সুবিমল— আমাদের জ্যাকোবিন-নায়ক

অত্রি ভট্টাচার্য

 



রাজনৈতিক কর্মী, বাংলা প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত

 

 

 

কীভাবে সাহিত্য রচনা না-করতে হয়, যা ঠিক সাহিত্য করতে না-চাওয়া নয়, সাহিত্য না-করতে চাওয়া, না-চাওয়াও, সেই খোঁজটারই শুরু এখান থেকে। সুবিমল যদিও ‘অ্যান্টি’ শব্দটির কম্ব্যাটিভ মোহ এড়াতে পারেননি, নিগেশন কার্যত এখান থেকেই ধনাত্মক হতে শুরু করে।

–সুব্রত সেন; বাঘের বাচ্চা পত্রিকার ‘ফিরে দেখা: সুবিমল মিশ্র’ সংখ্যা

সুবিমলের বিরুদ্ধে সুবিমল দাঁড়িয়েছিলেন। তাই, এহেন সুবিমলের বিরুদ্ধে কিছু কটুকাটুব্য দিয়ে শুরু করা গেল। নয়তো, ফেসবুক নিউজফিড জানান দিচ্ছে সুবিমল কেবলমাত্র কিছু ‘কোটেবল কোটস’ লিখে গেছেন, প্রথমেই গুলি করা অথবা সফল না-হওয়ার প্রসঙ্গে। অসফলতার টিআরপি এমন আকাশছোঁয়া জানা ছিল না। সুবিমল মরে জানিয়ে দিয়ে গেলেন। লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে শ্মশানের নিস্তব্ধতা, অবশ্য ওটি এখন শ্মশানই, একটি ভাগাড়মাত্র, যেখানে অ্যাকাডেমিক শকুনদের জন্য বরাদ্দ থাকে কিছু নিষ্ফলা লেখার শব। যদিও, নয় নম্বর গেটের বাথরুম, যা মেলার ভিতরের অন্তর্ঘাতী ফ্যাতাড়ুদলের মিলনস্থল, সান্ধ্য গলা ভেজানোর আশ্রয়, সেখানে, সেই দেওয়ালে কারা যেন লিখে গেছে— ‘বইমেলায় সুবিমলের ভূত ঘুরছে, সাবধানে যাস বোকাচোদা প্রতিষ্ঠান’…

হাঃ সুবিমল, বাথরুমই শেষমেশ তোমাকে ধারণ করার সাহস দেখায়। দুশাম্পের সেই পেচ্ছাপ-ভাস্কর্যটির মতো এই পরিণতিটিও এযাবৎকালের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ‘ইভেন্ট’ হয়ে ওঠে। পাঠক, খেয়াল করুন, আমাদের খিস্তিগুলি তার রণসাজ হারিয়েছে। তাদের নাইট-বসন খসে গিয়েছে, সে এখন গোবেচারা, গালফোলা কমপ্ল্যান বয়। আরও যেটি লক্ষণীয়, প্রতিষ্ঠানকে আজও আমরা অহেতুক ঢিল ছুড়ি, যা এসে লাগে নিজেদেরই গায়ে। মনে রাখার কথা, কমরেডস, সুবিমল তাঁর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার প্রোগ্রামটিকেও একদা সন্দেহ করেছিলেন।

সুবর্ণরেখার হরপ্রসাদ আমাদের জানলা দিয়ে উঁকি মারেন, ‘যাবা, যাবা সেই বেচার হাটে?’— সুবিমল গেছিলেন, অথবা সুবিমল যাননি, তার অক্ষরেরা গুটিগুটি পায়ে ঢুকে গিয়েছিল হার্পার কলিন্সের মসৃণ পেপারব্যাকে অথবা গাঙচিলের গ্লসি হার্ডবাউন্ডে। আমাদের চোখ ঝলসেছিল খানিক, শোনা গেছিল হরপ্রসাদ বলছেন— ‘জীবনটা তো ব্রহ্মচর্য কইরা কাটাইলা!’

সুবিমলের কেষ্টচেতনা অক্ষয় হয়েছে, তার হারাণ মাঝিতে আকাশবাণী হয়েছিল— ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িবে সে’… হাঃ সুবিমল, বধ আজও সম্পন্ন হয়নি, আসেনি সেই গোষ্ঠপ্রিয় রাখাল, যার আসার কথা ছিল। আগস্ট ১৯৬৯— গল্পের নাম— ‘পার্কস্ট্রিটের ট্রাফিক পোস্টে হলুদ রং’— যার ক্লাইম্যাক্সে ‘যে পাগলটা তিতবিরক্ত, নেমে এল মাটিতে, বলল ভিখিরিটা মরে ভূত হয়ে তোমাদের ঘাড়ে চাপুক, বলল তোমাদের ঘাড় মটকে দিক, বলল লড়কে লেঙ্গে ঝুমঝুমা, বলে নিজের বুক চাপড়াতে চাপড়াতে খিদিরপুরের অন্ধকারের দিকে চলে গেল, আর তার বুকের রক্ত-করা নিশান, মনুমেন্টের ওপর পৎ পৎ উড়ল সারারাত।’ সে নিশানে আজ ধুলো জমা, সে পাগল আজ কারাগার, কারাগার চিৎকার করে, সেই সুবিমল, আপনিও এইমাত্র ছাই হয়ে গেলেন।

সুবিমলের কৃতিত্বটি ঠিক কী, বলতে হলে আমি বলি, অ-সাহিত্যের বা না-সাহিত্যের একটি নাটবল্টু হিসাবে সারি সারি দৈনন্দিন সংবাদের অংশকে কাট-আপ পদ্ধতিতে তুলে ধরা। আমরা যারা ‘ভুটুতন্ত্র’ ইত্যাদিকে প্রায় পরীক্ষার পড়ার মত পড়েছি, তারা জানি একটি বলাৎকারের বিবরণ অথবা লোকাল লুম্পেনদের ফাইট সিকোয়েন্সকে, সুবিমলের মত ওই করালবদন, মনস্টার গদ্যে কেউ কখনওই লেখেনি। স্বভাবতান্ত্রিক— সুবিমল আমাদের ভবানী দত্ত লেনের মর্গদর্শন করতে গিয়ে দেখিয়েছেন, রাত এগারোটায় জাতীয় সঙ্গীত চলাকালীন মৃতদেহের সঙ্গে যৌনসঙ্গম চলতেই পারে। হাঃ সুবিমল, ভাগ্যিস আপনাকে মাল্টিপ্লেক্সে, ডিজিটাল ইন্ডিয়ার হাতে জাতীয় সঙ্গীত চলাকালীন না দাঁড়ানোর জন্য লিঞ্চড হতে হয়নি।

সুবিমলের ‘রামযাত্রা’য় আমরা জেনেছি ‘কণিষ্ক মুণ্ডহীন অবস্থায় এদেশে বছরের পর বছর রাজত্ব করেছেন।’ এই মুণ্ডহীনদের রাজত্বকে সুবিমল দেখেছেন লোহার তারে, যা বাঘ ও দর্শকের মধ্যে রক্ত ভালবাসে— আর সেই গল্পকে, গোল গল্পকে লিখনে তিনি অস্বীকার করেছেন— ‘সামগ্রিক ন্যায়বোধ ও শুভবোধের নামে কাহিনিবিন্যাসের যে প্রচলিত ছক তা দিয়ে আধিপত্য ও প্রতিষ্ঠান কবলিত evil-অধ্যুষিত জগতে অনুপ্রবেশ সম্ভব নয়।’ হাঃ সুবিমল, আমাদের মিথোলজিতে যে কখনওই কোনও ইভিল ছিল না, আমরা সকলেই এক একজন স্বর্গচ্যুত রাক্ষস।

সুবিমলের বিরুদ্ধে সুবিমল, নিজেকে আক্রমণের জন্য তৈরি রাখতে বলেছিল। যেন সে নিজেই নিজেকে দেবে একটি অমোঘ মুষ্টিবদ্ধ পাঞ্চ, নিজেই নিজেকে মনে করাবে আমি ‘সাহিত্য মারানোয় একদম নেই।’ তাই সে অকপট, সাইবার অপরাধের বিপুল গহ্বর, এলফ-ল্যান্ড ইত্যাদিকে চোখের সামনে জাগতে দেখে বলে ওঠে— ‘আর, এখন, এই-ব্যবস্থায় সবচেয়ে অশ্লীল ব্যপার হল বিখ্যাত হয়ে যাওয়া…।’ হাঃ সুবিমল, আমিও তবে আবদ্ধ হলাম ‘কোটেবল কোটসে’।

সুবিমল বাতাই অথবা ফুকো থেকে কী পেয়েছিলেন, জানিবার সাধ নাই। তাঁর লেখার উপর আরোপিত কৃত্রিম ফুকোডিয়ান ব্যাখা দিয়ে কেউ নিজের সিভি বাড়াতেই পারেন। তিনি বাংলা পর্ণোগ্রাফিতে বেনামে হাত মকশো করতেন কিনা, তাও অবিবেচ্য। এক্ষণে, একটি লোকমুখে প্রাপ্ত অ্যানেকডোট শোনাই। একদা সুবিমল নাকি, মেট্রো সিনেমার সামনেই টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে নিজের বই নিজেই পড়তেন। উৎসাহী কেউ যখন জিজ্ঞেস করতেন— ‘কার বই এত মন দিয়ে পড়ছেন?’ তখন সুবিমলোচিত ভঙ্গিতে উত্তর আসত— ‘সুবিমল মিশ্র।’

সাংস্কৃতিক-রাজনীতির পরিসরে, এক্সট্রা-লিটারারি অ্যাক্টিভিটি আজ যতই ডালপালা মেলুক, বাংলাবাজারে এ বিষয়ের চাঁদমারিটিতে যথার্থ তির মেরেছিলেন, ওই পাতিরাম-দে’জ দ্বারা প্রত্যাখাত, ক্ষ্যাপা রোবসপিয়ের, ওই সুবিমল মিশ্রই। কখনও কখনও কসাইয়ের কাজটিও যে কাব্যিকতাকে ছুঁয়ে ফেলে, রক্ত ও পুঁজ হয়ে ওঠে শৈল্পিক ভঙ্গি, তা সেই গিলোটিনপ্রেমী যথার্থই জানতেন।

ভাল্টার বেনিয়ামিন বিরচিত ‘পবিত্র হিংসা’ অথবা ‘হিংসার পবিত্রতা’কে, বিমূর্ত থেকে মূর্ত ভাষায় প্রাণ দেওয়া, ওই সুবিমলই ভাষার বাস্তিল ভাঙেন, লেখক নাম্নী ষোড়শ লুইয়ের কাটা মাথাটিকে ভিড়ের ভিতরে ছুড়ে দেন, লুফে নে বলে। হাঃ সুবিমল, কয়েক দশকে কমিউন ভেঙে যায়, লেখকদল সরকারি ও দরকারি হয়ে ওঠেন।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...