একজন শিক্ষকের দৃষ্টিতে মাধ্যমিকের সিলেবাস বিয়োজন এবং তার ফলাফল

শিল্পী সেন

 




শিক্ষক, সমাজকর্মী

 

 

 

বিশ্বে কোভিড ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয় ২০১৯-এর শেষ দিকে। আমাদের দেশে ২০২০-র প্রথম থেকে এর সূত্রপাত। এই দীর্ঘ সময়ে করোনা-আক্রান্ত হয়ে প্রাণ ঝরে গেছে অগণন মানুষের। আমাদের দেশে বহু অভিবাসী শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে। কাজ হারিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। দেশের অর্থনীতির অবস্থা খুব খারাপ জায়গায় পৌঁছে গেছে। তবে সবচেয়ে বেশি যা এই সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে— তা হল শিক্ষাক্ষেত্র— মানুষ গড়ার ক্ষেত্র।

২০২০-২১ জুড়ে আমাদের রাজ্যে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা ছাত্রছাত্রীদের জন্য বন্ধ রয়েছে। ২০২১-এ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা কোন সময়ে হবে তা ঘোষণা করার পরও পরীক্ষাগুলি বাতিল করা হয়েছে। যদিও আগেই ছাত্রছাত্রী-অভিভাবকদের মধ্যে পরীক্ষা হওয়ার সম্ভাবনাকে জাগিয়ে রেখে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ্যসূচি অনেকটা কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ বছরও একই ধারা মেনে ২০২২-এর মাধ্যমিকের পাঠ্যসূচি থেকে বিভিন্ন বিষয়ের বেশ কিছু অধ্যায় বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে— যা নিয়ে শিক্ষামহল সহ সমাজের সর্বস্তরে ঝড় উঠেছে। আমার আলোচনা এই বিষয়টিকে ঘিরেই আবর্তিত।

কোনও একটি স্তরের পাঠ্যসূচি অন্য স্তরের পাঠ্যসূচি থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও বিষয় নয়। একটি শ্রেণির বিষয়ভিত্তিক পাঠ্যসূচির সঙ্গে অন্য শ্রেণির পাঠ্যসূচির নিবিড় যোগ থাকে। প্রথমে নিচু শ্রেণিতে বিষয়ের ভিত্তি গড়ে তুলে পরবর্তী শ্রেণিগুলিতে উত্তরোত্তর বিষয়ের গভীরে অর্থাৎ সহজ থেকে কঠিন যাওয়া হয়। সুতরাং পাঠ্যসূচি থেকে বিভিন্ন অংশ বাদ দিলে সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা পায় না। কোনও স্তরের কোনও বিষয়ের সিলেবাস যদি অবিন্যস্তভাবে হ্রাস করা হয়, তাহলে ছাত্রছাত্রীরা সেই বিষয়ে উচ্চতর পড়াশোনার ক্ষেত্রে ব্যাপক সমস্যার সম্মুখীন হতে বাধ্য।

এ বছর মাধ্যমিকে গণিতের সিলেবাস থেকে বাদ গেছে ত্রিকোণমিতি, রাশিবিজ্ঞান এবং পিথাগোরাসের উপপাদ্য। যারা উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান নিয়ে পড়বে— তাদের ত্রিকোণমিতির এই প্রয়োজনীয় প্রাথমিক জ্ঞান ছাড়াই উচ্চমাধ্যমিকে গণিতের পড়াশোনা শুরু করতে হবে। শুধু তাই নয়। উচ্চমাধ্যমিকের পদার্থবিদ্যা বিষয়েও বহু ক্ষেত্রে ত্রিকোণমিতির সূত্রগুলির প্রয়োগ করা হয়। তাই ত্রিকোণমিতি বাদ যাওয়া উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনার ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করবে।

ভৌতবিজ্ঞান বিষয়ে বাদের তালিকাতে রয়েছে তাপের ঘটনাসমূহ, পরমাণুর নিউক্লিয়াস, অজৈব রসায়নের অংশবিশেষ, ধাতুবিদ্যা এবং জৈব রসায়ন। মাধ্যমিকে পরমাণুর নিউক্লিয়াস সম্পর্কে ধারণা উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পদার্থবিদ্যায় পরমাণুর কেন্দ্রক বিষয়ে পাঠের সোপান। সেই সিঁড়ির ধাপ বাদ দিয়েই উচ্চতর পাঠের ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের পদক্ষেপ করতে হবে। তার সঙ্গে আইনস্টাইনের যুগান্তকারী সমীকরণ E = mc2-কে কাজে লাগিয়ে নিউক্লীয় বিক্রিয়াগুলির মাধ্যমে হিরোশিমা-নাগাসাকির মতো বিজ্ঞানের ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী অপপ্রয়োগ এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ তৈরির মানবকল্যাণকর প্রয়োগ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান থেকেও তারা বঞ্চিত হবে। জৈব রসায়নের বিয়োজন উচ্চমাধ্যমিকে রসায়ন পাঠে একইরকম সমস্যার জন্ম দেবে।

শিক্ষা হল মানবশিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধন। পাঠ্যসূচি সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের হাতিয়ার। পরিবেশের ভয়াবহ দূষণ, বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়া, অসংখ্য প্রজাতির বিলোপ, জীবনের জন্য অপরিহার্য প্রাকৃতিক সম্পদগুলিকে অপব্যবহারের মাধ্যমে শেষ করে ফেলা— মানবজাতির অস্তিত্বকে আজ সঙ্কটজনক করে তুলেছে। ছাত্র-ছাত্রীদের পরিবেশ সচেতনতাই পারে মানুষের বাসযোগ্য পরিবেশের এই ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তুলতে— তাদের মধ্যে থেকেই উঠে আসে কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গের মতো পরিবেশবিপ্লবী। অথচ ছাত্র-ছাত্রীদের পরিবেশ বাঁচানোর পাঠ দেওয়ার বদলে জীবনবিজ্ঞানের সিলেবাস থেকে বাদ গেছে পরিবেশ, তার সম্পদ এবং তাদের সংরক্ষণ নামের অতি প্রাসঙ্গিক অধ্যায়টি। জীবনবিজ্ঞান থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে অভিব্যক্তি ও অভিযোজন-এর মতো অধ্যায়, যা পৃথিবীর বুকে প্রাণের বিকাশ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে তুলতে এবং কুসংস্কারমুক্ত বিজ্ঞানমনস্ক চেতনা তৈরিতে অপরিহার্য।

ইতিহাসের সিলেবাস থেকে বিয়োজিত হয়েছে বিশ শতকের কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন, বিশ শতকের নারী, ছাত্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আন্দোলন, উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারত (১৯৪৭-১৯৬৪)— এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলি। একজন ছাত্রের পক্ষে দেশের ইতিহাস সম্পর্কে বোধ অবশ্যপ্রয়োজনীয়। দেশের শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র আন্দোলন এবং গণ আন্দোলন সম্পর্কে জানা সেই ইতিহাসচেতনার অপরিহার্য উপাদান। স্বাধীন দেশের দায়িত্বশীল নাগরিক হয়ে ওঠার জন্য যেমন স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে জানা প্রয়োজন, তেমনই নারী এবং সমাজের দুর্বলতর শ্রেণিগুলির সংগ্রাম সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ পরিচয় পারে একজন শিক্ষার্থীকে একপেশে মানুষের পরিবর্তে একজন পূর্ণ মানুষ রূপে গড়ে তুলতে। সিলেবাস বিয়োজনের মাধ্যমে মানবসম্পদের সেই বিকাশের পথটি অবহেলিত থেকে গেছে।

সব মিলিয়ে মাধ্যমিকের সিলেবাসের এই বিয়োজন প্রক্রিয়াটি অপরিকল্পিত এবং অবৈজ্ঞানিক বলে ধারণা হতে বাধ্য।

সরকারি বোর্ডের বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিতে সিলেবাসের এই লঘুকরণ অন্য বোর্ডের স্কুলগুলিতে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করতে অভিভাবকদের উৎসাহিত করবে— সন্তানের উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুবিধার জন্য। এর পরিণতিতে শিক্ষাব্যবস্থার বেসরকারিকরণের পথ প্রশস্ত হবে।

এই দেড় বছর ধরে স্কুলগুলি ছাত্রছাত্রীদের জন্য বন্ধ রাখা, মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা না নেওয়া, পরীক্ষা ছাড়াই সকলকে পাশ করিয়ে দেওয়ার যে সরকারি নীতি— সেই দৃষ্টিভঙ্গিই সিলেবাসের এই ব্যাপক হ্রাসের মধ্যে প্রতিফলিত। অথচ এই পথটিই অনিবার্যভাবে গ্রহণীয় পথ ছিল না। স্কুল-কলেজ বাদে জনসমাগমের সমস্ত ক্ষেত্রই যখন উন্মুক্ত, স্কুলগুলিও মিড ডে মিল ও নানা সরকারি প্রকল্পের ব্যবস্থাপনার জন্য বহুদিনই খোলা থাকছে, বহু রাজ্যে স্কুলগুলিতে পঠন-পাঠন চালু হয়ে গেছে— তখন কোভিড বিধি মেনে সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন শ্রেণির পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা করা, প্রয়োজনে মাধ্যমিক পরীক্ষা পিছিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ সিলেবাসটিই ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো যেত।

শিক্ষাবিদ, শিক্ষক সংগঠন, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পিত নীতির পরিবর্তে এই সহজ, জনমোহিনী নীতি রূপায়ণে মানবসম্পদের যে অবশ্যম্ভাবী নিদারুণ অপচয়— সেই অপরিমেয় ক্ষতি কি কোনওদিন পূরণ করা যাবে?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4861 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. খুবই যুক্তিপূর্ণ কথার অবতারণা করেছেন। বিষয় বর্জনে আরও আলোচনার দরকার ছিল।

  2. অত্যন্ত জরুরি বিষয়। ইস্কুল খোলা , পুনরায় লেখাপড়া শুরু করা দরকার।যথেষ্ট সময় নষ্ট হয়ে গেছে।
    হীরক সেনগুপ্ত

আপনার মতামত...