বাংলা উপন্যাসের অন্দরমহল: আঞ্চলিকতা ও বাংলা উপন্যাস

বাংলা উপন্যাসের অন্দরমহল: আঞ্চলিকতা ও বাংলা উপন্যাস | দেবকুমার সোম

দেবকুমার সোম

 



কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

পূর্বপ্রসঙ্গ: ইতিহাস ও ইতিহাসকথা

বাংলা মূলধারার সাহিত্যে আঞ্চলিকতার প্রবেশ ঘটে বস্তুবাদী উপন্যাস আন্দোলনের কারণে। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ঠিক একশো বছর আগে তাঁর কয়লাকুঠি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। যা ছিল বাংলায় সাড়া জাগানো প্রান্তভাষী মানুষের জীবনকথা। তখন ‘কল্লোল’ আর ‘কালি–কলম’-এর যুগ। বস্তুবাদী উপন্যাস রচনায় সেদিন সামিল হয়েছিলেন কমিউনিস্ট ভাবধারার লেখকেরাও। এ প্রসঙ্গে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর উপলব্ধির কথা যেভাবে উচ্চারণ করেছেন তা হল:

বাংলা সাহিত্যে এই আধুনিকতা একটা বিপ্লবের তোড়জোড় বেঁধেই এসেছিল কিন্তু বিপ্লব হয়নি, হওয়া সম্ভবও ছিল না— সাহিত্যের চলতি সংস্কার ও প্রথার বিরুদ্ধে মধ্যবিত্ত তারুণ্যের বিক্ষোভ বিপ্লব এনে দিতে পারে না।

জোরের সঙ্গে দাবি করা হয়েছিল যে, আমরা বস্তুপন্থী সাহিত্য সৃষ্টি করছি, কিন্তু প্রকৃত বস্তুবাদী আদর্শ কল্লোল, কালি-কলমীয় সাহিত্যিক অভিযানের পেছনে ছিল না।[1]

বাংলা সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান আঞ্চলিকতা। মানিকবাবু যদিও তাঁর নভেলের কোথাও খোলসা করে জানাননি কুবের মিঞা কিংবা তাদের গ্রাম বাংলাদেশের কোন‌্‌‌ জেলা কিংবা উপজেলায় অবস্থিত। তিনি স্থানীয় ভূগোল সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছিলেন পাঠকের কল্পনার ওপর। কিন্তু সেদিনের বাংলা সাহিত্যে তিনি এক বিশেষ ধরনের ভাষায় সংলাপ রচনা করেছিলেন। যে সংলাপ তখন পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে ছিল অধরা। অচেনা। ফলে পদ্মানদীর মাঝিদের আখ্যান লিখতে গিয়ে তিনি স্থানিক হয়েও সম্পূর্ণত নির্দিষ্ট কোনও স্থানকে উল্লেখ না করে সমগ্র পদ্মার ধারবর্তী যে কোনও মাঝিগ্রামের কথা লিখেছেন। এমনকি দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ফ্রেজারগঞ্জের মতো মৎস্যবন্দরে পর্যটনের মানসিকতা নিয়ে পৌঁছালে সেখানেও হয়তো অনুসন্ধিৎসু মন কুবের মাঝিদের পেয়ে যেতে পারে।

স্থানিকতায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অস্পষ্ট ধোঁয়াশা রেখে দিলেন। অন্যদিকে সংলাপ নির্মাণে তারাশঙ্কর স্থানিকতাকে ছুঁয়ে গেলেন নিজস্বতায়। যেমন হাঁসুলিবাঁকের উপকথা উপন্যাসে তিনি যে সংলাপ লিখলেন স্থানিকতার স্তর পাঠকের দরবারে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার উদাহরণ, ‘মেয়ে-পুরুষের ভালোবাসা হলে ওরা বলে— অঙ লাগায়েছে দুজনাতে। রঙ-ই বটে। গাঢ় লাল রঙ।’ বিভূতিভূষণের আরণ্যক স্থানিক কাহিনি হয়েও স্থানবিবর্জিত সংলাপে মুখর। বিভূতিভূষণ তাঁর উপন্যাসের সংলাপ রচনা করেছেন নদে-শান্তিপুরী বাংলাভাষায়। এর কারণ হয়তো তিনি নির্ধারণ করেছিলেন, যেহেতু তাঁর পাঠক বাঙালি মধ্যবিত্ত এবং তারা নদে-শান্তিপুরী বাংলাভাষায় স্বচ্ছন্দ, তাই সেই ভাষায় উপন্যাস লেখাটা সমীচীন। ব্যাপারটা উচিত-অনুচিতের বিষয় নয়। লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল। বিভূতিভূষণ মনে করেছেন লবটুলিয়ার জঙ্গলে মটুকনাথ পাঁড়েকে আবিষ্কার করে তাঁর সঙ্গে নাগরিক বাংলা ভাষায় কথোপকথন লেখা হলে নিশ্চিত মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে ওঠে না। মটুকনাথ তার পরিচয় দেয় স্পষ্ট নাগরিক বাচনভঙ্গিতে। ‘লোকটা উঠিয়া আমার দিকে আশীর্ব্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুলিল। বলিল— হুজুর, আমার নাম মটুকনাথ পাঁড়ে, ব্রাহ্মণ, আপনার কাছেই যাচ্ছি।’

পরবর্তী সময়ে আঞ্চলিক বিষয়ভিত্তিক বাংলা সাহিত্যে আমরা দেখতে পাই সংলাপ অংশেও আঞ্চলিকতার খানিক ছোঁয়া থেকে যাচ্ছে। কারণ সম্ভবত এই, তখন থেকে আর পর্যটকের দৃষ্টিতে আঞ্চলিক বিষয়ে সাহিত্য লেখা হচ্ছে না। রাজনীতির ভাবধারায় লিখিত সতীনাথের ঢোঁড়াই চরিতমানস উপন্যাসে ভাষার দিকে আমরা একটু খেয়াল করে দেখতে চাই।

বাবুলাল ঐ কাপড় দেখে বলে, বাওয়া তুমি পরতে লেঙট। তুমি এ পাড়ওয়ালা কাপড় নিয়ে করবে কী। সরকারী ‘গিরানির’ দোকান আছে না, সেখান থেকে হাকিম, বাঙালীবাবু আর চাপরাসীদের শস্তায় কাপড় চাল দেয়, সেখান থেকে আমি পেয়েছি খুব ভাল মার্কিন, ‘জাপৈনী’ (জাপানী) আট আনা করে, পাঁচশ পঞ্চান্ন নম্বর থেকেও ভাল জিনিস।[2]

এখানে সতীনাথ তার ভাষা পালটালেন না। বরং প্রমিত বাংলায় সংলাপ লিখেছেন। কেবল চরিত্রের স্থানিকতা বোঝাতে কয়েকটা শব্দের আঞ্চলিক উচ্চারণ উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখে তিনি পৃথক করলেন। পাঠে অনুভব করা যায় সতীনাথ কিংবা বিভূতিভূষণ বঙ্কিমচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথের সৃজিত সংলাপ প্রকরণ থেকে বিচ্যূত হতে চাননি। আর সাহিত্য জীবনের প্রথম পর্বে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আঞ্চলিক সংলাপ ব্যবহার করেও পরবর্তীকালে ফের সরে এসেছিলেন মূলধারার সংলাপ রচনায়।

বাংলা উপন্যাস প্রাকৃতজনের মুখের ভাষায় মুখরিত হল দেশভাগে অব্যহিত পরেই। পূর্ব পাকিস্তানে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর লালসালু উপন্যাস রচনা শুরু করেন কলকাতায়। যখন তিনি দ্য স্টেট‌্‌সম্যান পত্রিকায় কর্মরত। এই উপন্যাস শেষ হয় ১৯৪৮ সাল নাগাদ। যখন তিনি ঢাকায় অবস্থান করছেন। শুরুতে এই উপন্যাস স্বাভাবিকভাবেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। প্রথম সংস্করণে দু হাজার কপি ছাপানো হয়। কিন্তু মাত্র দুশো কপির মতো বিক্রি হয়েছিল। বাংলা উপন্যাসসাহিত্যে লালসালু রচনা করে ওয়ালীউল্লাহ নতুন এক অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছেন। লালসালু উপন্যাস নির্মাণে সংলাপের তীক্ষ্মতাকে অথর ওয়ালীউল্লাহ এমন এক স্তরে উন্নীত করেছেন যে আজ প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শতাব্দী পার হয়ে এসেও সেই সংলাপ সপাট। অনণুকরণীয়। সমকালীন।

বতোর দিন ঘুরে আসে, আবার পেরিয়ে যায়। মজিদের জমিজোত বাড়ে, সঙ্গে–সঙ্গে সম্মানও বাড়ে। গাঁয়ের মাতব্বর ওর কথা ছাড়া কথা কয় না; সলাপরামর্শ, আদেশ–উপদেশ, নছিহতের জন্য তার কাছেই আসে, চির নীরব সালু কাপড়ে আবৃত মাজারে মুখপাত্র হিসেবে তার কথা সাগ্রহে শোনে, খরা পড়লে তারই কাছে ছুটে আসে খতম পড়াবার জন্য। খোদা রিজিকদেনেওয়ালা এ–কথা তারা আজ বোঝে। মাঠের বুক গান গেয়ে গজব কাটানো যায় না, বোঝে। মজিদও আত্মবিশ্বাস পায়। মজিদ সাত ছেলের বাপ দুদু মিঞাকে প্রশ্ন করে,

—কলমা জান মিঞা?

ঘাড় গুঁজে আধাপাকা মাথা চুলকায় দুদু মিঞা। মুখে সলজ্জ হাসি।

–হাসিও না মিঞা।

থতমত খেয়ে হাসি বন্ধ করে দুদু মিঞা।”[3]

এর কিছু পরে সংলাপ আরও মাটির সংলগ্নতা পায়:

একদিন ধাড়ি ধাড়ি ছেলে কয়েকটি পাকড়াও করে মজিদ।

—কী রে ব্যাটা, খৎনা হইছে?

একটি ছেলে আরেকটিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে,

—অর অয় নাই।

সে রেগে বলে,— অরও অয় নাই।[4]

বাংলাভাষার আঞ্চলিকতার বিস্তার এতটাই যে এক সময় বলা হত প্রতি দু ক্রোশ অন্তর বাংলাভাষার বাচনভঙ্গি পালটে পালটে যায়। কেবল বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরা এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে বাংলাভাষার এত রকমফের যে, চট্টগ্রামের মানুষের সঙ্গে ঝাড়গ্রামের মানুষের কথপোকথনের সময় একজন দোভাষীর প্রয়োজন। এর বাইরেও রয়ে গেছে আন্দামান কিংবা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাংলাভাষীদের কলোনির বুকনি কিংবা দ্বারভাঙা বা নাগপুরের বাঙালিদের ভোকাবুলারি। আর বর্তমান প্রজন্ম যারা তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের সঙ্গে জড়িত, যারা দক্ষিণভারত বা বিদেশবাসী বাঙালি, তাদের প্রতিদিনের বাংলাভাষার ব্যবহারকে মাপতে চাইলে এক নতুন রামধনু সৃষ্টি হবে। আর সেই রামধনুর রং নিশ্চিত গণনা করা যাবে না। ঔপনিবেশিকতার দুষ্ট ক্ষত প্রান্তিক বা মার্জিনাল মানুষের মুখের কথাকে মিউজিয়ামে পাঠিয়ে দেওয়ার কারসাজি। তাই বাণিজ্যিক বা কর্পোরেটলালিত সাহিত্য সব সময় চেষ্টা করে যায় শাসকের ভাষাকেই সাহিত্যের ভাষায় প্রয়োগ করতে। কিন্তু সেই অপচেষ্টার বাইরে চলে গিয়ে কখনও কখনও প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকও প্রান্তভাষীর সংলাপকে সাহিত্যে মর্যাদা দেন। আর তার ফলে তৈরি হয় এক সংঘাতমুখর সাহিত্যিক অন্তর্ঘাত। আমরা এখানে দুটো পৃথক আলোচনায় স্পষ্ট করতে চাই আমাদের এই যুক্তি।

‘হুজুর, মুই আসি গেছু, মুই ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মন।’ ফরেস্টার তার দুটি হাত জোড়া করতে চায়, কিন্তু সেটা কিছুতেই হয়ে উঠতে পারে না। দুটো হাতের যেন দু-ধরনের গতি ও ভার। বাঁ হাতটা ওঠে ত ডান হাতটা ওঠেই না। বাঁ হাতটাকে নমস্কারের ভঙ্গিতে অনেকখানি তুলে ফরেস্টার চোখ কুঁচকে দেখে তার ডান হাতটি নেই, চোখটা আরো পাকিয়ে সে যেন বুঝে উঠতে চায়, ডান হাতটা গেল কোথায়।

… এবার হেসে বলে, ‘হুজুর, আসি গেইছি। মুই ফরেস্টারচন্দ্র। ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মন। দেখি নেন। মোর মুখখানা, দেহখানা, দেখি নেন। টর্চ ফিকেন, কি ম্যাচিসের কাঠি জ্বালান। দেখি নেন। ওয়ান-টু-থিরি।[5]

বিভিন্ন রচনার সূত্রে আমরা জেনেছি জীবনের প্রথম পর্বে বিভূতিভূষণকে মুঙ্গের অঞ্চলে দীর্ঘকাল কাটাতে হয়। সেই সূত্রে রচিত তাঁর আরণ্যক উপন্যাস লবটুলিয়ার জঙ্গলজীবনের কথা। কিন্তু ভাষার কারণেই বিভুতিভূষণে আরণ্যক হয়ে ওঠে প্রান্তিক জীবনকে দূর থেকে দেখার প্রায়াস। বিভুতিভূষণ ভাষার কোনও কারসাজি করেন না। তিনি তাঁর ভাষ্যে স্পষ্ট করে দিয়েছেন, যে জীবনের কথা তিনি বিধৃত করেছেন, সেই জনজীবনের প্রতি তাঁর দরদ থাকলেও তিনি সেই শ্রেণির প্রতিনিধি নন। উল্টোদিকে রাজনীতির কারণে খুব অল্পবয়সে দেবেশ রায় মিশে গিয়েছিলেন রাজবংশী জনজীবনের সঙ্গে। তিনি উপন্যাস লেখার তাগিদে নয়, সম্পূর্ণত রাজনীতির কারণে রাজবংশীদের থালায় ভাত খেয়েছেন। শীতরাতে তাঁদের ঘরে, তাঁদেরই দেওয়া সামান্য শীতবস্ত্রে রাত কাটিয়েছেন। ফলে দেবেশ রায় ক্রমে তাঁর যাবতীয় নাগরিকতাকে বর্জন করে হয়ে উঠতে চেয়েছেন রাজবংশী জনজাতির ঘরের লোক। তিনি রাজবংশী ভাষায় ছিলেন মাতৃভাষার মতোই সাবলীল।

আমরা জানি হাসান আজিজুল হকের সৃষ্টিপ্রকরণ, তাঁর রাজনৈতিক বীক্ষা, সমাজদর্শন দেবেশ রায়ের যাপিত জীবনের থেকে বহু কিলোমিটার দূরে। হাসান আজিজুলকে দেশভাগের পরে রাজশাহীতে চলে যেতে হলেও তিনি একদিনের জন্যও বিস্মৃত হননি তাঁর জন্মভিটের মায়া। সারাজীবন তাঁর লেখায়, বেঁচেবর্তে থাকায় ধারণ করেছেন তাঁর ঘটিত্ব। তিনি শিনা উঁচিয়ে বারবার ঘোষণা করেন তার নাড়ির টান পশ্চিমবাংলার বর্ধমানে। আমরা তাঁর বহু খ্যাত আগুনপাখি উপন্যাসে সে প্রান্তিক মানুষটাকে দেখতে পাই সেই নিরক্ষর গ্রাম্য মহিলার কণ্ঠে যে আর্তি ফুটে ওঠে তা যেন স্বয়ং অথর হাসান আজিজুলের নিজস্ব উচ্চারণ:

আমি জেদ করি নাই, কারুর কথার অবাধ্য হই নাই। আমি সবকিছু শুদু নিজে বুঝে নিতে চেয়েছি। আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না ক্যানে আলেদা একটো দ্যাশ হয়েছে গোঁজামিল দিয়ে যিখানে শুদু মোসলমানরা থাকবে কিন্তুক হিঁদু কেরেস্তানও আবার থাকতে পারবে। তাইলে আলেদা কিসের? আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না যি সেই দ্যাশটো আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটি আমার লয়। আমাকে আরও বোঝাইতে পারলে না যি ছেলেমেয়ে আর জায়গায় গেয়েছে বলে আমাকেও সিখানে যেতে হবে। আমার সোয়ামি গেলে আমি আর কি করব? আমি আর আমার সোয়ামি তো একটি মানুষ লয়, আলেদা মানুষ। খুবই আপন মানুষ, জানের মানুষ, কিন্তুক আলেদা মানুষ।[6]

হাসান আজিজুল একজন প্রান্তিক মানুষের মুখের সংলাপ দিয়ে স্পষ্ট করে দিয়েছেন স্বাধীনতার নামে দেশভাগ, ধর্মের জিগির তুলে দেশভাগ কেমন অবিমৃষ্যকারিতা ছিল প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর অ্যাজেন্ডায়।

আমরা এবার নজর ঘোরাতে চাই বাংলা উপন্যাসের বিকল্প স্রোতমুখী যে সাহিত্য, সেখানে প্রান্তিক মানুষেরা, তাদের জনগোষ্ঠী কীভাবে উঠে আসছে। রামচন্দ্র প্রামাণিক রচিত হাথক দরপণ এই সময়ের এমন এক ব্যতিক্রমী উপন্যাস, যেখানে ঔপন্যাসিক ঔপনিবেশিক নভেল কাঠামোকে কেবল ভেঙে ফেলেননি, তাঁর কলমে নির্মমভাবে উঠে এসেছে উত্তর চব্বিশ পরগণার লোকজীবনের কথা। সে কথা বড় ক্রূর। বেদনাবিধুর। ‘প্রসূতি ও নবজাতক’ এমন একটি অধ্যায়, যেখানে প্রান্তিক মানুষের লোকাচারের বর্ণনা রামচন্দ্রের লেখনীতে কেমন সজীবতা পায়।

বধূটির গর্ভধানের সাথে সাথে শশুড়ির আচার-বিচার বেড়ে যেত— তুলসীতলা গৃহদেবতার বাড়িতে। গর্ভের প্রাণকে রক্ষা করতে হবে হাজার হাজার নৈসর্গিক অনৈসর্গিক বিপত্তি থেকে। গর্ভিণীর বাইরে বেরুনো বারণ দুপুরবেলা সন্ধেবেলা। চুল খুলে রাখা বারণ। বড়ো করে টিপ পরা বারণ। চোখে পড়ার মতো সাজগোজ করা বারণ। একা একা বাইরে যাওয়া বারণ। কাপড়ে গিঁট দিয়ে রাখতে হবে। এটি একটি ‘তুক’।[7]

মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক, বিশেষত প্রান্তিক মানুষের সম্পর্ক অতি নিকট। উদ্ভব যখন তার ছেলেকে শেখায় কীভাবে খেজুর গাছে ভাঁড় টাঙাতে হবে, তখন সে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলে, ‘ভাঁড়ের কানা যেন নলিতে ধাক্কা না দেয়। তাহলে নলি উপড়ে পড়ে যাবে, সারারাত্রি রস গড়াবে গাছের গায়ে। গাছের কোনও খেতি যেন না হয় বাবা। খেয়াল রেখো।’ হাথক দরপণ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের লোকজীবনকে উত্তর ঔপনিবেশিক সময়কালে নতুন দৃষ্টি দিয়েছে। যা বাংলার নিজস্ব। যার উৎস সম্ভবত ‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসে ঠগচাচার সংলাপ রচনার মধ্য থেকেই।

ঔপনিবেশিক সময়কালে নাগরিক বাবুসমাজ যারা জাতে উচ্চবর্ণের হিন্দু এবং কলকাতা শহরের সম্পন্ন মানুষ ছিলেন, তাঁরা ছোটনাগপুরের বিভিন্ন ছোট-ছোট শহরে তাঁদের নিজেদের উপনিবেশ তৈরি করে নেন। এবং ঔপনিবেশিক রাজনীতিকে অন্ধের মতো অনুকরণ করে ডালটনগঞ্জ, মধুপুর, চাঁইবাসা, রাঁচি, গিরিডি, শিমুলতলা এমন বহু অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষদের ওপর চাপিয়ে দেন তাঁদের লালিত শিল্পসংস্কৃতি। যা ছিল মূলত ব্রিটিশদের ব্যর্থ অনুকরণ। ফলে আদিবাসী সমাজ অধ্যুষিত এসব জায়গায় ভদ্রকুলের বাঙালি সন্তানরা হলেন ড্যাঞ্চিবাবু (কথাটার উদ্ভব হয়েছে ইংরাজি ‘ড্যাম চিপ’ শব্দ বন্ধন থেকে। তখনকার দিনে ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের অর্থনীতি ছিল শহর কলকাতা থেকে বেশ খানিকটা সস্তার। ফলে সেখানে ফূর্তির সব উপকরণ তখনকার দিনের বাবুদের কাছে ছিল ‘ড্যাম চিপ’)। পরবর্তীকালে সাঁওতাল জনজাতির লবজে এইসব ভদ্দরলোকেরা হলেন ‘দিকু’। আর দিকুদের চোখে ছোটলোক আদিবাসীরা ‘টুডু’। দিকুদের আজও সম্মানের চোখে দেখে না আদিবাসী সমাজ।

উত্তর-ঔপনিবেশিক কালে যখন হিপি সংস্কৃতির তীব্র আকর্ষণ ঢেউ তুলল ভারতভূমিতে (বিশেষত কাশী বা কাঠমান্ডু, যেখানে সস্তায় উৎকৃষ্ট গাঁজা পাওয়া যায়), তখন ড্যাঞ্চিবাবু সম্প্রদায়ের পরবর্তী প্রজন্ম, যাঁরা বাংলা সারস্বত সমাজের আগামীদিনের উজ্জ্বল নক্ষত্র হবেন, তাঁরা দল বেঁধে ছুটলেন সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও, কুর্মি কিংবা ভূমিজ অধ্যুষিত এইসব পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে। ততদিনে বাঁচার তাগিদে খ্রিস্টান বনে গেছে আদিবাসীপাড়ার পরবর্তী প্রজন্ম। উদ্দেশ্য খুব মহান। এসব আদিবাসী জীবনে দু-একদিন পর্যটকের মতো হুল্লোড়বাজি করা। সস্তায় লিটার-লিটার হাঁড়িয়া, তাড়ি, মহুয়া কিংবা পচাই খেয়ে, বনবাংলোর চৌকিদারের বউয়ের হাতে দেশি মুরগির ঝোল খাওয়া। আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিনি পয়সায় আদিবাসী দুহিতার যোনিছেদন। তারপর ফের হুল্লোড় করে নিজের আকাশের নীচে ফিরে যাওয়া। আদিবাসী জীবন নিয়ে কবিতা লেখা। উপন্যাস, গল্প লেখা। শারদীয় সাহিত্য পত্রিকায় সেসব সাপ্লাই করা। এহ বাহ্য। খালাসিটোলা কিংবা বিভিন্ন মদের ঠেকে অন্য নাগরিক বন্ধুদের উসকে দিয়ে জাহির করা কে ক লিটার হাঁড়িয়া বা তাড়ি খেতে পারেন। কে এক রাতে কতজন আদিবাসী রমণীকে ছেদন করতে পারেন। মদের ঠেকে বসেই প্ল্যান করে নেওয়া আগামী হুল্লোড়বাজির গন্তব্য ও করণীয় কর্তব্যসকল। এইসব প্রথিতযশ সারস্বত সমাজের ভদ্রজনেদের এজেন্ট থাকতেন ওইসব অঞ্চলে। তাঁরাও বেশ লেখকটাইপ। কলকাতার পত্রপত্রিকায় তাঁদের ‘টুকটাক’ লেখা ছাপা হয়। এর মধ্যে যাঁরা নেতাগোছের, তাঁরা আবার পরের মরশুমে পর্যটনের সময় তাঁদের স্বজন কিংবা অনুজ মেধাজীবীদের হাত ধরে চিনিয়ে দিতেন পচাই, হাঁড়িয়ার ঠেক। তাঁদের পরিচিত মেয়েমানুষদের দান করে দিতেন দলের নবাগতদের। কারণ তাঁরা তখন অন্য কোনও আদিবাসী রমণীর কোমল তনুর হদিস পেয়ে গেছেন। এই বাস্তুশৃঙ্খল কিংবা বাস্তুঘুঘুর দঙ্গল ভাঙতে একজন মহিয়সী নারী সেদিন কলম ধরেছিলেন। তিনি দিনের-পর-দিন আদিবাসী সমাজে পড়ে থেকে তাঁদের জীবন আর সংস্কৃতিকে আমাদের পাঠ্যবস্তু করে তুলেছিলেন। তাঁর নাম মহাশ্বেতা দেবী। তবে একা এক নারীর পক্ষে এই সমবেত নারীশরীর ভোগকাতর সারস্বত সমাজের সঙ্গে কি পেরে ওঠা সম্ভব? না পারার কথা? বিশেষত যাঁরা তখনকার দু দিনের সাঁওতাল পরগণার মোচ্ছব নিয়ে সাহিত্যচর্চা করতেন, তাঁরা যেমন দীর্ঘ কয়েক প্রজন্ম উৎপাদনশীলতার বাইরে থেকেই ওপর-ওপর রগরগে রোমান্টিক উপন্যাস লিখেছেন, ঠিক তেমনই তো যাঁরা এইসব সাহিত্যের ভোক্তা, সেই সব পাঠকসমাজও দীর্ঘ কয়েক প্রজন্ম ধরে জলজমির লড়াই থেকে বিচ্যূত। ফলে মহাশ্বেতা দেবীর সেদিনের কাতর স্বর আর পৌরুষমেশা উপন্যাসগুলো বাংলা সাহিত্যের মজা খালে কোনও তরঙ্গ তুলতে পারেনি। বরং তাঁকে আর তাঁর লেখাকে হাস্যকরভাবে তুচ্ছ করা হয়েছে। সেই কলঙ্কের ইতিহাস বাংলা উপন্যাসের গা থেকে এখনও যায়নি। এখনও বাংলা সাহিত্যের দামড়া নায়কদের পরবর্তী প্রজন্মের ছোট নক্ষত্ররা সাঁওতাল পল্লীগুলোতে যান। চেষ্টাচরিত্র খুব করেন। তবে দিন পাল্টেছে। দিকুদের মতো টুডুরাও আজ বেশ সেয়ানা হয়ে গেছে। ফলে বিনা পয়সায় আদিবাসী মেয়েছেলে পাওয়া এখন দুর্লভ ব্যাপার। ফলে মন চলো নিজ শান্তিনিকেতন বা মন্দারমণি।

সাঁওতাল কিংবা মুন্ডাদের এখনও ভদ্রলোকেরা মাঝি বলে। কেন বলে? এই ভ্রান্তির কারণ কী? প্রায় দুশো বছর ব্রিটিশদের পা চেটে আমাদের পিতা-প্রপিতামহরা শিখিয়ে দিয়ে গেছেন সাঁওতাল, মুন্ডারা আদিবাসী। তাঁরা মানুষ নন। ফলে ‘মাঝি’ বা ‘মাঝিন’ এমন একটা বন্ধনীতে সকলকে আটক করে বাংলা সাহিত্যের পচা খালে মহান সাহিত্যিকেরা নাও ভাসিয়েছেন। আর যেহেতু তাঁদের পাঠক টার্গেট সেই ব্রিটিশের পা-চাটাদের পরবর্তী প্রজন্ম, তাই পাঠকও ধর্মগ্রন্থের মতো কপালে ঠেকিয়ে কুলুঙ্গিতে রেখে দিয়েছে প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে অবমাননাকর সেইসব উপন্যাসগুলোকে। সিনেমায় ব্যবহার হয়েছে সে-সব কাহিনি (সেখানেও ব্যাখ্যাকার ঔপনিবেশিক মানসিকতায় বেড়ে ওঠা)। সস্তার লোকেশন হিসাবে ব্যবহার হয়েছে ছোটনাগপুর মালভূমি। বাহাসুন্দরীদের মুখে ‘কেনে’, ‘বটে’ এমন মুখচলতি বুকনি দিয়ে ফাটিয়ে দিয়েছে।

এর বিপ্রতীপে রচিত অনুপম দত্তের বোঙারুম নাচ ও শকুন কথা উপন্যাস। মুন্ডাদের যেমন প্রধান দেবতা মারাংবুরু, সাঁওতালদের তেমনই গিদিবোঙা (অর্থাৎ শকুন)। সাঁওতালদের দাঁসাই পরবকে কেন্দ্রে রেখে অনুপম তাঁর ভদ্রলোক পাঠকদের সঙ্গে এক ডিসকোর্স তৈরি করেছেন এই উপন্যাসে। এখানে সে–অর্থে কোনও একরৈখিক কাহিনি নেই। কাহিনি জমিয়ে দেওয়ার মতো মশলা তো অনুপম আয়ত্ত করেননি। তিনি হাঁড়িয়া, তাড়ি কিংবা ‘দুলি’র খবর দেওয়ার জন্য কলম কিংবা কিবোর্ডে আঙুল ছোঁয়াননি। কাহিনির যেটুকু অংশ তা হল উপন্যাসের প্রধান দুই চরিত্র চুনু আর মাতাল। তারা মাঝেরপাড়া থেকে আসে দাঁসাই গুরু বুলয় মুর্মুর বাড়ি। সেখান থেকে তারা বুলয়কে নিয়ে ফিরে যায় তাদের গাঁ মাঝেরপাড়ায় দাঁসাই পরবে। কাহিনির আর কোনও বিস্তার নেই। দাঁসাই উৎসব আসলে হিন্দু বাঙালিদের শারদীয় দুর্গাপুজোর অনুসঙ্গে লেগে থাকা এক পৌরাণিক কাহিনি নির্ভর। কাহিনি সেই এক। তার রূপ দুতরফে ভিন্ন। রাবণ হত্যার জন্য রামচন্দ্রকে দেবী দুর্গার অকালবোধন করতে হয়। আর দেবী পুজোয় অত্যাবশ্যক একশো আটখানা নীলপদ্মের মধ্যে একটা যখন গুনতিতে কম পড়ে, তখন দশরথনন্দন নিজের নীল চোখ (হিটলারের দর্শনে জর্মান) উপড়ে দেবীকে দিতে চায়। তখন যে ব্যাধ জোগাড় করে দেয় সেই একশো আটতম দুর্লভ নীলপদ্ম, সেই হল টুডুদের জাতভাই। ফলে বুলয় মুর্মু কথকঠাকুরের ঢঙে তাঁর শ্রোতাদের শোনান, ‘তু দিকুরা যে দুগ‌্‌গো পুজো করছে, তার অনেক আগে থেকে আমাদের দাঁসাই পরব কিনা।… উরা মূর্তিপুজো করে মন্দিরে, আটচালায়, প্যান্ডেলে। আমরা বোঙাদের পুজো আকাশে-বাতাসে ঘরে পথে ডাঙালে, ডহরে, জঙ্গলে।’ এ তো ধর্মীয় দর্শনের কথা। নিজ ধর্মের স্বপক্ষে দার্শনিকতা। কিন্তু বুলয় মুর্মুর বুকের খাঁচার ভেতরে যে যন্ত্রণা কুড়ে-কুড়ে খায় তা হল বর্তমান প্রজন্মের অন্তঃসারশূন্য জীবনযাপন। রাষ্ট্র যাকে উন্নয়ন বলছে, তা যে মূলত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনধারা, তাদের সংস্কৃতি, তাদের বেঁচেবর্তে থাকাকে মার্জিনালাইসড করে ক্ষমতাবানদের পরিধি বরাবর টেনে নিয়ে আসা। মোটের ওপর প্রান্তিক জনজীবনকে ধ্বংস করে দেওয়ার আয়োজন। তাই দাঁসাই গুরু বুলয় মুর্মুর বুক ফেটে উচ্চারিত হয় বিচ্ছিন্নতার সংলাপ:

দেখ্‌ কেনে, আমাদের কোড়া হড়রা মেতে যেছে দিকুদের যত রংবাজি গানে লাচে। ডুবে রইতে চাইছে ভিডিউ–র মিছা সব মজাতে। দন্তক চোলাই মাল খেছে আর দিকুদের জামা-প্যান্ট পিন‌্‌হে লটর পটর করে ঘুরে বিড়াইতেছে। হাতে বান‌্‌ধছে ঘড়ি সিটার সুময় দেখতে জানে না। চুখে দিছে চশমা কত রঙের শোভা দেখছে না। কেউ কেউ আবার কানে তুলছে মানুষের সাথে কথা বলা যন্তর। তাই তারা শক্তির ভাষা বোঙাদের কথা শুনতে পেছে না।[8]

প্রান্তিক মানুষের জীবনগুলোকে কেমনভাবে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় ব্যবহার করা হয়েছে, তার স্পষ্ট ইতিহাস আমাদের কাছে তুলে ধরেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। আর আজকের অনুপম দত্তের মতো ঔপন্যাসিকেরা তুলে আনছেন একবিশ্বের মেরুকরণহীন কর্পোরেট রাষ্ট্রে প্রান্তিক মানুষদের অবক্ষয়ের চিহ্নগুলো।

প্রান্তিক মানুষের জীবনকে আজকের বিকল্প উপন্যাস ভাবনায় যারা হাজির করেছেন, তাঁদের মধ্যে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য দুটি নাম আনসারউদ্দিন এবং বিমল লামা। এই দুই ঔপন্যাসিক নিজেদের শ্রেণি অবস্থান থেকেই সৃষ্টি করে চলেছেন তাঁদের রচনাভূমি। এরা উভয়ই এক অর্থে অদ্বৈত মল্লবর্মণের সাক্ষাৎ উত্তরসূরি। আনসারউদ্দিন রচিত গো-রাখালের কথকতা যেমন আমাদের গ্রামদেশের প্রান্তিক মানুষগুলোর বেঁচেবর্তে থাকাকে এক মলাটের মধ্যে মুন‌্‌শিআনার সঙ্গে হাজির করেছে, তেমনই বিমল লামা আমাদের শুনিয়েছেন তাঁর নুন চা উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ি জনজাতির জীবনজিজ্ঞাসা। যা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মানচিত্রের মধ্যে বিরাজ করেও সমতলের সঙ্গে দুস্তর এক ব্যবধানে রয়ে গেছে।

আনসারউদ্দিন তাঁর গো–রাখালের কথকতা উপন্যাসে আমাদের শুনিয়েছেন এক আধুনিক রূপকথা। যার মধ্যে অবশ্যই অর্থনৈতিক অচলতা রয়েছে। রয়েছে নিম্নবর্গের, সংখ্যালঘুদের টিকে থাকার ধরণ-ধারণ। তাদের মাথার ওপর রয়েছে বাদল মেঘের মতো রাজনৈতিক অস্থিরতা। তবু এই কাহিনি রূপকথার মতো। একে আমরা তাই উপন্যাস না বলে যদি দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের সিদ্ধান্ত ধার করে বলি ‘কথা’, তাহলে পাঠকের আশাহত হওয়ার আপাত কোনও কারণ থাকে না। কারণ এ কাহিনি জ্যান্ত বাস্তব হয়েও আমাদের মধ্যবিত্ত অভিজ্ঞতার ঢের বাইরের জিনিস।

আমরা ছোট বয়সে পড়েছি মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুতোষ ছড়া: ‘পাখী সব করে রব রাতি পোহাইল।/ কাননে কুসুম কলি ফুটিয়া উঠিল।।/রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে।/ শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে।।’ রাখাল বা রাখালির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ এর বেশি কিছু নয়। আমরা দূর থেকে দেখেছি রাখালদের। তাদের মধ্যেও যে গোত্র বিভাজন আছে, সেটা আমাদের জানানো কোনও বিশিষ্ট তর্কলঙ্কারের পক্ষে সম্ভব নয়। তিতাসের পাড়ে মালোপাড়ার কথা বলতে গেলে যেমন মালোদের মধ্যে থেকে কোনও একজন মল্লবর্মণের প্রয়োজন হয়েছিল, ঠিক তেমনই রাখালদের সম্পর্কে আমাদের কে আর বিস্তারিত বলতে পারেন আনসারউদ্দিনের মতো মাটির উৎপাদনশীলতার সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন ‘কথাকার’ ছাড়া? আমরা যাদের রাখাল বা রাখালি বলি, তাদের মধ্যে যারা গরু চড়ায় কিংবা গরুর পরিচর্যা করে, তারাই গো-রাখাল। এটা বোঝার জন্য আমাদের অভিধানের কোনও প্রয়োজন হয় না। কিন্তু তার স্তরভেদ? অভিধানও তো শাসকশ্রেণির তৈরি আর একটা কৌশল। যার সাহায্যে ক্ষমতাবানেরা চিহ্নিত করতে পারেন সেই সব বিষয়বস্তুকে, যেগুলোর সঙ্গে উৎপাদনশীলতার যোগ আজ অপ্রাসঙ্গিক। যার থেকে বিচ্ছিন্ন শাসকসমাজ। ফলে অভিধান তন্নতন্ন করে ঘাটলেও ‘গো-রাখাল’ শব্দের আভিধানিক ব্যুৎপত্তির কোনও খোঁজ মিলবে না। এরপর পাঠকের জন্য চমক হল গো-রাখালের শ্রেণিবিন্যাসে সবচেয়ে নিচের ধাপ পেটভাতের রাখাল। দুবেলা পেট ভর্তি ভাতের চুক্তিতে যারা মুনিষ খাটে। উপাখ্যানের নায়ক হাকিমুদ্দিনকে তার বাপ পেটভাতের চুক্তিতে খানদার ফরাজির বাড়িতে সেই ছোট্টবেলায় রেখে যায়। তারপর ক্রমে-ক্রমে সে পেটভাতের রাখাল থেকে হয় গো-রাখাল। তখন তার কাজ রাখালি। তার কর্তব্য গোয়ালের দেখভাল। এরপর তার পদোন্নতি হয় পাশিতে। সেখান থেকে কাঁধি। শেষকালে সে হয় মোড়ল। এখানে মোড়ল বলতে গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান নয় নিশ্চিত। মোড়ল হল রাখালিদের নেতা। এদের সবার ওপরে থাকে শির-রাখাল। বিষয়টা সেটা নয়। বিষয়টা রূপকথার মতো অনাস্বাদিত। হাকিমুদ্দিন যেমন ধীরে-ধীরে বেড়ে উঠতে থাকে, ধীরে-ধীরে তার মনিববাড়ির অন্দরমহলে ঠাঁই হয়, ক্রমে সে ছোট শিশু থেকে কিশোর হয়। তার পদন্নতি হয়। সে প্রেমে পড়ে। তারপর তার জীবনে আসে অনাস্বাদিত যৌন অভিজ্ঞতা। ছোটভাবির বর আরজের মাথায় বাজ পড়ে মৃত্যু হলে হাকিমুদ্দিনের যে তীব্র শোক হয়, সেই শোক প্রশমিত করতে গিয়ে সদ্য স্বামীহারা ছোটোভাবি অনুভব করে শোকের মধ্যেও তাপে পুড়ে যাচ্ছে হাকিমের শরীর। যৌনঅভিজ্ঞতাসম্পন্ন ছোটোভাবি দেখে হাকিমুদ্দিনের গোঁফের রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এর মধ্যে।

যাঁরা গরু নিয়ে রাজনীতি করেন, যাঁরা রটিয়ে বেড়ান মুসলমানেরা গরুখেকো, যাঁদের (অপ)বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে গো-চোনায় সোনা পাওয়া যায়, যাঁদের চিকিৎসাব্যবস্থা এমন প্রমাণ করে দিয়েছে গোমূত্র পানে ক্যানসারের মতো মারণব্যাধি সম্পূর্ণ নির্মূল হয়, আর সারা গায়ে গোবর মাখলে করোনা মহামারি থেকে উদ্ধার হওয়া যায়, এই উপন্যাস তাদের গালে ঠাস‌্‌ ঠাস‌্‌ করে চড় মারে। একটা গোটা গ্রামজীবন, যেখানে গবাদি পশু সেই আর্যরা আসার আগে থেকেই প্রধানতম অর্থনীতি ছিল (আর্যরা কৃষিকাজ জানত না), সেই অর্থনীতি এক দরদি কথাশিল্পীর কলমে ফুটে উঠেছে। আমাদের বাংলা সাহিত্যের সাম্প্রতিক বিকল্পধারার গর্বিত সংযোজন আনসারউদ্দিনের এই কথকতা।

বিমল লামার নুন চা— চায়ের দেশের নুনকথা আর একটি বিস্ময়কর উপন্যাস। যার নমুনা বাংলা সাহিত্যে পূর্বাপর নেই। পাহাড়ি মানুষ নুন মেশানো চা পান করে। এর পেছনে রয়েছে এক প্রাচীন তিব্বতি লোকগাথা। যা দার্জিলিং আর সিকিমের পাহাড়ঘেরা অঞ্চলের মানুষগুলোর জন্ম ইস্তক জানা। নুন চা সেই জনজাতির উপাখ্যান, যাদের আমরা ‘নাক চ্যাপটা নেপালি’ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে শিখিনি। সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও কিংবা ভূমিজ মাত্রই যেমন আমাদের চোখে ‘মাঝি’ বা ‘মাঝিন’, ঠিক তেমন ভোটে, লাপচে, নেপালি, তামাং, গুরুং, গোর্খা সকলেই আমাদের সবজান্তা মধ্যবিত্ত বাঙালির চোখে নেপালি। যাদের পুরুষদের সমতলের বিভিন্ন কারখানা, বিদ্যায়তন কিংবা আবাসনে সিকিউরিটি গার্ড হিসাবে দেখা যায়। যাদের সর্বজনীন নাম ‘বাহাদুর’। শিলিগুড়ি শহরে একটু ছানবিন করলে যাদের মেয়েদের দেখা পাওয়া যাবে। কলকাতার শীতঋতুতে তারা পার্কের রেলিংগুলোতে ‘ভুটিয়া সোয়েটার’-এর পশরা নিয়ে বসে। ব্যাস এই হল পাহাড়ি মানুষদের সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান। অথচ সেই গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সময় থেকেই আমরা আমোদগেঁড়ে বঙ্গসন্তানেরা চিল্লে যাচ্ছি দার্জিলিংকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলাদা করা যাবে না। দার্জিলিং পশ্চিমবঙ্গেরই একটা অংশ। জবরদস্ত অংশ।

সেই পর্যটকস্থানের মানুষের জীবনকথা খানিক নেপালি আর বাকিটা সরল বাংলা বাক্যে আমাদের শুনিয়েছেন বিমল লামা। তাঁর দরদ একজন সাচ্চা ঔপন্যাসিকের মতো। তাঁর বিচারধারা একজন খাঁটি অথরের মতো। আমরা এমন লেখার প্রত্যাশায় থাকি। আর যখন হাতের মুঠোয় পেয়ে যাই এমন অত্যাশ্চার্য কথন, তখন স্বাভাবিকভাবেই বড় আপন, বড় কাছের হয়ে ওঠেন পাহাড়ি মানুষগুলো। প্রান্তিক মানুষগুলো। যাঁরা খুব সামান্য চাহিদা নিয়েই আমাদের পড়শি হিসাবে শতাব্দ থেকে শতাব্দ নীরবে থেকে গেছেন। কেবল পাহাড়ের মানুষের জীবনপ্রবাহ জানার জন্য নয়, পাহাড়ের কুয়াশাময় রাজনীতির ধাঁচ জানতে নুন চা উপন্যাসের কোনও বিকল্প নেই।

 

(আবার আগামী সংখ্যায়)


[1] বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক। সাহিত্য করার আগে; মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সমগ্র প্রবন্ধ এবং। সম্পাদনা: মণ্ডল, শুভময়; বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকান্ত। কলকাতা: দীপ প্রকাশন। প্রথম প্রকাশ: ১৯ মে ২০১৫। পৃষ্ঠা ১৩২। ISBN 978-93-84561-57-4.
[2] ভাদুড়ী, সতীনাথ। ঢোঁড়াই চরিতমানস: প্রথম চরণ; সতীনাথ গ্রন্থাবলী দ্বিতীয় খণ্ড। সম্পাদনা: ঘোষ, শঙ্খ; আচার্য, নির্মাল্য। কলকাতা: অরুণা প্রকাশনী। এপ্রিল ১৯৯২। পৃষ্ঠা ১৫।
[3] ওয়ালীউল্লাহ, সৈয়দ। লাল সালু; সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস সমগ্র। কলকাতা: নয়া উদ্যোগ। প্রথম ভারতী সংস্করণ। পৌষ ১৪০৯, জানুয়ারি ২০০৩। পৃষ্ঠা ৩১।
[4] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩২।
[5] রায়, দেবেশ। তিস্তাপারের বৃত্তান্ত। কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং। একাদশ সংস্করণ: মাঘ ১৪০৭, ফেব্রুয়ারি ২০০১। পৃষ্ঠা ৩৮। ISBN 81-7079-483-8।
[6] হক, হাসান আজিজুল। আগুনপাখি। কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং। প্রথম প্রকাশ: এপ্রিল ২০০৮, বৈশাখ ১৪১৫। পৃষ্ঠা ২৫২। ISBN 978-81-295-0820-1।
[7] প্রামাণিক, রামচন্দ্র। হাথক দরপণ। কলকাতা: ঋতাক্ষর প্রকাশন। প্রথম প্রকাশ: আগস্ট ২০০৮। পৃষ্ঠা ১১৪। ISBN 978-93-84186-08-1।
[8] দত্ত, অনুপম। বোঙারুম নাচ ও শকুন কথা। বর্ধমান: ঐক্য প্রকাশন। পৃষ্ঠা ৩৮।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

1 Trackback / Pingback

  1. বাংলা উপন্যাসের অন্দরমহল: উপন্যাসের পাঠঅভিজ্ঞতা – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপনার মতামত...