‘কণ্ঠ যে রোধ করে…’

‘কণ্ঠ যে রোধ করে…’ | অনির্বাণ ভট্টাচার্য

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

 

‘কোনওদিন জানল না কেউ। কোনও কোনও মানুষের গান। ফিকে আকাশের মতো ম্লান’। গান বলতে বয়স বুঝি। বুঝি বার্ধক্য। সেনিলিটি। এক বৃদ্ধা তাঁর হতেই পারত এমন এক উজ্জ্বল সঙ্গীতজীবন আর কিছুই হয়নি এমন এমন এক নিঠুর দরদি চৌহদ্দির মাঝে ধরে রেখে দিয়েছেন গান। উলের কাঁটা বেয়ে ওঠা মেলানকোলিক টোন। আমাদের রেকর্ড প্লেয়ারে বারবার এক জায়গায় এসে আটকে যাচ্ছে পিন। কথা, সুর, গায়কি, জীবন— প্রতীকী। বারবার গোঁত্তা খাওয়া। বৃত্ত যেন। যেন ওখানেই আটকাবে, কথা ছিল এমনই। যেটুকু ছিল, কণ্ঠে, ধরে রাখো। মাঝে মাঝে গেও। গুনগুন। মৌমাছি জীবন। কনসোলেশন প্রাইজ। সেই প্রাইজের মাশুল গুনতে সন্তানের পর সন্তান। হেঁশেল। মুড়ির কৌটো। উনুন। শরিকি সমস্যা। কত কত গান। হিংস্রতার গান। যান্ত্রিকতার গান। তবে, সব মিটে গেলে সেদিনের মতো মিটে গেলে কোনও কোনও দিন বৃষ্টি হত খুব। ফিরোজা বেগমের এনিগমা আর অনেক অনেক দূরের এক সাধারণ নিপাট গেরস্থালি নারীত্বের ঠোঁটে এমন বরষা। আঁখিপাতে বারি। ‘কাঁদিবে আকাশ মোর ব্যথায়। বাদলও ঝড়ে প্রিয়’। পুরনো প্রেমিক ছিল কেউ? বা অতটা না, স্টেজে উঠলে চোখ পড়ে যেত কারও দিকে। লজ্জায় মাথা নুইয়ে গলা বুঝে আসত গানের মাঝে। এমন কেউ? মনে নেই। বা মনে পড়া বারণ। কিংবা, মনে পড়ে লাভ নেই কোনও। এর কোনটা সত্যি টিক দেওয়ার আগে খাতা নিয়ে চলে যেতেন ইনভিজিলেটর। আমাদের সেই কিছুই না বোঝা উদ্দাম মিউজিকাল নাইনটিয়ানায় তখন উঠোন, কার্নিশ, লোহার ঘোরানো সিঁড়ি। পাথরে, লোহায় টুংটাং। আমি পায়রা ধরতাম। নমনীয়তা, স্নেহ। মৃত্যুবোধের মতো। ঈশানের দিক করে উড়িয়ে দিতাম। চারটে দিকের বাইরে ওই একটাই দিক, নাম চিনতাম। চোখ বুঝলে ভাগ্যশ্রীর চুল উড়ত। ‘কবুতর যাহ্‌, যাহ্‌’। পাখিরা ফিরে আসে, ধরলেও বারবার ছাড়া পেয়ে যাওয়ায় অভিজ্ঞতায়, চালের গুঁড়ো পাওয়ার লোভে ফিরে আসে। আর বাদবাকি যারা চলে যায়, উড়ে যায়, ফেরে না কেন? অন্তত সামনে না এলেও কার্নিশে বসে থাকতে পারত না কি? আমি দুপুরে গোটা বাড়ি চষতে বেরোলে চোখাচুখি হত। কিছু বলতাম না। মনে করতাম মুখগুলো। এখনও এমন আছে? খেতে পায় ঠিকঠাক? একসঙ্গে, পাত পেড়ে? এমন একটা সময় অন্ত্যক্ষরী মনে পড়ে। একটা সময় খেলতে খেলতে উঠে পড়ত বড়রা। যেন, আমাদের যাওয়ার সময় হয়েছে। বড়জোর, একটু এগিয়ে দিতে পারি। তার বেশি না। কেন জানি না, ঘুরেফিরে ন-য় শেষ হত গান। ওই ন দিয়েই খেলা শেষ। ন-য় না-বোধ। আমাদের আজন্মকাল বনেদিয়ানায় একটা বড়সড় ‘না’। শরিক, ছোট পরিবার, বাবার চাকরি— অন্ত্যমিলে না। অথবা ন-য় নারীত্ব। আমার স্বপ্নে আশিকির ওই মেয়েটা। ‘তেরি চাহত পে…’। কালো, খুব কালো, অথচ…। অথবা সাজন। একটা পাহাড়ি উপত্যকতায় গাছের পর গাছ। একটা লোক বেশি দূর হাঁটতে পারছে না প্রতিবন্ধকতায়। তবু, স্বপ্নে সে রাজা, প্রেমিক। কাঁধের কাছে ওই মেয়েটার হাসি, চুল, গন্ধ। ‘মেরা দিল ভি…’। কী সব কুয়াশার দিন সেইসব। গোটা সংসার খুব ভর থেকে শুরু। আর এমনই এক ভোরে দেখতে মনে হত সাদা একটা চাদরে দূর থেকে হেঁটে আসছেন হেমন্ত। আমাদের বড়রা সবাই ওঁর কণ্ঠে অন্যমনস্ক হচ্ছেন। ঠাকুমার স্মৃতিতে আসছে ‘জীবনের মধুমাসের কুসুম ছিঁড়ে গাথা মালার শিশির ভেজা’ সেইসব সলিলোকি। আমিও কিছু না বুঝে অসহ্য গরমে ঘর-বাহির করছি। মেঘ দেখছি। পেয়েছি, এই তো পেয়েছি। মাটির সঙ্গে ধুলোর ওই রোম্যান্স। ওই সোঁদা গন্ধ। কালো আকাশ। ঝড়। বাউল বাতাস। যেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ ছাড়া ঝড় আসতেই পারে না। তখনও বুঝিনি, প্রতীকী সবই। বনেদিয়ানা, লেগ্যাসি, সাতমহলা স্বপ্নপুরী। নিভল হাজার বাতি। নিয়মরক্ষার ম্যাচ। লাস্টম্যানের কোনও ব্যাটিং হয় না কি? এমনটাই সবকিছু। লিজ নেওয়া। এর ভেতরেই কুমিরডাঙা, ডাম্ব-সারাত খেলার মতো জীবন। ওর মধ্যেই আলো। রং। শ্রাবন্তী মজুমদারের মতো একটা মিষ্টি গলা বুকের ভেতরে ছ্যাঁত করে উঠত। বেশি বয়সের কোনও মুখ, গঠন, বিভঙ্গ তখন সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক। সব ক্ষত ঢেকে দেওয়া বোরোলিনের গান। মনে হত রেকর্ড প্লেয়ারটা অনেকদিন একলা আছে। ঠাকুমা বলত ফিয়েস্তা। আমি ওপরের রেকর্ডগুলোর বারবার চালাতাম। নিচেরগুলো টানতে পারতাম না। ভার। ট্রিনিটি বুঝিনি। বুঝিনি কোনজন ফাদার, সন, হলি ঘোস্ট। তবে হেমন্ত দিয়ে মিউজিকাল বোধ শুরু করা আমার প্রথম ট্রিলজি বলতে হেমন্ত-মান্না-শ্যামল। একলা ঘরে অঝোরে কান্নার দিনের শেষে…। ‘যে জন আছে মাঝখানে’। পঙ্কজ মল্লিক। যারা চলে গেছে, যারা অনেক পরে যাবে, তাদের দুজনের মাঝখানে যারা, তারা এই গান আমার সঙ্গে শোনেনি কোনওদিন? কেন? বড়রা কাঁদে না। ছেলেরা কাঁদে না। আমি কিন্তু প্রায়ই টুপটাপ করে জল ফেলতাম। তোতাপাখি, বাঁশবাগানের মাথা, রঙিন খাম। আমার ঘরে, চিলেকোঠায়, বনেদি ছাদে হেঁটে যেতেন নির্মলা, প্রতিমা, বনশ্রী, জটিলেশ্বর। আত্মীয়, আত্মীয়া। খেলে ঘরে ফিরলে চুলে বিলি করে দিতেন। বাবা, এত বড় হয়ে গেছিস? তারপর বেরোবার তাড়া। আমি আন্দাজ করে সবার চটি লুকিয়ে ফেলছি। আর ওঁরা ছদ্ম রাগে নালিশ করছেন বড়দের। তখন সবাই মিলে খোঁজাখুঁজি। আর শেষমেশ না পেয়ে আমারই শেষমেশ খুঁজে দেওয়া। মেনে নেওয়া। বড় হওয়া, চলে যাওয়া, একেবারের জন্য চলে যাওয়া— সব, সবকিছু মেনে নেওয়া।

নব্বইয়ের শেষদিকটা ঝাপসা। আমার তখনকার কথাগুলো অনেক পরে সুমন বলল। আমার পাড়ার কথায়, রোয়াকের কথায়। ‘তার সুরটা চেনা চেনা…’। তবে, ওই ঘর তখন চলে গেছে অনেকটাই। রেকর্ড প্লেয়ার ছেড়ে ক্যাসেটে উঠে আসা আমার টিউশন জীবনে তখন বুক খোলা জীবনবোধ। গিটারবোধ। পৌলমী, নীলাঞ্জনা, শতাব্দী, বেলা বোস। সে এক অন্য গল্প। ছোট গল্প।

শেষদিকটায় গরমের ছুটি, অসুস্থতা, একটা দুটো বিয়ে, পৈতে মিলিয়ে দিত। দুই বয়সের দুই প্রজন্মের হাত। টেল এন্ডে ঠাকুমা ব্যাট করতে করতে ধরে রাখত নজরুল, রবীন্দ্রনাথ। ‘কণ্ঠ যে রোধ করে, সুর তো নাহি সরে…’। ঈষৎ কাঁপত গলা। টেলিফোনে অ্যামনেশিয়া। শেষদিকের স্মৃতিতে, কিছুটা কল্পনায় বানাত ডক্টর পারনেশাসের ইমাজিনারিয়াম। অদ্ভুত ম্যাজিকাল এক যাত্রাকোম্পানি।

সেই স্টেজ, সেই অডিয়েন্স, সেই মেমোরি লেন, সেই শেষ অক্ষর, সেই সি-মাইনর আমার ওষুধ, আমার অহং, আমার ‘দিশা— অকূল অন্ধকারে…’

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4859 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...