আজি হতে শতবর্ষ পরে, কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি…

আজি হতে শতবর্ষ পরে, কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি… | শৌভিক চক্রবর্তী

শৌভিক চক্রবর্তী

 

ভারতীয় সময়, রাত ২.২০।

সামান্য দেরি করেছে শুরু হতে। টাইব্রেকারে জিতে তখনও হুঙ্কার দেওয়া ছাড়ছে না দি মিনাউর। অ্যান্ডি মারের রিটার্নকে ‘বাপি বাড়ি যা’ বলে হাত মুঠো করে ঝাঁকিয়ে সেন্টার কোর্ট থেকে হেঁটে ঢুকছে লাউঞ্জে। অদূরে দাঁড়িয়ে জন ম্যাকেনরো। যিনি সহাস্যে পিঠ চাপড়েই মুহূর্তে গম্ভীর। চেয়ার আম্পায়ার রেডি, দুটো টিমের ক্যাপ্টেন নিজ নিজ স্থানে। এবার ভরা এরিনার গমগমে হাততালির মাঝে চিরপরিচিত ফেট্টি বেঁধে পায়ে পায়ে ঢুকলেন ওই দুজন।

‘ওই দুজন!’

যার একজনের ১৯৯৮-তে কেরিয়ার শুরু। অসম্ভবকে সম্ভব করে প্রথম মেজর জিততে তখনও বছর চারেক। কিন্তু তারপর তো আর তাকাতে হয়নি। যে লেভেলে গ্রাঁ পি-তে হুশ করে বেরিয়ে যেতেন মাইকেল শুম্যাখ্যার, ওই জেটগতিতে উত্থান। পরপর গোটাকতক অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, ইউএস ওপেন জিতে একটা বেঞ্চমার্ক তৈরি করে নেওয়া এবং সঙ্গে, ঘাসের কোর্ট উইম্বলেডনের পাশেই নিজের নাম জুড়ে নেওয়া— নিজের চারপাশে একটা অদৃশ্য বলয় বানিয়ে সেখানে একা এবং একা বিরাজ করছে একটা পনিটেল। অবাধ্য চুলগুলোকে সযত্নে ঠিকঠাক জায়গায় প্লেস করে ফের বাজপাখির ক্ষিপ্রতায় অপোনেন্টের দিকে তাকানো।

নাহ্, থেমে গেল তো। ওই তো থামল। কোত্থেকে মায়োর্কার একটা ষাঁড় এসে পুরো ছবিটা পাল্টে দিল। ফেডেরার নাগালই পেলেন না গোটাটা বোঝার। তার আগেই বীভৎস কিলার ইন্সটিংক্ট নিয়ে হাজির হয়ে গেছেন আরেকটা লম্বা চুল। বাঁ হাতি, আর প্রতিপক্ষের উপর জাঁকিয়ে বসতে ব্যাপক পারেন। ইনিই তিনি, যিনি ২০০৫-২০০৭ ডমিনেন্স দেখিয়ে এসেছেন প্যারিসে। দুবার ক্লে-তে স্ট্রেট সেটে ফেডেরারকে হারিয়েছেন। এবার আর মাটি, সুরকি নয়। টোটাল ঘাস। নাদালের কাছে ফেড সেখানেও হাত তুললেন।

‘ওই দুজন’।

যার একজন কাল নেট প্লে দেখাচ্ছিলেন আগের মতোই। ওয়ান হ্যান্ডেড ব্যাকহ্যান্ডের ছটা পড়ছে সেন্টার কোর্ট চত্বরে। পাওয়ার দিয়ে একজন ক্রমাগত স্পেস তৈরি করে দুরূহ কোণে সরে গিয়ে ফোরহ্যান্ড মারছেন ক্রসকোর্টে। একটা বল সোজা গিয়ে পড়ল গ্যালারিতে। একজন অসাধারণ একটা ক্যাচ ধরলেন। নিচে হাসছেন দুজন। সেকেন্ড সেটের একটা সময় নেট-গেম এত ফাস্ট এগোল, ওইখান থেকে বেসলাইনে বুদ্ধি করে প্লেস করে দিলেন জ্যাক সক। ব্যস! সব্বার মাথায় হাত, এটা কী করে করলেন! ফেড-রাফা পর্যন্ত হেসে ফেললেন, ইভেন, বাইরে থেকে ‘মাই গড’ বলে উঠলেন জকোভিচ, সিসিপাসরাও।

কাহিনির শিরোনামে সুইটজারল্যাণ্ডের বাসেল প্রদেশে জন্মানো এক এঞ্জেলো। হাতে তুলি নিতে নিতে আরও বছর ১৯ কেটে যাবে। তারপর একদিন ঘাসের কোর্টে নায়কের তাজ পরে বসে থাকা পিট সাম্প্রাসকে হারিয়ে দেবেন উইম্বলেডনেই!

সৌভাগ্যবশত, ২১ শতকে, শিল্প এবং খেলাধূলার মধ্যে সেই পুরনো এবং প্রধানত কৃত্রিম বিভাজনটি অনেকাংশে মুছে ফেলা হয়েছে। ধীরে ধীরে তার জায়গায় এমন একটা পরিসরের জন্ম হয়ে গেছে যে এটা এখন পুরোপুরি সম্ভব যে কেউ শিল্প এবং খেলাধূলা উভয়কেই সমানভাবে ভালবাসতে পারে। তার চেয়েও বড় কথা, এটা এখন সর্বজনস্বীকৃত যে সবচেয়ে বড় খেলাই শিল্পের গুণমান অর্জন করতে পারে। ২০০৪-এ আর্সেনাল ইনভিন্সিবলস দলের ফর্ম যখন শীর্ষে, তখন ম্যানেজার আর্সেন ওয়েঙ্গার খোলাখুলিভাবে সর্বোত্তম ফুটবল হচ্ছে একটা অসাধারণ শিল্প— যার ফর্ম সম্পর্কে একটা কথা বলেছিলেন। যাই হোক, ওয়েঙ্গার, তার সর্বশ্রেষ্ঠ আর্সেনাল টিম এবং অন্য যে কোনও সুপার্ব ক্রীড়াবিদদের প্রতি যথাযথ সম্মানের সঙ্গেই বলা যায়, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীড়াশিল্পী নিঃসন্দেহে রজার ফেডেরার। ফেডেরার টেনিস খেলতেন, যা সর্বদা সৌন্দর্যের জন্য খেলা। সম্ভবত এটাই ছিল সম্পূর্ণ পেশাদার হয়ে ওঠার শেষ প্রধান পেশাদার খেলা (রাগবি ইউনিয়ন বাদে, যেখানে টেনিসের বিশ্বব্যাপী নাগাল নেই)। টেনিস একটি অনন্যভাবে বিশুদ্ধ, অভিব্যক্তিপূর্ণ এবং ব্যক্তিগত খেলা, যেখানে নিজস্ব পুরস্কার এবং পারিশ্রমিকের প্রয়োজন হয় না। এবং অবশ্যই শিল্পীদের, এমনকি মহান শিল্পীদের সবচেয়ে প্রিয় খেলা।

কিন্তু শিল্পীদের দ্বারা টেনিসের সাধারণ আরাধনা সত্ত্বেও, ফেডেরার অন্য কিছু। অনন্য, অসাধারণ। প্রকৃতপক্ষে ওর খেলার স্টাইল নিয়েই তো বিশ্বে দুর্দান্ত কিছু প্রবন্ধ আছে। তাদের মধ্যে সেরা হল প্রয়াত ডেভিড ফস্টার ওয়ালেসের বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘রজার ফেডেরার অ্যাজ রিলিজিয়াস এক্সপেরিয়েন্স’ (২০০৬) আর উইলিয়াম স্কিডেলস্কির অসাধারণ স্মৃতিকথা ‘ফেদেরার অ্যান্ড মি: আ স্টোরি অফ অবসেশন’ (২০১৫)। ফস্টার ওয়ালেস এবং স্কিডেলস্কি দুজনেই ভাল জুনিয়র টেনিস খেলোয়াড় ছিলেন, বিশেষ করে ফস্টার ওয়ালেস। তাই লিখতে গিয়ে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকতেন লোকটার খেলার দিকে। যখন তাঁরা দুজনেই জানতেন যে টেনিস প্রযুক্তিগতভাবে সবচেয়ে বেশি চাহিদাপূর্ণ খেলা।

ফস্টার ওয়ালেস এবং স্কিডেলস্কি উভয়েই যুক্তি দিয়েছিলেন, ফেডেরারের খেলাটি সত্যিই শৈল্পিক ছিল। চার্লি চ্যাপলিন একবার বলেছিলেন যে তিনি সবচেয়ে সুন্দর জিনিসটা দেখেছেন সেটা হল হেলেন উইলস মুডির টেনিস কোর্টে চলাফেরা, কিন্তু তিনি একটা জিনিস মিস করে গেলেন। ১৯৭৭-এ না গিয়ে ২০১৯-এ গেলে হয়তো দেখতে পেতেন একজন জিনিয়াসকে। তিনি ফেডেরারকে কখনও দেখলেন না। প্রায় অসম্ভব কল্পনাপ্রসূত শট-মেকিং ওই ইন্টেন্সিটিতে (২০০৩ সালের উইম্বলডন সেমিফাইনালে অ্যান্ডি রডিকের বিরুদ্ধে হাফ-ভলিতে দৌড়ে নিজেকে বিশ্বের কাছে ঘোষণা করেছিলেন, এটা এমন একটি শট যা বেশিরভাগ টেনিস ধারাভাষ্যকাররা আগে কখনও কল্পনাও করেননি), সঙ্গে রাইভ্যাল রাফায়েল নাদাল এবং নোভাক জোকোভিচের মতো ওই দুটো মেশিনের বিরুদ্ধে একা অবিরাম আক্রমণের কৌশল, সার্ভ এবং ভলি (যেমন ক্যারিয়ারের শুরুতে আরও অনেক কিছু করেছিলেন), বা বেসলাইন-প্রধান খেলা।

ফেডেরার সর্বকালের সবচেয়ে গ্রেসফুল টেনিস প্লেয়ার, এটা তো সর্বজনবিদিত। কিন্তু আরও একধাপ এগিয়ে বলা যায় যে ফেড হল সর্বকালের সেরা গ্রেসফুল অ্যাথলিট, তর্কযোগ্যভাবে। টেনিস না খেলে লোকটা সিনেমা করলেও হয়তো একইরকম অসাধারণই থাকতেন, কারণ একইসঙ্গে মিষ্টি দেখতে আর অসম্ভব শৈল্পিক, গ্রেসফুল প্লেয়ার— এই দুইয়ের কম্বো হলেন বাসেলের বিস্ময়। একমাত্র জিনেদিন জিদান সম্ভবত সবচেয়ে কাছের সমকক্ষ। তাও কি? ২০টা মেজরের কাছে কিছু এসে দাঁড়াতে পারে কি?

শেষ ম্যাচ। ভারতীয় সময়, রাত ৩টে।

ম্যাচের শুরুতেই নাদালের ডাবল ফল্ট। এরপর যত এগিয়েছে, বেশ বোঝা গেছে যে এটাই শেষ ম্যাচ, আর দুজনের কেউই একেবারে ফিট নন। তাও প্রথম সেট কোনওরকমে ৬-৪ ফেভারে হল। কিন্তু সেকেন্ড সেটে টিফো-সক আগুনে ক্ষিপ্রতায় ব্যাক করছে। ফোরহ্যান্ডের উত্তরে সহজ রিটার্ন ফস্কাচ্ছেন নাদাল। পাশে ফেড হাসছেন। পেশাদারিত্বের চরম পর্যায়ে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ টেনিস প্লেয়ার নিজের শেষ ডাবলসে দাঁড়িয়ে অপোনেন্টের মিসে হেসে ফেলছে। কোথাও কি সূক্ষ্ম বেদনা লুকিয়ে ছিল হাসির ভিতরে? ফেড কি জানতেন, উল্টোদিকের অস্ত্রকে রোখার মতো অস্ত্র তাঁর ভাণ্ডারে আর নেই, জানতেন তিনি হেরে যাবেন? রাফাও হাসলেন, তিনটে বলের আড়ালে মুখ লুকিয়ে রাফাকে সেটাই বলছিলেন কি তিনি? শেষে তিনবার ডিউস করিয়েও তো লাভ কিছুই হল না।

৬-৬, টাইব্রেকার। আর সেখানে পরপর পয়েন্ট তুলে নিশ্চিন্ত জায়গায় রজার-রাফা। ৩-০। এরপরেই তাল কাটল। ৩-০ থেকে ৩-৩, ৩-৪। শেষমেশ এমন পরিস্থিতি যে ৯-৯। কী যে হল, ফ্রিক পয়েন্টে কেমন করে ম্যাচ নিয়ে গেল চিলে, ফেড দাঁড়িয়ে। কিন্তু, দুজন যে তখনও সেন্টার কোর্টেই।

যার একজনের শেষ ইন্টারভিউতে ডেকে নিলেন সমস্ত সতীর্থদের। একে একে এসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন বিয়ন বর্গ, অ্যান্ডি মারে, সিসিপাসরা। একটু তফাতে দাঁড়িয়ে রাফা। ডুকরে কেঁদে উঠলেন। রজারের চোখের জল বাঁধ মানছে না। আর ভোর ছটার সময় সার দিয়ে মনে পড়ে যাচ্ছে ২০০৮ উইম্বলেডন, ২০০৯ উইম্বলেডন, ২০০৬-০৭ ফ্রেঞ্চ ওপেন, ২০১৯ উইম্বলেডন সেমি। কখনও এটিপি ট্যুরে একসঙ্গে জুটি বেঁধে খেলা, কখনও একে অপরকে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে মেপে নেওয়ার বোবাযুদ্ধ। শেষ পর্যায়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলা। নাদালের মাসল যদি হয় ক্ষমতা প্রদর্শনের সর্বোত্তম ধাপ, নোভাকের রোবটসম ট্যাকটিক্স যদি হয় গ্রেটেস্ট হয়ে ওঠার জবরদস্ত ফর্মুলা, তবে সেই জ্যাজ-রকের মধ্যেই হঠাৎ মঞ্চে উঠে গাইতে শুরু করলেন—

“বিরহের জ্বালার পরে মধুর লাগে, বড় মধুর লাগে মিলন সুধা পান…”

একটা হারমোনিয়াম নিয়ে যিনি গোটা রক কনসার্টকে নিমেষে চুপ করিয়ে দিতে পারতেন, তিনিই কাল বললেন, বৌ ছিল বলেই ৪০ বছর ধরে খেলতে পারলাম। না হলে আরও আগেই…

ফলশ্রুতিতে, ফেড যতগুলো মেজর জিতেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে যদি তিনি আর GOAT (Greatest of all time) না হন, তবুও ফেডেরার সর্বদা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠই হবেন। শুধুমাত্র নান্দনিকতার সর্বোচ্চ প্রদর্শনই নয়, এখনও পর্যন্ত লোকটা নান্দনিকভাবে গ্রেটেস্ট ক্রীড়াবিদ। নিছক খেলাধূলাকে মহান শিল্পের স্তরে উন্নীত করেছেন এমন খুব বেশি প্লেয়ার নেই তালিকায়, আর সেখানেই তো লোকটা জিতে বেরিয়ে গেলেন। টেনিস যখন প্রায় মহাদানবদের হাতে চলেই গেছিল, তখন ফিনিক্স হয়ে এসে র‍্যাকেট ধরে আলতো ছোঁয়ায় বলকে কথা শুনিয়ে যাওয়ার জন্য লোকটার একটা ধন্যবাদ তো প্রাপ্য। এবং এর জন্য আমরা যারা খেলা এবং শিল্প উভয়কেই সমানভাবে ভালবাসি, তারা সর্বদা ফেডকে ভালবেসেই যাব। ভালবেসে সুখী হতে বলো কে না চায়…

রজার কেঁদে ফেলছেন। রাফা আজকের পর আরও একা। সবাই বলছেন রজার আর আসবে না, ফেড একটাই, এক এবং একমেবাদ্বিতীয়ম… ইতোমধ্যে ক্যামেরায় ধরা পড়ল নোভাক জকোভিচ। যিনি অনেক চেষ্টা করছেন চোখের জল আড়াল করতে, কিন্তু রাতের ঝলমলে সেন্টার কোর্টে সেটা যে আরও বেশি করেই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। নোভাক, আপনি আজ দেখতে দিন। নিছক স্ট্যাট, বিশ্লেষণের দিন পড়েই তো রইল। কেউ না কেউ এসে ক্যাঁক করে ধরবে। ধরুক, আজ আর কিছু যায় আসে না। পরে ওসব আবার হবে কোনও একদিন, যখন এই বিদায়গুলো ধীরে ধীরে সয়ে যাবে। বিরহগাথার মতো।

রজার চললেন। রাফাও যাবেন। একটা ডিকেডের অনেক অনেক বছর পর মধ্যরাতের সেন্টার কোর্ট হাসবে। এমনিই, কোনও কারণ ছাড়াই। আজি হতে শতবর্ষ পরে…

“মাঝে মাঝে মন্দ হলে, মন্দ কী!”

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4656 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...