‘ক্ষমতার লড়াইয়ে তুমি ছিলে না’

ঈশিতা ভাদুড়ী

 



কবি, গদ্যকার

 

 

 

১ মানে আমি
২ মানে আমি আর সে
৩ মানে আমরা দুজন আর বাচ্চাটা
৪ মানে আমরা চার বন্ধু
৫ মানে আমরা পাঁচ ভাইবোন
তারপর আর কোনো সংখ্যা নেই
এই ক’জন মিলেই
পরস্পরকে অনুসরণ করে অন্তরঙ্গ
বৃত্তাকার।
আমরা কজন?
১ ২ ৩ ৪ এবং ৫
মনে রেখো, প্রত্যেক সংখ্যার মধ্যেই আমি আছি
অর্থাৎ আমরা মোট দশজন
১০
অর্থাৎ আবার সেই আমি আর আমার সামনে
বৃত্তাকার অনুসরণ।

আজ থেকে অনেকবছর আগে এই কবিতা লিখেছেন পাঁচের দশকের অন্যতম কবি শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়। মৌরির বাগান ও কিছু নতুন কবিতা (মে ১৯৭২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা লি) বইতে। এই বইটি আমি প্রথম পড়েছিলাম বিয়াল্লিশ বছর আগে, যখন কবিতা লিখব বা পত্রিকা করব ভাবিওনি, তখন।

পরবর্তীকালে ঠুংরী নামে একটি পত্রিকা করেছিলাম কিছুদিন। তখন বহু বিখ্যাত মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলাম। মেঘমল্লার বিল্ডিং-এ শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় বিজয়া মুখোপাধ্যায়-এর ফ্ল্যাটে গিয়ে কবিতা সংগ্রহ করেছিলাম পত্রিকার জন্যে। সে অনেকদিন আগের কথা, ১৯৮৫ সাল, তখন তাঁদের পুত্র সায়ন খুবই ছোট। শরৎদা লিখেছিলেন আমাকে— “পুত্রের মাধ্যমিক পরীক্ষা সম্প্রতি শেষ হয়েছে। সংসারে আবার শান্তি ফিরে এসেছে।” প্রাথমিক আলাপে বিজয়াদি শরৎদা খুবই রাশভারী ছিলেন। কিন্তু আদপে তাঁরা একেবারেই অন্যরকম ছিলেন, খুবই আন্তরিক।

‘মধ্যরাতে কলকাতা শাসন’ করতেন যে যুবকেরা বলে পড়েছি বা শুনেছি, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। কৃত্তিবাস পত্রিকাতেও তাঁর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রথম জীবনে ‘নমিতা মুখোপাধ্যায়’ এবং ‘ত্রিশঙ্কু’ ছদ্মনামেও তিনি লিখতেন।

শরৎদা আপাতদৃষ্টিতে গম্ভীর দেখতে হলেও আসলে খুবই রসিক মানুষ ছিলেন, বিভিন্ন সময়ে তাঁর পরিচয় পেয়েছি। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা বলার লোভ সামলাতে পারছি না, যদিও আগে কখনও লিখেছি। অল্পবয়স তখন, ঠুংরী পত্রিকা বের করছি। ‘দেশ’ পত্রিকার অফিসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়েকে পত্রিকা দিতে গিয়েছি। সুনীলদার সামনে এক ব্যক্তি বসে, হিমানীশ গোস্বামী ভেবে তাঁকে আমি বললাম আপনার সংখ্যাটি ওপরে শক্তিদার (শক্তি চট্টোপাধ্যায়) কাছে দিয়ে এসেছি, হিমানীশ গোস্বামী তখন আনন্দবাজারে কর্মরত ছিলেন। তিনি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে মাথা নাড়ালেন। কাজকর্ম সেরে বাড়ি ফিরে এলাম, তখন চন্দননগরে থাকতাম। রাত্রিবেলা ঘুমাতে যাওয়ার সময় আমার মনে হল (এইসময়ই আমার সব ভাবনাগুলো আসে) আরে আমি হিমানীশ গোস্বামী ভেবে যাঁর সঙ্গে কথা বললাম, তিনি তো আসলে শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়! সারারাত জিভ কেটে গেলাম, ঘুম এল না। পরের দিন ঘুম থেকে উঠেই আমি লজ্জিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে একটি চিঠি লিখলাম, বাড়ি গিয়ে ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই আমার। এক সপ্তাহর মধ্যেই শরৎদার একটি লম্বা চিঠি এল। লিখলেন, “…এ সবই স্বাভাবিক ব্যাপার। ক্ষমা প্রার্থনা করার মতো কোনও অপরাধ নয়।… নিয়মিত একটি দোকান থেকে আমি মাছ কিনি, লোকটির নাম চিত্ত। একদিন তাকে প্রিয়া সিনেমার সামনে আমারই সঙ্গে লাইন দিতে দেখে চিনতে পারলাম না। গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, পরনে ধোপদুরস্ত পাজামা, লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরাচ্ছে। কে এ? মুখটা খুব চেনা-চেনা। জিজ্ঞেস করলাম, ভালো? ও বলল, ভালো। আন্দাজে ঢিল ছুড়লাম, আজকাল দেখি না কেন? ও বলল, আপনি বোধহয় অন্য বাজারে যান। ব্যস তখনই ক্লিক করল।…” সেইদিন থেকে শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় শরৎদা হয়ে গেলেন।

কত সহজেই না আমার ভুলটাকে মাফ করে আমার মতো অর্বাচীনকে কাছে টেনে নিলেন। তখন মানুষজন অন্যরকম ছিলেন, দিনকালও অন্যরকম ছিল। তাঁর ভাষাতেই বলি—

বলো তো, আমরা কবে জন্মেছিলাম?
অনেককাল আগে
তখন দিনকাল ছিল অন্যরকম।
বলো তো, আমরা কবে মরবো?
অনেককাল পরে,
তখন দিনকাল হবে অন্যরকম…

শরৎদা এমন পাই-টু-পাই হিসেবের এই দিনকালে পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট মানুষ হয়েও লেখালিখির জন্যে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই স্বেচ্ছাঅবসর নেন। এবং পুরোপুরি সাহিত্যকর্মে মনোনিবেশ করেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থের মধ্যে আহত ভ্রূবিলাস, অন্ধকার লেবুবন, ঘুমের বড়ির মতো চাঁদ উল্লেখযোগ্য। অন্যান্য বইও মনোযোগ আকর্ষণ করার মতই। প্রতিটি কবিতাই সমকালীন কবিতা বলেই মনে হয়। পাঠক পড়ুন—

নিচু হতে হতে মাথাটা ছুঁয়েছে পা
আর কতো নিচু হবো?
মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ ছোঁবে না
হৃদয় হবে না দ্রব,
এ কেমনতরো জীবন?
এমন জীবন ফিরিয়ে নাও
আমি ফিরে যাই ফের…

অথবা—

পলিথিনের বালতি এসে গেছে, নাইলনের মশারি, ট্রানজিসটরে মহম্মদ রফির গান। তবু গ্রাম। দূরে শুয়ে থাকা বিশাল রমণীর মতো পাহাড় রোদ খায়। সূর্য হেলে গেলেই এক আকাশ পাখি ফিরতে শুরু করে। আলো মানে আলো। অন্ধকার মানে অন্ধকার…

এরকম অজস্র অসাধারণ সব কবিতা উপহার দিয়ে গেছেন আমাদের জন্যে। কবিতা ছাড়া উপন্যাস এবং গল্পও তিনি লিখেছেন অনেক, এবং অনুবাদও। ২০০৯ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পান তাঁর কবিতার বই ‘ঘুমের বড়ির মতো চাঁদ’-এর জন্যে। এছাড়াও বহু পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। তৎসত্ত্বেও শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতন উল্লেখযোগ্য কবি তাঁর যোগ্য সম্মান পাননি। বাংলা সাহিত্যের এমন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বকে আমরা যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে পারিনি। আমি আশা করব পরবর্তী প্রজন্ম তাঁকে খুঁজে নেবে।

অন্তরঙ্গ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত তাঁর কবিতাসমগ্র তিনি স্বহস্তে আমাকে উপহার দিয়েছিলেন, এ আমার পরম প্রাপ্তি। তাঁর স্নেহ প্রশ্রয় যা পেয়েছি তোলা থাক আমার হৃদয়ে। শেষে তাঁরই একটি কবিতা উদ্ধৃত করে তাঁকে শ্রদ্ধা জানালাম—

তোমার জন্য শোকসভা হবে না মহম্মদ আলি
কেননা
ক্ষমতার লড়াইয়ে তুমি ছিলে না
নামডাকে ছিলে না
তাছাড়া, তুমি পা ফসকে পড়ে গেছ।
অতএব এই কবিতা।
শুক্রবার সকালের পর কাজ করোনি তুমি
তবু শনিবার অবধি মাইনে পাবে।
ঠিকেদার সদয় হলে
পনেরো হাজার টাকা জীবন বীমা
তা-ও পাবে তোমার বিবি,
পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকলে যা পেতে না।
মেট্রো রেল ভবনের ওই উঁচু দেওয়াল
তোমার হাতে রং…
মানুষকে ছোট দেখাচ্ছে, ছোট দেখাচ্ছে
ভাবতে ভাবতে তোমার পা ফসকে গেল।
এই খবরটাও সকলের জানা দরকার।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...