সংশোধনবাদের পক্ষে একটি অলিখিত ইস্তাহার, এবং কোবাড

অত্রি ভট্টাচার্য

 

তোমার বুকের ’পরে আমাদের পৃথিবীর রাত:
নদীর সাপিনী, লতা, বিলীন বিশ্বাস।

–জীবনানন্দ দাশ

সংশোধনবাদ— কথাটা শোনামাত্রই জানি, অনেকে বিদ্যুৎ-পেষা, শকগ্রস্তের মতো তড়াক করে উঠবে। বিশেষত, যারা পার্টিজান বামপন্থী, পার্টি এক ও অদ্বিতীয় সত্য, পার্টিই একমাত্র উপাস্য ঈশ্বর যাদের কাছে। পরিভাষার সমস্যা, অনুবাদের গোলযোগ, কোনও একটি বিষয়কে ভাবগত জায়গা থেকে না বুঝে শুধুমাত্র ভাষিক অর্থে বোঝা, এইসব আমাদের অনেকগুলি, যাকে বলে শিকড়ের সমস্যা তৈরি করেছে। ধরা যাক, আমরা নব্বই-পরবর্তী বিশ্বায়ন ও কর্পোরেট-প্রণোদিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ‘উদারনীতি’ বলি, কিন্তু সত্যিই কি সেই ব্যবস্থা/অবয়ব/কাঠামো কোনও উদারতা অনুশীলন করে? করে না। তেমনই, সংশোধন করা বা সংশোধিত হওয়া নিয়ে, অন্তত বামপন্থীদের তো কোনওরকম অনীহা থাকার কথা নয়। এখন দেখতে হবে, অতি অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, সেই সংশোধন-বিরোধী বুর্জোয়া আর্থসামাজিক ব্যবস্থার গাছটিকে, সার-জল জোগাচ্ছে কি না? ব্যস, এটুকুই। এই লেখায় আমরা মূলত চেষ্টা করব, কোবাড গান্ধির জেলে বসে লেখা পলিটিক্যাল পলিমিক্স ও স্মৃতিচারণার অভূতপূর্ব কেতাব, ‘ফ্র্যাকচারড ফ্রিডম’ থেকে একটি অধ্যায়, বইটির শেষতম অধ্যায় ‘রিফ্লেকশন অ্যান্ড রেলেভেন্স’, এবং সেই লেখাটি নিয়ে কোবাডের পার্টি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)-র যে আদর্শগত আপত্তি, তার ঐতিহাসিক চরিত্র নিরূপণ করার। এছাড়াও, আমরা পাশাপাশি রাখব কমিউনিস্ট পার্টির চোখে দুই সংশোধনবাদী কার্ল কাউটস্কি ও এডওয়ার্ড বার্নস্টাইনকে, যাঁদের কথা উঠলেই ঋত্বিককুমার ঘটকের ভাষায়, ‘বিভিন্ন মতের ও পথের দাদারা’ খানিক খচে যান। এই নিবন্ধটি যিনি ফাঁদছেন, তার এঁদের প্রতি বিশেষ কোনও টান নেই, এঁরা তার চোখে নায়ক-খলনায়ক কিছুই নন, কিন্তু একটি বিশেষ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এঁদের অবস্থানটিকেও তাত্ত্বিকভাবে চেখে নেওয়ার প্রয়োজন আছে।

 

এক.

মনে রাখতে হবে, এই বইটি আত্মজৈবনিক। এই বইটি লেখার অপরাধে কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মাওবাদী) কোবাডকে, পার্টি থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নভেম্বর ১৭, ২০২১-এ পার্টি মুখপাত্র কমরেড অভয়, জানিয়েছেন, ‘Mr. Ghandy was wrong in saying that the movement has failed in reaching its target and there is no happiness and freedom in the Marxist way of life.’ এই মতপার্থক্যের কারণ বোঝা যাবে, আমরা যদি কোবাডের বইয়ের অন্তিম অধ্যায়টি পড়ি। যেখানে, শুরুতেই তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, আর্থ-সামাজিক যে ব্যাধিগুলি পৃথিবীর বুকে এখনও বর্তমান, তার উত্তর কি আদৌ কমিউনিজমের প্রোজেক্টটির মধ্যে রয়েছে? যেখানে, গোটা পৃথিবীর শাসকগোষ্ঠী হয়ে গিয়েছে অত্যন্ত ধূর্ত ও ফ্যাসিস্ট, তাদের সঙ্গে কর্পোরেট সংস্থাগুলোর সরাসরি মাখামাখি সম্পর্কে, শোষণব্যবস্থার জাঁতাকল হয়ে উঠছে  আরও শক্তিশালী, সেখানে কোবাড সন্ধান করছেন কমিউনিস্ট ইউটোপিয়ার প্রাসঙ্গিকতাকে।

নিজের ৩ নম্বর তিহারি কয়েদখানার বাইরে, একমাত্র গাছটিকে নিজের ছায়া হিসাবে ধারণ করে কোবাড যদিও বলছেন, ’till today no other economic system has appeared that is more just and sustainable than the communist project.’ কোবাড পরবর্তী বিপ্লবের ও নতুন পৃথিবীর স্বপ্নিল চারাগাছগুলিকে প্রতিপালনের তিনটি শর্ত রেখেছেন:

১. স্বাধীনতায় ভরপুর একটি পরিবেশ।
২. নতুন মূল্যবোধের জন্ম, যা তিনি  দেখেছিলেন নিজের আজীবন রাজনৈতিক সহযোদ্ধা, কমরেড অনুরাধা গান্ধি (জানকি)-র মধ্যে।
৩. একটি সর্বজনীন আনন্দময়তা (Universal happiness)-এর লক্ষ্য।

কোবাড জেলে থাকাকালীন সময়ে, নিজের মতাদর্শগত পরিসরে মানুষ ও পুঁজির বলয় ব্যতীত, প্রাণীজগতের কথা ভেবেছেন প্রায় ২,৫০০ বছরের প্রাচীন পঞ্চতন্ত্র, জাতকের গল্প ও হিতোপদেশের গল্পগুলোকে পুনঃপাঠের মাধ্যমে। প্রেমের রাজনীতি, মুক্তির লোকনীতি ও যে ‘ইউনিভার্সাল হ্যাপিনেসে’র তাত্ত্বিক কাঠামো কোবাড তৈরি করেছেন, তার উপাদান তিনি সংগ্রহ করেছেন সুফি ইসলামের মওলানা রুমির দর্শন থেকে, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকের ভক্তি পরম্পরার চক্রধর স্বামীর মহানুভব আন্দোলনের দর্শন থেকে। কিন্তু, এই দেশজ বামপন্থার সন্ধানী ও অনুসন্ধিৎসু চর্চাকে মেনে নিতে পারেননি ইউরোপীয় আলোকায়নের গুপ্ত সন্তান ভারতীয় বামপন্থীরা। কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মাওবাদী)র পক্ষ থেকে স্পষ্টতই জানানো হয়েছে— “the 70-year-old Ghandy was being expelled for abandoning the key tenets of “Marxism-Leninism-Maoist ideology” and adopting the bourgeois philosophy of “idealism, happiness and spiritualism.”

বাংলাতে তাদের রাজনীতির প্রতি সহানুভূতিশীল ছাত্রসংগঠন বিপ্লবী ছাত্র ফ্রন্টের মুখপাত্র কমরেড তথাগত রায়চৌধুরী, এই সময়ের অন্যতম জরুরি রাজনৈতিক পত্রিকা ‘Towards a new dawn’-এ লিখেছেন ‘The philosophical outlook required to combat these reactionary classes cannot be derived from the old Bhakti movement, despite it retaining its historical importance and cultural value. But in this case, instead of building up struggle depending upon Marxist science, the author has been a victim of idealist musings.’ এখানে লক্ষণীয়, যারা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের কথা দিবারাত্র বলেন, যারা ‘দুটি প্রকট বৈপরীত্যের মধ্যে যুগপৎ ঐক্য ও সংগ্রামের’ কথা জানেন, তারা এই দার্শনিক অবস্থানগুলির মধ্যে কেবল পশ্চাদপসরণের চিন্তাই দেখতে পেলেন, তার বিরুদ্ধে সংগ্রামে রত হতে গিয়ে এই দার্শনিক ভাষ্যগুলির সহজ পরিভাষায় যেভাবে লোকজ জনতার কাছে পৌঁছানোর ক্ষমতা রয়েছে তাকে উপেক্ষা করা হল, লড়াইয়ের প্রয়োজনের জন্য ঐক্যের কথা দূর অস্ত।

গণতন্ত্র প্রসঙ্গে সহজ সত্যটি কোবাড আবিষ্কার করেননি, বরং পুনরুচ্চারণ করেছেন, যে গণতন্ত্র কোনও কৃত্রিম, চাপিয়ে দেওয়া কাঠামোবাদী নির্মাণ নয়, এর গঠনে প্রয়োজন মানুষের মৌলিক গুণাবলী: দয়া ও করুণা, কৌমবদ্ধ জীবন, সহাবস্থানের রাজনীতির জাগরণ ও অনুশীলন। তাই গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার ধ্বজাধারীদের কিছু কঠিন প্রশ্নের মুখে ফেলে কোবাড লিখছেন, ‘In fact, new ideas in Marxist circles are often seen as dangerous, and the person is either label-led, targeted or isolated. This approach does not help growth, particularly at a time when there have been enormous change in society and most movements for change are marking time or retreating.’ কার্ল কাউটস্কি, যে জার্মান মার্কসবাদী ছিলেন লেনিন সহ বলশেভিকদের মতাদর্শগত পলেমিক্যাল আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু, তিনি ১৯১৭ সালে রুশ ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে একটি প্রবন্ধ লেখেন, যার মূল বিষয় ছিল সমাজতন্ত্রের সঙ্গে গণতন্ত্রের আবশ্যিক সম্পর্ক। সেই প্রবন্ধেই তিনি বলশেভিকদের প্রায় এই কোবাডোচিত ভঙ্গিতেই সতর্ক করে লিখেছিলেন, ‘social production without democracy could become a most oppressive bond. Democracy without socialism would allow the persistence of the economic dependence of the proletariat.’ কাউটস্কি পরবর্তীতে তার ‘ডিক্টেটর অফ দ্য প্রোলেতারিয়েত’-এ বলার চেষ্টা করেছিলেন যে, কেবলমাত্র সমাজতন্ত্র অর্জন করে থামলেই চলবে না। আমাদের সমাজ থেকে শ্রেণি, রাষ্ট্র, জাতি ও পার্টির নামে হয়ে চলা সমস্ত শোষণ ও নিপীড়নকে উৎখাত করতে হবে। শেষ পর্যন্ত কাউটস্কির, গণতন্ত্রের শূন্যতায়, অনুপস্থিতিতে সমাজতন্ত্রের নির্মাণ সম্ভব হবে না’ এহেন নিদান, পাগলা মেহের আলির সব ঝুট হ্যায়’-এর মতো প্রতিধ্বনিত হয়েছিল সরকারি বামপন্থার অন্দরমহলে।

 

দুই.

আজকের চরম-ভোগবাদী সমাজে, শ্রমিকের নিজের শ্রমের ফসল থেকে বিযুক্তি এমন ভয়াবহ জায়গায় গিয়েছে, যে ৯৯ শতাংশ জনগণের শ্রমশক্তির উপর নির্ভর করে নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করছে এলন মাস্ক, জেফ বেসোস, গৌতম আদানিরা। প্রতিটি ব্যক্তিমানুষ ভার্চুয়াল অ্যালিয়েনেশনের শিকার, সমস্ত মানবিক অনুভূতিগুলির দ্রুত মৃত্যু ঘটছে। এহেন প্রেক্ষিতে, কোবাড পুনরায় পাঠ করছেন মার্কসের লেখা ফয়েরবাখ থিসিসের তৃতীয় অংশ, যেখানে মার্কস লিখছেন, ‘the proletariat would, in the process of remaking the world, also remake itself’, এই যে নিজেকে পুনরায় বুনে নেওয়ার সঙ্কেত, একেই কোবাড ফুটে উঠতে দেখছেন রুমির কাব্যে, যেখানে রুমি বলছেন— প্রেম, একমাত্র প্রেমই, এই লোলচর্ম চাকর, লাথখোর ও চুরির নেশায় মাতোয়ারা আমিকে মুকুটহীন সম্রাটের মর্যাদা দিয়েছে।

আরেক জার্মান সমাজ-গণতন্ত্রী, যিনিও আজীবন ওই সংশোধনবাদের কাঁটার মুকুট বয়েছিলেন, তাঁর ‘দি প্রিকন্ডিশনস অফ সোশ্যালিজম’-এ লিখেছিলেন, ‘Nowadays we find the opression of a minority by the majority ‘undemocratic’, although it was originally held to be quite consistent with government by the people.’ এই সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদের যুগে, গণতন্ত্রের বা সমাজতন্ত্রের এই কাল্ট দিকটিও কি উল্লেখযোগ্য নয়? তাই তো আজও আমাদের মুসোলিনির ফ্যাসিবাদের কথা বলতে যতটা সুখ হয়, স্তালিনের মার্কসবাদের নামে চালানো আধিবিদ্যক অপকর্মগুলির কথা বলতে মুখে আটকায়।

এইখানেই কোবাড অনন্য একটি আবিষ্কার করেছেন, আমাদের সমস্ত পূর্বসংস্কার তিনি ধুয়ে ফেলতে চেয়েছেন, পরম্পরা থেকেই আসা সহজসাধনার জলে, তাই তিনি রুমি পড়েন, বয়েৎ ইত্যাদিতে ফিরে যান, যেখানে বলা হচ্ছে— ‘হয়ে ওঠো একটি বৃক্ষের মত, এবং ঝরে যেতে দাও মৃত পাতাদের’।

কমরেডরা কি এই সঙ্কেত, এই লিপি, সত্যিই পড়তে অপারগ হলেন?

Fractured Freedom: A Prison Memoi. Kobad Ghandy. Roli. Rs.559.

গ্রন্থপঞ্জি:

  • Roychowdhury, Tathagata. A Few Words about Kobad Ghandy’s Fractured Freedom. Towards a new dawn: January, 2022.
  • Salvadori, Massimo. Karl Kautsky and the Socialist Revolution 1880-1938. P-352, 421, 422.
  • Ostrowski, Marius S. Eduard Bernstein on Socialism Past and Present: Essays and Lectures on Ideology. Palgrave Macmillan. P-838.
  • Ghandy, Kobad. Fractured Freedom: A Prison Memoi. Roli. P-264 to 297.
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...