আমাদের অভিভাবক অধ্যাপক সুজয় বসু

প্রদীপ দত্ত

 


পরমাণু শক্তি বিরোধী সমাজকর্মী ও পরিবেশবিদ

 

 

 

বেলার দিকে ক্লাস নিয়ে ওয়ার্কশপে ফিরেই হাঁক দিতেন ‘চা কই’। সুজয়দা, অর্থাৎ সুজয় বসুর (২ অক্টোবর ১৯৩৮ — ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০) জন্য জল খাওয়ার বড় গ্লাসে লাল চা আসত, সঙ্গে সবার জন্য। বিকেলের দিকে কখনও বলতেন ‘খিদে পেয়েছে, মুড়ি খাওয়াবে না?’ ঠোঙায় করে মুড়ি-বাদাম আসত। তা থেকে ‘মুড়ি খাও’ বলে অন্যদের সাধতেন। শেষ বিকেলে বাড়ি যাওয়ার আগে তাঁর বিভাগের মেন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ জনসংযোগ করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতজনেরা পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, তিনি ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে নানাজনকে নানা সম্বোধন করে বাক্য বিনিময় করছেন, কাউকে দু হাত তুলে নমস্কার করছেন। পড়ন্ত বিকেলে দু-তিন মিনিটের হাঁটা পথ পেরিয়ে যাবেন ইব্রাহিমপুর রোডের ভাড়াবাড়িতে। সেখানে তাঁর বসার ঘর ভর্তি বই। আলোচনার সময় কথার সমর্থনে এ-বই সে-বই টেনে এনে দেখাতেন। পরে অবশ্য সেই বাড়ি ছেড়ে দেশপ্রিয় পার্কের কাছে মনোহরপুকুর রোডের ফ্ল্যাট বাড়িতে উঠেছিলেন।

ছিলেন দীর্ঘদেহী, সুদর্শন ও মিষ্টভাষী ও সুরসিক। বক্তৃতা বা আলোচনার সময় প্রাসঙ্গিক নাম-সাল-তারিখ নিপুণভাবে উল্লেখ করতেন। অবাক হয়ে ভাবতাম এত পুঙ্খানুপুঙ্খ বলেন কী করে! পরে একসঙ্গে কলকাতার বাইরে গিয়ে দেখেছি বক্তৃতার আগে কখনও কখনও হোমওয়ার্ক করতেন। বলার সময় ঠোঁটের কোণে লেগে থাকত অননুকরণীয় আলতো হাসি।

তাঁর লেখায় ও কথায় বাংলা ভাষার প্রয়োগ ছিল শিক্ষণীয়। স্থূল ভূলে বিরক্ত হয়ে কাউকে সম্বোধন করতেন ‘আরে মর্কট’, ক্যান্সারকে লিখতেন ‘কর্কট’। বড়দের উল্লেখ করতেন ‘অগ্রজ’ বলে, ছোটদের ‘অনুজ’। চাকরি জীবনের শেষ পাঁচ বছর হয়েছিলেন স্কুল অফ এনার্জি স্টাডিজের প্রথম ডিরেক্টর, সেই বিভাগের জন্ম হয়েছিল তাঁর হাত ধরে। যাদবপুর সেই প্রথম ইন্টারডিসিপ্লিনারি বিভাগের সূত্রপাত।

কোনও ছাত্রের পরীক্ষার ফল ততটা ভালো হয়নি, কিন্তু তার পরিবার খুবই দুঃস্থ, চাকরি না হলেই নয়। সুজয়দা চললেন কোনও কোম্পানির দপ্তরে, তার চাকরির বন্দোবস্ত করতে। কোনও ছাত্র বড় বেশি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে কিন্তু পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। তাকে নিজের প্রজেক্টে টেনে নিয়ে মাসোহারার ব্যবস্থা করেছেন। তারপরও রাজনীতি করতে গিয়ে তার কাজে উপস্থিতি অনিয়মিত। বকাঝকা করে তাকে দায়িত্বশীল করে তুলছেন। তাঁর মতো মানুষের জন্যই ‘ছাত্রদরদি’, ‘ছাত্রবৎসল’ কথাগুলো চালু হয়েছে। আমাদের শেখাতেন, দুর্বাঘাসের মত বিনয়ী হও। কখনও তোমাকে লোকে পায়ে দলে যাবে, তুমি থাকবে শান্ত এবং দৃঢ়।

ছিলেন আদ্যোপান্ত পরমাণু অস্ত্রবিরোধী। ১৯৭৪ সালে, ইন্দিরা গান্ধির আমলে ভারতের প্রথম পরীক্ষামূলক পরমাণু বিস্ফোরণের পর তাঁর বিভাগের নোটিস বোর্ডে সাদা কাগজে বিস্ফোরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কথা লিখে টাঙিয়ে দিয়েছিলেন। সেই প্রতিবাদের জন্য কর্মস্থলে প্রোমোশন বছর দুয়েক পিছিয়ে গিয়েছিল। তাঁর সক্রিয় প্রচেষ্টাতেই কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করেও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় সামরিক বিভাগের কোনও গবেষণা প্রকল্প এক সময় চালু করা যায়নি। তদানীন্তন ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ডিআরডিও) তরফে এ পি জে আব্দুল কালাম (ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) তাঁর দপ্তরে এসেও তাঁকে এ বিষয়ে সম্মত করাতে পারেননি।

১৯৮৬ সালে হেলেন ও বিল ক্যালডিকট এদেশে এসেছিলেন। তাঁরা আমেরিকার শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ এবং বিশিষ্ট অ্যান্টি-নিউক্লিয়ার অ্যাক্টিভিস্ট। তখন সবে হেলেনের ‘নিউক্লিয়ার ম্যাডনেস’ বইটা প্রকাশিত হয়েছে। যাদবপুরের ইন্দুমতী সভাঘরে তাদের নিয়ে সভা হল। সঞ্চালক সুজয় বসু। কথা তো নয়, কথার যাদুকর। তাঁর বয়স তখন পঞ্চাশ পেরোয়নি। ছ ফুট লম্বা, সুন্দর স্বাস্থ্য, পরনে সাদা ধুতিপাঞ্জাবি। সেই প্রথম তাঁকে দেখলাম, মুগ্ধ হলাম। তখন পরমাণু শক্তির বিরোধিতা করার লোক পাওয়া যেত না, তা খায় না মাথায় দেয় তাই লোকে জানত না। সভাঘরে উপস্থিত অধিকাংশই ছিলেন তাঁর বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী। হেলেন ও বিল ক্যালডিকটকে এদেশে এনেছিলেন ডাক্তার মনন গাঙ্গুলী। তিনিই সুজয়দাকে খুঁজে বার করেছিলেন।

কী একটা কারণে কয়েকজন প্রিয় ছাত্র এবং আমায় ও অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়কে (‘উৎস মানুষ’ পত্রিকার প্রয়াত সম্পাদক) ইব্রাহিমপুর রোডের বাড়িতে ডেকে খাওয়ালেন। সন্ধ্যায় আমি আর অশোকদা গেছি, বাকিরা আগে এসে ফিরে গেছেন। বৌদি কোনও কারণে তাঁর প্রতি সামান্য উষ্মা প্রকাশ করেছেন। সুজয়দা বললেন, তোমার কাছে আশ্রিতের মতো থাকি…। ওই বাক্য ও বাচনভঙ্গিতে বৌদি সহ আমরা সবাই হেসে উঠলাম। হোমফ্রন্ট ম্যানেজমেন্টে এমন সুন্দর কথা ও ভঙ্গি আগে ও পরে কখনও দেখিনি। বৌদিও নিজের পেশায় ছিলেন সম্মানীয়। ব্যাক্তিগত আলাপচারিতায় সুজয়দা স্ত্রীকে সব সময় উল্লেখ করতেন ‘মিসেস বসু’ বলে।

অপ্রীতিকর কথাবার্তা বা কাণ্ড ঘটলে চুপ করে যেতেন। একবার কোথা থেকে যেন একসঙ্গে ফিরছি। আমাদের মধ্যে কেউ জোর দিয়ে বলল, বিদ্যুতের একক ‘গিগাওয়াট’ কথাটা আসলে হবে ‘জিগাওয়াট’। এতদিন তিনি এবং আমরা যে শব্দটা ব্যাবহার করে আসছি তা নাকি ঠিক নয়! ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রবীণ মাস্টারমশাই একেবারে চুপ। আমি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে, তবুও তিনি চুপ। পরে ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম, ‘গিগাওয়াট’ কথাটাই চালু, অবশ্য দু-একটা দেশে ‘জিগাওয়াট’ বলারও চল রয়েছে।

আশির দশক থেকেই তিনি ছিলেন আমাদের বলভরসা ও গর্ব। নানা ছোট-বড় সভা, ওয়ার্কশপের মধ্যমণি। ওই দশকের প্রথম ভাগ থেকেই আমরা পরমাণু শক্তির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজ করছি, সুজয়দার যোগদান আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছিল। তাঁর মুখের কথা গোগ্রাসে গিলতাম। সেই সময় আমাদের পড়াশোনা বলতে ব্রিটেনের আ্যন্টি-নিউক্লিয়ার বইপত্রই সম্বল। মাঝেমধ্যে নামী আন্তর্জাতিক পত্রিকা থেকে প্রাসঙ্গিক ভালো লেখা ফটোকপি করে সুজয়দা আমাদের বিলি করতেন। ২০০০ সালের পরেও কয়েক বছর ঘরে ঘরে মোবাইল বা ইন্টারনেট সার্ভিস চালু ছিল না। কাজেই তাঁর কাছে বিলির জন্য মজুত থাকত ওয়ার্ল্ড উইন্ড এনার্জি অ্যাসোসিয়েশনের বায়ুবিদ্যুতের অগ্রগতির বার্ষিক রিপোর্টের কয়েক পৃষ্ঠা অথবা অন্য কোনও জার্নালের লেখা, পত্রিকার খবরের ফটোকপি। জনে জনে তা আমাদের হাতে দিয়ে বলতেন, বায়ুবিদ্যুতের এত দ্রুত অগ্রগতি হচ্ছে, কোল লবি এখন আর তাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না (নবায়নযোগ্য শক্তির বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রথম বছর দশেক বায়ুবিদ্যুৎই  দ্রুত বেড়ে উঠছিল)।

আশির দশকের শেষে ডাক্তার মনন গাঙ্গুলী ও তাঁর স্ত্রী জ্যানেট অ্যাটকিনের ব্যবস্থাপনায় সুজয়দা ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজে বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন। ছিলেন তাঁদের সঙ্গে। সেখান থেকে গাড়িতে ১৫ মিনিট গেলে এক অ্যানিম্যাল সেন্টারে (অসুস্থ জীব-জন্তুর আশ্রয়স্থল) ছিল একটা বড় বায়ুবিদ্যুৎ যন্ত্র। সেটা দেখার জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। তখনও এদেশে বায়ুবিদ্যুতের প্রসার শুরুই হয়নি।

পরে তাঁর উদ্যোগেই নব্বইয়ের দশকের প্রথম ভাগে সুন্দরবনের কৈখালিতে বায়ুবিদ্যুৎ যন্ত্র বসেছিল। অর্থ দিয়েছিল কেন্দ্রের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ। সে-ই ছিল ভারতে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের আদি উদ্যোগ। হয়তো কেম্ব্রিজের বায়ুবিদ্যুৎ যন্ত্র দেখেই তাঁর কৈখালিতে ওই যন্ত্র বসানোর ঝোঁক চেপে ছিল। তবে সে যাত্রায় কাজের কাজ হয়নি। কারণ তখনও দেশের উইন্ড ম্যাপিং করা হয়নি। তাই কৈখালির দৈনন্দিন বাতাসপ্রবাহের গতিপ্রকৃতির সঠিক হিসাব জানা ছিল না। অনেক পরে জানা গেছে পশ্চিমবঙ্গে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের উপযুক্ত অঞ্চল প্রায় নেই।

১৯৮৭ সালে নাট্যকার বাদল সরকারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে। তিনি পরমাণু শক্তির বিরোধিতার যুক্তি মন দিয়ে শুনেছেন। আমাদের সঙ্গে থাকবেন বলেছেন। সুজয়দা তাতে খুবই উৎসাহিত হলেন। ১৯৮৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের বেকার হলের বাইরের চাতালে তিন দিন ধরে থার্ড থিয়েটার ও বিজ্ঞানকর্মীদের যৌথ উদ্যোগে মৃত্যুবিরোধী নাট্য উৎসব হল, প্রতিদিন নির্দিষ্ট বিষয়ে এক একজন বলবেন, তারপরে হবে প্রাসঙ্গিক নাটক। প্রথম দিন বললেন সুজয়দা, মাঝের দিন শুভেন্দু দাশগুপ্ত, শেষ দিন মৃণাল সেন। শেষ দিন নাটকের শেষে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ও অনুষ্ঠান করেছিলেন। ওই উৎসবে লোকজনের ভিড় দেখে বাদলদা এবং সুজয়দা দুজনেই খুব উৎসাহিত বোধ করেছিলেন। বাদলদা গেটের বাইরে সিঁড়ির সামনে বসে নাটকের বইপত্র বিক্রি করতেন আর শেষবেলায় বিক্রির হিসাব মেলাতে মাথার চুল ছিঁড়তেন।

১৯৮৮ সালে দিন পনেরো চালচুলোহীনের মতো দিল্লি, মুম্বাই ও বেঙ্গালুরু ঘুরে ঘুরে অ্যান্টিনিউক্লিয়ার অ্যাক্টিভিস্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, থেকেছি পরিচিত-অপরিচিতজনের বাড়িতে। একমাত্র দিল্লি যাওয়ার ট্রেন ছাড়া আর কোনও রিজার্ভেশন ছিল না, এখন ভাবলে গায়ে জ্বর আসে। দিল্লিতে অধ্যাপক ধীরেন্দ্র শর্মা বললেন, কর্নাটকের কাইগায় পরমাণু চুল্লি স্থাপন নিয়ে রাজ্য সরকার দুদিনের বিতর্কসভার আয়োজন করেছে ব্যাঙ্গালোর আইআইএসসি-তে। সেখানে নাকি আমার যাওয়া দরকার। অথচ সেখানে কেবল আমন্ত্রিত ব্যাক্তিরাই যেতে পারবেন। তখন রবিবারের অমৃতবাজার পত্রিকায় দুটো কভার স্টোরি লিখেছিলাম, সেই ভরসায় তারা আমায় সাংবাদিক পরিচয়ের চিঠি দিয়েছিল, তাই সেখানে যেতে অসুবিধা হয়নি।

পরের বছর আমরা গোখেল রোডে দ্য ইনস্টিটিউশন অফ ইঞ্জিনিয়ার্স-এর আর এন মুখার্জি হল-এ পরমাণু বিদ্যুৎ বিষয়ে সারা দিনের জাতীয় কনভেনশন আয়োজন করতে চলেছি, যার মুখ্য অংশ হবে বিতর্কসভা। কমিটি তৈরি করতে হবে। সুজয়দার পরামর্শে দু-লাইনের আবেদনপত্র তৈরি হল। তার মর্ম ছিল: নিউক্লিয়ার পাওয়ার ও তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্কসভার আয়োজন করা হলে আমি সভার আয়োজক কমিটির উপদেষ্টা হতে রাজি আছি। আবেদনে স্বাক্ষর করলেন বাদল সরকার এবং সুজয়দা। তার ভিত্তিতে কলকাতার প্রায় সমস্ত বড় বড় মানুষের স্বাক্ষর পেতে অসুবিধা হল না। বহু স্বনামধন্য বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, অর্থনীতিবিদ, শিল্পী-সাহিত্যিক, চিত্রপরিচালক তাতে স্বাক্ষর করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে যেমন বিজ্ঞানী বি ডি নাগচৌধুরী, সুশীল মুখার্জী, বিনায়ক দত্ত রায় ছিলেন, তেমনি অমিয় কুমার বাগচি, শঙ্কর সেন, সুচিত্রা মিত্র, ভূপেন হাজারিকা, শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গাঙ্গুলী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, চিন্তামণি কর, গণেশ হালুই, গণেশ পাইন, শানু লাহিড়ী, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (সরোদিয়া), মৃণাল সেনও ছিলেন। বাদলদাকে ওইসব গুণী ব্যক্তিদের অনেকেই যে কী অসম্ভব শ্রদ্ধা করেন তাও স্বাক্ষর নিতে গিয়ে বুঝেছিলাম। যখন কনভেনশন আয়োজনের জন্য ‘সিটিজেন্স’ অর্গানাইজিং কমিটি’র লেটারহেড তৈরি হল, বাঁদিকে লম্বা কলমে রইল কমিটির ৩১ জন উপদেষ্টার নাম। কমিটির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন হেলথ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ও ড্রাগ অ্যাকশন ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত ডাক্তার সুজিত দাস। নানা জায়গায় ওই লেটারহেডে যখন চিঠি যেত সবাই খুব গুরুত্ব দিতেন। সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছিল ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জি (ডিএই)। তাই বিতর্কসভা খুব সফল হয়েছিল।

আগের বছর বেঙ্গালুরুর আইআইএসসি-তে কাইগা পরমাণু কেন্দ্র স্থাপন নিয়ে দু দিন ধরে যে বিতর্কসভার আয়োজন করেছিল কর্নাটক সরকার সেখানে ডিএই-র পক্ষ থেকে কয়েক ডজন বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ এসেছিলেন। সংখ্যায় তারা বিরোধীদের চেয়ে অনেক বেশি ছিলেন। বিতর্কের আয়োজন করছি, তাই পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন যারা চান তাদেরও ডাকা চাই। কিন্তু পক্ষের বক্তাই বেশি হয়ে গেলে মুশকিল, আমাদের বিরোধী বক্তা চারজনের বেশি নয়। তাই ভয়ে ভয়ে সভার সাত-আট দিন আগে ডিএই-কে বিতর্কে অংশগ্রহণের জন্য সাধারণ পোস্টে চিঠি পাঠানো হল। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য কোনও ফোন নম্বর ছিল না। কারণ আমার বাড়িতে তখন ল্যান্ডফোন ছিল না। ডিএই ওই সভায় অংশগ্রহণের জন্য উঠে পড়ে লাগল। তাদের পক্ষ থেকে কলকাতা, চেন্নাই ও মুম্বাইয়ের তিনজন বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ এসেছিলেন। অ্যাটমিক এনার্জি বোর্ডের চেয়ারম্যান এ কে দে তখন কলকাতায় ছুটি কাটাচ্ছিলেন। ডিএই থেকে তাঁকে বলা হল, ওই কনভেনশনে উপস্থিত থাকতেই হবে, তিনি এলেন। কলপক্কম থেকে এক পরমাণু বিজ্ঞানী টেলিগ্রাম করে জানালেন, এয়ারপোর্টে এসে শত চেষ্টা করেও টিকিট পেলেন না বলে সভায় অংশ নেওয়া হল না।

সারা ভারতের অনেক বিশিষ্ট বিজ্ঞানীকেই আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। বেশিরভাগই আগে থেকে ঠিক হয়ে থাকা নানা কর্মসূচিতে ব্যস্ততার জন্য আসতে পারবেন না বলে জানিয়েছিলেন। যেমন টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চএর (টিআইএফআর-এর) জয়ন্তবিষ্ণু নার্লিকার, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সেস-এর (আইআইএসসি) অমূল্য এন রেড্ডি। বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং পরমাণু শক্তিবিরোধী অ্যাক্টিভিস্ট প্রয়াত প্রফুল বিদোয়াইয়ের গাড়ি দুর্ঘটনায় পা ভেঙে গিয়েছিল, অল ইন্ডিয়া ইওনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস-এ (এআইআইএমএস) তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। কিন্তু তিনি আসতে পারেননি। এখানে বলা প্র্যয়োজন তার উদ্যোগেই ১৯৮৬ সালে মুম্বাইয়ে প্রথম পরমাণু শক্তি নিয়ে নাগরিক কনভেনশন আয়োজিত হয়েছিল।

বড় মাপের কনভেনশন করতে চলেছি অথচ আমাদের টাকা-পয়সা নেই। পরমাণু শক্তির বিপক্ষে বলবার জন্য অধ্যাপক ধীরেন্দ্র শর্মা এবং সুরেন্দ্র গাদেকার এসেছিলেন। গাদেকারকে যাতায়াতের জন্য দ্বিতীয় শ্রেণির ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। ধীরেন্দ্র শর্মা ছিলেন জহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটির সায়েন্স পলিসি সেন্টারের চেয়ারম্যান এবং সেই সময় ভারতে পরমাণু শক্তির বিরোধিতায় প্রধান মুখ। তিনি প্লেনে চড়ে আসবেন। সুজয়দা বুদ্ধি করে তাঁকে আগের দিন যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে অন্য এক বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ডেকে নিলেন। তাঁর যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার খরচ আমাদের জোগাতে হল না। বিপক্ষের অন্য দুজন বক্তা ছিলেন সুজয়দা এবং ডাক্তার স্মরজিৎ জানা। বিতর্ক পরিচালনা করেছিলেন যাদবপুরের ডিন অব সায়েন্স অধ্যাপক ডি কে সোম।

সভার শুরুতে বলেছিলেন অম্লান দত্ত ও আইসিএস অশোক মিত্র। সেই সময় পরমাণু বিদ্যুতের বিপদের কথা তাঁরা তেমন জানতেন না। তিনি এ বিষয়ে বিরোধিতার কারণ জানতে চেয়েছিলেন। আমরা অশোকবাবুকে পড়বার জন্য হেলেন ক্যালডিকটের ‘নিউক্লিয়ার ম্যাডনেস’ এবং অম্লানবাবুকে অ্যামরি বি লভিন্সের ‘সফট এনার্জি পাথ’ দিয়ে এসেছিলাম। এছাড়া সেই সময় অমৃতবাজার পত্রিকার সানডে সাপ্লিমেন্টারির দুটো ইস্যুতে যে পরমাণু বিতর্ক প্রকাশিত হয়েছিল, সেই কপিগুলোও দিয়েছিলাম।

শ্রোতাদের মধ্যে ছিলেন বাদল সরকার, তাপস সেন, শ্যামলী খাস্তগীর সহ কলকাতা, যাদবপুর ও কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন অধ্যাপক ও অন্যান্যরা। বৌদিও উপস্থিত ছিলেন। দশটা থেকে প্রায় সাড়ে চারটে পর্যন্ত জোরদার সভা হয়েছিল। বাদলদা অনেকদিন পর্যন্ত সেই সভার কথা বলতেন। সভার সাফল্যের চাবিকাঠি ছিল উপদেষ্টামণ্ডলীর ভার। সেই বুদ্ধিটা এবং পরিকল্পনার অনেকটা ছিল সুজয়দার। দুই-তৃতীয়াংশ সাক্ষরও তিনিই জোগাড় করেছিলেন।

পরমাণু শক্তি উন্নয়নের তীব্র বিরোধিতা করে সুজয়দা নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসারের কথা বলেছিলেন। তাঁর মতে, পরমাণু বিদ্যুতের প্রসারের জন্য সরকার যে বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয় করে, সৌরশক্তিভিত্তিক নবায়নযোগ্য খাতে তা বরাদ্দ করলে সহজেই বিকল্প বিদ্যুতের প্রসার হত। সুইডেন ও জার্মানির কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, ওই দুই দেশের সরকার সেই পথে হাঁটবার পরিকল্পনা করছে। নবায়নযোগ্য শক্তি থেকেই যাবতীয় বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো সম্ভব, তবে বিদ্যুতের অপচয়ও বন্ধ করতে হবে। মানুষকে শাসন করার বদলে সেবা করার কথা শাসকেরা ভাবেন না বলেই নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসার হয় না। তিনি এসব কথা বলেছেন আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে। উষ্ণায়নের বিপদ থেকে বাঁচতে আজ কিন্তু পৃথিবী নবায়নযোগ্য শক্তির পথেই চলেছে।

সেদিন ধীরেন্দ্র শর্মা বলেছিলেন, আজ যদি সরকার নবায়নযোগ্য শক্তির জন্য দশ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে এইসব পরমাণুবিজ্ঞানী সেদিকেই ছুটবে এবং বলবে নবায়নযোগ্য শক্তিই একমাত্র পথ। পরমাণুবিজ্ঞানীরা অর্থ, অন্য সুযোসুবিধার দাসত্ব করে, এদের বিবেক বলে কিছু নেই। সেই কথা বাদলদার খুব পছন্দ হয়েছিল, পরে কয়েকবার তা উল্লেখ করেছিলেন।

ওই কনভেনশনের পর ঠিক করলাম পরিবেশ দূষণ ও পরমাণু শক্তির বিপদ নিয়ে জনচেতনা বাড়ানোর জন্য সর্বভারতীয় ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশ করব। নাম ঠিক হল ‘সেফ এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’। পত্রিকার পাঁচজন উপদেষ্টা ছিলেন। সুজয়দা ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি, পরিবেশবাদী কৃষ্ণা আয়ার, দিল্লির ধীরেন্দ্র শর্মা, টি আর শিবাজী রাও অন্ধ্রপ্রদেশের, তামিলনাড়ুর দেবনায়কম।

পত্রিকার গ্রাহক সংগ্রহের জন্য বারবার তাঁর সঙ্গে নানা জায়গায় গিয়ে দেখেছি প্রাক্তন ছাত্র ও বন্ধুদের কাছে তাঁর কী বিপুল সমাদর। সিইএসসি বা সিমেন্স যে অফিসেই গিয়েছি তাঁকে ঘিরে বন্ধু-ছাত্র-পরিচিতদের বলয় তৈরি হয়েছে। যতদূর মনে পড়ে এভারেস্ট হাউসে ছিল সিমেন্সের অফিস। সেখানে তাঁকে দেখে নিমেষে ১০-১২ জন প্রাক্তন ছাত্র ঘিরে ফেলল। কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের এক উচ্চপদস্থ কর্তাও এলেন। সুজয়দাকে বললেন, ছেলেদের মুখে আপনার কথা এত শুনি, তাই আলাপ করতে চলে এলাম। সুজয়দা সবাইকে বললেন, তোমরা এই পত্রিকার গ্রাহক হয়ে যাও। তখনই ১০-১২ জন গ্রাহক পেয়ে গেলাম।

এলগিন রোড থেকে হরিশ মুখার্জি স্ট্রিট পেরিয়ে ন্যাশনাল লাইব্রেরির দিকে যেতে সিইএসসি-র একটা বড় অফিস ছিল, রাস্তার নামটা মনে নেই। সেখানে পৌঁছলে সাত-আটজন পদস্থ কর্তা একসঙ্গে তাঁকে নিয়ে চা-বিস্কুট সহযোগে খোশগল্প শুরু করলেন। কথা বলছেন সবাই, মধ্যমণি তিনি। নানা চেম্বার অব কমার্স থেকে তাঁর কথা শুনতে বারবার ডাক আসত। চারিদিকে এত খাতির কিন্তু একটা বিজ্ঞাপনও এনে দেননি। কারণ, কারও কাছে অনুগ্রহ চাইবেন না। তখন কিন্তু মনে মনে ক্ষুব্ধ হতাম। ছাত্রদের ওপর তাঁর প্রভাব দেখে অবাক লাগত। পরে দেখেছি ষাটের দশকের ছাত্ররাও মুক্তকণ্ঠে তাঁর গুণগান করতেন।

পাঁচ বছর চলার পর আমাদের পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে হয়। আমরা টাকা-পয়সা নিয়ে কাজ করার কথা ভাবতাম না। অথচ দিন দিন পত্রিকার কাজের চাপ বাড়ছিল। অফিস আর হোলটাইমার ছাড়া পত্রিকা চালানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। প্রচুর চিঠিপত্র আসত, অথচ দু-তিন বছর ধরে সেসবের উত্তর দেওয়ার সময় নেই। তারপর যখন পত্রিকা চালানোর জন্য অনেক টাকার প্রস্তাব এল, জাত খোয়াবার ভয়ে পত্রিকা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

এখন মনে হয় সব কিছু ছেড়ে পত্রিকাটা পেশাগতভাবে চালানোই উচিত ছিল। কারণ পরমাণু শক্তি এবং পরিবেশ দূষণ নিয়ে কথা বলার মত পত্রিকা তখন ছিল না। ছিল শুধু ‘অণুমুক্তি’, তবে তার প্রকাশ ছিল অনিয়মিত। বন্ধ করার দু-এক বছরের মধ্যে অবশ্য ‘ডাউন টু আর্থ’ প্রকাশ শুরু হয়। সুজয়দা কয়েকবার বলেছিলেন, স্যার বলছিলেন, পত্রিকাটা তো আর পাই না! স্যার মানে প্রাক্তন বিদ্যুৎমন্ত্রী এবং যাদবপুরের প্রাক্তন উপাচার্য শঙ্কর সেন। ১৯৯৮ সালে ভারতের পরীক্ষামূলক পরমাণু বিস্ফোরণের পর আমরা সবাই তখন রাস্তায় নেমেছি। সুজয়দা বললেন, আর একবার পত্রিকাটা বার করলে হয় না! সত্যিই খুব প্রয়োজন থাকলেও ফের তা বার করার আর উৎসাহ ছিল না।

পরের বছর, ১৯৯৯ সালে নাগাদ যখন রাজ্যে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কথা উঠল মানুষকে পরমাণু শক্তির বিপদের কথা বলতে সুজয়দা ছোটাছুটি শুরু করলেন। বেলঘড়িয়া, বনগাঁ সর্বত্রই যেতেন। এই সময় আমন্ত্রিত হিসেবে তাঁর সঙ্গে বেশ কয়েকটা জায়গায় গিয়েছি, এমনকি বীরভূমের এক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেও। বারবার তাঁর বাগ্মিতায় মুগ্ধ হয়েছি। সকাল থেকে প্রায় না খেয়ে থাকেন, কয়েকবার শুধু চিনি ছাড়া লাল চা। শত অনুরোধেও কিছু মুখে দেন না। রাতে ভালো করে খাবার খান। এইরকমই নিয়ম করে নিয়েছিলেন। এই সময়েই খেয়াল করলাম দিনে যে খান দুয়েক সুগন্ধি জর্দ্দা পান খেতেন তাও বন্ধ করে দিয়েছেন।

ইন্সটিটিউট অফ ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসের প্রাক্তন অধিকর্তা কৃষ্ণস্বামী সুব্রম্মন্যন ও অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান রাজা রামান্না প্রসঙ্গে একদিন বললেন, এরা এত অসভ্য, কী বলব! পরে জানলাম যাদবপুরের প্রতিরক্ষা বিষয়ের এক সভায় তাঁর সঙ্গে তাঁদের কিছুটা বাদানুবাদ হয়েছে। রাজা রামান্নার আমলেই ভারত পাঁচটি পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। সেই কাজের পুরস্কার হিসাবে তাঁকে প্রতিরক্ষা দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়েছিল। তা নিয়ে সুজয়দার বক্তব্য ছিল, পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার দায়িত্বে যিনি ছিলেন তাঁকে প্রতিরক্ষা বিভাগের রাষ্ট্রমন্ত্রী করা হলে শান্তিকামী দেশ হিসাবে ভারতের ভাবমূর্তিতে কালি লেপা হয়, পাকিস্তানই বা কী ভাবে? এই কথা বলার সময় সুব্রম্মন্যন তাঁকে বাধা দেবার চেষ্টা করেছিলেন। সে জন্যই ওই বিরক্তি। এই ঘটনার পর কিছুদিন ধরে তাঁর ল্যান্ডফোনে গোয়েন্দা দপ্তর আড়ি পাততে শুরু করে। বিষয়টা পুরোপুরি জানতে আমাদের অনেক সময় লেগেছিল। কারণ কখনওই নিজের সম্বন্ধে তেমন কিছু বলতেন না।

কয়েক বছর পরে বললেন, এই যে রাজেন্দ্র পচৌরিকে আইপিসিসি-র (ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) চেয়ারম্যান করা হল, তা কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ উইলিয়াম বুশ এবং কয়েকটি বহুজাতিক জীবাশ্ম জালানি ও পরমাণুবিদ্যুৎ কোম্পানির অঙ্গুলি হেলনে। আইপিসিসি তাদের প্রথম তিনটি রিপোর্টে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে পরমাণু বিদ্যুতের কথা বলেনি, আপত্তি ছিল পচৌরির পূর্বসুরি রবার্ট ওয়াটসনের। তাই আমেরিকার রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট বুশের নেতৃত্বে ওই সমস্ত কোম্পানি তদ্বির করে ২০০২ সালে চেয়ারম্যান হিসেবে ওয়াটসনের জায়গায় নিয়ে এল রাজেন্দ্র পচৌরিকে, যাকে তাদের ইচ্ছেমতো চালনা করা যাবে। বিজ্ঞানী ওয়াটসনের চর্চার বিষয় ছিল বায়ুমণ্ডল, পচৌরির বিষয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং, তিনিই হলেন পরবর্তী চেয়ারম্যান।

তার আগে থেকেই পরমাণুবিদ্যুতের কোণঠাসা অবস্থা শুরু হয়েছিল, উৎপাদন ক্ষমতা তেমন বাড়ছিল না। বায়ু ও সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা অল্প হলেও বাড়তে শুরু করেছিল। পরমাণুবিদ্যুতের কারবারিরা এবং আইএইএ (ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি) চাইছিল শুধু নবায়নযোগ্য শক্তি নয় আইপিসিসি পরমাণুবিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর কথাও বলুক। তাদের ইচ্ছেতেই পচৌরি আইপিসিসি-র চতুর্থ রিপোর্টে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে সৌর ও বায়ুবিদ্যুতের সঙ্গে পারমাণুবিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বললেন।

আইপিসিসি-র প্রথম রিপোর্টে উষ্ণায়নকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। দ্বিতীয়টাতে আরও শক্তিশালীভাবে উষ্ণায়নের তথ্য উপস্থাপিত করা হয়। তৃতীয় রিপোর্ট সারা পৃথিবীকে কিছু করতেই হবে বলে উজ্জীবিত করেছিল। পচৌরির লাইন ছিল— আমেরিকা যা বলবে তাই করব। তাই তিনি ২০০২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত টানা আইপিসিসি-র চেয়ারপার্সন ছিলেন। ২০০৭ সালে আইপিসিসি নোবেল পিস প্রাইজ পেয়ে গেল। নোবেল পিস প্রাইজ মানে, অনেক সময় ওয়াশিংটন থেকে যে নাম আসবে, তাকে প্রাইজটা দিতে হবে। অনেক সময় পিস প্রাইজের উদ্দেশ্য হয় আমেরিকার তাঁবেদার রাজনীতিবিদকে মহিমান্বিত করা। যেমন, শান্তি হল কি হল না, ইজরায়েল আর আরবকে নোবেল পিস প্রাইজ দিয়ে দেওয়া হল।

নিঃসরণ কমানো কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়! দেশের অর্থনীতি ভীষনভাবে ধাক্কা খাবে। নানা শক্তিশালী মহল এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কাজ করে। তার ওপর চার বছর ধরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পৃথিবীটাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন। তিনি উষ্ণায়ন হচ্ছে বলে মনেই করেন না, জলবায়ু বদল বিষয়টাকে আমল দেননি। তাঁর আমলে আমেরিকা প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছিল। ট্রাম্পের কথাবার্তা, কাজ-কর্মে উৎসাহ পেয়ে চিন, ভারত, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশ নিঃসরণ কমানোর উদ্যোগে কিছুটা জল ঢেলে ছিল।

ওবামা যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, নিজের দেশের কার্বন নিঃসরণ কম করার উদ্যোগ ছাড়াও যেসব দেশ বেশি নিঃসরণ করে তাদের ডেকে, বুঝিয়ে নানাভাবে নিঃসরণ কমানোর জন্য দায়বদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ভারত-চিনকে বাবা-বাছা বলে লাইনে আনতেন। চার বছরে বড় ক্ষতি হয়ে গেলেও এখন প্রেসিডেন্ট বাইডেন আমেরিকাকে আবার প্যারিস চুক্তিতে ফিরিয়ে এনেছেন, কার্বন নিঃসরণ কমানোর উদ্যোগ শুরু করছেন।

যে বই থেকে সুজয়দা আমেরিকার ওই ষড়যন্ত্র বিষয়ে বিস্তারিত জেনেছিলেন, বইটা এবং লেখকের নাম আমায় লিখে দিয়েছিলেন। হাতের লেখা তো নয় মুক্তাক্ষর। আমি তখন নিয়মিত আমেরিকান লাইব্রেরিতে যেতাম। সেখানে হঠাৎই একদিন সুজয়দার সঙ্গে দেখা। দেখলাম পকেট থেকে লজেন্স বার করে সেখানকার লাইব্রেরি অ্যাসিস্ট্যান্টদের দিচ্ছেন। অনুজদের দেওয়ার জন্য সাধারণত তাঁর পকেটে লজেন্স থাকত, আমাদেরও দিতেন। লাইব্রেরির র‍্যাক থেকে সেদিন তিনি বইটা বার করে আমায় দিলেন।

২০০৬ সালে এ রাজ্যে দ্বিতীয় দফায় পরমাণু চুল্লি স্থাপনের কথা উঠল— হরিপুরে। আমরা বার বার হরিপুর, জুনপুট ও কাঁথিতে সভা করলাম। সুজয়দা যেতে পারেননি। পরে বলেছিলেন, যাব, আমাকে নিয়ে যেও। ততদিনে রাজ্য সরকার বুঝে গিয়েছিল যে এ রাজ্যে পরমাণু শক্তির বিরুদ্ধে বিরোধিতা এত প্রবল যে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা প্রায় অসম্ভব। ওদিকে আন্দোলনও ঝিমিয়ে গেছে, আর তেমন যাওয়ার দরকার হয়নি। তবে ভারতের নানা স্থানের পরমাণু বিরোধীদের নিয়ে সেই সময় কলকাতায় যে সভা হয়েছিল সেখানে স্বমহিমায় ছিলেন।

ন্যাশনাল ফিশওয়ার্কার্স ফোরামের প্রেসিডেন্ট, হরিপুর পরমাণুশক্তি বিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা হরেকৃষ্ণ দেবনাথ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে একদিন নার্সিংহোমে গিয়ে সারাক্ষণ তাঁর হাত ধরে বসে কথা বললেন। হরেকৃষ্ণদার যে রোগ হয়েছিল তাতে তাঁর ফিরে আসবার কথা ছিল না। তবু কয়েক মাস পরে তাঁর মৃত্যুসংবাদ পেলে শিশুর মতো হাউ হাউ করে কেঁদেছিলেন।

২০১৫ সালে রাসবিহারী অ্যাভেনিউয়ের ওপর ট্র্যাঙ্গুলার পার্কে পাঁচ দিন ধরে দুর্বার মহিলা সঙ্ঘের সম্মেলন হয়। সেখানে একদিন পরমাণু বিদ্যুৎ নিয়ে আলোচনা ছিল। সুজয়দা টানা পঁয়তাল্লিশ মিনিট বললেন। শেষে এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন যে তাঁর চোখে জল এসে গিয়েছিল। বলেছিলেন, চেষ্টা যে করিনি তা তো নয়, কিন্তু আমরা পৃথিবীটা বদলাতে পারিনি। আমাদের দিন শেষ হয়ে এল। বলতে কুণ্ঠা হয়, কাজটা আপনাদের জন্যই ফেলে রেখে যেতে হল।

মানুষকে খুব ভালোবাসতেন, ভালো মানুষকে আরও বেশি। ছাত্রজীবন থেকেই ধুতি-পাঞ্জাবি পরতেন। অনেক পরে অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স পড়তে এসেছিলেন রবীন চক্রবর্তী। তিনিও ধুতি-পাঞ্জাবিই পরতেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের পড়া শেষে সুজয়দা এখানেই পড়েছিলেন। পুরনো বিভাগে তাঁর রীতিমত যাতায়াত ছিল। পোশাকের সাদৃশ্যের জন্য রবীনদাকে ‘ভাইটি’ বলে ডাকতেন। পরে রবীনদা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স বিভাগেই অধ্যাপনা করেন। একবার তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে লেক রোডে শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন। ‘ভাইটি’র অসুস্থতার খবর পেয়ে শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা কীভাবে জোগাড় করে ফুলের তোড়া নিয়ে একদিন সুজয়দা সেখানে হাজির হলেন। রবীনদা শুধু বিস্মিত নন, অভিভূত।

কয়েক বছর ধরে দুই হাঁটুর সমস্যায় ভুগছিলেন। অমন লম্বা মানুষের খুঁড়িয়ে হাঁটা দেখলেও কষ্ট হয়। কিন্তু তিনি হাঁটু বদলাবেন না। জিজ্ঞেস করলে বলেন, ওটা করব না, গরীব মাস্টার পয়সা কোথায়! কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারমশাইদের বড়রকমের মাইনে বৃদ্ধির আগেই তিনি অবসর নিয়েছেন। তাই কাহিল হাঁটু নিয়ে যাদবপুর যেতে হলেও বাসে চড়েই যেতেন। নিজের জন্য বেশি খরচ করবেন না। শরীরের কথা জিজ্ঞেস করলে স্বভাবসুলভ রসিকতা করে বলতেন, শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে আশি বছর পেরোলাম।

২০১৭ সালে শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক নিয়ে এক সভা শুরু হওয়ার আগে তাঁর পাশে গিয়ে বসলাম। বললেন, এক ছাত্রীর পিএইচডি থিসিস পড়ছি, মেয়েটি খুব ভালো কাজ করেছে। আমি জানালাম, জলবায়ু বদল নিয়ে লেখা বইয়ের জন্য বছর দুয়েক আগে পুরস্কৃত হয়েছি। আরও বললাম ২০১২ সালে দিল্লির সিএমএস ঘটা করে আমাকে ‘গ্রিন অ্যাম্বাস্যাডর’ উপাধি দিয়েছে। অবাক হয়ে বললেন, একবার জানালে না! তারপর আরও কঠোর ভাষায় তিরষ্কার করলেন। আমার তখন ধরণী দ্বিধা হও অবস্থা। লজ্জায় মাথা হেঁট করে বসেছিলাম। সময়মতো জানাইনি বলে খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। প্রিয়জনের সাফল্যে গুরুজনদের আনন্দ হয় সে কথা ভুলে আমার পুরস্কার পাওয়ার কথা জানানোটা গৌরবের প্রচার ভেবে নিই। সেই ভুল ধারণাতে তিনি প্রবল ধাক্কা দিলেন। মনে পড়ল প্রতিদিন পত্রিকার তরফ থেকে তাঁকে সম্মানিত করা হলে প্রথম দেখাতেই কিন্তু আমাকে জানিয়েছিলেন। কিছুদিন পর তাঁকে ফোন করে ক্ষমা চাওয়া এবং কেন কথাগুলো বলা হয়নি ইনিয়ে-বিনিয়ে সেই কথা বলার পর বললেন, একদিন এসো, আমরা বাইরে বেরিয়ে কফি খাব, তখন অনেক কথা হবে। শুনে স্বস্তি হল।

১৯৬১ সাল থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। রাজ্যের অপ্রচলিত শক্তি মন্ত্রক ও যোজনা কমিশনের উপদেষ্টা ছিলেন বহুদিন। শিক্ষকতা ছাড়া সহজ সরল জীবনযাত্রা ও সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে ছাত্র-ছাত্রী ও আমাদের কাছের মানুষ করেছে। কিছুদিন আগে তিনি সবুজ মঞ্চের প্রেসিডেন্ট হয়ে পরিবেশ দূষণ রোধের কাজে যুক্ত থাকলেও অধ্যাপনা ছাড়া তাঁর মূল পরিচয় ছিল বিশিষ্ট অ্যান্টি-নিউক্লিয়ার অ্যাক্টিভিস্ট— পরমাণু বোমা ও শক্তি দুইয়েরই বিরোধী হিসাবে। বয়স ও অন্যান্য কারণে সভাসমিতির কাজ কিছুটা কমে। তবে দুই হাঁটুর কাহিল অবস্থা নিয়েও পরিবেশ দূষণ ও উষ্ণায়ন রোধের নানা উদ্যোগে সামিল হতেন।

কত কিছুর সঙ্গে যে জড়িয়ে ছিলেন বলা মুশকিল। যতদিন বয়স ছিল নিয়ম করে স্টুডেন্টস হেলথ হোমে রক্ত দিয়েছেন, লোকজনকে রক্ত দিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাঁর প্রেরণায় আমিও বছরে দুবার রক্ত দিতাম। ১৯৯৫-৯৬ সাল থেকে ব্লাইন্ড পার্সন্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, দৃষ্টিহীনদের পড়াশোনার জন্য ব্রেইল তৈরি করার কর্মকাণ্ড যখন নেওয়া হয়েছিল সেই সূচনাপর্ব থেকেই। তাদের সংগঠনকে সাহায্য করেছিলেন বন্ধু হিসাবে, বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে, তাঁর প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়ে। তাদের কর্মকাণ্ডেও সাধ্যমতো যোগ দিতেন। একবার পুজোর সময় দেশপ্রিয় পার্কের সামনে পাবলিক কালেকশনের জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে পথচলতি মানুষের কাছ থেকে অনুদান নিয়ে রসিদ কেটেছেন। শেষের দিকে হাঁটুর সমস্যার জন্য তাদের কাছে যেতে না পারলেও ফোনে যোগাযোগ রাখতেন।

অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন শুনে তাঁর বাড়ি গেলাম। দু-তিন দিন হল বাড়িতে ফিরেছেন। দেখে খুশি হলেন। মুখে সেকথা বললেন। কিন্তু দেখলাম তাঁর প্রাণোচ্ছলতা হারিয়ে গেছে। কথা বলছেন একটু থেমে থেমে। যে অগ্রজের কাছে তাঁর অসুস্থতার কথা শুনে দেখা করতে গিয়েছিলাম তাঁর নামটা ফের জিজ্ঞেস করলেন। এমন স্মৃতি হারিয়ে যাওয়া অবস্থায় তাঁকে কখনও দেখিনি। উঠে আসার আগে বললেন, আমাদের টিমটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, টিমটা যেন থাকে। তাঁকে ও বাদল সরকাকে নিয়ে সত্যিই আমাদের একটা টিম ছিল। সময়ে সময়ে নানাজনকে নিয়ে টিম আরও বড় হত। ২০১২ সালে বাদলদার মৃত্যুর অনেক আগে থেকেই নানা কারণে টিম আর কাজ করছে না। ভাবছিলাম, হঠাৎ সেই টিমের উল্লেখ কেন! পরে জানলাম ডিমেনসিয়া হলে মানুষ বর্তমান ভুলে যায়, পুরনো কথা মনে পড়ে। বলে এলাম, আবার আসব। চার-পাঁচ দিনের মধ্যে আর যাওয়া হয়নি।

তাঁকে দেখলাম মৃত্যুর পরে। মুখের স্বাভাবিক প্রসন্নতা নেই, যেন অনেক লড়াই করে এখন শান্ত।

সমাজ, দেশ এখন অনেক অশান্ত। অনেক আশাতীত ইস্যু এখন দৈনন্দিন ভাবনার মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব তাঁকেও কষ্ট দিত, কারণ তাঁর মন ছিল মানুষের প্রতি ভালোবাসায় ভরা। এখন আমরা মনকে বোঝাই, এই অবস্থায় তিনি চলে গেছেন, তা মন্দ নয়। বেঁচে থেকে এই নতুন জ্বালায় তাঁর মন আর প্রভাবিত হবে না, হাঁটুর বেহাল অবস্থা থেকেও মুক্তি পেলেন। তাছাড়া শরীরে যে সঙ্কট দেখা দিয়েছিল, পরে হয়তো একেবারে বিছানা নিতে হত। ডিমেনসিয়ায় ভুগছিলেন। কদিন ধরে কী করব, কোথায় যাব, কী খাব— এসব নিয়ে কথা বলতেন। ২২ ফেব্রুয়ারি (২০২০) সকালবেলা খাওয়ার সময় বৌদি কাছেই বসেছিলেন। অল্প একটু সুপ তুলে দিয়ে বাকিটা খেলেন, তারপরেই চলে গেলেন।

তাঁর সহজ সরল ব্যবহার, দরদী মন আর অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা ছিল আমাদের প্রেরণা। তাঁর সঙ্গ আমাদের তাজা রাখত। যেদিন দেখা হত বাড়তি আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। অমন প্রাণোচ্ছল প্রসন্ন মুখের বড়ই অভাব। ভাবতে কষ্ট হয়, সেই অভিজ্ঞতা আর হবে না, আমাদের এই অভিভাবককে আর দেখতে পাব না।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...