি করবে বলে অভিজ্ঞ মহলের দৃঢ় বিশ্বাস।

এই দুই কঠিন পরিস্থিতির মুখে স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বর্ষে দেশ আজ দাঁড়িয়ে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-তে একদিকে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের ঢালাও ছাড়পত্র অন্যদিকে ভারতীয় সংবিধানের বহুত্ববাদের ঐতিহ্যকে পদদলিত করার ঘৃণ্য প্রয়াস— শিক্ষার ভবিষ্যৎ সত্যিই ভয়াবহ। নয়া শিক্ষানীতিতে ওপর-ওপর ছাত্র-ছাত্রীদের এক গভীর দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ করার ভাবনা এবং দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তা জাতপাত ধর্ম ও সংস্কৃতির কদর্য বিভাজনে উদ্যত। এই সঙ্কীর্ণতা অনিবার্যভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে পাঠক্রম রচনা থেকে শুরু করে পঠন-পাঠন মূল্যায়ন ও গবেষণা— সর্বত্র। শিক্ষানীতির প্রারম্ভে ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্যের গৌরবগাথাকে মহিমান্বিত করা হলেও বহুত্ববাদের কৃষ্টির অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উত্থাপন করা হয়নি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। ভ্যালু এডুকেশন-এর ঐতিহ্যের কথা বলতে নিয়ে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে সমগ্র মধ্যযুগকে, যে সময়ে ইসলামি ধারার সঙ্গে হিন্দু ঐতিহ্য মিশে সিনক্রেটিক সুফিজমের বিকাশ ঘটে।

এই শিক্ষানীতিতে উপেক্ষিত থেকেছে এদেশে দলিত ও বহুজনদের শত শতাব্দীর বঞ্চনা ও নিপীড়নের ইতিহাস। সেই সঙ্গে এই শিক্ষানীতি এদেশে জাতপাতের বৈষম্যের প্রসঙ্গ তথা জাতপাতবিরোধী গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনগুলিরও কোনও উল্লেখ করেনি।

আজ স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তির সন্ধিক্ষণে কোভিড অতিমারির আবহে সমগ্র জাতিই বিপন্ন। শিক্ষার পরিস্থিতি ছাত্র-ছাত্রীদের বিপন্নতা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের নিরিখে একটু বেশিই গুরুতর। দেশজুড়ে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষাঙ্গন আজ বন্ধ দেড় বছর হয়ে গেল। এরই মধ্যে কার্যকর হওয়া নয়া শিক্ষানীতির গর্হিত এবং নেতিবাচক অসংখ্য নীতি ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরওই বিপন্ন করবে। শিক্ষিত সমাজ তথা সমাজকর্মী, গবেষক, সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিদদের একযোগে দায়িত্ব নিতে হবে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার এই সঙ্কট মোকাবিলার। কোভিড অতিমারি আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। এই অতিমারিকে এখনও বিজ্ঞানীরা হয়তো সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। কিন্তু এই ভাইরাস ধীরে ধীরে রাজনৈতিক এবং কর্পোরেট দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে। আলফা-বিটা-ডেল্টা-গামা কোথায় কখন তা বাড়বে অথবা কমবে হয়তো ভবিষ্যতে তা নির্ধারণ করবে শাসকশ্রেণি তথা কর্পোরেট দুনিয়া। আর তার ফলে লকডাউন হবে, কলকারখানা বন্ধ হবে, শ্রমিকদের চাকরি যাবে। এই নিউ নর্মাল দুনিয়াতেই এগোতে হবে ছাত্রছাত্রী-শিক্ষকদের তথা সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকেই। আর শিক্ষার তো কথাই নেই— এ তো আর কোনও জরুরি পরিষেবা নয়— শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে প্রয়োজনে বন্ধ রেখে দেওয়া হবে বছরের পর বছর।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...