মনোনীত রাজ্যপালের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন

মনোনীত রাজ্যপালের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন | অনুপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

অনুপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

 


অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

 

প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কোনও সাংবিধানিক সঙ্কট উপস্থিত হলে তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়ম লঙ্ঘন করতে হয়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই সাংবিধানিক প্রধানের হাতে এই বিশেষ ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে। ভারতীয় প্রশাসনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিই এই দায়িত্বটি পালন করেন। রাষ্ট্রপতির মতই রাজ্যপালদের হাতেও প্রচুর ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে যাতে রাজ্যে কোনওরকম সাংবিধানিক সঙ্কট ঘটলে তা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এই কথাটা সংবিধানে খুব স্পষ্ট করে কোথাও বলা না থাকলেও অতীতে কোনওদিন কাউকেই অকারণে এই ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করতে দেখা যায়নি। সঙ্কটকালে প্রয়োগের অস্ত্র যদি সাধারণ অবস্থায় প্রয়োগ করা হয় তাহলে বোধহয় শুধু সেই কারণেই সঙ্কট ঘনিয়ে আসতে পারে। পশ্চিমবাংলায় এখন ঠিক এই সমস্যাটাই দেখা দিয়েছে। বর্তমান রাজ্যপাল ক্ষমতার প্রাচুর্যে দিশেহারা হয়ে গেছেন। এই সঙ্গে ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাঁর নিজের দলের প্রতি আনুগত্য দেখানোরও প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তাই তাঁর এক্তিয়ারে থাকা সমস্ত প্রতিষ্ঠানেরই প্রশাসনিক কাজে তিনি হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেছেন। এর ফলে সম্প্রতি তিনি বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেন। মনে রাখতে হবে রাজ্যপাল রাষ্ট্রপতির দ্বারা মনোনীত হন। অপরদিকে মুখ্যমন্ত্রী জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। এই বিতর্কও কিন্তু আজকের নয়। সংবিধান রচনার প্রথম দিন থেকেই এই বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছিল। গণপরিষদের কার্যবিবরণীতে এর উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে। কংগ্রেস নেতা শ্রীযুক্ত রোহিনী কুমার চৌধুরী ১৯৪৯ সালের ২ জুন গণপরিষদের সংবিধান সংক্রান্ত সভায় ১৬৭ নং ধারার (সেদিনের ১৪৭ নং ধারা) ওপর আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন:

It seems as if to say that the Governor is the same Governor, a representative of the British monarch and as such the Chief Minister is subject to him and must carry out his orders; it is not so under the present Constitution as we are framing it. We are not placing anybody here either as a monarch or as any representative of the monarch. There is no question of monarchy; it is a question of democracy. The Governor has no business to poke his nose into the affairs of the State which is entirely the consideration of the Ministry.[1]

রাজ্যপালকে প্রদত্ত ক্ষমতা প্রসঙ্গে সভা খুব সচেতনভাবে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত “সঙ্কট ত্রাতা” রাজ্যপালের হাতে অনন্ত ক্ষমতা রয়েই গেল আর বোধহয় সেই কারণেই বিতর্কও চলতেই থাকল। এই বিতর্ক কেবল রাজ্যপালকে নিয়েই কেন তা বুঝতে গেলে ভারতবর্ষের প্রশাসন পরিকাঠামোটি বোঝা প্রয়োজন। এই লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্যে আমরা ভারতীয় সংবিধানকে একটু বিশদে অনুধাবন করব। সংবিধানের ১ নং ধারায় ভারতবর্ষের গঠন সম্পর্কে বলা হয়েছে। যেহেতু দেশটিতে একের অধিক রাজ্য রয়েছে তাই প্রশাসনেরও দুটি স্তর আছে। একটি গোটা ভারতবর্ষের জন্যে, অন্যগুলি বিভিন্ন রাজ্যের জন্যে রয়েছে। প্রথম স্তরে আমরা যে দুজনের কথা পাচ্ছি তাঁরা হলেন রাষ্ট্রপতি (৫২ নং ধারা) এবং উপরাষ্ট্রপতি (৬৩ নং ধারা)। দুজনেই নির্বাচনের মাধ্যমে এই পদ লাভ করেন। রাষ্ট্রপতি হলেন গোটা ভারতবর্ষের প্রশাসনিক প্রধান। আমরা দুটি সভার নাম পাচ্ছি: (১) লোকসভা এবং (২) রাজ্যসভা (৭৯ নং ধারা)। এই দুটি সভা থেকেই রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রী পরিষদের অন্যান্য সদস্যদের নির্বাচন করেন। এরপর আসা যাক রাজ্যগুলির কথায়। প্রত্যেক রাজ্যে প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে একজন করে রাজ্যপাল (১৫৩ নং ধারা) আছেন। এর সঙ্গে সঙ্গে পাচ্ছি বিধানসভার (১৬৮ নং ধারা) নাম। কয়েকটি রাজ্যে (অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, তামিলনাডু, তেলেঙ্গানা এবং উত্তরপ্রদেশে) বিধানসভা ছাড়াও বিধান পরিষদের অস্তিত্বও আছে। রাজ্যপাল এই সভা(গুলি) থেকে মুখ্যমন্ত্রী এবং মন্ত্রী পরিষদের অন্যান্য সদস্যদের বেছে নেন।

সবই তো হল, কিন্তু রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে প্রতি রাজ্যের বিধানসভার সদস্যদের বেছে নেওয়া হবে কী করে? ৩২৪ নং ধারায় বলা হল দেশে একটি নির্বাচন কমিশন থাকবে তারাই এই বেছে নেওয়ার কাজটি করবে। এই ধারারই ২ নং উপধারায় বলা হল:

(2) The Election Commission shall consist of the Chief Election Commissioner and such number of other Election Commissioners, if any, as the President may from time to time fix and the appointment of the Chief Election Commissioner and other Election Commissioners shall, subject to the provisions of any law made in that behalf by Parliament, be made by the President.

নির্বাচন কমিশন প্রত্যেক রাজ্যের জন্য একটি নির্বাচক তালিকা তৈরি করবে। কারা সেই তালিকায় থাকবে? ৩২৫ নং ধারায় বলা হল দেশের সমস্ত (প্রাপ্তবয়স্ক) মানুষ জাতি, ধর্ম অথবা লিঙ্গ নির্বিশেষে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন।

এবারে দেখা যাক এই সভাগুলি কীভাবে গড়ে ওঠে। প্রথমে আসব লোকসভা এবং বিধানসভার কথায়। প্রত্যেক রাজ্যকে কতকগুলি নির্বাচনী এলাকায় ভাগ করা হয়। এই সমস্ত এলাকা থেকে নির্বাচক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকরা তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেন এবং এই প্রতিনিধিদের নিয়েই গড়ে ওঠে বিধানসভা এবং লোকসভা। ৮০ নং ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক রাজ্যের বিধানসভার সদস্যরা নির্বাচনের মাধ্যমে রাজ্যসভায় তাঁদের প্রতিনিধি পাঠাবেন। যদিও রাষ্ট্রপতির মনোনীত কয়েকজন সদস্যও রাজ্যসভায় অন্তর্ভুক্ত হন। বিধান পরিষদের সদস্যরা ১৭১ নং ধারা অনুযায়ী বিভিন্ন নির্বাচকমণ্ডলীর দ্বারা নির্বাচিত হন। এখানেও কিছু সংখ্যক মনোনীত সদস্য থাকেন তাঁরা রাজ্যপাল দ্বারা মনোনীত হন। রাষ্ট্রপতি রাজ্যপালকে ১৫৫ ধারায় নিয়োগ করেন। এই আলোচনা আর না এগিয়ে আমরা রাজ্যপাল নিয়োগ পদ্ধতিটা একটু জেনে নেব। সংবিধানের ১৫৫ নং ধারায় বলা হচ্ছে:

155. Appointment of Governor— The Governor of a State shall be appointed by the President by warrant under his hand and seal.

কোনওরকম নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে না। ১৬৪ ধারায় তাঁর ক্ষমতার কিছু আভাস পাই।

164. Other provisions as to Ministers— (1) The Chief Minister shall be appointed by the Governor and the other Ministers shall be appointed by the Governor on the advice of the Chief Minister, and the Ministers shall hold office during the pleasure of the Governor.

কী মারাত্মক কথা! নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকছেন রাজ্যপাল যাঁর কোনও গণসমর্থনের প্রয়োজন নেই। যদিও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সকলের থেকে বেশি কিন্তু তাঁকেও নির্বাচনের মাধ্যমেই আসতে হয়। এই নির্বাচনের পদ্ধতি হল:

54. Election of President— The President shall be elected by the members of an electoral college consisting of—

(a) the elected members of both Houses of Parliament; and
(b) the elected members of the Legislative Assemblies of the States.

সুতরাং আমাদের ভেবে দেখার সময় হয়েছে যে নির্বাচিত নয় এমন একজন মানুষের (রাজ্যপাল) হাতে এত ক্ষমতা দিয়ে রাখাটা কতটা যুক্তিযুক্ত। একটাই স্বস্তির কথা যে—

156. Term of office of Governor— (1) The Governor shall hold office during the pleasure of the President.

ওপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পারছি যে রাজ্যপাল এবং রাজ্যসভা ও বিধান পরিষদের কয়েকজন মনোনীত সদস্য ছাড়া আর সকলকেই নির্বাচনের মাধ্যমে প্রশাসনে আসতে হয়। রাজ্যসভা ও বিধান পরিষদের মনোনীত সদস্যদের খুব বেশি ক্ষমতা না থাকার কারণে এঁরা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নন। কিন্তু রাজ্যপাল এত ক্ষমতার অধিকারী যে তাঁর সামান্য বেচালও গোটা প্রশাসনটিকে ওলটপালট করে দিতে পারে।

কেন এমন হল? আমার মনে হয় আমরা ইংরেজ শাসনের উত্তরাধিকার এখনও বয়ে চলেছি। সেদিন গভর্নর রানির প্রতিভূ হয়ে দেশ শাসন করতেন আর তাই সঙ্গত কারণেই এঁদের অনেক বেশি করে ক্ষমতা দেওয়া থাকত। আজকের রাজ্যপালেরাও বোধহয় ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ট্র্যাডিশন সমানে বহন করে চলেছেন।  নাহলে মুখ্যমন্ত্রী, যিনি একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি তাঁর ক্ষমতা রাজ্যপালের থেকে কম হয় কী করে। ১৬৩ ধারার ২নং উপধারায় বলা হল:

(2) If any question arises whether any matter is or is not a matter as respects which the Governor is by or under this Constitution required to act in his discretion, the decision of the Governor in his discretion shall be final, and the validity of anything done by the Governor shall not be called in question on the ground that he ought or ought not to have acted in his discretion.

রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে একই ধরনের আইন রয়েছে। ৭৪ নং ধারার ১নং উপধারায় রয়েছে:

74. Council of Ministers to aid and advise President— (1) There shall be a Council of Ministers with the Prime Minister at the head to aid and advise the President who shall, in the exercise of his functions, act in accordance with such advice: Provided that the President may require the Council of Ministers to reconsider such advice, either generally or otherwise, and the President shall act in accordance with the advice tendered after such reconsideration.

রাজ্যপাল মন্ত্রিপরিষদের পরামর্শ নাও মেনে চলতে পারেন অথচ রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে মেনে চলাটা বাধ্যতামূলক। কী ভয়ানক কথা! নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা তাঁর দ্বারাই মনোনীত রাজ্যপালের ক্ষমতার থেকে কম। এই ক্ষমতার বলে রাজ্যপাল অন্তত একটি রাজ্যকে প্রশাসনিক অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দিতেই পারেন। কেন্দ্র এবং রাজ্যে দুটি আলাদা রাজনৈতিক দল শাসন ক্ষমতায় থাকলে এ ঘটনাটি ঘটতেই পারে। আজকের পশ্চিমবঙ্গে হয়ত এই আশঙ্কাটি অমূলক নয়।

আগেই বলেছি আমাদের ভেবে দেখার সময় হয়েছে যে নির্বাচিত নন এমন একজন মানুষের (রাজ্যপাল) হাতে এত ক্ষমতা দিয়ে রাখাটা কতটা যুক্তিযুক্ত। ওপরের আলোচনার পর মনে হচ্ছে রাজ্যপালের পদটিই নিছকই অপ্রয়োজনীয়। আর পদটি যদি রাখতেই হয় তবে তিনি সহকারী হিসাবে থাকুন কিন্তু ক্ষমতার রাশটি থাকুক পুরোপুরি রাষ্ট্রপতির হাতে।


[1] Constituent Assembly Debates On 2 June, 1949 Part I, CONSTITUENT ASSEMBLY OF INDIA – Volume VIII

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4888 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...