তিনটি অণুগল্প

অম্লান চক্রবর্ত্তী

 

আয়া

অ্যালার্ম বাজার আগেই কাশির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল মেহেরুন্নিসার। ভয়ঙ্কর শব্দে কাশছে পাশের মানুষটি। হেপো রুগী আলমের সঙ্গে সেই কোন কচি বয়সে বিয়ে হয়ে গেছিল মেহেরুনের। তারপর চল্লিশ বছর কেটে গেল। দুই ছেলে, এক মেয়ে জন্মাল, তারা বড় হল, তাদের বিয়ে হল, অন্যত্র চলে গেল, কিন্তু আলমের হাঁপানি আর থামল না। কত তাবিজ-কবজ-জলপড়া-ওষুধ পড়ল। কিন্তু কিছুতেই লাভ হল না। নতুন ডাক্তারের দেওয়া ওষুধটায় কাজ একটু করে বটে। সেটা আবার ফ্রি মেডিসিনের দোকানে পাওয়া যায় না। বাইরে থেকে কিনতেও অনেক খরচ। কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে আলমের তাও প্রায় ১০ বছর হতে চলল। এখন রোজগেরে বলতে একমাত্র মেহেরুন। কিন্তু পেট তিনটে। মেয়েটা পোয়াতি হওয়ার পর থেকেই জামাই দিয়ে গেছে বাপের বাড়িতে। মেহেরুনের ঘাড় ভেঙেই বাচ্চাটা পয়দা করিয়ে নেবে। হাসপাতালে ফ্রি কার্ডে চিকিৎসা হয়, কিন্তু পথ্যি কিনতে হয়। এদিকে কী একখান রোগ এসে সারা পৃথিবী বন্ধ করে দিল। ঠিকাদারের কাছে মেহেরুনের কাজ চলে গেল। পিএমবাবু তো “পুরি দেশ মে লকডাউন” বলেই খালাস। কিন্তু মুখপোড়া খিদে তো লকডাউন বলে পার পাবে না। তাই ধার করে পেট চালাতে হয়েছিল। এখনও কয়েক হাজার টাকা শোধ করা বাকি। এইসব ভাবতে-ভাবতে তৈরি হয়ে, গুষ্টির জন্য রেঁধে স্টেশনের দিকে পা বাড়াল মেহেরুন।

–আরে এই মাগী, বেরো না বাল বাথরুম থেকে, মাড়াচ্ছিস নাকি এখানে?

শেয়ালদা স্টেশনের আট নম্বর প্লাটফর্মের মহিলা শৌচালয়ের দরজায় ধাক্কা মারছে এক মহিলা। সুলতা ভিতরে। তার মুখে খিস্তি এলেও সে চুপ করে কাজ সারছিল। আরও মিনিট খানেক পর বাথরুম থেকে বেরোল। দ্রুত পায়ে চলল ক্রিক রোর দিকে। সময়মতোই পৌঁছে গেল বাজোরিয়াদের বাড়িতে। ঠিক সাতটার সময় কলিংবেল টিপল। রাতের আয়াটা এবার বেরিয়ে যাবে। দুই বুড়োবুড়ির দায়িত্ব এবার সুলতার। করোনার পর থেকেই এই নতুন মাড়োয়ারি বাড়ির কাজটা সে নিয়েছে। ছেলেমেয়েরা বাইরে থাকে। সত্তরোর্ধ বাবা-মায়ের জন্য দুটো আয়া। এমনিতে নির্ঝঞ্ঝাট কাজ। রান্নাকরা, জলখাবার আর দুপুরের খাওয়াটা বেড়ে দেওয়া, বুড়োর ডায়াপার বদলানো, আর ঘর পরিষ্কার রাখা ছাড়া তেমন কোনও কাজ নেই। মাসে বারো হাজার টাকা দেয়। তাঁদের দাবি ছিল শুদ্ধ শাকাহারী হিন্দু মেয়ে। সুলতা বিধবা জেনেই কাজটা দিয়েছিল।

সন্ধে সাতটা বাজতেই রাতের আয়া চলে আসায় সুলতা বেরিয়ে গেল। শেয়ালদা স্টেশানে বাথরুমে ঢুকল সে। শাড়ি ছেড়ে সালোয়ার কামিজ পরে বোরখাটা গলিয়ে নিল। তারপর উঠল আটটার ক্যানিং লোকালে। আজ মাইনে হয়েছে। আজ স্টেশনে নেমে বরের জন্য ওষুধ এবং পোয়াতি মেয়েটার জন্য কিছু ফল কিনতে হবে।

 

পকেটমার

–দূর শালা, এই লকডাউনের কি শেষ নেই নাকি?

বলে উঠল রূপা। বামনগাছি স্টেশানের বাইরে আজ মিটিং বসেছে পকেটমারদের। বনগাঁ লাইনের ভিড় ট্রেনে সূক্ষ্ম হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ বা প্যান্টের পকেট কেটে মানিব্যাগ বা মোবাইল হাতানো যাঁরা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন, তাঁদের মিটিং আজ। এই দলের অন্যতম বড় শিল্পী রূপা।

বয়স চল্লিশ হলেও, আজও রূপার চেহারার বাঁধন বেশ নজরকাড়া। রূপেও বেশ চটক আছে। জেনারেল কম্পার্টমেন্টের যে কোনও কামরায় ওঠার পর তার ছোঁয়া পেতে উদগ্র হয় বহু পুরুষ। সেও ওজন বুঝে বেশ গুছিয়ে দাঁড়ায় কোনও এক পুরুষের পিছনে। নরম-গরম স্পর্শে যখন পুরুষটি বেশ মাখোমাখো আবেশে বিভোর, তখনই ডান হাতের অনামিকায় আংটির ভাঁজে থাকা ব্লেড পুরুষটির পকেট কেটে মোবাইলটিকে মাধ্যাকর্ষণের সূত্র মেনে নিচে নামতে বাধ্য করে। পাশে দাঁড়ানো তপন একদম সিলি মিড্অফে দাঁড়ানো ফিল্ডারের মতো ক্যাচ লুফে নেয়। ঘটনাটি ঘটে ঠিক বারাসাত বা দত্তপুকুরে ট্রেন থামার আগে। ফলে পরের কয়েক মুহূর্তেই নেমে যায় রূপা এবং তপন।

দীর্ঘ দশ বছর এভাবেই চালাচ্ছে রূপা। বেশ পয়সাকড়িও করে ফেলেছে সে। ফলে একটু স্নো-পমেটম মেখে বেশ ‘ভদ্র ঘরের মেয়ে’ জাতীয় একটা চেহারা হয়েছে তার। যা আরও আকর্ষণ করে ট্রেনের যাত্রী-পুরুষদের।

তারপরেই এল সেই ব্যাধি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, “আজ রাত বারা বাজে সে পুরি দেশ মে সম্পূর্ণ লকডাউন হোনে যা রাহা হ্যায়।” সেইদিন থেকে ঘরে বসা। ঠিক ছিল, কয়েকদিনের মধ্যেই খুলে যাবে সব। কিন্তু বাস্তবে তাই হল না। আরও বেড়ে গেল লকডাউন। ভবিষ্যৎ কী হবে, তাই নিয়েই আজ মিটিং। যদিও কোনও সুরাহা হল না। এমনকি আশার আলোও দেখা গেল না।

মিটিংয়ের পর দুই সপ্তাহ কেটে গেল। এর মধ্যে রূপার কপালে সিঁদুরও মুছে গেল। চলে গেল ছোট ছেলেটাও।

পাগলপ্রায় দশায় কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না সে। তার খালি মনে হচ্ছে, কর্মফল। কত লোকের পকেট কেটেছে। ওই পাপ আর নয়। কিন্তু এখন সে করবেই বা কী। লেখাপড়া তেমন নেই। সেলাই-ফোঁড়াইও জানে না। আয়া বা অন্য কাজও সে পারবে না। অতএব গতর বেচা ছাড়া তার আর উপায় কিছু আছে কি?

–কী করবে কিছু ভাবলে দিদি? তপন বলল। কিছু বাজার করে দিতে আজ এসেছিল।

রূপা নীরবে দুইদিকে ঘাড় নাড়ল।

–মনে হয় অন্য ব্যবসা ধরতে হবে। শালা চাষ করতেও তো জানি না, মিস্তিরির কাজও জানি না। আর ক্লাস এইট পাশকে কে অন্য কাজ দেবে? তপন বলে চলল।

‘চাষ’ শব্দটা শুনে চমকে উঠল রুপা। মনে পড়ল, বসিরহাট ছাড়িয়ে ডান্ডিরহাট অঞ্চলে তার বাপের বাড়িতে সামান্য কিছু জমি আছে। সেখানে ঝোপঝাড় হয়ে আছে। পরিষ্কার করে যদি শাকপাতা লাগানো যায়, তবে তা বেচেও আরামসে চলে যাবে। সঞ্চয়ে এখন আর হাত দিতে হবে না। বিয়ের আগে সে তো বাবাকে চাষ করতে সাহায্যও করত। কিছুই কি মনে নেই তার? মাটি তৈরি, ছাড়া বা বীজ পোঁতা, সার-জল দেওয়া, সময়মতো কেটে নেওয়া সবই তো দেখেছে এককালে। বাবা মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর হল। দুটো ভাইয়ের একটা হারিয়ে গেছে, আরেক ভাই আসানসোলে শ্রমিক। একা মা বাড়িতে। নিশ্চই বড় নাতির মুখ চেয়ে বুড়ি রাজি হবে।

ছোটবেলায় শুনেছিল, কোন এক ডাকাত যেন পরে রামায়ণ লিখেছিল। এবার সে সৃষ্টির পথে চলুক। পকেটমার থেকে হয়ে উঠুক চাষি।

 

ভিখারিণী

মালতীকে মনে আছে? বা তার বরকে? না থাকারই কথা। আপনাদের মন অ্যাকুয়ারিয়ামের মাছের মতো। জলদি ভুলে যান। আপনি বারাসাত থেকে ট্রেনে উঠতেন, মালতী আর তার বর উঠত নিউব্যারাকপুর থেকে। বরটা অন্ধ। মালতী তাকে ধরে নিয়ে চলত। দুইজন মিলে গাইত, “যো ওয়াদা কিয়া উও নিভানা পড়েগা”। আপনারা আপিস যাওয়ার পথে, আড্ডা মারতে-মারতে শুনতেন। আপনারা বলাবলি করতেন, লতার থেকেও ভাল গায়। কিন্তু তারপর বরটা যখন পেটের দায়ে হাত পাতত, আপনারা “মাফ করো” বলে কাটিয়ে দিতেন। একটু একটু মনে পড়ছে না এবার?

তাহলে আরেকটু মনে করাই। আপনাদের মধ্যে একজন ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সেই গান ফেসবুক লাইভ করে সেলিব্রিটি হয়ে গেল, মনে পড়ে? সেদিন অবশ্য ভিডিও করার জন্য আপনারা ‘ভিক্ষে’ দিয়েছিলেন। আঃ, ফেসবুকে নিজের ইমেজটা রাখতে হবে তো! সোশ্যাল মিডিয়ার বিজ্ঞাপন থেকে পাওয়া কয়েক হাজার টাকায় আপনারা চারজন অফিস-ফেরতা বারে বসে মদও খেয়েছিলেন, মনে পড়ে? আপনি এখন দাঁত বের করে হেঁহেঁ করছেন।

কিন্তু লকডাউনের পর মালতীর কোনও খবর রাখেন? মাথা চুলকোচ্ছেন তো?

প্রধানমন্ত্রী যেই সন্ধেয় বললেন “পুরি দেশ মে সম্পূর্ণ লকডাউন হোনে যা রাহা হয়” সেদিন আপনাকে আর পায় কে? ওয়ার্ক ফ্রম হোম, ডালগোনা কফি আর ওয়েব-সিরিজে আপনি মশগুল, ঠিক সেই মুহূর্তে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিল মালতীরা। প্রথমে জমানো টাকায় কিছুদিন চলল। ক্ষুদ্র সঞ্চয় শেষ হল।

এদিকে লকডাউন বেড়ে গেল। আপনার হাসিকান এঁটো করল। যাতায়াতের টাকা বেঁচে যাচ্ছে। সেভিংস হচ্ছে। আর মালতীদের সঞ্চয় কমছে। তারপর কী হল জানেন? মাত্র একবেলা খেত ওরা। তার মধ্যে সেবার মালতীর প্রচণ্ড জ্বরের মধ্যে পিরিয়ড এল। জ্বর ও প্রথম দিনের ব্যাথায় মালতী বেশ কাবু। ফলে ওর বরকে মুড়ি কিনতে একা বেরোতে হয় রাস্তায়। লাঠি ছিল ঠিকই। কিন্তু গোবরে পা হড়কে পড়ে যায় সে। মাথার পিছনে আঘাত।

তারপর? ওদের সন্তানাদি না হওয়ার কারণে এমনিতেই পাড়াপড়শি ও আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে ওরা একঘরে। একা মালতী বাড়িতে। যৌবন পড়ন্ত হলেও চেহারা তখনও ভরন্ত। ফলে, লোভী কিছু নজর ছিল। কিন্তু এর মধ্যেই মালতীর হঠাৎ দেখা হয় স্বপনের সঙ্গে। ছোটবেলায় স্বপনের সঙ্গে একটা মিষ্টি সম্পর্ক হওয়ার মুখেই মালতীর বিয়ে হয়ে যায়। স্বপন বয়সে মালতীর থেকে ছোট তাই। জোর করেই বিয়ে দেওয়া হয়। স্বপন পরে চলে যায় নয়ডায় ঠিকাদারের সঙ্গে কাজ করতে। লকডাউনে সেও ফিরেছে। তারা বিয়ে করেছে। গতকাল সল্টলেকে একটি বাড়ির সামনে একটি চটকদার মেয়েকে দেখে আপনার ‘দেজাভু’ হয়েছিল মনে আছে? স্বপন ও মালতী ওই বাড়ির কেয়ারটেকার।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...