আধার-ভোটার সংযোগ করার আইন ভারতের গণতন্ত্রের জন্য সমূহ বিপদ

সুমন সেনগুপ্ত

 



লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার

 

 

 

 

বারোজন রাজ্যসভার সাংসদকে বহিষ্কার করে, প্রায় কোনও আলোচনা বা বিতর্ক না হতে দিয়ে নরেন্দ্র মোদি সরকার নির্বাচনী সংস্কার সংক্রান্ত বিল পাশ করিয়ে আইনে পরিণত করল। পাশাপাশি তাঁরা ১৯৫০ সালের রিপ্রেজেন্টেশন অফ পিপলস অ্যাক্টকেও পরিবর্তন করেছে। বলা হয়েছে, একজন মানুষের কাছ থেকে একজন নির্বাচনী অফিসার যদি আধার নম্বর চান, তাহলে সেই মানুষটিকে তা দিতে হবে। যদি তিনি এই আধার না দিতে পারেন তাঁর ভোটার কার্ড যাচাই না করার জন্য, তাহলে তাঁর নাম নির্বাচনী তালিকা থেকে বাদ দেওয়াও হতে পারে। এই প্রক্রিয়াকেই বলা হচ্ছে আধার-ভোটার সংযোগ করা।

অনেকের এই প্রক্রিয়াকে নতুন মনে হলেও, আগে কিন্তু বিক্ষিপ্তভাবে বেশ কিছু রাজ্যে এই প্রক্রিয়া নেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তেলেঙ্গানার বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই প্রক্রিয়ার ফলে যথাক্রমে ৪০ লক্ষ ও ২৩ লক্ষ মানুষের নাম বাদ যায়। এই নিয়ে বেশ কিছু হইচই হওয়ার পরে তখনকার মতো এই প্রক্রিয়া রদ করা হলেও, ঘুরপথে এই প্রক্রিয়া কিন্তু চলতেই থাকে। তখন বলা হয়, যেহেতু আধার নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতে মামলা চলছে, তাই এই প্রক্রিয়া বন্ধ করা হোক। তারপর সর্বোচ্চ আদালত রায় দেয়, যে আধার একমাত্র সরকারি সুযোগসুবিধা পাওয়া ছাড়া কোনও ক্ষেত্রেই আর ব্যবহার করা যাবে না। কেন্দ্রীয় সরকার তখনকার মতো দমে গেলেও, তারা তাদের মতো কিন্তু আধারকে প্রায় সবক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করানোর কাজটি চালিয়ে যেতেই থাকে। মানুষও সমস্ত কিছু বুঝে অথবা না বুঝে, বাধ্য হয়ে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে মোবাইল ফোন সমস্ত কিছুর সঙ্গে আধারকে যুক্ত করার কাজটি মন দিয়ে করে যেতেই থাকেন। এরপর ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন আরও একটি কাজ করে— এতদিন ভোট দেওয়ার জন্য বিভিন্ন পরিচয়পত্র ব্যবহার করা গেলেও আধার কোনওদিন ব্যবহৃত হয়নি, এবার তাঁরা বলেন, আধার দেখিয়েও ভোট দেওয়া যাবে। তখনও অনেকে বুঝতে পারেননি, সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে চলেছে। তারপর আবারও বলা হয় ইলেক্টোরাল রোল ভেরিফিকেশন করা জরুরি এবং ১২টি ব্যক্তিগত পরিচয়পত্র দিয়ে ভোটার কার্ডকে যাচাই করতে হবে। এটা মুখে বলা হলেও, মুখে মুখে প্রচার করা হয় যে আধার দিয়ে ভোটার কার্ডকে যাচাই করতে হবে। এতেও বহু মানুষের মনে কোনও প্রশ্ন আসেনি, ভোটার কার্ডকে প্রমাণ হিসেবে দেখিয়ে আধার পাওয়া গেলেও, কেন ভোটার কার্ড যাচাই করতে আধারের প্রয়োজন হচ্ছে? ফলে এবারও বিপুল সংখ্যক মানুষ না বুঝে, না প্রশ্ন করে এই আধার এবং ভোটার সংযোগ করিয়ে ফেলেন।

এরপর আসা যাক কেন বেশ কিছু মানুষ এই আধার-ভোটার কার্ড সংযোগের বিরোধিতা করছেন? প্রথমত আধারের সঙ্গে প্রায় প্রতিটি মানুষের ফোন নম্বর সংযুক্ত করা আছে, সেই ফোনের সঙ্গে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, গ্যাসের সংযোগ বা রেশন কার্ড যুক্ত আছে। একজন মানুষ সরকারি যা যা সুবিধা পান, তা এই মুহূর্তে আধার দেখিয়েই পেয়ে থাকেন, সে পিএম-কিসান হোক বা রাজ্য সরকারের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। তাহলে একটি রাজনৈতিক দল যদি মনে করে, তারা সেই মানুষটিকে তাঁর মতো করে, তাঁর মোবাইলে নির্বাচনী বিজ্ঞাপন পাঠাবে, তা কি খুব কঠিন? যদি চিহ্নিত করা যায় (যা অসম্ভব নয়) তাহলে কি পরবর্তীতে সরকারি সুবিধা থেকে তাঁকে বঞ্চিত করবেন? তাও কি খুব অসম্ভব?

দ্বিতীয়ত, আজকের সময়ে যাঁরা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করেন, তাঁরা মোবাইল ফোন দিয়েই ব্যবহার করেন। একজন মানুষকে চিনতে, তিনি সামাজিক মাধ্যমে কী ধরনের আলোচনার মধ্যে থাকছেন, কী পছন্দ করছেন, কোন রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করছেন বা করছেন না, তা খেয়াল করলেই কি বোঝা সম্ভব নয়? তারপর যদি সেই মানুষটির নাম বাদ যায় এই আধার এবং ভোটার সংযোগের মধ্যে দিয়ে তাহলে কি এই কথাটা বলা খুব অনুচিত হবে, যে আধার-ভোটার সংযোগের এটাই অন্যতম উদ্দেশ্য?

তৃতীয়ত, আধারের ডেমোগ্রাফিক তথ্য হিসেবে যা সংরক্ষিত থাকে, তা দিয়ে একজন মানুষের জাত, লিঙ্গ, বয়স ইত্যাদি খুব সহজেই জানা যায়। কোন জনগোষ্ঠী বা কোন ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষ আজকের শাসকদের ভোট দেবে না, তা যেহেতু সহজেই অনুমেয়, তাই তাঁদের নাম বাদ দেওয়া তো মাত্র একটা কম্পিউটারের মাউস ক্লিকেই সম্ভব। ঠিক যেভাবে অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তেলেঙ্গানাতে মূলত সংখ্যালঘু মানুষদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই কি সারা দেশে বেছে বেছে সংখ্যালঘু মুসলমান এবং খ্রিস্টান বা আদিবাসীদের বাদ দেওয়া হবে না?

চতুর্থত, আধারের বায়োমেট্রিক্স নিয়েও কিছু কথা বলা যাক। যেহেতু ইউআইডিআই, আগে একটি আরটিআই-এর উত্তরে জানিয়েছে, যে তাঁরা কোনও মানুষের বায়োমেট্রিক্স অর্থাৎ চোখের মণি, মুখের ছবি বা হাতের ছাপ দেখে চিনতে পারে না সেগুলো কোনও একজন নির্দিষ্ট মানুষের কি না, তাহলে কে চিনবে কোনও আধার কোনও ভোটার কার্ডের সঙ্গে সংযুক্ত হল কি না? নির্বাচন কমিশন কি করে চিনবে? পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই মুহূর্তে দেশে যত ভোটার কার্ড আছে, তাঁর থেকে অনেক বেশি সংখ্যক আধার আছে। তাছাড়া আধারের তথ্যভাণ্ডার কোনও সংস্থা দ্বারা প্রত্যয়িত বা পরীক্ষিত হয়নি। তাহলে কী করে বোঝা সম্ভব কত ভুঁয়ো আধার আছে?

পিএম-কিসানের টাকা যখন আধার দেখিয়ে বিভিন্ন কৃষকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে, তখন দেখা গিয়েছিল বহু দুর্নীতি হয়েছিল। তাহলে যে আধার, নিজেই একটা দুর্নীতি করার ব্যবস্থা, তা দিয়ে কী করে ভুয়ো ভোটার ধরা সম্ভব?

এরপর কী ঘটতে চলেছে? এরপরের প্রস্তাব সাধারণ বা কমন ইলেক্টরাল রোল বা তালিকা হবে, যা দিয়ে লোকসভা, বিধানসভা বা পঞ্চায়েতের ভোটও হবে। তারপর বলা হবে, অভিবাসী শ্রমিকেরা যাতে নিজের নিজের কাজের শহরে বসে, নিজের অঞ্চলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে। কিন্তু ভাবুন তো, একজন নির্বাচনের কর্মী কী করে বুঝবেন, কে কার বায়োমেট্রিক্স ব্যবহার করে ভোট দিচ্ছেন? তার আগে ডিমিলিটেশন করে লোকসভার আসন বাড়ানো হবে। তারপরে আনা হবে এক দেশ এক ভোট। কোনও আঞ্চলিক দলেরই আর কোনও অস্তিত্ব কি থাকতে পারে আর? যে আঞ্চলিক দলেরা এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না এই ভোটার এবং আধারের সংযোগের বিপদ, তাদের আর কোনও ভূমিকাও থাকবে না। ভারতের গণতন্ত্রের শেষ পেরেকটা এই আধার-ভোটার সংযোগের মধ্যে দিয়ে হয়ে গেছে, কৃষক আন্দোলন বা সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের মত কোনও রাস্তার লড়াই না গড়া গেলে আগামী ১০০ বছরেও হয়তো বিজেপিকে নির্বাচনে পরাস্ত করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু এই বিপদটা কি আমরা বুঝতে পারছি?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. ইতিবাচক হয়ত হল, হয়ত আদৌ নয়…। কিন্তু গগনচুম্বী দানবীয় দুর্নীতি ! ডাহা ফেল করে যাওয়া এই আমি, আপনি, আমাদের
    হাতে তো রইল শুধু পেন্সিল ।
    যোগ্যতমের উদ্বর্তন হল কী ?
    হীরক সেনগুপ্ত

  2. ভয়ংকর রকমের সত্যি। তা ছাড়া, ডেটা নিয়ন্ত্রণকারী শক্তিশালী কোনো আইনের অভাবে আধারের গোপনীয়তা তো কবেই চুলোয় গেছে। শেষ অনুচ্ছেদের সম্ভাবনাগুলি বাস্তবায়িত হওয়া আটকাতে যে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন তা ক’জন শুনবে জানি না, তবে ফ্যাসিবাদী বুটের আওয়াজ যে প্রতিদিন আরও স্পষ্ট হচ্ছে, তাতে কোনো ভুল নেই। যারা বিরোধী জোট আটকাতে আড়কাঠির মতো কাজ করছে, মানুষ কিন্তু তাদের ক্ষমা করবে না। এখনো জার্মানির লোকের কিন্তু আগেকার প্রজন্মকে ক্ষমা করে নি।

Leave a Reply to Syamal Chakrabarti Cancel reply