ভাষা চিন্তা মন: শারীরিক অবকাঠামো — একটি সহজপাঠ [৬]

অশোক মুখোপাধ্যায়

 

পূর্ব প্রসঙ্গ: মস্তিষ্কের কিছু কার্যকলাপ

মস্তিষ্কের নজরদারি

উচ্চতর স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলির উচ্চতর স্নায়বিক ক্রিয়াকলাপ বুঝতে হলে আরও তিনটি বিষয় আমাদের জেনে রাখতে হবে। উন্নত মস্তিষ্ক যে কতখানি হুঁশিয়ার থাকে সেটাও আমরা এই ফাঁকে দেখতে পাব।

প্রথমত, আগের আলোচনায় দেখা গেল, যে কোনও পরাবর্ত ক্রিয়ার শুরু একটা উদ্দীপনার সংবেদন দিয়ে এবং শেষ হয় কোনও অঙ্গ সঞ্চালনের মাধ্যমে তাতে সাড়া দেওয়ার দ্বারা। এই ধরনের সরল আচরণকে অনেক সময় “উদ্দীপনা-সাড়া” (stimulus-response) কিংবা “সংবেদন থেকে সঞ্চালন ক্রিয়া” (sensation to motor action) হিসাবে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারপরেও ক্রিয়াটির একটা ধাপ আছে। উদ্দীপনায় সাড়া দেওয়ার সময় যে দেহাঙ্গ সঞ্চালন হল, তার থেকেও সেই সঞ্চালনের একটা সংবেদন মস্তিষ্কের দেহানুভূতি অঞ্চলে চলে যায়। একে অনেক সময় সূক্ষ্ম পেশী সঞ্চালনের সংবেদন (kinaesthetic sensation) বলা হয়। অনেকটা আমাদের কোথাও বেড়াতে গিয়ে বাড়িতে পৌঁছসংবাদ প্রদানের মতো ব্যাপার। এর অর্থ হল, মস্তিষ্ক শুধু নির্দেশ পাঠিয়েই কাজ শেষ করে না, কাজটা ঠিকমতো সম্পন্ন হল কিনা তারও খবর পায়। কেন না, একবার একটা উদ্দীপনায় কার্যকরভাবে সাড়া দেওয়া হয়ে গেলে মস্তিষ্ক সেই খবর পাওয়ার পর আর তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। এই প্রতি-বেদন পদ্ধতি (feedback mechanism)-কে একজন বিশিষ্ট সোভিয়েত মনোবিজ্ঞানী পিওতর্‌ কুৎস্‌মিচ আনোখিন (১৮৯৮-১৯৭৪) নাম দিয়েছেন জবাবি সংবেদন ক্রিয়াপদ্ধতি (return afferentation system)।[1]

এই বিষয়টি নিয়ে প্রচুর গবেষণা করে তিনি দেখিয়েছেন: “প্রতিটি পরাবর্ত ক্রিয়ার পরেই প্রাণীটি খবর পায়, ক্রিয়াটি তার অভীষ্ট উদ্দেশ্য সাধন করতে পারল কিনা। এই ব্যবস্থা থাকলেই, অর্থাৎ, প্রতিটি পরাবর্ত ক্রিয়ার সঙ্গে প্রতিধ্বনির মতো অনবরত জবাবি সংবেদন চলতে থাকলেই একটা প্রাণীর স্বাভাবিক আচরণগত ক্রিয়া গড়ে উঠতে, বন্ধ হতে বা পালটে যেতে পারে, প্রাণীটিও চতুর্পাশ্বের অবস্থার সঙ্গে সুসঙ্গত অভিযোজন ঘটাতে সক্ষম হয়।”[2] বোঝাই যাচ্ছে, জীবনধারণের ক্ষেত্রে এই প্রতি-বেদনমূলক কর্মপদ্ধতির গুরুত্ব অনেক। পরে, মানুষের চিন্তন ক্রিয়ার ক্ষেত্রে আমরা এর একটা বড় ভূমিকা দেখতে পাব।

দ্বিতীয়ত, কোনও উদ্দীপক থেকে ইন্দ্রিয় দ্বারা গৃহীত একটা সংবেদন অন্তর্বাহী স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অঞ্চলে এসে পৌঁছলে সেখানকার স্নায়ুকোষগুলি উত্তেজিত হয়ে ওঠে। সেই উত্তেজনা (excitation)-র ফলে একটা স্নায়বিক তরঙ্গ তার আশেপাশের কোষগুলিতেও ছড়িয়ে পড়ে। সংযোগস্নায়ুর মাধ্যমে তার অভিঘাত নির্দিষ্ট সঞ্চালনকেন্দ্রে চলে যায়, অন্যান্য কোষগুলিকেও সজাগ করে তোলে। কিন্তু একই সঙ্গে আবার উত্তেজিত কোষগুলির মধ্যে একটা বিপরীত ক্রিয়াও শুরু হয়ে যায়— উত্তেজনা প্রশমন বা নিস্তেজনা (inhibition)। এর ফলে, আলোচ্য উদ্দীপক সরে গেলে, তার থেকে আসা সংবেদন যখন আর আসছে না, অথবা এলেও তা একঘেয়ে হয়ে পড়েছে, তখন সংশ্লিষ্ট মস্তিষ্ক কোষগুলির উত্তেজনাও ধীরে ধীরে প্রশমিত হয়ে যাবে।

এই নিস্তেজনা ক্রিয়া যে কোনও প্রাণীর পক্ষে একটা নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। এটা না থাকলে সাংঘাতিক মুশকিল হত। খাদ্যের উদ্দীপনায় একবার খাওয়ার জন্য উত্তেজিত হয়ে গেলে, খাদ্য না থাকলেও বা ক্ষুধা নিবৃত্তির পরেও উত্তেজনাটা চলতেই থাকত। অন্যান্য উদ্দীপনাতেও সেরকম হত। নিস্তেজনা ক্রিয়া চালু হয়ে গিয়ে এই ঝামেলাকে আটকে দেয়। স্নায়ুকোষগুলি রাসায়নিক পদ্ধতিতে এই উত্তেজনা প্রশমনের কাজটি বজায় রাখে। ঘুম মস্তিষ্কের একটা সাধারণ এবং উন্নততর নিস্তেজনা ক্রিয়া, যার মাধ্যমে অগ্রমস্তিষ্ক কিছু সময়ের জন্য সংবেদন গ্রহণ ও সঞ্চালন ক্রিয়া বন্ধ রাখে। নিস্তেজনা ক্রিয়া থাকে বলেই একটা উদ্দীপনায় সাড়া দেওয়ার পর তার সফল সমাপ্তির খবর পেলে নতুন করে সংবেদন না আসা পর্যন্ত মস্তিষ্ক আর একই সঞ্চালন ক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করে না।

যে কারণেই হোক, যাদের মস্তিষ্কের সংবেদক অঞ্চলের স্নায়ুকোষগুলির নিস্তেজনা ক্রিয়া দুর্বল বা অক্ষম হয়ে পড়ে, তাদের হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হতে দেখা যায়। যে কোনও ঘটনায় তাদের মস্তিষ্ক একবার উত্তেজিত হলে তার রেশ আর সহজে কাটতে চায় না। তাই পাভলভ বলেছেন, “আমাদের সমগ্র স্নায়বিক কার্যকলাপের দুটি পরস্পর সম্পর্কিত বিপরীত প্রক্রিয়া হল উত্তেজনা আর নিস্তেজনা। এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষিত হওয়ার ওপরেই নির্ভর করে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য।”[3]

তৃতীয়ত, উচ্চতর স্তন্যপায়ী প্রাণীর আচরণে একটা বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এরা নিম্নতর প্রাণীদের মতো এক একটি উদ্দীপনায় আলাদা আলাদা করে সাড়া দেয় না, একটা বিশেষ মুহূর্তে অনেকগুলি উদ্দীপকের সংবেদনে একত্রে সাড়া দেয়। যেটা একটা সুসংবদ্ধ আচরণ। যা দেখে অনেক সময় মনে হতে পারে, এরা বোধহয় বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করতে সক্ষম।

যেমন, ধরা যাক, একটা বেড়াল এক জায়গায় ইঁদুর ধরার জন্য ওঁত পেতে বসে আছে। আবার কাছাকাছি একটা সাপের গন্ধও নাকে আসছে। বেড়াল বাহাদুর কী করবে? সে কি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবে? না, সেই সমস্যা তার হবে না। তার মস্তিষ্ক ইঁদুর এবং সাপের গন্ধের মধ্যে তুলনা করে যেটার তীব্রতা বেশি তার প্রতিই মনোযোগ দেবে। যদি ইঁদুরের গন্ধ শক্তিশালী হয়, তার দিকেই সে নজর দেবে, যদিও সাপ সম্পর্কেও সে সতর্ক থাকবে। আর যদি সাপের গন্ধই তীব্রতর হয়, তাহলে সে সাবধান হয়ে যাবে, ইঁদুরের দিকে ফিরেও তাকাবে না। কেন না, ইঁদুরের দিক থেকে তার আক্রান্ত হওয়ার ভয় নেই।

আর দু-একটা সুপরিচিত উদাহরণ নেওয়া যাক।

বাড়ির পোষা কুকুরকে শিশুরা অনেক সময় নানাভাবে উত্যক্ত করে। কান মুচড়ায়, লেজ টানে, ইত্যাদি। কুকুর কিন্তু সহজে তাদের কামড়ায় না। অথচ কোনও অপরিচিত লোকজন দেখলেই ঘেউঘেউ করে ওঠে। বাড়ির পোষা বেড়াল লেজ মাড়িয়ে দিলে পরিচিত লোককে কামড়ালেও দাঁত ফোটায় না। এইসব ঘটনা থেকে বোঝা যায়, কুকুর বেড়াল থেকে শুরু করে সমস্ত উচ্চতর স্তন্যপায়ী প্রাণী বাহ্যিক পরিবেশ সম্পর্কে একটা পূর্ণাঙ্গ অনুভূতি লাভ করতে ও তার ভিত্তিতে বিভিন্নরকম আচরণ করতে পারে। মস্তিষ্কের সাহায্যে পরিবেশ ও উদ্দীপক সম্বন্ধে এই রকম প্রেক্ষামূলক অনুভূতি লাভের ঘটনাকে বলা হয় প্রত্যক্ষণ (perception)।

বিজ্ঞানের যে শাখায় পশুপাখিদের এই জাতীয় সাড়াগুলিকে অধ্যয়ন করা হয় তার নাম আচরণবিদ্যা (ethology)। সেখানে সংবেদন ও প্রত্যক্ষণের মধ্যে যে পার্থক্য সূচিত করা হয় তা এই রকম: সংবেদন হল ইন্দ্রিয় দ্বারা বাইরের পরিবেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে মস্তিষ্কে প্রেরণ; আর প্রত্যক্ষণ হল বিভিন্ন সংবেদনগুলিকে মস্তিষ্কে সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশ সম্পর্কে বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে একটা সামগ্রিক অনুভূতি তৈরি করা এবং তার দ্বারা উদ্দীপনায় সাড়া দানের কাজ নিয়ন্ত্রণ করা।[4]

আর, একটা প্রাণীর আচরণের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষণের ভূমিকা হল দ্বিবিধ: “(a) the organization of sensations into percepts; (b) the utilization of percepts in the control of responses to the environment which caused the original sensations.”[5] এই অনুভূতিগুলি যেন ছবি (image)-র মতো মস্তিষ্কে স্মৃতি হিসাবে ধরা থাকে। তবে আনুষঙ্গিক সংবেদনগুলির আগমন দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ হয়ে গেলে তার প্রত্যক্ষণের প্রক্রিয়াও বন্ধ হয়ে যায় এবং সংশ্লিষ্ট ছবি মুছে যায়।

তাহলে, উচ্চতর স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলির আচরণকে এইভাবে বোঝানো যায়:
সংবেদন → প্রত্যক্ষণ → অঙ্গসঞ্চালন → জবাবি সংবেদন।

এই প্রক্রিয়াকে নীচের ছকে আরও স্পষ্ট করে রাখা হল।

কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্ক সংক্রান্ত এই সব বিষয় জানার ফলে একটা জিনিস পরিষ্কার হল। মানুষ সাধারণত নিজের আচরণের সঙ্গে তুলনা করে কুকুর বেড়াল বাঘ সিংহ বানর পাখি ইত্যাদির নানা কাজকর্মের উপর নিজেদের অজান্তেই অনেক মানবোপম বৈশিষ্ট্য আরোপ করে ফেলে। এমনকি চার্লস ডারউইনের মতো বিশিষ্ট জ্ঞানীরাও করেছেন। কিন্তু এখন জানা গেল, এদের যে আচরণগুলিকে ওপর থেকে খুব বুদ্ধিদীপ্ত বলে মনে হয়, তা আসলে একদিকে অসংখ্য শর্তাধীন পরাবর্ত অর্জন ও বর্জনের ক্ষমতা, অপরদিকে জটিল থেকে জটিলতর প্রত্যক্ষণ আয়ত্ত করার ক্ষমতা। তাছাড়া, পশুপাখিকে পোষ মানানো, রাস্তায় বা সার্কাসে তাদের দিয়ে খেলা দেখানো কীভাবে সম্ভব হয়, সেই রহস্যও এর ফলে উদ্ঘাটিত হল। পুলিশ যে শিকারি কুকুরের সাহায্যে অপরাধীকে এবং/অথবা অপরাধস্থলকে খুঁজে বের করতে পারে, সেটাও আসলে অনুসন্ধানমূলক কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানারকম প্রয়োজনীয় পরাবর্ত ক্রিয়ার ট্রেনিং দিয়েই করা হয়। অনেকে ভাবেন, পুলিশের কুকুর পুলিশের চেয়েও বুদ্ধিমান। সেটা হয়তো পুরোপুরি সত্য নয়। সেই সব কুকুরের অদ্ভুত সব কার্যকলাপ দেখেই বোধহয় লোকে এরকম ভাবে। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে শিম্পাঞ্জিকে ট্রেনিং দিয়ে টেবিল চেয়ারে বসে কাঁটা চামচ দিয়ে খেতে, চাবি ঢুকিয়ে আলমারি দেরাজ খুলতে এবং স্বল্প দূরত্বে গাড়ি চালাতে শেখানো সম্ভব হয়েছিল। এও আসলে শর্তাধীন পরাবর্ত গঠন এবং প্রত্যক্ষণ ক্ষমতারই ফল।

এই ব্যাপারে কিছু সাধারণ পর্যবেক্ষণযোগ্য উদাহরণ দিলে বিষয়টা বুঝতে আরও সুবিধা হবে।

অনেকেই দেখেছেন, একতলা বাড়িতে রাতেরবেলায় বাথরুমের নালী দিয়ে বা বাইরের দিকের দরজার তলার ফাঁক দিয়ে ব্যাং ছুঁচো ইঁদুর ঘরে ঢোকে। ব্যাং খোঁজে পোকামাকড়। ছুঁচো বা ইঁদুর আসে মেঝেয় নামিয়ে রাখা থালা বাসনে বা আশেপাশে পড়ে থাকা ভুক্তাবশেষ খেতে। টের পেয়ে তখন যদি আলো জ্বালিয়ে তাড়া করা হয়, দেখা যাবে, ব্যাং ফিরে যাওয়ার পথটা চট করে খুঁজে পায় না। কিন্তু ছুঁচো বা ইঁদুর যে পথে ঢুকেছে সেই পথেই ছুটে পালায়। এর কারণ যে ব্যাঙের তুলনায় ছুঁচো-ইঁদুরের মস্তিষ্কের উন্নততর সংগঠন ও সামর্থ্য, তা নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।

বাঘ সিংহ জাতীয় মাংশাসী শিকারী প্রাণীগুলি শিকার খুঁজে পায় গন্ধ শুঁকে। বিশেষ বিশেষ শিকারের ঘ্রাণ চিনতে পারা এদের পক্ষে সম্ভব হয় শাবক অবস্থায় এদের মা শিকার ধরে এনে মুখের সামনে ধরে বলে। তারপর এই ব্যাপারটা খুব শক্তিশালী অর্জিত পরাবর্ত হিসাবে গড়ে ওঠে। এখন গন্ধ পাওয়াটা আবার নির্ভর করে হাওয়ার গতিমুখের উপর। হাওয়ার অভিমুখে চলতে থাকলে বাঘ সিংহ ভালুকের নাকে সামনে কোনও শিকার্য প্রাণী থাকলেও তার গন্ধ ঢুকবে না। তাই, জিম করবেট তাঁর নানা শিকারকাহিনিতে লিখেছেন, এরা শিকার করতে বেরিয়ে সর্বদাই হাওয়া চলাচলের বিপরীত দিকে এগোয়। এটাও এদের সহজাত ক্ষমতা নয়, শিকার ধরার ব্যর্থতা ও সাফল্যের মধ্য দিয়ে এরা এই ক্ষমতাটা আয়ত্ত করে ফেলে। বনদপ্তরের কর্মচারীদের পক্ষে তাই গভীর জঙ্গলে বুঝে নিয়ে হাওয়া যেদিকে সেই দিক বরাবর চলাই নিরাপদ। কাছাকাছি থাকলে বাঘমামারা তখন সামনের দিকে থাকবে। নজরে আসবে। হাওয়া বুঝে চলার প্রবাদ বাক্যটির উৎপত্তিও সম্ভবত এই শিকারি প্রাণীদের আচরণ থেকেই হয়েছে।

গ্রামাঞ্চলে গৃহপালিত পশুর কিছু আচরণ চোখে পড়ে যার মধ্যেও শর্তাধীন পরাবর্ত গড়ে ওঠার খুব সুন্দর উদাহরণ দেখা যায়। যারা গরুর গাড়িতে করে মাল বেচাকেনার জন্য শহরে বাজার করতে যায়, তাদের কাছে শুনবেন, যেতে যা সময় লাগে ফিরে আসতে তার চাইতে কম সময় লাগে। এটা কিন্তু শহরে যাওয়া বা আসার সময় রাস্তায় গাড়িঘোড়ার ভিড় বা গাড়িতে মালের বোঝার পরিমাণের উপর নির্ভর করে না। বাজারে সওদা কিনে ফিরে আসার সময় তো মালের বোঝা বেশিই হবে। তবুও সময় কিন্তু কম লাগে। গ্রামের লোকেরা বলেন, “ঘরমুখো গরু জোরে ছোটে।” বস্তুত, গরুগুলো শব্দ স্পর্শ সংবেদন থেকে শর্তাধীন পরাবর্ত আয়ত্ত করার ভিত্তিতে যাওয়া এবং আসার দুরকম প্রত্যক্ষণ লাভ করেছে। অপরিচিত জায়গায় থাকার চাইতে পরিচিত জায়গায় ফিরে আসার সম্ভাবনা তার গতিবেগ বৃদ্ধিতে প্ররোচিত করে। আবার গ্রামের রাখালরা যখন একটা গ্রামের সমস্ত গরু ছাগল ভেড়াদের দূরের চারণভূমিতে চড়িয়ে এনে গ্রামে ফিরিয়ে আনে, দেখা যায়, যার যার বাড়ির পশু নিজে থেকেই চিনে চিনে ঘরে ঢুকে পড়ে। এই দৃশ্য দেখতে খুব চমৎকার লাগে।

কুকুর বেড়ালের বাচ্চাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে ছেড়ে দিলেও তারা আবার পুরনো আস্তানা খুঁজে ফিরে চলে আসে। কীভাবে আসে? পরিচিত জায়গার শব্দ ও গন্ধের সংবেদনগুলি কোন দিকে গেলে শক্তিশালী হয়, সেটা বুঝে বুঝে তারা পথ চিনে চলে আসে। যে বয়সে তাদের মস্তিষ্কে এই সব পরাবর্ত গড়ে ওঠেনি, তার মধ্যে পার করে দিলে অবশ্য তারা আর ফিরে আসতে পারবে না।

আজ থেকে চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগে প্রথম যখন মফস্বল বা গ্রামের দিকে মোটরসাইকেল ও স্কুটার চালু হয়, তখন সারা দিনে একটা রাস্তায় খুব জোর একটা দুটো বাইক চলত এবং একবার দুবার যাতায়াত করত। তখন আমরা দেখতাম, রাস্তার কুকুরগুলো বাইক দেখলেই ঘেউঘেউ করত, পেছন পেছন ধাওয়া করত। হয়তো নতুন কোনও অপরিচিত জানোয়ার বলে মনে করত। আর আজকাল কুকুরগুলি পাশ দিয়ে বাইক গেলে ফিরেও তাকায় না। কারণ, এই “জানোয়ার”-গুলোর সঙ্গে বাচ্চা বয়স থেকেই এদের এত ঘন ঘন সাক্ষাত হয় যে এরা আর অপরিচিত থাকে না। এক রকম বাইক পরাবর্ত বোধ হয় খুব দ্রুত গড়ে ওঠে। ইত্যাদি ইত্যাদি…।

 

(আবার আগামী সংখ্যায়)


[1] Anokhin. 1966
[2] Anokhin 1966, 76
[3] Asratyan and Simonov 1966, 59
[4] James 1970, 79
[5] Ibid, 81

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Trackback / Pingback

  1. ভাষা চিন্তা মন: শারীরিক অবকাঠামো — একটি সহজপাঠ [৭] – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপনার মতামত...