পার্থপ্রতিম মণ্ডল
সাল ১৮৩৬ থেকে ১৯০৯। ৩৪৯০ কিলোমিটার পথ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলে যে দেশটাকে আমরা চিনি তার গড়ে ওঠার পিছনে এই সাত দশকব্যাপী ৩৪৯০ কিলোমিটার পথচলা। পুব থেকে পশ্চিমে। কিছুটা অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়, কিছুটা ধর্মপ্রচারের লক্ষ্যে, তবে মূলত জমিদখলের লালসায়। বলদ আর খচ্চরে টানা গাড়িতে, অরণ্য, পাহাড়, খরস্রোতা নদী, বিস্তীর্ণ প্রান্তর— লক্ষ লক্ষ আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা ভাগ্যের অন্বেষণে পাড়ি দিয়েছিলেন এই পথ। গন্তব্য সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট ধারণা ছাড়াই, বন্ধুর পথে অচেনা নানা ভয় মাথায় নিয়ে, ভয়ঙ্কর রোগজ্বালা, মহামারিতে বারেবারে পর্যুদস্ত হয়ে, সর্বোপরি যাদের আদিভূমি তাঁরা দখল নিতে চলেছেন তাদের প্র্রতি-আক্রমণে মৃত্যু হতে পারে জেনেও তাঁরা এই পথচলা থেকে বিরত হননি।
হ্যাঁ। একান্ন রাজ্য ও এক যুক্তরাষ্ট্রীয় জেলা নিয়ে গঠিত ৯৮.৩ লক্ষ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট যে দেশটিকে আমরা আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলে জানি, তা তৈরি হওয়ার পিছনে কাজ করেছে লক্ষ লক্ষ মানুষের এই যাত্রাপথ— মার্কিন ইতিহাসে যা ‘ওরেগন ট্রেল’ নামে বিখ্যাত। এই যাত্রাপথে অংশগ্রহণকারী সকলেই যে ইংরেজ ছিলেন এমন নয়, ছিলেন ফরাসি, জার্মান, ডাচ, স্প্যানিশ— সব ভাষাগোষ্ঠীর দখলদাররাই। তবে তারা প্রায় সকলেই যে শ্বেতাঙ্গ সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কতিপয় কৃষাঙ্গ যাঁরা ছিলেন তাঁরা যোগ দিয়েছিলেন হয় শ্বেতাঙ্গ মালিকদের ক্রীতদাস হিসেবে, না হয় পূর্বতন শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের কবল থেকে মুক্তির আশায়। আর ছিল ‘বাফেলো সোলজার্স’-এর দল। তারাও কালো চামড়ার। আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে লড়াইয়ে যাদের শ্বেতাঙ্গ সেনাপ্রধানরা এগিয়ে দিয়েছিল সামনের সারিতে।
কিন্তু ঠিক কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল এই যাত্রাপথে অংশগ্রহণকারী সেই মানুষগুলোর? কেমন ছিল ভয়ঙ্কর শীতে বা প্রবল বর্ষায়, অজানা ধূ ধূ প্রান্তরে বা দূর্গম পথের ধারে সপরিবারে তাদের জীবনযাপন? তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ, কেমনধারা মানুষ ছিল মার্কিন ভূখণ্ডের সুপ্রাচীন সেই উপজাতিরা, শ্বেতাঙ্গ আগ্রাসন যাদের এক বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিতে পর্যবসিত করেছে? শত শত গোষ্ঠীতে বিভক্ত, তবু প্রকৃতিনির্ভর এক অবিচ্ছেদ্য সংস্কৃতিতে একসূত্রে বাঁধা, এই আদিবাসীরা কমপক্ষে বারো হাজার বছর আগে এশিয়া থেকে অভিবাসী হয়ে এ-অঞ্চলে এসেছিল। কেমন ছিল শ্বেতাঙ্গ আগন্তুকদের প্রতি তাদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া… কীভাবে সেই প্রতিক্রিয়া বদলে গিয়েছিল ভয়াল সংঘর্ষে… ১৮৬২ সালে আব্রাহাম লিঙ্কন যখন ‘হোমস্টেড অ্যাক্ট’ পাশ করলেন, (যে আইনের বলে দখলদাররা ১৬০ একর পর্যন্ত দখলিকৃত জমির মালিক হওয়ার আইনি অধিকার লাভ করল) তখন কীরকম ছিল এই আগ্রাসনের মাত্রাটা?
এই সময়কে যাপন করেছিলেন যে ব্যক্তিরা তাদের স্মৃতিকথায় যদি উঠে আসে সেসব প্রশ্নের উত্তর তাহলে তার থেকে জীবন্ত ইতিহাস আর কীই হতে পারে! আলোচ্য বইয়ে সম্পাদক ও অনুবাদক নীলাঞ্জন হাজরা আমাদের পড়িয়েছেন এমনই চার ব্যক্তির স্মৃতিকথা যাদের কথনে সেই অগ্নিগর্ভ দিনগুলির ছবি আমাদের চোখে জীবন্ত হয়ে ওঠে। স্মৃতিকথার দুটি দুই শ্বেতাঙ্গ মহিলার, একটি এক শ্বেতাঙ্গ পুরুষের আর চতুর্থটি এক কিংবদন্তি ইন্ডিয়ান যোদ্ধার— আপাচে নেতা জেরোনিমো-র।
এই চার স্মৃতিকথার প্রথমটির লেখক এজরা মিকার। মূল বইটির নাম Ox-Team Days on The Oregon, যেখানে এজরা মিকার ১৮৫২ সালে তার তরুণী স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে নিয়ে ‘ওরেগন ট্রেল’ ধরে পশ্চিমে পাড়ি দেওয়ার রোমহর্ষক কাহিনি বর্ণনা করেছেন। ভূমিকায় নীলাঞ্জন লিখেছেন, মার্কিন মূল ধারার ইতিহাসে পশ্চিমে পাড়ি দেওয়ার এই ইতিহাসকে দেখানো হয় শ্বেতাঙ্গদের রক্তে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যে ঝুঁকি নেওয়ার সাহস, ক্ষমতা ও উদ্যম হিসেবে। কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস বলে, শ্বেতাঙ্গরা বেরিয়ে পড়েছিলেন একরকম বাধ্য হয়ে। পুঁজিবাদ তাদের তাড়া করেছিল, যে পুঁজিবাদের রাষ্ট্রীয় রূপ ছিল মার্কিন সরকার। কথাটা যে কী ভীষণ সত্যি তা এজরা মিকারের স্মৃতিকথা পড়লে ছত্রে ছত্রে উপলব্ধি হয়। সেই সঙ্গে স্পষ্ট হয় নেটিভ ইন্ডিয়ান আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতি তাদের মানসিকতা। একটি ছোট্ট উদ্ধৃতি দিলেই পাঠক বুঝতে পারবেন। স্মৃতিকথার এক জায়গায় এজরা মিকার লিখছেন: “আমাদের দলগুলো মিসোরি নদীর পূর্ব পাড়ে হাজির হওয়া ইস্তক আমাদের সঙ্গে ইন্ডিয়ানদের ঝামেলা শুরু হয়ে গেল। খোলাখুলি সংঘাত নয়, ভিক্ষে করার অছিলায় চুরি-ডাকাতি।“ মার্কিন শ্বেতাঙ্গ ও নেটিভ ইন্ডিয়ানদের দীর্ঘ লড়াইয়ের প্রথমদিককার কথা লিখছেন মিকার। কিন্তু অন্যায়ভাবে আদিবাসীদের মাটি দখল করে নেওয়া নিয়ে কোনও বিবেকের দংশন তো দুরের কথা, বরং যাবতীয় মূল্যবোধকে ধামাচাপা দিয়ে এক শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ তার প্রতিটি অক্ষরে স্পষ্ট। যে শ্রেষ্ঠত্ববাদ নেটিভদের গায়ে ‘চোর’ ও ভিখারি’র তকমা সেঁটে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না।
তবে এরও মধ্যে কেউ কেউ যে এই যাত্রাপথে অংশ নিয়েছিলেন জমি দখলের উদ্দেশ্যে নয়, প্রভু যিশুর ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বা তাদের লব্জে আদিম জনগোষ্ঠীকে ‘সভ্য’ করার লক্ষ্যে সেকথাটাও সমানভাবে সত্যি। এই ‘সভ্য’ করার ব্যাপারটা যে পুঁজিবাদী ঔপনিবেশিকতারই আরেক পিঠ সেকথাটা তাঁদের যদিও কোনওভাবেই মনে হয়নি। ‘ওরেগন ট্রেল’-র প্রথমদিককার যাত্রীদের মধ্যে এরকমই একজন ছিলেন, পাদরি-চিকিৎসক মার্কাস হুইটম্যান। এলাইজা স্প্যাল্ডিং ও ক্যাথেরিন স্যাগার-এর স্মৃতিকথা দুটিতে পাঠক খুঁজে পাবেন সেই ইতিহাস।
তবে এই বইয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে অধ্যায় তা হল, জেরোনিমোর জীবনকাহিনি। জেরোনিমো, মার্কিন ইতিহাসের এক কিংবদন্তি, এক ‘হিংস্র, রক্তপিপাসু, বর্বর’ থেকে যিনি হয়ে উঠেছিলেন মার্কিন জাতীয় হিরো, যাঁকে নিয়ে তৈরি হয়েছে একাধিক সিনেমা, লেখা হয়েছে অজস্র বই, তাঁর নাম আর শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে নেটিভ আমেরিকানদের সুদীর্ঘ লড়াই আজ সমার্থক হয়ে গেছে। মার্কিন সামরিক শক্তির হাত থেকে তাঁদের বাসভূমিকে রক্ষা করার আপসহীন লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন জেরোনিমো। মেক্সিকান হত্যাকারীদের হাতে মা, স্ত্রী, সন্তানদের হত্যা যাঁর রক্তে প্রতিশোধের আগুন জ্বেলেছিল, মার্কিন সরকার তাঁকে বন্দি করার বারেবারে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। ইতিহাসের এ এক পরিহাস যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট নির্বাচনে জিতে তাঁর বিজয় মিছিলে সামিল করেছিলেন তাঁকে। কিন্তু সত্যিই কি রাজনৈতিক চাল জেরোনিমোকে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল? ১৯০৯ সালে, ১৭ ফেব্রুয়ারি, মৃত্যুর ঠিক আগে জেরোনিমো বলেছিলেন: ‘উচিত ছিল না আত্মসমর্পণ। উচিত ছিল লড়াই করে যাওয়া ততক্ষণ, যতক্ষণ না আমিই থেকে যাই শেষ জীবিত ব্যক্তি হয়ে।’ এস এম ব্যারেটের অনুলিখনে জেরোনিমোর জীবনকাহিনির এই বাংলা তর্জমা আমাদের মতো পাঠকের কাছে এক বড় প্রাপ্তি।
চার স্মৃতিকথা ছাড়াও বইয়ের এক বড় অংশ জুড়ে রয়েছে আরও দুটি প্রয়োজনীয় অধ্যায়। তর্জমাকারের বহু প্রচেষ্টায় সন্ধান পাওয়া এক বাফেলো সোলজারের (নাম, রুবেন ওয়ালার) এক দীর্ঘ চিঠি। চিঠিটির নাম: ‘ঊননব্বই বছর বয়সে এক দাসের স্বরচিত ইতিহাস’। অপর অধ্যায়টি নীলাঞ্জনের প্রিয় বিষয়: যাত্রাপথের খানাদানা। খাদ্য যেহেতু শুধু খাদ্য নয়, ইতিহাসকে জানার, সংস্কৃতিকে জানার তা জরুরি উপাদানও, তাই এ অধ্যায়টিও অনুসন্ধিৎসু পাঠকের খুব কাজে লাগবে। পাঠকের কাছে এই বই উল্লেখযোগ্য দলিল আরও এক কারণে। তা হল, পাতায় পাতায় দেওয়া অসংখ্য ছবি, আর সম্পাদকের প্রয়োজনীয় ফুটনোট। দুর্লভ ছবিগুলি বইটির মূল্য যে অনেক, অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
চকমকি (মার্কিন পশ্চিমের অগ্নিগর্ভ দিনকালের স্মৃতি)
সম্পাদনা ও তরজমা: নীলাঞ্জন হাজরা
প্রকাশক: ধানসিড়ি।
৬০ এফ কালীচরণ ঘোষ রোড, কলকাতা ৭০০০৫০
দাম: ৬৫০ টাকা