বিদ্যাসাগরের ইতিহাসবোধ

বিদ্যাসাগরের ইতিহাসবোধ | শুভেন্দু সরকার

শুভেন্দু সরকার

 



ইংরাজি সাহিত্যের অধ্যাপক, গবেষক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

প্রথমবার (১৮৪৭) সংস্কৃত কলেজের চাকরি ছাড়ার পর আর দ্বিতীয়বার (১৮৪৯) ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (১৮০০)-এ যোগ দেওয়ার আগে বিদ্যাসাগরের দুটি বই বেরোয়— ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ (১৮৪৭) আর ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ (দ্বিতীয় ভাগ) (১৮৪৮)। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুসারে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ব্রিটিশ সিভিলিয়ান ছাত্রদের বাংলা শেখানোর উদ্দেশে সেগুলি লেখা হয়। বই দুটি আদতে ছিল প্রচলিত হিন্দি ‘বৈতাল পঁচ্চিসি’ (মূলে সংস্কৃত) আর শ্রীরামপুরের পাদ্রি জন ক্লার্ক মার্শম্যান (১৭৯৪-১৮৭৭)-এর ‘আউটলাইন অফ দ্য হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল’ (১৮৩৮)-এর তর্জমা। দেখার বিষয়, হুবহু অনুবাদের পরিবর্তে এখানে বিদ্যাসাগর স্বাধীনতা নিয়েছেন যথেষ্ট। বলা যায়, যেখানে বেতাল-এ তাঁর সৃষ্টিশীল সত্তার খানিক দেখা মেলে সেখানে বাঙ্গালার ইতিহাস-এ স্পষ্ট বেরিয়ে আসে বিদ্যাসাগরের ইতিহাসবোধ।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বিদেশি ছাত্রদের বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয়ের স্বার্থে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের লেখা নানা বইপত্তর ঘেঁটে একটি সহজপাঠ্য সংস্করণ তৈরি করেছিলেন মার্শম্যান। তাতে ধরা পড়েছিল একটি বিস্তৃত সময়— এগারো-বারো শতকের সেন যুগ থেকে উনিশ শতকের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল। কিন্তু অনুবাদের সময় বিদ্যাসাগর নিজের পরিধি অনেকখানি ছোট করে ফেললেন। বাঙ্গালার ইতিহাসএ তিনি বেছে নিলেন ১৭৫৬ থেকে ১৮৩৫ অব্দি— সিরাজদ্দৌলার নবাব হওয়ার পর থেকে উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক (১৭৭৪-১৮৩৯)-এর শাসনকাল।

বাঙ্গালার ইতিহাসএর ‘বিজ্ঞাপন’-এ বিদ্যাসাগর জানিয়েছেন, মার্শম্যান-এর বইয়ের অবিকল অনুবাদ তিনি করেননি: “কোনও কোনও অংশ, অনাবশ্যকবোধে, পরিত্যক্ত হইয়াছে, এবং কোনও কোনও বিষয়, আবশ্যক বোধে, গ্রন্থান্তর হইতে সঙ্কলনপূর্বক, সন্নিবেশিত হইয়াছে।“ স্বাভাবিক যে, উদ্দিষ্ট পাঠকের সুবিধার্থে মূলের অল্পবিস্তর পরিমার্জন ঘটবে তর্জমায়। কিন্তু যোগ-বিয়োগের পেছনে যদি অনুবাদকের মতাদর্শগত অবস্থানের ভূমিকা থাকে— তা নিঃসন্দেহে হয়ে ওঠে তাৎপর্যপূর্ণ। মার্শম্যান-এর বইয়ের শেষ নটি অধ্যায়ের অনুবাদে এমনটাই নজরে আসে। তাই বলা চলে, মূলের সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে বাঙ্গালার ইতিহাসএ বিদ্যাসাগরের মনোজগৎ সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়।

বাঙ্গালার ইতিহাসএর ‘বিজ্ঞাপন’ থেকে এও পরিষ্কার হয়, অতীত ও বর্তমানকে কী চোখে দেখতেন বিদ্যাসাগর। তাঁর কাছে সিরাজদ্দৌলা ‘অতি দুরাচার’ আর উল্টোদিকে বেন্টিঙ্ক হলেন ‘চিরস্মরণীয়’। বলা বাহুল্য, বিশেষণ দুটি স্রেফ ঐ দুই ঐতিহাসিক ব্যক্তির চরিত্র সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন নয়। একইসঙ্গে, ইতিহাসের দুটি পর্বর প্রতিভূ হিসেবে দেখা দিয়েছেন তাঁরা। মনে রাখা জরুরি, বাংলা তথা ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল প্রগতিশীল— সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মোটের ওপর সেখানে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি উন্নত হয়েছে ক্রমশ। নবাব আমলের তুলনায় ব্রিটিশ শাসনকে তাই তাঁর মনে হয়েছে অনেকখানি উন্নত। মনে রাখা দরকার, সার্বিকভাবে মার্শম্যান-এর ইতিহাসচেতনার সঙ্গে এক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের দৃষ্টিভঙ্গির সামঞ্জস্য নজরে আসে।

ঘটনা হল, সিরাজদ্দৌলা ও পরবর্তী নবাবদের শাসনকালের পাশাপাশি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যুগও একইরকম ঠেকেছিল বিদ্যাসাগরের চোখে। দুদিকেই ক্ষমতা ও মুনাফার স্বার্থে সামরিকশক্তি ছাড়াও অবাধে কাজে লাগানো হয় কূটনীতি, চক্রান্ত, শঠতা ও শোষণ। বলা যায়, শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে রবার্ট ক্লাইভ-এর নেতৃত্বে ইংরেজরা জয়ী হয়েছিল। ক্ষমতাবদলের সঙ্গে সঙ্গে তাই শাসনব্যবস্থায় কোনও গুণগত পরিবর্তন নজরে আসেনি। যুগান্তরের পরেও জনগণের দুর্দশা ছিল একইরকম। কোম্পানির স্বার্থ দেখা ছাড়াও ব্যক্তিগত ব্যবসায় ডুবে থাকতেন ইংরেজ কর্মীরা; মুনাফা কামানোই ছিল তাঁদের অন্তিম উদ্দেশ্য। সেইজন্যে নিজেদের মনোনীত নবাব মীরকাশিমকেও সরানোর দরকার পড়েছিল। অন্যদিকে, কর্মচারীদের ব্যক্তিগত দুর্নীতি আটকাতে চেষ্টার ত্রুটি করেননি কোম্পানির ডিরেক্টররা। মার্শম্যান-এর মত অনুসারে ১৭৬৫ নাগাদ বাংলার পরিস্থিতি নিয়ে বিদ্যাসাগর লিখলেন:

অন্যের কথা দূরে থাকুক, কৌন্সিলের মেম্বারেরাও কোম্পানির মঙ্গলচেষ্টা করেন না। সমুদয় কর্মচারীর অভিপ্রায় এই, যে কোনও উপায়ে অর্থোপার্জন করিয়া, ত্বরায় ইংলণ্ডে প্রতিগমন করিবেন। সকল বিষয়েই সম্পূর্ণরূপ অবিচার; আর, এতদ্দেশীয় লোকদিগের উপর এত অত্যাচার হইতে আরম্ভ হইয়াছিল যে, ইংরেজ এই শব্দ শুনিলে, তাঁহাদের মনে ঘৃণার উদয় হইত। ফলতঃ, তৎকালে, গবর্ণমেন্ট সংক্রান্ত ব্যক্তিদিগের ধর্মাধর্মজ্ঞান ও ভদ্রতার লেশমাত্র ছিল না। (পৃঃ ১৪৯৪)

ইংরেজ বণিকরা বাংলা, বিহার আর ওড়িশার দেওয়ানি পাওয়ার পরও, ১৭৭২ অব্দি, বহাল থাকে সামগ্রিক অরাজকতা। তখন পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের ভার ছিল মহম্মদ রেজা খাঁ, সিতাব রায় প্রমুখ দেশীয় অমাত্যদের ওপর।

১৭৭২-এর পর অবস্থা খানিক পাল্টাল— ক্রমশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডিরেক্টরদের ক্ষমতা কমল; ভারতের ব্যাপারে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিল। ফলে, আইনি ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক স্তরে তৈরি হলো নানা নতুন নিয়ম। একইসঙ্গে অবশ্য শাসকমহলে বজায় থাকল স্বার্থ ও ক্ষমতা নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ব— সুপ্রিম কাউন্সিলের সদস্যদের মধ্যে সংঘাত যার প্রমাণ। এর পেছনে রয়েছে শাসন-পদ্ধতি নিয়ে উঠ্‌তি বণিকশ্রেণি আর সামন্তশ্রেণি/রাজন্যবর্গর ধ্যানধারণার তফাত। মনে রাখতে হবে, তখনও বুর্জোয়ারা পুরোপুরি ক্ষমতাদখল করতে পারেনি ইংল্যান্ডে।

শাসনব্যবস্থায় কিছু অদলবদলের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয়দের বেলায় ব্রিটিশদের মনোভাব পাল্টে গেছিল— এমন ভাবার অবশ্য হেতু নেই। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস-এর বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ তোলার পর সুপ্রিম কোর্টে দুর্নীতির মামলায় উলটে নন্দকুমারের ফাঁসি হল ১৭৭৫-এ। মজার ব্যাপার, মার্শম্যান-এর লেখায় প্রসঙ্গটি ছিল, কিন্তু বিদ্যাসাগরের অনুবাদে হেস্টিংস-নন্দকুমার পর্বটি অন্য মাত্রা পেল। সম্পূর্ণ নতুন দুটি অনুচ্ছেদ যোগ করলেন তিনি।

নন্দকুমার এতদ্দেশে একজন অতি প্রধান লোক ছিলেন। ইংরেজদিগের সৌভাগ্যদশা উদিত হইবার পূর্বে, তাঁহার এরূপ আধিপত্য ছিল যে, ইংরেজরাও বিপদ পড়িলে, সময় সময়ে, তাঁহার আনুগত্য করিতেন ও শরণাগত হইতেন। নন্দকুমার দুরাচার ছিলেন, যথার্থ বটে; কিন্তু ইম্পি ও হেস্টিংস তাহা অপেক্ষা অধিক দুরাচার, তাহার সন্দেহ নাই।

নন্দকুমার, হেস্টিংসের নামে, নানা অভিযোগ উপস্থিত করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। হেস্টিংস দেখিলেন, নন্দকুমার জীবিত থাকিতে তাঁহার ভদ্রস্থতা নাই; অতএব, যে কোনও উপায়ে, উহার প্রাণবধ করা নিতান্ত আবশ্যক। তদনুসারে, কামালউদ্দীনকে উপলক্ষ্য করিয়া, সুপ্রীম কোর্টে পূর্বোক্ত অভিযোগ উপস্থিত করেন। ধর্মাসনারূঢ় ইম্পি, গবর্ণর জেনেরলের পদারূঢ় হেষ্টিংসের পরিতোষার্থে, একবারেই ধর্মাধর্মজ্ঞান ও ন্যায় অন্যায় বিবেচনায় শূন্য হইয়া, নন্দকুমারের প্রাণবধ করিলেন। হেস্টিংস, তিন চারি বৎসর পরে, এক পত্র লিখিয়াছিলেন; তাহাতে ইম্পিকৃত এই মহোপকারের বিষয় উল্লিখিত হইয়াছিল। ঐ পত্রে এইরূপ লিখিত ছিল, এক সময়ে, ইম্পির আনুকূল্যে, আমার সৌভাগ্য ও সম্ভ্রম রক্ষা পাইয়াছে। এই লিখন দ্বারা ইহাও প্রতিপন্ন হইতে পারে, নন্দকুমার হেষ্টিংসের নামে যে সকল অভিযোগ উপস্থিত করিয়াছিলেন, সে সমস্ত অমূলক নহে; আর, সুপ্রিম কোর্টের অবিচারে তাঁহার প্রাণদণ্ড না হইলে, তিনি সে সমুদায় সপ্রমাণও করিয়া দিতেন, সেই ভয়েই হেষ্টিংস ইম্পির সহিত পরামর্শ করিয়া, নন্দকুমারের প্রাণবধসাধন করেন। (পৃঃ ১৫০৯)

নন্দকুমারের ফাঁসির জন্যে সরাসরি হেস্টিংস আর সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ইলাইজা ইম্পি-র যোগসাজশকে চিহ্নিত করেন বিদ্যাসাগর। শাসকশ্রেণির দুরভিসন্ধি তাঁর চোখে পরিষ্কার ধরা পড়েছিল। তাই সে-কথা পাঠককে জানাতে ভুললেন না বিদ্যাসাগর। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ছাত্রদের জন্যে ফরমায়েশি অনুবাদেও তাঁর স্বকীয়তা বজায় রইল। এও দেখার, নন্দকুমারের নামের আগে ‘কুখ্যাত’ (infamous) বিশেষণ ব্যবহার করেন মার্শম্যান; অনুবাদে সেটি বাদ গেল প্রত্যেকবার। বলা যায়, ইতিহাস নিয়ে বিদ্যাসাগরের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নৈর্ব্যক্তিক। তাই মার্শম্যান-এর সঙ্গে যেমন কোনও কোনও জায়গায় তাঁর মতপার্থক্য দেখা গেল তেমনি পরবর্তীকালের জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক প্রকল্পের নিরিখেও তাঁর অবস্থান বিলকুল বেমানান ঠেকল।

এও বলা চলে, ইতিহাসের মূল্যায়ন করার সময় তুলনামূলক বিচারপদ্ধতিকে সর্বদা প্রাধান্য দিতেন বিদ্যাসাগর। মার্শম্যান-এর লেখায় যেখানে এমন পরিমার্গ নজরে এসেছে সেখানেই তিনি তা হুবহু তুলে ধরেছেন। নমুনা হিসেবে কর্নওয়ালিস-এর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (১৭৯৩)-র প্রসঙ্গটি হাজির করছি।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়াতে, বাঙ্গালা দেশের যে সবিশেষ উপকার দর্শিয়াছে, ইহাতে কোনও সন্দেহ নাই। এরূপ না হইয়া, যদি, পূর্বের ন্যায়, রাজস্ব বিষয়ে নিত্য নূতন পরিবর্তের প্রথা প্রচলিত থাকিত, তাহা হইলে, এদেশের কখনই মঙ্গল হইত না। কিন্তু ইহাতে দুই অমঙ্গল ঘটিয়াছে; প্রথম এই যে, ভূমি ও ভূমির মূল্য নিশ্চিত না জানিয়া, বন্দোবস্ত করা হইয়াছে; তাহাতে কোনও কোনও ভূমিতে অত্যন্ত অধিক, কোনও কোনও ভূমিতে অতি সামান্য, কর নির্ধারিত হইয়াছে; দ্বিতীয় এই যে, সমুদয় ভূমি যখন বন্দোবস্ত করিয়া দেওয়া গেল, তখন যে সকল প্রজারা, আবাদ করিয়া, চিরকাল, ভূমির উপস্বত্ব ভোগ করিয়া আসিতেছিল, নূতন ভূম্যাধিকারীদিগের স্বেচ্ছাচার হইতে তাহাদের পরিত্রাণের কোনও বিশিষ্ট উপায় নির্দিষ্ট করা হয় নাই। (পৃ. ১৫২০)

ইংরেজ শাসনের যে দিকগুলি বাংলা তথা ভারতে এক আধুনিক যুগের সূচনা করেছিল সেগুলির প্রতি যে বিদ্যাসাগরের সমর্থন থাকবে— এ তো জানা কথা। পাশ্চাত্য ধারণা অনুযায়ী শিক্ষা ও সমাজসংক্রান্ত সংস্কারের প্রসঙ্গ তাই ঘুরেফিরে এসেছে বাঙ্গালার ইতিহাসএ। বই (১৭৭৮) ও সংবাদপত্র (১৭৮০) ছেপে বেরনো, এশিয়াটিক সোসাইটি (১৭৯৪) ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা (১৮০০), গঙ্গাসাগরে শিশু বিসর্জন রোধ আইন (১৮০২) আর সতীদাহ প্রথা রদ আইন (১৮২৯)— সবই জায়গায় পেয়েছে এখানে (সবই অবশ্য মার্শম্যান-এ ছিল)। যুক্তিবাদী বিশ্ববীক্ষার পক্ষে বিদ্যাসাগর যে নিজেই সওয়াল করছেন তা বোঝা যায় যখন রক্ষণশীল সমাজের বিরুদ্ধে বেন্টিঙ্ক-এর অবস্থানকে তিনি সমর্থন জানান।

কতকগুলি ধনাঢ্য সম্ভ্রান্ত বাঙ্গালি, এই হিতানুষ্ঠানকে অহিত জ্ঞান করিলেন, এবং তাঁহাদের ধর্ম বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা হইল বলিয়া, গবর্ণর জেনেরল বাহাদুরের নিকট এই প্রার্থনায় আবেদন করিলেন যে, ঐ আইন রদ করা যায়। লার্ড উইলিয়ম, এই ধর্ম রহিত করিবার বহুবিধ প্রবল যুক্তির প্রদর্শন পূর্বক, তাঁহাদের প্রার্থনা অগ্রাহ্য করিলেন। সেই সময়ে, দ্বারকানাথ ঠাকুর, কালীনাথ রায়চৌধুরী প্রভৃতি কতকগুলি সম্ভ্রান্ত বাঙ্গালি লার্ড উইলিয়ম বেন্টিক বাহাদুরকে এক অভিনন্দনপত্র প্রদান করেন; তাহার মর্ম এই, আমরা, শ্রীযুতের এই দয়ার কার্যে অনুগৃহীত হইয়া, ধন্যবাদ করিতেছি। (পৃ. ১৫৩০-৩১)

শুধু তা-ই নয়, এরপর রামমোহন রায় প্রসঙ্গে দেখা যায় বিদ্যাসাগরের প্রশংসাসূচক মন্তব্য। সেখানেও যথারীতি জোর পড়েছে রামমোহনের যুক্তিবাদী মনোভাবের ওপর।

পূর্বকালে, সমুদ্রযাত্রাস্বীকারে, ভারতবর্ষীয়দিগের নিন্দা ও অধর্ম হইত না; ইদানীন্তন সময়ে, কোনও ব্যক্তি জাহাজে গমন করিলে, তাহাকে জাতিভ্রষ্ট হইতে হয়। কিন্তু, রাজা রামমোহন রায়, অসঙ্কুচিত চিত্তে, জাহাজে আরোহণপূর্বক, ইংলণ্ডে গমন করেন। তিনি, তথায় উপস্থিত হইয়া, যার পর নাই সমাদর প্রাপ্ত হয়েন। (পৃ. ১৫৩২)

বুঝতে অসুবিধে হয় না, বিদ্যাসাগরের ইতিহাসবোধ ছিল তাঁর অখণ্ড বস্তুবাদী দার্শনিক বিশ্ববীক্ষার অধীন।

ইংরাজি শিক্ষা চালু করা নিয়ে আমহার্স্ট-কে ১৮২৩-এ চিঠি লিখেছিলেন রামমোহন। সে আবেদন নাকচ হয়েছিল। তাই পরবর্তীকালে যখন বেন্টিঙ্ক ইংরাজি শিক্ষার প্রসার ঘটালেন তখন স্বাভাবিকভাবেই তা বিদ্যাসাগরের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হল।

লার্ড উইলিয়ম বেন্টিক, প্রজাগণের বিদ্যাবৃদ্ধি বিষয়ে যত্নবান হইয়া, ইংরেজী শিক্ষায় সবিশেষ উৎসাহ দিয়াছিলেন। ১৮১৩ সালে, পার্লিয়ামেন্টের অনুমতি হয়, প্রজাদিগের বিদ্যাশিক্ষা বিষয়ে, রাজস্ব হইতে, প্রতি বৎসর, লক্ষ টাকা দেওয়া যাইবেক। এই টাকা, প্রায় সমুদায়ই, সংস্কৃত ও আরবী বিদ্যার অনুশীলনে ব্যয়িত হইত। লার্ড উইলিয়ম বেন্টিক, ইংরেজী ভাষার অনুশীলনে তদপেক্ষা অধিক উপকার বিবেচনা করিয়া, উক্ত উভয় বিষয়ের ব্যয়সংক্ষেপ, ও স্থানে স্থানে ইংরেজী বিদ্যালয় স্থাপন, করিবার অনুমতি দিলেন। তদবধি, এতদ্দেশে, ইংরেজী ভাষার বিশিষ্টরূপ অনুশীলন হইতে আরম্ভ হইয়াছে। (পৃ. ১৫৩৩)

এছাড়া, কলকাতায় মেডিকেল কলেজ আর সেভিংস ব্যাঙ্কও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বেন্টিঙ্ক। তিনি যে বিদ্যাসাগর কাছে ‘চিরস্মরণীয়’ হয়ে উঠবেন— এ আর আশ্চর্য কী!

জনগণের বৌদ্ধিক ও সামাজিক বিকাশ (যত সীমিত অর্থেই হোক) ছিল বিদ্যাসাগরের প্রগতিশীল ইতিহাসচেতনার ভিত্তি। দেশি আর বিদেশি শাসকের মধ্যে তুলনামূলক বিচারের সময় তাঁর মাপকাঠি ছিল সেটাই। জাতীয়তাবাদী অথবা আরও পরের উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তাবিদ্‌রা নিজেদের ধারণার খোপে তাই বিদ্যাসাগরকে পুরতে পারেননি। বলতে বাধা নেই, দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে উনিশ শতকের বাস্তবতার নিরিখে বিদ্যাসাগরের স্বাদেশিকতাকে যাচাই না করার ফলে এই বিপত্তি।

আগেই দেখেছি, নন্দকুমার-হেস্টিংস পর্বে বিদ্যাসাগরের ইতিহাসবোধের স্পষ্ট ছবি বেরিয়ে আসে। একইসঙ্গে তাঁর স্বাদেশিকতাও পরিষ্কার হয় সেখানে। মজার ব্যাপার, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ছাত্রদের জন্যে ১৮৫০-এ বাঙ্গালার ইতিহাসএর যে আক্ষরিক ইংরিজি অনুবাদ হাজির করলেন অধ্যক্ষ মেজর জি টি মার্শাল, সেখানে ঐ দুটি অনুচ্ছেদ (যা ম্যার্শম্যান-এ ছিল না) বাদ পড়ল। অভিধানের ধাঁচে লেখা (যেখানে পাদটীকায় বাংলা শব্দের ইংরিজি প্রতিশব্দ পর্যন্ত উল্লেখ আছে) মার্শাল-এর ‘এ গাইড টু বেঙ্গল’এ এমন ঘটল কেন? মনে হয়, ব্যক্তিগত সুসম্পর্কর জেরেই বিদ্যাসাগরকে অস্বস্তিতে ফেলতে চাননি মার্শাল। বাঙ্গালার ইতিহাসএ যেভাবে হেস্টিংস ও ইম্পিকে দেখানো হয়েছিল, তা সর্বসমক্ষে এলে নিঃসন্দেহে বিদ্যাসাগরের বিড়ম্বনা বাড়ত। তাই সম্ভবত সেটি নিঃশব্দে ছেঁটে ফেলা হল। মার্শাল-কে একপেশে উত্তর-ঔপনিবেশিক চোখ দিয়ে বিচার না-করলেই বরং কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দেওয়া হবে। ভুললে চলবে না, তথ্য সরিয়ে রেখে স্রেফ তত্ত্ব দিয়ে ইতিহাস বিচার মূর্খামি।

 

সূত্র:

১. বিদ্যসাগর, ঈশ্বরচন্দ্র। বিদ্যাসাগর রচনাবলী, খণ্ড ২। কলকাতা: তুলি-কলম। ১৯৯৪ (বাঙ্গালার ইতিহাসএর সব উদ্ধৃতি এখান থেকে নেওয়া)।
২. Marshall, G. T. A Guide to Bengal. Calcutta: P. S. D’rozario and Co., 1850.
৩. Marshman, John C. Outline of the History of Bengal. Serampore: Serampore Mission Press, 1857.

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...