তারান্তিনো, সিজন দুই — বাইশ

প্রিয়ক মিত্র

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

কিছুক্ষণের জন্য থম মেরে ছিল ভগা আর রাইটু।

চায়ের দোকানটার সামনে ভিড় জমছে। আস্তে আস্তে। হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ তিরের মতো জিনিস কোথা থেকে এসে গেঁথে গেল কাঁচা মাটির দেওয়ালে? এ জিনিস কারও মাথায় লাগলে তো সে খুন হয়ে যাবে!

রোহিতাশ্বকে নিয়ে জোরদার আলোচনা শুরু হয়ে গেছে দোকানে। চা-দোকানির সাফ বক্তব্য, ওই লোকটার মাথা তাক করেই আসছিল ব্যাপারটা। ও মাথা সরিয়ে না নিলে এতক্ষণে…

লোকটা কে?

কোথা থেকে এসেছে? এই তল্লাটের? আগে কেউ দেখেছে?

কেন লোকটাকে মারতে চাইবে কেউ?

পাবলিকের নিজস্ব গোয়েন্দাগিরি শুরু হয়ে গেছে।

ভগা আর রাইটু আস্তে করে গাড়িটা এগিয়ে নিয়ে এসে একটা গাছের আড়াল থেকে দেখছিল রোহিতাশ্ব আর সপ্তর্ষিকে। একটু দূরেই ছিল ওরা। তাই ঘটনাটা বুঝতে পারেনি প্রথমে। কিন্তু রোহিতাশ্ব সপ্তর্ষিকে নিয়ে মোটরসাইকেলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ওরা আন্দাজ করে, কিছু একটা গোলমাল আছে। তাই হালকা করে নেমে এসেছিল ব্যাপারটা জরিপ করতে।

গোটা ঘটনাটা দেখে ওদের চক্ষু চড়কগাছ।

ব্যাপারটা এতটা গোলমেলে, যখন বেগুনিবাবু প্রথম ওদের রোহিতাশ্বকে ফলো করতে বলেছিল, তখন বোঝেনি ওরা। কে এই লোকটা? কেইই বা পেছনে লেগেছে লোকটার?

পাবলিক এখন কথা বলছে থানা-পুলিশ করা ঠিক হবে কি না, তাই নিয়ে।

ওরা দুজনেই বুঝতে পারল, বস আদৌ খুশি হবে না ঘটনাটা শুনলে।

 

হু হু করে ছুটছিল মোটরবাইক।

সপ্তর্ষি একবার ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, কে এরকম করতে…

প্রশ্ন শেষ হল না, তার আগেই রোহিতাশ্বর উত্তর এল, জানি না। উত্তর সপাট এবং দৃঢ়।

সত্যিই আন্দাজ নেই রোহিতাশ্বর, একেবারে আন্তর্জাতিক স্তরের স্নাইপারদের দক্ষতায় কে ছুড়ল ডার্টটা?

একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক।

১৯৭৯ সালের শেষে আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরু করল সোভিয়েত রাশিয়া। ঠান্ডা লড়াই তখন তুঙ্গে। হোয়াইট হাউসে বসে জিমি কার্টার। সেই সময় হঠাৎই একটা অপ্রত্যাশিত খবর একটু সমস্যার মধ্যে ফেলে সেই মুহূর্তে ওয়াশিংটনে কর্মরত মৌলিনাথ সেনকে। মহাকাশ-বিজ্ঞানী মৌলিনাথকে রওনা দিতে হবে ইউএস স্পেস স্টেশনে আর দিনকয়েকের মধ্যেই। এই কয়েক বছর আগে, ১৯৭৫-এ আমেরিকার অ্যাপোলো আর সোভিয়েতের সুয়েজের যৌথ মহাকাশ অভিযানের সময় ভাবা হয়েছিল, এইবার বোধহয় একখানা ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন হল বলে। কিন্তু সে গুড়ে বালি! কতটা যে সুবিধে হত, মৌলিনাথ ভাবেন‌। যতদিন এই ঠান্ডা যুদ্ধ চলবে, বিজ্ঞান নিজের পথে কিছুতেই হাঁটতে পারবে না।

গবেষণার শুরুর দিনগুলো মনে পড়লেই বিভীষিকা হয় মৌলিনাথের। স্পুটনিক থ্রি ছেড়ে দিয়েছে রাশিয়া, তার আগে স্পুটনিক দুইয়ে করে স্পেস ডগ লাইকাকে পাঠিয়েছে মহাকাশে। সে বেঁচে ফিরতে না পারলেও তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তো পড়েছে! মৌলিনাথ জানেন, তাঁর কমিউনিস্ট বাবা সেদিন আদতে যতই আহত হন, বাইরে বেশ আনন্দই প্রকাশ করেছিলেন। মৌলিনাথকে লেখা চিঠিতে যদিও লাইকাকে মহাকাশে পাঠানো নিয়ে খেদ প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু মৌলিনাথ একমত ছিল না। ভাগ্যক্রমে মার্কিন দেশে কাজ করতে এলেও তারও তো মন পড়ে ছিল লেনিনের দেশে। কলকাতায় তাঁর যৌবনে তখন নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য দাদাকে দেখেছেন মৌলিনাথ, যে দাদার বেঁচে থাকা-মরে যাওয়া নিয়ে সর্বক্ষণের দুশ্চিন্তা ছিল বাবা-মার। কিন্তু পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে একচুল টলেনি বাবা-মা। সাউথ সিঁথির সদ্য গজিয়ে ওঠা মেসবাড়িতে মাটিতে ভাত খেতে বসেছিল ওরা, দাদার খোঁজ করতে আসা পুলিশ দাদাকে না পেয়ে লাথি মেরে সকলের ভাতের থালা উল্টে দিয়ে চলে যায়। মৌলিনাথ ভেবেছিলেন, মা বূঝি কেঁদে ফেলবেন। কিন্তু একফোঁটাও চোখের জল পড়েনি তার। মা-ও বাবার মতোই দুর্ভিক্ষ থেকে তেভাগা পর্যন্ত লড়াই করা মানুষ। সব মিলিয়ে মৌলিনাথের ভেতর ওই আগুনটা ছিল। মার্কিন মুলুকে যখন তিনি গবেষণা করতে এলেন, তখন তাঁর বাবা অবশ্য একেবারেই বাধা দেননি। কারণ মৌলিনাথের মূল লক্ষ্য ছিল বিজ্ঞানসাধনা। আর সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই মৌলিনাথ মনে করেছিলেন, স্পেস ডগ পাঠানোটা এমন কিছু অপরাধ নয়, কমিউনিজম-বিরোধী কাজও নয়। বাবাকে খোলা মনেই নিতে বলেছিল সেই ঘটনাকে মৌলিনাথ। কিন্তু আমেরিকা সেসময় উত্তাল। একদিকে রাশিয়াকে টেক্কা দেওয়ার যাবতীয় জারিজুরি, অন্যদিকে চাঁদে যাওয়া নিয়ে সে কী হুটোপাটি! প্রতিযোগিতা করে কি আর বিজ্ঞানচর্চা হয়?

যাই হোক, সাত-পাঁচ ভেবে লাভ নেই। যে আভাস তিনি পাচ্ছেন, তা হাতেনাতে মিলিয়ে দেখতেই হবে। আর এই ব্যাপারে তার একমাত্র সঙ্গী হতে পারে শাহিদ। শাহিদের মতো প্রতিভাবান ছেলে খুব কম দেখেছে মৌলিনাথ। তাই গার্ডনার সাহেবকে আগেভাগেই ওর কথা বলে রেখেছিল মৌলিনাথ।

কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা হচ্ছে, আজ সকালে ল্যাবরেটরি ছেড়ে চলে গেছে শাহিদ‌। চিঠিতে লিখে গেছে, সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধে যোগ দেবে সে, আফগানিস্তানের প্রতি তার প্রচ্ছন্ন সমর্থন থাকতেই পারে, কিন্তু এক্ষেত্রে সে সোভিয়েতকেই সমর্থন করছে। সে মিলিটারি পরিবারের ছেলে। যুদ্ধ জানে। সোভিয়েত যদি তাকে সেনাবাহিনিতে যোগ দিতে না দেয়, সে ডাক্তারি করবে। কারণ, ডাক্তারিটাও সে ভালোই জানে!

পাগল!

বেছে বেছে এই সময়টাই শাহিদকে বেছে নিতে হল! সে তো জানত, কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে তাদের এই অভিযান! তাছাড়া, হতে পারে, শাহিদের বাবা নেতাজির ফৌজে ছিলেন, কিন্তু তা বলে তার মধ্যে তো এরকম যুদ্ধবাজ সত্তা তো কোনওদিন দেখেননি মৌলিনাথ। সে সোভিয়েত-অন্তপ্রাণ, একটু বাড়াবাড়ি রকমেরই, সেকথা ঠিক। কিন্তু তা বলে…

–হেই মল্লি, স্টিভ ইজ কলিং ইউ।

স্টিভ গার্ডনারের ব্যক্তিগত সচিব অ্যাঞ্জেলা ডাকল মৌলিনাথকে। মৌলিনাথের ঠোঁটের কোণে একটা হাসি দেখা দিল। অ্যাঞ্জেলা এখনও তাঁর নামটা সঠিকভাবে বলতে পারে না। গার্ডনারের দেখাদেখি ওও ভুল উচ্চারণটাই করে।

মৌলিনাথের হঠাৎ কী খেয়াল চাপল, এত দুশ্চিন্তার মাঝেও, তিনি অ্যাঞ্জেলার হাত ধরে মারলেন একটা হ্যাঁচকা টান, তারপর তার ঘাড়ে-গলায় পাগলের মতো আদর করতে করতে শুয়ে পড়লেন সামনের বিশাল টেবিলে। একটু একটু করে অ্যাঞ্জেলা আর নিজেকে উন্মুক্ত করতে লাগলেন তিনি।

–ওহ মল্লি… নট নাও! স্টিভ ইজ পিসড অফ!

শান্ত হলেন মৌলিনাথ। প্রকৃতিস্থ অবস্থায় ফিরলেন। শার্টে বুকের বোতাম লাগাতে লাগাতে এবার অ্যাঞ্জেলা বলল— হোয়াট অ্যাবাউট শাহিড? এনি আপডেট?

অন্যমনস্ক মৌলিনাথ জামা ঠিক করতে করতে মুচকি হেসে বললেন— ইউ ক্যান প্রোনাউন্স হিজ নেম কোয়ায়েট প্রপারলি! ওহ অ্যাঞ্জেলা, আই থিঙ্ক, ইউ আর স্লিপিং উইথ দ্য রং গাই!

–শাট আপ! ফাক অফ!

রাগত অ্যাঞ্জেলা গটগট করে বেরিয়ে গেল কনফারেন্স রুম থেকে‌।

মৌলিনাথ নিজেকে কিঞ্চিৎ গুছিয়ে নিয়ে ঢুকলেন গার্ডনারের ঘরে। তাঁর আন্দাজ আছে, কী ঘটতে চলেছে।

ঘরে ঢুকেই মৌলিনাথের চোখ পড়ল, গার্ডনারের সামনের চেয়ারে বসে যে লোকটা পিছন ঘুরে আছে, তার দিকে। দশাসই চেহারার লোকটার লম্বা জুলপি, ব্রিটিশদের মতো করে স্যুট পরে। গলায় বো টাই‌। মুখে পাইপ ঝুলছে। আর লোকটা যেন অতিরিক্ত সাদা।

–হোয়াট দ্য হেল হ্যাপেনড মল্লিনাথ! আই টোল্ড ইউ, দিস গাই ইজ নট রিলায়েবল। আই ডাউটেড হিজ মুভমেন্টস ফ্রম দ্য ভেরি ফার্স্ট মোমেন্ট। নাও দিস জেন্টলম্যান ইজ হিয়ার টু স্পনসর আওয়ার এক্সপিডিশন, অ্যান্ড উই আর নট রেডি ফর দ্যাট!

অস্থির, অধৈর্য গার্ডনার। চিৎকার করছে। ওকে এখন কিছুই বোঝানো মুশকিল।

মাথা নীচু করে ছিল মৌলিনাথ। এবার ওর কাঁধে হাত রাখল লোকটা।

–নাইস টু মিট ইউ ইয়ং জেন্টলম্যান! রিচার্ড রডরিগেজ হিয়ার!

লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠল মৌলিনাথ।

হাসির আড়ালে লুকিয়ে আশ্চর্য ক্রুরতা, যেন চোখ দিয়েই ফালা ফালা করে দিতে পারে যে কোনও লাশ।

 

[এরপর আগামী সংখ্যায়]

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...