সঞ্জয় সিংহ
একটু মনে করে দেখুন তো, এতদিন বাংলা সিনেমায় শিক্ষকদের কেমন চরিত্রে দেখে এসেছেন? মানে, যেমন ধরুন পুলিশ— হয় একেবারে আদর্শবান, নয় চূড়ান্ত দুর্নীতিগ্রস্ত। আবার ধরুন ডাক্তার— হয় একেবারে অগ্নীশ্বরমার্কা; নয়— না দুর্নীতিগ্রস্ত ডাক্তার সিনেমাতে কমই দেখেছেন, সেখানে মিনিটখানেকের মধ্যে মুমূর্ষু রোগীকে জবাব দিলেই তার কাজ শেষ, সাধারণত সিরিয়ালেই ডাক্তাররা ভুল রিপোর্ট দিয়ে বা ক্ষতিকারক ওষুধ দিয়ে নায়ক-নায়িকার জীবন সংশয় করে তোলে। কিন্তু শিক্ষক? কষ্ট করে মনে করে দেখুন, আদর্শে অটল থাকা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, নানান প্রগতিশীল সামাজিক কাজে নেতৃত্ব দেওয়া ছাড়া মাস্টারমশাইদের বাংলা সিনেমায় অন্য কোনও কাজ করতে দেখেছেন কি?
তো এই রকম পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে একটি ওয়েব সিরিজে দেখা দিয়েছেন এক প্রাথমিক স্কুলের মাস্টারমশাই। যে দূর গ্রামে তার পোস্টিং, তার নাম বিরহী। ব্যস, আমি জানি অনেকেই এবার বলতে শুরু করেছেন, ‘বিরহী’ ওয়েব সিরিজ তো? পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য তো? কিন্তু হয়তো কেউ কেউ হাত তোলেননি, তাদের জন্য বলি, চট্ করে দেখে ফেলুন সব কটা এপিসোড, কারণ আজকের আড্ডাটা ‘বিরহী’কে নিয়েই। জানেনই তো, আগে থেকে গল্প বলে দিলে সিনেমার ঠাকুর পাপ দেন, আমাকে সে আতান্তরে ফেলবেন না! পয়সাকড়ি লাগবে না, প্রথমে ইউটিউবে যান, উরিবাবা চ্যানেলে খুঁজুন, সেখানে বিরহী ওয়েব সিরিজ নম্বর এ— মোট ছটা এপিসোডই পেয়ে যাবেন।
দেখলেন তো সিরিজটা? খেয়াল করুন, ইউটিউবে দেখানোর ফলে একটা মজার ঘটনা ঘটল, প্রতিটি এপিসোডের নীচেই কয়েক হাজার দর্শকদের নানারকম মন্তব্য পাওয়া গেল। এমনটা কিন্তু সিনেমাতে তো নয়ই, ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোতেও হয় না। মন্তব্যগুলোর মধ্যে বিপুল পরিমাণে প্রশংসা, মুগ্ধতা ইত্যাদির সঙ্গে বেশ কিছু প্রশ্ন এবং বিরূপতাও রয়েছে। রয়েছে কিছু তুলনাও— ‘পঞ্চায়েত’ ওয়েব সিরিজের সঙ্গে, নির্দেশকের প্রথম সিনেমা ‘বাকিটা ব্যক্তিগতে’র সঙ্গে। কিন্তু দেখেছেন এত্তজন, সব্বাই! ফলে ‘বিরহী’র অভিজ্ঞতা শুধু ওয়েব সিরিজের নয়, অনেক দিন পরে শো শেষের চায়ের আড্ডাশুদ্ধ পুরোটা ফিরে পাওয়া গেল ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। সিনেমা, তার দর্শক— সব মিলিয়ে এক বিরাট কার্নিভাল!
বিরহী নামে নদীয়াতে একটা জায়গা থাকলেও তার সঙ্গে এই বিরহীর কোনও যোগ নেই। আর কে নারায়ণ যেমন তার নিজের ছেলেবেলা আর আমাদের নিজেদের ছেলেবেলা জুড়ে জুড়ে গড়ে তুলেছেন মালগুডি, প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য নিজেই তার প্রথম ছবিতে গড়ে তুলেছিলেন মোহিনী নামের এক গ্রাম যার হদিশ কেবল মাত্র প্রেমের খোঁজে বেরিয়ে পড়া মানুষই পেতে পারে, তেমনি বিরহীও এক মনের মধ্যে গড়ে ওঠা জগৎ। আবার ঠিক তেমনি নয়ও। আগের দুটো গ্রাম আমাদের স্বপ্নে দেখা; আমাদের মূল সমাজের নৈতিকতা, সুকুমার অনুভূতি, আমাদের মধ্যবিত্ত মূল্যবোধকে যথার্থ ধরে নিয়ে গড়ে তোলা স্বপ্নের দেশ, বিরহী ঠিক তার অন্য মেরুতে। পর্দায় যে সব তথাকথিত নৈতিকতা দেখতে আমরা অভ্যস্ত, সে সব ছাপিয়ে চারপাশের যে খারাপ হাওয়ার মধ্যে বেঁচে থাকতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি, এই সিরিজ তার গন্ধ বয়ে আনে।
নির্দেশক এই সিরিজটা পেশ করেছেন এক অনবদ্য ভঙ্গিতে, যা বাস্তব ঘেঁষা অথচ নিখুঁত বাস্তব হয়ে উঠতে আগ্রহী নয়, বরঞ্চ তার ঝোঁক প্রতিদিনের জীবন থেকে কৌতূহল জাগানো আর মজার উপাদান বের করে এনে তাই দিয়ে তার বলার কথাগুলো বলে ফেলা। প্রথম দৃশ্যেই লাল শাক আর পেঁয়াজকলির ক্ষেতে বলিউডি স্টাইলে প্রি-ওয়েডিং শুটের এক ব্যঙ্গচিত্র আঁকতে আঁকতে তিনি পুরো সিরিজের সুর বেঁধে দিয়েছেন। গোটা সিরিজেই দর্শকদের জন্য ছেড়ে গেছেন প্রচুর ফাঁকা জায়গা, সেই শূন্যস্থান পূরণের লোভ দেখিয়েই গেঁথে ফেলেছেন দর্শককে। দর্শকদের মন্তব্যগুলো খেয়াল করলেই বোঝা যায়, তারা পর্দায় দৈনন্দিন জীবনের এমন রূপায়ণ দেখে উচ্ছসিত। অধীর আগ্রহে তারা এক সপ্তাহ ধরে অপেক্ষা করেছেন পরের এপিসোডের জন্য। তাদের বেশিরভাগ পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম ও মফস্বলের মানুষ, এবং নবীন প্রজন্ম।
“পশ্চিমবঙ্গ জায়গাটা কলকাতার একটা পাড়া নয়,” বিরানব্বইয়ের শীতে সাহিত্যিক অমিয়ভূষণ মজুমদার বালুরঘাটে বাংলা অ্যাকাডেমির এক সভায় কলকাতার সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্টজনদের উদ্দেশ্য করে কথাটা বলেছিলেন, যা আমি পেয়েছিলাম সাহিত্যিক অভিজিৎ সেনের স্মৃতিচারণ থেকে। কলকাতায় যা হচ্ছে এবং কলকাতাকে নিয়ে যা হচ্ছে তাই একমাত্র কথা, এমন একটা বাতাবরণের বিরুদ্ধে তিনি এই বার্তাটা দিয়েছিলেন। সে ছিল সাহিত্যের প্রেক্ষিত। কিন্তু কথাটা মনে পড়ে গেল ‘বিরহী’ দেখতে দেখতে। মাল্টিপ্লেক্সের নগরকেন্দ্রিক দর্শকদের জন্য তৈরি ছবি দেখতে দেখতে এবং নায়ক-নায়িকার সাউথ সিটি বা আর্বানার ফ্ল্যাটের প্রতিটি স্কোয়ার ইঞ্চি মুখস্থ করে ফেলার পরে এ যেন হঠাৎ সিলেবাসের বাইরে থেকে প্রশ্ন এল। আমাদের সামনে হাজির হল বিরহী নামের একটা গ্রাম, সিনেমায় এতদিন যেরকম গ্রাম দেখানো হয়েছে (বিপ্লবী বা শোষিত বা রোমান্টিক), সেরকম হয়ে ওঠার ইচ্ছা তার একেবারেই নেই, খুব বাস্তবও তাকে বলা যাবে না, কেবল তার বাস্তবতার ল্যাজ সামান্য মুচড়ে দিয়ে পরিচালক আমাদের সামনে ছেড়ে দিয়েছেন।
কৃষ্ণকান্ত হালদার এই সিরিজের নায়ক, তার যাত্রাপথের সঙ্গী আমরা। জীবনের যাত্রাপথের অনেকটা জুড়েই তার নিত্যযাত্রা— বাসে, সাইকেলে, সাইকেল ঘাড়ে করে খাল পেরিয়ে। প্রথম এপিসোডের গোড়ার বেকার কৃষ্ণ বিচিত্র ধরনের সাময়িক পেশা আর নানা ধরনের অপমান পেরিয়ে শেষে একদিন হাতে পেয়ে যায় প্রাইমারি শিক্ষকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। পোস্টিং বিরহী গ্রামে। সে কেমন গ্রাম?
বাসে কৃষ্ণর সহযাত্রীর ভাষায়— “সে এক মার্ডার ইন্ডাস্ট্রি মশাই!” সেখানে বোমা বাঁধার কুটিরশিল্প— বোমা নয়, স্থানীয় ডাকনাম ‘বাবা’— সে ইন্ডাস্ট্রির এক্সপার্ট হল মুম্বাইফেরত ভুল ইংরিজি বলা ‘বোম বলাই’। চাষের কাজ হয় বটে, তবে চাষ হয় ‘হাবা’— এক ধরনের মাদক গাছ। শিশু-কিশোরের দল স্কুলের পথ মাড়ায় না, সবাই মোবাইল হাতে গেম খেলতে ব্যস্ত, এমনকি মাস্টারদেরও তারা পাত্তা দেয় না। আছে গদাইয়ের ‘কাম বটিকা’র দোকান, সাফল্য সুনিশ্চিত, এমনকি হেডস্যারও তার নিয়মিত কাস্টমার। গ্রামে মাঝে মাঝে হানা দেয় মস্তান ট্যাঁপা, সে কৃষ্ণর কাছে তোলা চায়। এমত বিপদে অসহায় কৃষ্ণকে কে বাঁচায়? বাঁচায় জমিদার। গ্রামের জমিদার? না, জমিদারদিদি। স্কুলের সহায়িকা। অসম্ভব দাপুটে। কৃষ্ণকে সে ভাই পাতায়। গ্রামের সবরকম বিপদ থেকে তাকে রক্ষা করার অঙ্গীকার করে। জমিদারের নাম করে কৃষ্ণ ট্যাঁপার হাত থেকে রক্ষা পায়। পরে জানা যাবে ট্যাঁপা জমিদারের স্বামী এবং সে সংক্রান্ত কাহিনির জটিলতা তো আপনারা জানেনই। আর আছে রাধা। এনজিও কর্মী। কৃষ্ণর সহযাত্রী— বাসে এবং পাশাপাশি সাইকেলে। সময় গড়ালে তারা নিত্যপথের বাইরে, ঘনিষ্ঠ প্রকৃতি কোলে। কতকাল ধরে তো সেরকমটাই হয়ে আসছে, বাংলার কীর্তন গান সে খবর বয়ে আনছে কত কাল ধরে। কিন্তু রাধা বড় ঠোঁটকাটা, কৃষ্ণর সঙ্গে মাসিক নিয়ে আলোচনাতেও তার কুণ্ঠা নেই, এমনকি তার ডিভোর্সের কথা জানিয়ে দিয়ে প্রেমিকটিকে মেপেও নেয়! ভালোমানুষ কৃষ্ণ একটু অস্বস্তিতে থাকে, মেয়েদের এমন হাবভাব বা তাদের মুখে এসব কথা শোনার অভ্যাস নেই কিনা! আবার চার নম্বর এপিসোডে এসে হাজির হয় এক দম্পতি, রুবিনা আর সেলিম। বউয়ের সঙ্গে ঝামেলা করে এই নিয়ে চোদ্দবারের সুইসাইডটা করার জন্য সেলিম বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, রুবিনা তাকে খুঁজে পেয়ে চোদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে দেয়। “ছেক্সের” ব্যাপারস্যাপার নিয়ে তারা যখন প্রকাশ্যেই ঝগড়া শুরু করে দেয়, কৃষ্ণর তো তখন কানে আঙুল!
সিরিজটায় তো দেখেছেনই, খুব চেনা এক পৃথিবী— কেবল কার্টুনশিল্পীরা যেমন চরিত্রের মুখের বৈশিষ্ট্যগুলো বাড়িয়ে বাড়িয়ে আঁকেন, নাকটা একটু লম্বা করে দেন অথবা গালটাকে একটু বেশি ফুলোফুলো বা চিমড়ে করে দেন, তেমনি। এই সিরিজ দেখতে দেখতে গল্পকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভেবেছেন কি মরেছেন। আবার যদি খুব যুক্তি টুক্তি বাগিয়ে ধরেন, মানে এই ধরুন ভাবতে বসলেন কৃষ্ণকান্ত তাহলে খাল পেরোনোর পর কোথায় জাঙ্গিয়া শুকোয়, তাহলেও আপনি ভুল ফাঁদে পা দিচ্ছেন! গল্প ছাড়া যেহেতু আমাদের চলে না, নির্দেশক তাই একটা গল্প গল্প ব্যাপার, থ্রিলার থ্রিলার আবহাওয়ার সুঁচ দিয়ে সিরিজটা সেলাই করে দিয়েছেন। আসলে তিনি কিছু অভ্যস্ততা থেকে আমাদের বের করে আনতে চাইছিলেন, বলে ফেলতে চাইছিলেন অনেকগুলো জরুরি বিষয়। সেইদিকটা নিয়ে একটু কথা বলা যাক।
বিরহীর দর্শকদের কয়েক হাজার কমেন্টের বেশ কিছুটা পড়ার পর একটা জিনিস খেয়াল করলাম, বহু মানুষই বলেছেন তারা পরিবেশ ও চরিত্রগুলোর সঙ্গে একাত্মবোধ করেছেন। এইখানে বাংলার অন্যান্য ওয়েব সিরিজের থেকে বিরহী একটু স্বাতন্ত্র্য দাবী করে। খুব নিখুঁত এ সিরিজ নয়। সে আলোচনা পরে। কিন্তু এই খুঁতগুলোকে পাত্তা না দিয়েই দর্শক সিরিজটাকে ভালোবাসছেন, কারণ কোথাও একটা যোগাযোগ স্থাপিত হচ্ছে ভিতরে ভিতরে, যা উপরিতলের ধুলো-বালি-খড়-কুটো নিয়ে চিন্তিত নয়। বহুদিন ধরে সিরিয়ালের ফিডিং বোতলে অভ্যস্ত দর্শককে একটা ধাক্কা দেয় বিরহী। ড্রয়িংরুমে বসে একে অন্যের বিরুদ্ধে অবাস্তব সমস্ত ষড়যন্ত্রের সাজানোর বাইরে একটু নিশ্বাস ফেলার জায়গা দেয়। ধাক্কা দেয় বাংলা সিনেমার দর্শককেও, যারা অভ্যস্ত হয়ে গেছিলেন কলকাতার বাইরে শুটিং মানে হয় শান্তিনিকেতন নয় দার্জিলিং, মহিলা চরিত্র মানেই তারা সিঁথির সিঁদুর, ঘরের শান্তি এবং শেষ পর্যন্ত পুরুষের আধিপত্য ইত্যাদি রক্ষা করে চলবেন। আবার অন্যদিকে “বাংলা ওয়েব সিরিজ” শব্দটার সমার্থক হয়ে উঠেছে রহস্য কাহিনি বা যৌন সুড়সুড়ি মেশানো কমেডি। দু-চার জন দর্শকের খারাপ লেগেছে যে পর্দায় এত খারাপ খারাপ কথা কেন— তবে মজার বিষয় হল এই সমস্ত নিত্যদিনের খিস্তি আমাদের অনেকেরই বাগভঙ্গির অন্তর্গত হয়ে গেছে, এবং সে সব পর্দায় দেখার পরও বেশিরভাগ দর্শকই আলাদা করে সে নিয়ে কোনও মন্তব্যও করেননি। এবং যৌনতা। এত স্বাভাবিক ও খোলামেলাভাবে বিষয়টা আলোচনায় আসে, যে আমাদের মধ্যবিত্ত চিন্তা-চেতনা বেশ খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে শেষমেশ ফিক্ করে হেসে ফ্যালে। পরিচালক জমিদারকে দিয়ে একবার বকাও দেন আমাদের উঁকি মারার অভ্যাসকে, একদম সরাসরি থ্রেট। রাধা প্রথম থেকেই প্রেম সম্পর্কে আতুপুতু ধারণাকে ব্যঙ্গ করতে থাকে। ছোটবেলা থেকে মেয়েদের জামাকাপড় সামলানোর যে অভ্যাস তৈরি করে দেওয়া হয়, যেন শরীরকে আড়াল করে রাখাটাই মেয়েটির প্রধান কৃতকর্ম, রাধা তার চলনে-বলনে সে সবের প্রতি এক মূর্ত বিদ্রূপ। জমিদারের বড় ছেলে অরুণের হাবভাব মেয়েলি। কিন্তু এই সমাজে সে ব্যঙ্গের পাত্র নয়— ফুলকুমারীর বোর্ডিংয়ে থেকে সে পড়াশোনা করে, পরিবারের দায়িত্ব নেয়, এমনকি সন্ত্রস্ত কৃষ্ণকে ভরসা জোগায় সেই। বিরহী নানা স্তরে আমাদের চেনা পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাটাকে ব্যঙ্গ করে। মহিলার নাম জমিদার কেন? সিরিজ টুতে হয়ত পরিচালক এ সব গূঢ় বিষয় ফাঁস করবেন। কিন্তু আমার মনে হয়, প্রাইমারি স্কুলের পরিমণ্ডলের ক্ষমতার চাবিকাঠি তার হাতে, তাই তিনি জমিদার, পুরুষ না হয়েও। আবার বর্ণাশ্রম নিয়েও খোঁচা থাকে, মালো কৃষ্ণ আর ব্রাহ্মণ রাধাকে ঘিরে বাসের সহযাত্রী বা রাধার বাবা ও ভাইদের কথাবার্তায় তা ধরা পড়ে। আরও কত কিছুতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি— রাজনৈতিক নেতাটি কিরকম আমাদের অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া চেনা স্বরে ঘুষ নিয়ে আলোচনা করেন; আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি প্রি-ওয়েডিং শুটের এক হাঁসজারু সংস্কৃতিতে; বিয়ের সময় পণ নেওয়া আমাদের ‘ঐতিহ্যে’র অন্তর্গত; বোম বানানোর ইন্ডাস্ট্রিতেও আমরা অভ্যস্ত, প্রতিটি ভোটের মরশুমে কত কত প্রাণের বিনিময়ে তার প্রমাণ আমরা পেয়েই চলেছি। যাতে আমরা অভ্যস্ত, তা আমরা দেখেও দেখি না। বিরহী সেই জায়গাটাকে খুঁচিয়ে দেয়। আমাদের ভিতরে ভিতরে এত যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ জমে উঠেছিল, তাকে এক অনন্য ভঙ্গিতে প্রকাশ করল বিরহী।
আরেকটা স্তরে খেলা করে বিরহী। শহরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত জীবনযাপনের পাশে দাঁড় করিয়ে দেয় গ্রাম-মফস্বলের জীবনকে। দুধরনের সংস্কৃতি, দুধরনের মূল্যবোধকে নানা সময় মুখোমুখি ঠেলে দেয়। পর্দার ভিতরে কৃষ্ণ সেই সব জায়গাগুলোতে বড় অস্বস্তিতে পড়ে। পর্দার বাইরে আমরা দর্শকরা, যে দৃশ্যগুলোয় আমাদের মনে হয়, ইস, এটা বাড়ির লোকদের নিয়ে কীভাবে দেখব, বিরহী মিচকে হাসি দিয়ে আমাদের ঠিক সেই অস্বস্তিটার মধ্যেই ঠেলে দিতে চায়। আমরা জানি বিষয়গুলো বাস্তব, রোজ এই সবের ভিতর দিয়েই আমি ও আমার পরিবারের প্রতিটি সদস্যের যাতায়াত, কিন্তু কিছুতেই বাড়িতে সেসব আলোচনায় স্বচ্ছন্দ নই, আমাদের এই সমস্ত ট্যাবু, এই সমস্ত দ্বিচারিতাকে বেশ খানিকটা বেআব্রু করে দেয় বিরহী।
আমার মনে হয় বিরহীকে নিয়ে আরও নানা দৃষ্টিকোণ থেকে কথাবার্তা চালু হওয়া দরকার। বেশ এক কথায় ভালো বলে প্রশংসা বা খারাপ বলে উড়িয়ে দেওয়ার মত বই এ নয় দাদা। তবে আমরা কিন্তু মজে গেছি।
অনেক কথা হয়ে গেছে, এইবার কথার ভার থেকে মুক্ত হতে একবার “রাধাকুণ্ডে ডুব দিয়ে শ্যামকুণ্ডে” উঠতে হবে, সাত্যকি ব্যানার্জীর হাত ধরে। হাজার কথার বদলে এক একখানা গান কী করতে পারে, সাত্যকি ও প্রদীপ্ত জুটি দেখিয়ে দিয়েছেন। কৃষ্ণের প্রাইমারি মাস্টার জীবনের সূত্রপাতে এরা সেই যে সুরের নেশা ধরিয়ে দিয়েছে, তা থেকে আর দর্শকদের নিস্তার নেই। কী গান, আহা! “বিরহী রুটের শুকপাখি” অথবা “হাওয়া খারাপ,” আলাদা করে এই গানগুলোও শুনে চলেছেন হাজার হাজার শ্রোতা। এই গান আর সুর দিয়েই তো বাঁধা পড়েছে বিরহী! রাধাকৃষ্ণের ভালোবাসার দৃশ্য ধুয়ে যাচ্ছে কীর্তনের সুরে, কখনও রুবিনার বিলাপের পিছনে বেজে উঠছে যাত্রার করুণ সুর, পাশ্চাত্য সুর মিশে গিয়ে তৈরি হয়েছে “হাওয়া খারাপ,” সিরিজের শুরু হয় বলিউডের ছাপ মারা “জানা জানু” দিয়ে, আবার একটা গোটা বোলান গানের আসরই হাজির হয় ছয় নম্বর এপিসোডে। হয়ত বিরহীকে এক মিউজিক্যাল সিরিজ বললেও ভুল হবে না, সঙ্গীত এমন আঁটোসাঁটো করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে বিরহীকে আর তার দর্শককে।
গ্রামবাংলার এমন সহজ সরল উপস্থাপনা অনেকেরই ভালো লেগেছে। কিন্তু কত জটিল ক্যামেরা মুভমেন্ট, কত নিখুঁত ব্লকিং, কত বিপ্রতীপ আলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে এই সারল্যের পুনর্নির্মাণ করা গেছে, সে সব রহস্য দক্ষ হাতে সামলেছে জয়দীপ দে। বোম বলাইয়ের সঙ্গে ট্যাঁপার অ্যাকশন, জমিদারের সেই ভয়ঙ্কর রাত ক্যামেরার যোগ্য সঙ্গত ছাড়া সম্ভব ছিল না।
অভিনয়ের জন্য যাকে প্রথমেই সর্বান্তকরণে অভিবাদন জানাব, তিনি ঘোষিত মূল চরিত্র নন, তিনি জমিদার, শ্রাবন্তী ভট্টাচার্য। পর্দায় যতক্ষণ জমিদার, ততক্ষণই আমাদের চোখ তার দিকে। ছোট ছোট নিখুঁত অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে, বাচনভঙ্গি দিয়ে শ্রাবন্তী চরিত্রটাকে ছুঁয়ে দেখেছেন। কৃষ্ণের চরিত্রে সায়ন ঘোষ অসাধারণ। জল থেকে তুলে নেওয়া মাছের অবস্থা ভারী সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছেন। শতাক্ষী নন্দী রাধার চরিত্রের অপ্রত্যাশিত ডায়ালগগুলোতে এত সাবলীল, যে কৃষ্ণের সঙ্গে দর্শকও একটু সোজা হয়ে বসেন। বোম বলাই এবং ট্যাঁপা— অসম্ভব জীবনীশক্তি ভরে দিয়েছেন বিরহীতে। দুজনেই দুর্দান্ত অভিনেতা— দীপক হালদার ও অমিত সাহা। হেডস্যার, গদাই, রুবিনা, সেলিম, বাসের সহযাত্রী অজয়বাবু, জমিদারের বড় ছেলে অরুণ, চা দোকানের কানাই, পকাই, কৃষ্ণের প্রাক্তন প্রেমিকা, তার হবু বর “জানা জানু”— তালিকা বিশাল— সবাই মিলে জমিয়ে দিয়েছেন এই কার্নিভাল!
স্থানীয় মানুষদের অংশগ্রহণ এই সিরিজের একটা বৈশিষ্ট্য। এর ফলে শুটিংটাও যে আরেকটা কার্নিভালে পরিণত হয়েছিল, সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। এরা সবাই নানা দৃশ্যে অংশগ্রহণ করেছেন, তবে একটা মুশকিল হয়েছে, কারণ এরা দক্ষ অভিনেতা নন। ফলে অভিনয়ের দিক থেকে দেখলে এটা অবশ্যই একটা ত্রুটি। কিন্তু এই চরিত্রগুলোকেও দর্শকেরা আরেকভাবে অনুভব করেন। হয়ত ভাবেন, এ লোকাল বটে! আমি করলে এটা কেমন হত? নয়তো তারা এই সময় ছবিটা থেকে মন একটু আলগা করে ছবিটা নিয়ে মনে মনে একটু ভাবনাচিন্তা করে নেন। এই মজাটার একটা পণ্ডিতি নাম আছে বটে, সেটা থাক। মোদ্দা কথাটা হল দর্শক মূল বিষয়টা থেকে দূরে চলে যান না, সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয় না। এত এত সিরিয়ালের অখাদ্য অভিনয়, ভিনগ্রহ থেকে ভেসে আসা বাংলা ভাষা শুনতে শুনতেও দর্শক মূল বিষয়ের সঙ্গে একটা সংযোগ তৈরি করার চেষ্টা করেন, ধাক্কা খান সেই মূল বিষয়টারও অসারতায়, চর্বিত চর্বণে। যখন মূল বিষয়টা জমে যায়, দর্শকরা এ বিষয়গুলোকে পাত্তাই দেন না, যতক্ষণ না পণ্ডিতেরা সূক্ষ্ম বিচার করে এ সব খুঁচিয়ে তোলেন।
পরিচালক কাম চিত্রনাট্যকার কাম সম্পাদককে নিয়ে বলার কিছু নেই। যে হীরে তিনি কেটেছেন, তা সহস্রমুখী। এবং এত কম সময়ে এত কম বাজেটে তিনি অসাধ্য সাধন করেছেন। প্রত্যেকটা এপিসোডের শেষে রেখে গিয়েছেন পরের এপিসোডের জন্য টান টান আকর্ষণ। লোকে কী খেতে পছন্দ করে, সেই চেনা ফর্মুলা হাতে নিয়ে তিনি রাঁধতে বসেননি। বরঞ্চ তার হাতের সেরা রান্নাটাই তিনি দর্শককে পরিবেশন করেছেন। দর্শক যে কব্জি ডুবিয়ে খেয়েছেন, সে তো দেখাই যাচ্ছে! শুধু ওপরের স্তরের চ্যাংড়ামিটুকু দেখে যাঁরা নাক সিঁটকেছেন, তাঁরা একটু মন দিয়ে দেখুন, বুঝতে পারবেন এ আসলে এক বহুস্তরীয় চ্যাংড়ামি, একদমই ভিন্ন ধরনের পরিবেশনা। কয়েক বছর আগে মুক্তি পাওয়া একটা হিন্দি সিনেমার কথা বলি, “স্ত্রী,” এ বছর সেই টিমই বানিয়েছে “রুহি।” দুটোই ভূতের ছবি, মেয়ে ভূত। কিন্তু সিনেমাগুলো যদি দেখে থাকেন বুঝতে পারবেন, তাদের উদ্দেশ্য আদৌ একটি ভয় দেখানো ভূতের গল্প বলা নয়, তারা এক অনবদ্য ভঙ্গিতে সমাজে মেয়েদের অবস্থান, প্রত্যাশা— এই সমস্ত নিয়ে কিছু জরুরি বার্তা দর্শকের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছে। ফলে তারা ভেঙে দিয়েছে ভূতের ছবির দর্শক আর সামাজিক ছবির দর্শকের বাড়ির মাঝখানের বেড়া। বিরহীতেও পরিচালক বহু ধরনের দর্শকের জন্য দরজা খোলা রেখেছেন, তাদের ভালোবেসে, কখনও উস্কে দিয়ে, কখনও নিজস্ব গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসার চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিয়ে।
তবু অনেক দর্শকের সঙ্গে আমারও কয়েকটা বিষয় খচখচ করতে থাকে। রাত্রিবেলা পর্যন্ত কি প্রাইমারি স্কুল চালু থাকে? সাইকেল নিয়ে ওইভাবে রাত্রে যাতায়াত? রাধার মত ডাকাবুকো মেয়েকে ওর প্রাক্তন বর মারত? মানতে অসুবিধা হয়। ট্যাঁপার কাছে বন্দুক থাকাটাই স্বাভাবিক, ফলে তাকে ধরার পরিকল্পনায় সে বিষয়টা হিসেবে না রাখাটা একটু কেমন লাগে। কয়েকটা সংলাপে রাধা তার তৈরি করা অভিনয়ের মান ততটা ধরে রাখতে পারেনি। যে নদীর ধারের দৃশ্যে রাধা ছাত্রদের যত্ন করে মিড ডে মিল খাওয়ানোর কথা বোঝায় কৃষ্ণকে, সেটা আমরা আরেকটু কাছ থেকে দেখতে চাইছিলাম, ড্রোনের দূরত্ব খুব বাঞ্ছিত মনে হয় না। ডাবিংও কয়েকটা জায়গায় ঠিকঠাক সিঙ্ক করেনি। আর হ্যাঁ, এপিসোডের দৈর্ঘ্য ও বিষয়বস্তুর পরিমাণ কখনও কখনও আমাদের একটু অতৃপ্তি দিয়েছে, বিশেষত তৃতীয় এপিসোড।
অবশ্য এ সব খুব বড় কথা নয়। একটা জিনিস স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, এই কাজটার পিছনে রয়েছে বহুদিনের বোঝাপড়াওয়ালা ভালোবাসা দিয়ে গড়া একটা টিম। টিম বিরহী। স্যালুট! এই টিম শিগগির সিজন ২ নিয়ে আসবে, এই আশা নিয়ে শেষ করি।
খুব অ্যানালিটিকাল রিভিউ, অনেকগুলি দিককে সযত্নে ডিটেলসে তুলে ধরা হয়েছে, এই লেখা পড়ার পর দর্শকের সাথে বিরহীর যোগাযোগ এবং এক্সপ্লোরেশন নতুন মাত্রা পাবে। অনেক ধন্যবাদ।