রোমেল রহমান

রোমেল রহমান | গহীনে এক মাঘের কোকিল টের পাই

গহীনে এক মাঘের কোকিল টের পাই

 

দৌড়ে শীত ডিঙিয়ে যাওয়ার চেয়ে কফির মগে চায়ের কাপে কিংবা খোদ বাংলা মালের গ্লাসে লাফিয়ে পরা ভাল!
জায়নামাজ জাপ্টে কাঁপতে থাকা তালবেলেমের হাড়ে রাত্রি আজ আজ্রাইলের মতো নির্মম।
আমরা আগুন জ্বালবার জন্য হৃদয় খুলে রাস্তায় জড়ো করে বসে আছি দেশলাইয়ের অপেক্ষায়!
শুনেছি আগুন দেখলে ফায়ারব্রিগেড প্যান্ট খুলে ছুটে আসে; বিদ্রোহী দেখলে যেমন পুলিশ নাক ডেকে হানা দেয় পড়শির ঘুম চুরমার করে!
এ এমন শীতার্ত অভিজাত সবজির মরশুম যখন— হালুয়া খাওয়ার জন্য ঘি থাকে না;
বিলাইয়ের মতন ঘর্ঘর তুলে আমরা পরাজয় কাঁধে ওম খুজি আর বিপ্লব-বিরোধী পিতামাতারা পাত্র বা পাত্রী তালাশ করে নাতিপুতির খোয়াবে।

মুলোক্ষেতে সন্ত্রাস দেখে জন্মদিনে কাউকে ফুলকপি উপহার দিই! বাজারের ব্যাগ হাতে আব্বা আজকাল তেলাপিয়ামাছকে ইলিশ ভাবতে আগ্রহী! বোনের সংসারে তবু বেড়ে চলে হরিণের বাচ্চার ডিগবাজি!
উড়ন্ত গ্রিবাজ শুধু আমি একা রোদ্দুরহীন,
আঙুলগুলো লোহার রডের মতো হিম ও বেকার;
বেগানা গোরেস্তানে দাঁড়িয়ে ভোরের কুয়াশা মাপতে মাপতে পেরেশানে ডুবে যাই— আমার বুকের পর কত টন কুয়াশা জমাট হলে পাঁজরের কড়িকাঠ মড়মড় করে সব শীত লুফে নেবে বুকের গহীনে?

০৭ জানুয়ারি ২০২৩

 

প্রাতরাশ টেবিলে

নিহারির তপ্ত ঝোলে সাতার দিয়ে বসে আছি প্রাতরাশ টেবিলে!
দুধ-চায়ে সর কাঁপছে— স্মৃতির মতো তিরতির।
আবহাওয়া বার্তায় হাড়ে হাড় ঠকাঠক আগামী অনেকদিন!
তবু হাওয়ায় ভেসে আসছে তন্দুলপোড়া মিঠে ঘ্রাণ, আসন্ন মাঘের আগে জবুথুবু আমি বসে আছি গাছের গুঁড়ির মতো শ্রান্ত মহাকাল।
দূর থেকে ফুলকো রুটি হাতে ‘..ওস্তাদ ওস্তাদ’ হাঁক ছুড়ে ছুটে আসছে পেয়ারা জুম্মান;
বহুদিন মমতার হাত দিয়ে সে আমার পাত ভরে দেয়।

আর এই সকালবেলায় কোত্থেকে মেহেদি হাসান আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য গেয়ে যাচ্ছেন— ‘… আ ফির মুঝে ছোড়কে জাঁন্যে কি বাহা ন্যে!’
বিপন্ন আমার হৃদয় ঝাঁঝালো নাস্তার সমারোহে ভিখেরির মতো আচানক— নাজুক হয়ে গেল।
উষ্ণতা হারানো চায়ের কাপে ভেসে থাকা সরের মতন নিজেকে মনে হল চুমুক না দেওয়া এক পলকা জীবন;
বেদনার সঙ্গত পেলে কী ভীষণ তোলপাড় হয়ে গলে যায় মোমের মতন,
বেঘোর হৃদয় তাই মোনাজাত রাখে—
কুয়াশায় তলিয়ে থাকা কাকের পালকের মধ্যে সূর্য আজ ডুবে থাক সমস্ত দিন।

০৮ জানুয়ারি ২০২৩

 

পৌষ উৎসব

শীত ঘুমিয়ে আছে আমাদের ঘরের চালে,
আমরাও ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সারারাত তাকে পাহারা দিচ্ছি!
একটু ওমের খোঁজে শীত এসেছিল উঠোনে,
অথচ রোদের আশ্বাসে তাকে আমরা রাখিনি লেপের তলে।
শীত ঘুমিয়ে আছে পৌষের মাঠে,
ধানকাটা মাটিতে এখন ইঁদুরের সাথে আমাদের কল্লোল—
আগুন জ্বালিয়ে তাকে উদযাপন করতে করতে গ্যালারিতে বসিয়ে রেখেছি কুয়াশা পরিয়ে।
তাকে নিয়ে কাব্য করতে করতে রোদ উঠে যাবে,
আমাদের সব রাত সকাল হলেই সোয়েটার খুলে ফেলে।
ধোঁয়া ওঠা হাঁসের মাংসের সাথে সন্ধ্যায় শীতের তর্জমা খুলতে খুলতে অতিথি পাখির শোকে রক্তের ঘ্রাণ মুছে ফেলব আবার।
বিব্রত শীত শুধু রসের ফোঁটায় জমে উঠবে পায়েসের ঘ্রাণ হতে নির্বাক।
অথচ আমি জানি— কলাইশাকের ক্ষেতে আমার পায়ের চিহ্ন সূর্যের সাথে উবে যাবে;
তারই জন্যে আজ এই উৎসব!

২৮ ডিসেম্বর ২০২২

 

মানুষ নামের কোন ফুলে মানুষগন্ধ নেই

মানুষের মধ্যে দুঃখ দাঁড়িয়ে আছে!
অথচ মানুষ রঙিন পোষাকে ফুরফুরে।
তাকিয়ে আছি সেই ভোর থেকে, তবু কারও বিম্ব দেখছি না!
জলের মধ্যে কুয়াশা থকথকে,
কোথাও কারও কান্নার ঝুমঝুমি বেজে যাচ্ছে অনর্গল।
‘ওকে চুমু দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও।’
কার যে এমন গভীর কণ্ঠস্বর কানের পাশ ঘেঁষে উধাও হল।
অথচ তার দেহের গন্ধ কোথাও পাচ্ছি না।
দগ্ধ ফুলের বাগানবন্দি মানুষ দেখছি বিমর্ষ মুখ নিয়ে চায়ের কাপে নিজেকে খুঁজছে।
ডুবে যাওয়া বিস্কুটের ওই গন্ধে লাশের শোক,
চামচে নেই ভরসা আজকাল; নিজের উপর অনাস্থা প্রস্তাব।
আয়নাগুলো বিম্ববিহীন কফিন,
জলের মধ্যে গুলুজুলু;
না-কি অবয়বে খাদ?
নদী বলতে— অশ্রুবিহীন দাগ।
তবু আমরা দেখছি প্রতি ভোরে— আমাদেরই মধ্যে কুয়াশা কাঁপছে,
দুঃখ জমে আছে ফুঁপিয়ে কাঁদা কিশোরীর বুক ঠেলে।
(চারিদিকে রঙিন মোড়ক,)
অথচ আমার বাগানভর্তি মানুষ নামের কোনও ফুলে মানুষগন্ধ নেই!

২০ ডিসেম্বর ২০২২

 

অগ্রহায়ণের ঘ্রাণে

আমার সমস্ত শরীরে ধানের গন্ধ!
বুকে পিঠে রোদ, মাথায় কুয়াশা আর শিশিরের স্নান; বুকের মধ্যে হাহাকার!
বেদনাগ্রস্ত অগ্রহায়ণ আমার দশদিকে,
মানুষের দীর্ঘশ্বাসে নরম পথঘাট দিগন্তের সন্ধ্যানামা কুহক এখন!
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখেশুনে গভীর মৌন হয়ে আছি।
তসবিদানার মতো একে একে শিশিরের শব্দের জপ ফুরায় সকাল এলে, আমার দুচোখে ভোর ভেজা গন্ধের মতো লেপে থাকে।
শিকারির ফাঁদে পড়া কান্নার মতো একা আমি;
চেয়ে থাকি—
ভোরের পাখির ঝাঁক এলে তোমার ঠোঁটের মতো সর্বনাশা আশ্রয় পেতে ধানের গন্ধ নিয়ে শরীরের পরতে পরতে আকাশের দিকে!

১২ ডিসেম্বর ২০২২

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4861 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...