![rimi](https://i1.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2023/02/rimi.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
রিমি মুৎসুদ্দি
ওড়িশার এক মফঃস্বল মাইনিং টাউন বরবিল। সেখানে দূরে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ক্রমশ মায়া আর নীল আলোর মিথষ্ক্রিয়ায় যে ছেলেটা শৈশবে একটা নিজস্ব অলীক রাজপ্রাসাদ গড়েছিল, তার গল্পে কখনও মেঘ এসে উঁকি দেয় কখনও ‘হৃদয় আকাশে’ ‘লীলাছায়ায়’ শান্ত সে বিকেলে অথবা রোদেলাবেলায় অগুনতি আলোর আলোড়ন। সেই মায়াজগতে অশরীরী ছায়ার ভয় সব যেন ভাত ফোটার গন্ধে মিশে যেত। ছেলেটার ভূতের ভয় এভাবেই কেটে যেত! গল্প অথবা স্মৃতিধুলো আরও একটু উড়ল।
আলোর মালার থেকে উল্টোদিকে পিঠ করে দূরের কোনও লণ্ঠন-কুটিরে ক্রন্দনরত বাচ্চার শান্ত হয়ে যাওয়া অনুভব করতে করতে, দীর্ঘ ট্রেন যাত্রার পর তারার আকাশ দেখার সামান্য অবকাশ পেত ছেলেটির মা। সেইসব নিশ্চিন্ত রাত্রিগুলোকে হারিয়ে দিয়ে একটা রোদেলা দিন আর বিরাট বড় বিপর্যয়, ছেলেটার বাবার অসুস্থতা, জীবন থেকে শৈশবের বরবিলটুকুই বাদ পড়া যেন রাহুল দ্রাবিড়ের হেরে যেতে যেতেও মাঠে টিঁকে থাকা। ছেলেটার বিশ্বাস ‘…অসফল হতেই পারি কিন্তু তা যেন ভাল করে করতে পারি।’ Failing well, এ ভাবনায় তার অসীম বিশ্বাস।
অনির্বাণ ভট্টাচার্যের গদ্যের বই ‘মরা আলোর সিম্ফনি’ যেন মায়ার রঙে তুলি ডুবিয়ে আঁকা এক স্মৃতিগল্প। যেখানে ব্যক্তিগত স্মৃতি আর সমষ্টিগত ভাবনা বৃষ্টি আর কাঁচামাটির ঘ্রাণের মতো এক অদ্ভুত নেশা জাগায় পাঠকের মনে। পাঠক অনির্বাণের মায়ার আলপনায় নিজের টুকরো টুকরো ইমেজারি দেখতে পায়। দেখতে পায় কয়েকটা জানলা দরজা, যার মধ্যে এসে পড়ে কতগুলো আবশ্যিক অনুষঙ্গ। যেখানে কখনও মেকিং অফ পথের পাঁচালী-র খণ্ড দৃশ্য, কখনও লীলা মজুমদারের কলমের জাদুতে মগ্ন পাঠকের নিজের শৈশব, কখনও প্রফেসর শঙ্কুর ভাল মন্দ ঠিক বেঠিক, লোভ নির্লোভের সীমা নির্দিষ্ট করা কল্পজগত!
বাবার না ফেরার পথে চলে যাওয়া, রাহুল দ্রাবিড় আর কুরুক্ষেত্রর চক্রব্যূহ যেন এক মহাজাগতিক বিষণ্ণতার মেঘ। যা কেটে গেলেই ঝরঝরে রোদ উঠে পাঠককে পৌঁছে দেবেই না-ফিরতে চাওয়া সেই গলির প্রবেশদ্বারে। ওই যে বইটার ব্লার্বে অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন ‘আপনি যদি, মনের অজান্তে দিনে বার আষ্টেক ফোঁসফাঁস, দীর্ঘশ্বাস, ২০০৩-এর একটা মিস হওয়া ক্যাচ, গরম ভাতে এক দলা কচুবাটা, মাঝরাতের ট্রেনের হর্ন কিম্বা পাঁচতলা মলে দাঁড়িয়েও আপনার যদি মন খারাপ হয়।’ এই বইটায় গেঁথে দেওয়া অক্ষরজাল অথবা সুরের কোলাজ আপনাকে নিয়ে ফেলবেই অরক্ষিত কোনও রেললাইনের পারে। পাহাড়ি বৃষ্টি আর এক জড়বুদ্ধি মেঠো বালকের ধীরে ধীরে রেললাইন পেরিয়ে ঘরে ফেরা আবার গাড়ির শব্দে কার যেন ফিরে আসার অপেক্ষা। যে অপেক্ষায় গান হয়ে ভেসে আসে একটা মৃত হাতির গল্প।
যে নীল আলোয় বৃষ্টিভেজা পাহাড়ে সেই পুরাতন একটুকরো মায়ায় ভেসে উঠল হাওয়া আর তার সঙ্গে হাসির ঝিলিক ও কয়েকটা শব্দ ‘শেষে ফুলকিও নেই?’ তার থেকে আরও কয়েকঘর এগোলে উগান্ডার সেই যুবকের গল্প। যুদ্ধবন্দি ধর্ষিত যুবকের স্বীকারোক্তি, তার স্ত্রীর ধর্ষিত স্বামীকে অস্বীকার! এইসব কিছু ছাপিয়ে সেখানে আক্রান্তের শরীরের ক্ষত ও আর আক্রমণকারীর গায়ের গন্ধ যেন কালো কাপড়ে আপাদমস্তক মোড়া একটা রহস্যময় আগন্তুক!
মাকড়শার ঘর অর্থাৎ জাল দেখেছি। দেখিনি সে সুতোর বুনন অথবা ঘরের ভেতর। কেবল কখনও ক্বচিৎ পোকাদের আটকে থাকা দেখে মন যদি নিজেকেও অমন উদ্বাস্তু অযাচিত আটকে পড়া মনে করে তাহলে এই বইয়ের গদ্য যেন আপনার জন্যই গেয়ে উঠবে, ‘আর ইয়ু লোনসাম টুনাইট?’
মরা আলোর সিম্ফনি
অনির্বাণ ভট্টাচার্য
চিন্তা প্রকাশনী
৩৫০ টাকা