শতানীক রায়

যাতায়াত

 

কখনও কখনও প্রখর রোদ উঠলে ধুন্ধলা চোখে দেখি— সবকিছুই এক আলোর আবর্ত জলে মাখানো মাটির মতো নিজ গ্রন্থ হারিয়ে ফেলেছে। আর নিজেকে বই হিসেবে উপস্থাপন করছে এক অন্য আকাশ-মাটি-পর্বত ঘেরা বায়ু। কোনও কোনও মানুষ ভীষণ ধীরে হেঁটে যাচ্ছে জলে। এখানে ছোট সরোবর খুঁজে পেয়েছে একদল পাখি। একদল কোকিল একে-অপরের থেকে আলাদা হয়ে শুধুই সুর তুলে চলেছে। কোনও কোনও দিনে রৌদ্রতপ্ত দিনে আমার মনে পড়ে এইসব যুদ্ধহীন কবিতা।

 

যখন তোমার হাত পা ঠিকঠাক জায়গায় থাকে না। নতুন করে শিখতে হয় চলাফেরা। যখন মানুষ নিজের মতো ভীষণ থাকে না। মুখও বাইরের দিকে থাকে না। গাছ গজিয়ে ওঠে মাঝখানে। এই এক অদ্ভুত বিড়ম্বনা। মানুষ কেবল মানুষে পরিণত হয় না তাকে গাছের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। ঠিকঠাক থাকে না কোনও কিছুই। কেবলই নিজেকে মনে করাতে থাকে সে। হয়তো সে মানুষ। হয়তো তুমি এখন গাছ। হয়তো আমার এখন শরীরই নেই। ঘূর্ণন শুধু। সিঁড়িও হতে পারে। হয়তো আপন মনে কথা বলতে বলতে মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে।

 

এখানে অনুসন্ধান থাকে আর তুমি ডুবে যাও। হয়তো এরই মাঝে তুমি সাঁতার কেটে নাও কিছুটা। হয়তো ডোবার অভ্যেস হতে থাকে। ভাসার অভ্যেসও হয় কিছুটা। এখানে জন্মমৃত্যুর দিশা প্রাপ্তি হয়। যেভাবে তুমি মন-মুখ হারিয়ে ফেলো ভিড়ে। দানের ভেতর হারিয়ে ফেলো গ্রহণ। মানুষকে দেখো আর দিবানিশি ভাবতে থাকো সূর্য থেকে কত কত লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ দূরে আছি। এভাবেও তুমি থেমে যাও না। গাছে ফুল ফোটে। এই তোমার অভ্যেস গেঁথে গেঁথে নিয়ে চলা সব।

 

একত্রিত হতে থাকো। এখানে মানুষ তার অনুভূতির জন্য জড়ো হয়েছে আজ। তুমি দেখতে থাকো। আমিও এসব দেখি। লজ্জার ভেতর থেকে ছিঁড়ে ফেলি লজ্জাকে। পাখিকে পাখি কী দারুণ আশ্রয় দেয়। তুমি কথা বলতে থাকো। বা তুমি চুপ করে থাকো। আবার কথা বলো। বাড়ির ভেতর আশ্রয় চাও। আমি কথা শুরু করি। আমি গানের মতো চলতে থাকি। এই যে দুপুর পেরোনো আমি। এখন সন্ধ্যা শেষ করে রাত পর্যন্ত নিজেকে টেনে রাখি। এরকম টেনে রাখা শরীর কি কেউ কখনও দেখেছে?

 

তোমাকে একদিন না একদিন কথা শুরু করে টানা এগোতে হবে। নদীর গতি এরকম নয়। এভাবে মানুষ চলে না। কচ্ছপের গতি আরও মৃদুমন্দ। বাতাস একটু চঞ্চল। এখন পর্যন্ত পাখির আয়তন লক্ষ করে এগিয়ে যাওয়া। মানুষ ঠিক চলতে থাকে। একভাবে চলতে গিয়ে তার মনে পড়ে শরীরের আত্যাশ্চর্য বায়ু। মুখটা ঠিক মুখের জায়গায় নেই। ভেতরের দিকে কোথাও। অথচ তোমাকে টানা এগোতে হবে। পৃথিবী এভাবে এগোতে থাকে। আকাশপথে এত নক্ষত্র। এত স্থির। এত এত বছর বেঁচে থাকার পর এত কিছু দেখার পর একটা নির্দিষ্ট গন্ধের কাছে আমাকে ফিরে যেতে হয়। এত এত বছর পর আমার মুখের কথা এখন পাখির মতো হয়েছে। এখানে পাখির মতো কিছু কবিতা পড়ে আছে, আজ।

 

এই খানিকক্ষণ আগেই তার ইচ্ছে হল সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব খবরাখবর জেনে কোথাও উড়ে যাবে। সেখানে অরণ্যনির্জন আর জলঝরনার মতো ধ্বনি। সেখানে মানুষ আর পক্ষীর পার্থক্যে পৌঁছানো যায়নি এখনও। মানুষ কল্পনা করতে থাকে কেবল তার স্বপ্ন অবধি এত আকাঙ্ক্ষার পথ। আর দুর্গম এই জীবন… এই অস্তজ্ঞান আর ডানা ঝাপটানো। হায়… তুমি এসব কল্পনা করেছ কখনও? গভীর রাতের ভেতর আরও গভীর থাকে। তুমি কল্পনা করো শুধু। তোমার পথ কেবল পাখিতে ভরাট থাকল আজ।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4138 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...