জেমস ওয়াটের কেটলি ও গ্রেটা থুনবার্গ

অংশুমান দা

 


পরিবেশবিদ ও খাদ্যসুরক্ষা বিশেষজ্ঞ; কবি ও প্রাবন্ধিক

 

 

 

যদি জেমস ওয়াট কেটলির জল না ফুটতে দেখতেন তাহলে পৃথিবীর ইতিহাসটাই অন্যরকমভাবে লেখা হত! সেই আগুন আবিষ্কার থেকে মানুষ জল ফোটাচ্ছে— কেন যে জেমসের মাথাতেই এল যে কেটলির ঢাকা বারবার নড়ে নড়ে উঠছে, মানে বাষ্পের নিশ্চয়ই একটা শক্তি আছে আর সেটাকে যদি কাজে লাগানো যায় শারীরিক পরিশ্রমের কাজটা অনেক কমে যাবে। বড় হয়ে জেমস ওয়াট স্টিম ইঞ্জিনের ডিজাইনটাই বদলে দিলেন। মানুষের মাথা তখন উর্বর থেকে উর্বরতর হচ্ছে, পটাপট হয়ে যাচ্ছে নানা আবিষ্কার। আবিষ্কারের আড়ালে হাসছে মুনাফার শ্বদন্ত। মানুষের কাজকে মেশিন দিয়ে করিয়ে নিলে উৎপাদন যে অনেক বাড়িয়ে তোলা যায়— এটা বুঝতে বেশিদিন সময় লাগেনি। তাই কারখানার ভোলবদল, মানুষের চাকরি ছাঁটাই, উৎপাদন বৃদ্ধি— তাই কাঁচামালের সরবরাহে ঘাটতি। তাই কাঁচামালের খোঁজে দেশ আবিষ্কারের, দেশ দখলের হিড়িক— অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি এইসব ঘটতে থাকে দ্রুত। তার কিছুদিন পর থেকেই বিজ্ঞানীমহলে কিন্তু নানারকম টুকটাক পরীক্ষানিরীক্ষাও হতে থাকে কলকারখানা আর মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলে উৎপন্ন হওয়া কার্বন ডাই অক্সাইড আর নানা গ্যাসে বায়ুমণ্ডলে আচ্ছাদন পড়া নিয়ে। তাতে অবশ্য কৌতূহল যতটা ছিল, আশঙ্কা ততটা ছিল না।

১৮২০ সালে গণিতজ্ঞ জোসেফ ফুরিয়ার অত্যন্ত সহজভাবে বুঝিয়ে দেন সূর্য থেকে আসা তাপ, পৃথিবীর উত্তপ্ত হওয়া, তার সঙ্গে কিছু তাপ ফিরে যাওয়া ও কিছুটা আটকে থাকা— এইসবের মধ্যে একটা চমৎকার ভারসাম্য আছে। অর্থাৎ তা বিগড়ে গেলে কপালে দুঃখ আছে! সময় গড়িয়ে ১৮৬০। জন টিন্ডাল বললেন— তাপ আটকে রাখার ব্যাপারে কার্বন ডাই অক্সাইড আর অন্য কিছু গ্যাসের প্রভূত ভূমিকা আছে। এই গ্যাস পৃথিবীর বাইরে এমন এক চাদর তৈরি করেছে যে পৃথিবী থেকে তাপ বেরিয়ে যেতে গিয়ে সেই চাদরে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে আর ঘুরপাক খাচ্ছে পৃথিবীর মধ্যেই— বাড়িয়ে তুলছে তাপ। ১৯৩০ নাগাদ এ নিয়ে কপাল কুঁচকানো শুরু হল— স্টুয়ার্ট ক্যালেন্ডার বললেন শিল্পবিপ্লবের অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হিসাবে উত্তর আটলান্টিকের বরফ গলছে— কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে গেলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়ে যাবে— তখন যে কী হবে! ১৯৫০-এর শেষ দিকে গিয়ে আসলেই কুঁচকানো কপাল ঘেমে উঠল— কার্বন ডাই অক্সাআইডের পরিসংখ্যান থেকে পৃথিবীর উত্তপ্ত হয়ে ওঠার ব্যাপারটা জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল। আর সেই সঙ্গে মডেলিং-এর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রক্ষেপণের নানা বিজ্ঞান তখন আবিষ্কার হয়ে গেছে— ফলে বর্তমানের সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতের দুঃস্বপ্ন দেখাটাও সম্ভব হয়ে উঠছে।

জোসেফ ফুরিয়ার

তার মধ্যে আবার উল্টো চিন্তাও এসেছিল। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দূষণের জন্য কিছু পরিমাণ সূর্যরশ্মি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকেই ফিরে যায়— ফলে একটা আপাত শীত আসে ১৯৪০ থেকে ১৯৭০-এর মধ্যে। এইসব চাপানউতোরের মধ্যে থেকেই ১৯৭০ সালের ২২ এপ্রিল পৃথিবী জুড়ে আর্থ ডে পালন শুরু হয়— সে অবশ্য মূলত দূষণ সংক্রান্ত সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে। কিন্তু রাজনীতির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে কোথাও যে এগোনো যাবে না— সেই বোধ থেকেই মানুষ প্রতিবাদ প্রতিরোধ প্রখর করা শুরু করতে থাকে এই সময় থেকেই। ১৯৮০ থেকেই তাপমাত্রা বাড়া ও তার সঙ্গে জলবায়ু বদলের ঘটনা পর পর এমনভাবে ঘটতে থাকে যে পৃথিবীর নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। ১৯৮৮ গরমের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দেয়— যদিও তারপর থেকে অনেক গরমের রেকর্ড অবশ্য ভাঙা হয়ে গেছে। ১৯৮৯ সালে তৈরি হয় আইপিসিসি— ইন্টারগভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ। তখন থেকে লাগাতারভাবে জাতিসঙ্ঘের এই বিজ্ঞানীরা বিশ্ব উষ্ণায়ন ও সেই সংক্রান্ত জলবায়ু বদলের ভয়াবহতাগুলিকে সামনে নিয়ে আসছেন। তাতেও কিছু নিরেট মস্তিষ্কের মাথায় এ কথা ঢুকছে না যে দেরি হয়ে গেছে, বড় দেরি হয়ে যাচ্ছে।

প্রাচীন পশ্চিমি লুঠপাট যেভাবে বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক বৈষম্য ডেকে এনেছে, পৃথিবীকে তথাকথিত উন্নতিরেখা দিয়ে ভাগ করেছে— ঢালু জমিতে পাথর গড়িয়ে নামার মত তাকে আর রোখা যাচ্ছে না। তা ক্রমশ একটা সীমাহীন খনিজ তেল-নির্ভর, কার্বন-নির্ভর ভোগের দিকে আমাদের নিয়তিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কার্বন নিঃসরণের একটা মস্ত দায়ভার পশ্চিমি দেশগুলির হলেও যেভাবে বৈষম্য বাড়ছে পৃথিবী জুড়ে, তাতে এই ‘অনুন্নত’ গোলার্ধের ‘উন্নত’ লোকেরাও সমান ভাগীদার হয়ে উঠছে। এদেশেই ১০ শতাংশ লোকের কাছে ৭৭ শতাংশ সম্পদ। বাকি ৯০ শতাংশ শক্তিনির্ভর সুযোগসুবিধা— যেমন বিদ্যুৎ, পরিবহণ, যন্ত্র থেকে এখনও বঞ্চিত। এদেরকে যদি বঞ্চিত না রাখতে হয় তবে কার্বন ডাই অক্সাইডের চাদর আরও মোটা হবে এ কথা নিশ্চিত। উপরন্তু এখন বিশ্ব উষ্ণায়নে এই মানুষগুলির কোনও ভূমিকা না থাকলেও জলবায়ু বদলের ধাক্কা ঝড়, অতিবৃষ্টি, খরার মাধ্যমে এদেরকেই সহ্য করে যেতে হচ্ছে। ফলে একদিকে অতিরিক্ত অপরিকল্পিত শক্তি ভোগের উপরে রাশ টানা, অন্যদিকে শক্তি ব্যবহারের সুযোগসুবিধা বেশিরভাগ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া— এই নিখুঁত ভারসাম্য রাজনৈতিক দায়িত্ববোধ ছাড়া সম্ভব নয়। কারণ এর যা স্কেল, তা বিশ্বব্যাপী হতে হবে— নিছক আপনার আমার বসার ঘরের বিপ্লবে তাকে এঁটে ওঠা যাবে না।

এ সব আমরা বুঝতে পারিনি তা নয়। তাই ১৯৯২-এ রিওতে হল ‘আর্থ সামিট’— সেখানে ঠিক হল পরিবেশের কথা মাথায় রেখে কীভাবে হবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। পাঁচ বছর পরে ১৯৯৭-এ কিয়োটোয় ৪১টি দেশ সহ ইওরোপিয়ান ইউনিয়নের নেতারা ঠিক করেন ২০১২-র মধ্যে ১৯৯০-এর মাত্রার থেকেও ৫ শতাংশ কমিয়ে আনবেন গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রা। সে বিলে সই করেছিলেন বিল ক্লিন্টনও। ২০০১-এ জর্জ বুশ কিয়োটো প্রটোকল ভেঙে বেরিয়ে আসেন অর্থনৈতিক মন্দার সম্ভাবনার দোহাই দিয়ে। সুতরাং বুঝলেই যে বদলের সদিচ্ছা থাকবে তা নয়। অথচ তার আগে থেকেই আন্দোলন ঘনীভূত হচ্ছে পৃথিবী জুড়ে, তার পরেও। ২০০৫-এ মন্ট্রিয়েল, ২০০৯-এর কোপেনহেগেনে পৃথিবীজোড়া মানুষের ঢল নামে। সেই মিছিলে হাঁটার সৌভাগ্য হয়েছিলে আমারও। ২০০৬-এ আল গোর— যিনি কি না প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াবেন, জলবায়ু বদল নিয়ে বানালেন ‘অ্যান ইনকনভেনিয়েন্ট ট্রুথ’— অস্বস্তিকর সত্য নামে একটি তথ্যচিত্র— তা নিয়ে ঘুরে বেড়ালেন দেশে দেশে। তার মধ্যেই আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা খনিজ তেলের কোম্পানি থেকে শেয়ার তুলে নেওয়ার আন্দোলন চালাতে থাকে। এর ঢেউ যদিও এদিকে এতটা এসে পৌঁছায়নি, কিন্তু ২০১৯ সালের মধ্যে আসলে ১১ ট্রিলিয়ন ডলার তেলের বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক চাপানউতোর চলতেই থাকে। ২০১২, ডোনাল্ড ট্রাম্প তখনও প্রেসিডেন্ট হননি, বলে বসলেন— বিশ্ব উষ্ণায়ন আসলে চাইনিজদের একটা গিমিক, যাতে আমেরিকার অর্থনীতিতে ঘা দেওয়া যায়। ২০১৫-তে কিয়োটো প্রোটোকলের উপরে করতে হল প্যারিস ক্লাইমেট চুক্তি। এবারে ১৯৭টা দেশ বলল তারা পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে আটকে রাখবে সবাই। বারাক ওবামা এতে সই করলেও ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প এসেই সে চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে এলেন আবার। এখন জো বাইডেন আবার ফিরে আসছেন সেই চুক্তিতে।

ক্লাইমেট আন্দোলন পশ্চিমি দেশেই প্রখর হয়েছে— তা হওয়াই বাঞ্ছনীয়। 350.org, প্যাসিফিক ক্লাইমেট ওয়ারিয়র, এক্সটিঙ্কশন রেবেলিয়ন— সেইসঙ্গে আরও অনেক শিল্পী, সাধারণ মানুষ পৃথিবী জুড়ে আন্দোলনের রাশ হাতে তুলে নেন। ২০১৮-তে পনেরো বছর বয়সের গ্রেটা থুনবার্গ শুক্রবার শুক্রবার সুইডিশ পার্লামেন্টের বাইরে হাতে ‘জলবায়ুর জন্য স্কুল বনধ’ স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে বসে থাকা শুরু করেন। অচিরেই তা সারা পৃথিবীর নজর কাড়ে— এবং ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার— ভবিষ্যতের জন্য শুক্রবার— এক পৃথিবীব্যাপী আন্দোলনের রূপ নেয়। যার ঢেউ এখন ভারতেও এসে পৌঁছেছে। কিন্তু ভারতের লোক কীভাবে এই আন্দোলনকে দেখছেন? নানা ইস্তেহার পড়ে যতটুকু বোঝা যাচ্ছে তা হল আমরা এখনও ১৯৯২-এর রিও সম্মেলনের মূল বিষয়গুলির আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করছি, এখনও নিছক পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেই দেখছি একে। ক্লাইমেট আন্দোলনের একটা তীব্র রাজনৈতিক অভিমুখ আছে, যা বৈষম্যের সমীকরণগুলিকে নিয়ে সমালোচনা করবে, ঘাড়ে ধরে নীতি নির্ধারণ করাবে। ক্লাইমেট আন্দোলন ‘একটি গাছ একটি প্রাণ’-এর স্বর্গীয় সারল্য থেকে মুক্তি পেয়ে যত তাড়াতাড়ি মাটিতে আছড়ে পড়ার ব্যথা অনুভব করতে পারে ততই মঙ্গল।


About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...