সুবিমলমিশ্রর (অ্যান্টি)-গল্প

শতানীক রায়

 



কবি, গদ্যকার

 

 

 

প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে হচ্ছে— এই ভেবে কখনও প্রতিবাদ হয় না। প্রতিবাদের ক্রোধকে দীর্ঘদিন জাগ্রত রাখার জন্য রক্তের ভেতরে মাংসের ভেতরে ঘোরতর প্রতিবাদ লালন করতে শিখতে হয় তারপর একটা সময় তা প্রকাশ পায় ঠিকরে বেরিয়ে আসে। আলো যেভাবে ঠিকরে বেরিয়ে আসে, তার সঙ্গে নানারকম কালোর মধ্যে থেকেও যতটুকু আলো যেরকমভাবে বেরিয়ে আসে সেটাও একধরনের প্রতিবাদ। যুগের পর যুগ ধরে ক্রমাগত শোষিত পীড়িত মানুষের জন্য যে যে মাধ্যম প্রয়োজন যে যে সামাজিক স্তর যেরকম নির্মাণ বিনির্মাণ দাবি করে তার সবই প্রায় সুবিমলমিশ্র চেষ্টা করেছেন তাঁর অ্যান্টি-গল্পগুলোতে বলার। এবং তাঁর লেখনির প্রকাশভঙ্গিও পরিষ্কার কিন্তু ভাষার ওভারস্মার্টনেস ওভারকাম করে এক সহজ প্রতিবাদী কণ্ঠ, লৌকিক, সামাজিক হয়ে আমাদের সামনে ধরা দেয়।

আমার এই নিত্য জীবনে চলতে চলতে অদ্ভুত রকমের ক্লান্তি আসে। নানা রকমের অভিজ্ঞতা আমাকে যত বেশি অন্তর্মুখী করে তার চেয়ে বহির্মুখী হয়ে আমার স্বভাবকে প্রতিবাদী করে তুলি। একটু একটু করে এই প্রতিবাদ যতটা বাইরের দিকে ঘটে তার চেয়ে বেশি ভেতরে ঘটে। একটা জিনিস বারবার মনে হয় সুবিমলের গল্পে (অ্যান্টি-গল্প) বারবার মানুষের চরম দুর্দশার ছবি উঠে আসে। সাবলীলভাবে সেইসব মানুষেরা তাদের মেধাগত তাদের স্বভাবগত এবং যাপনগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে অবস্থান করে। এবং তারা নানাভাবে প্রতিনিয়ত নিয়তির ফাঁদে পড়ে, রাষ্ট্রশক্তির ফাঁদে পড়ে। সামাজিক নানা ধরনের শোষণের স্বীকার হয়। একদিক দিয়ে ভাবলে তাদের অন্ধকার গভীরতর অন্ধকার জীবনের আখ্যানই লেখেন সুবিমল। এবং প্রতিটি গল্পে নানাভাবে পরীক্ষা করেছেন। বিষয়ের সঙ্গে তার সাজুয্যতা খুব সাবলীল। আমার পরিচিত অনেক পাঠকদের কাছে জেনেছি যে, সুবিমলের লেখা তাদেরকে অস্বস্তিতে ফ্যালে। কেন ফ্যালে এরও কারণ আছে। তাঁর কিছু কিছু লেখা তীক্ষ্ণ ধারালো সমালোচনায় সিক্ত থাকে যে, সেখানে যে-কোনও মানুষের অন্তরের অন্ধকারকে স্পর্শ করে ফ্যালে এবং তাদের ভেতরের মুখটা আলগা করে দেয়, এতে কখনও কখনও অস্বস্তি হয় পাঠকদের। আবার অস্বস্তির আরেকটা কারণও আছে যেখানে তিনি লেখায় অনেক সময়ই এমন কিছু বাস্তবকে তুলে ধরেন যেটা আমাদের পরিশীলিত বেঁচে থাকার ভীষণ বিপরীত ও বিপক্ষে। সেই কারণেই সম্ভবত আমার বড় বেশি আগ্রহ তাঁর গল্পে।

তিনি তাঁর প্রতিটি গল্পে মানুষকে যেন চাষ করেন। এই ‘চাষ’ শব্দটা ব্যবহার করার পেছনে একটা কারণ আছে যা ক্রমে আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে উজাড় করবে। আসলে জমিকে চাষ হল এখানে ফিডেলিটির প্রতীক। তাঁর গল্প বলার ঢঙ। ন্যারেশন ভীষণ অদ্ভুত। সাবলীলভাবে উনি বলে চলেন। যেটাকে না বললেও হত সেটাকে বেশি করে বলেন। বাস্তব জীবনে যখন আমরা কোনও বাস্তবের অংশ অর্থাৎ, ঘটমান বর্তমানের অংশ সেই সময় আমাদের কাজকর্মের মধ্যে অনেক প্রবণতা কাজ করে যেটাকে সচরাচর আমরা এড়িয়ে চলি। অনেক ভাবনাচিন্তার ভেতর ধারালো প্রক্রিয়া কাজ করে যেটা ক্রমাগত পরিমার্জনের মাধ্যমে আমাদের বহন করতে হয়। এই মনস্তাত্ত্বিক অনুশীলন আমাদের সামাজিক করে তোলে। অনেক ভাবনার ঝুঁকি থেকে এমন কিছু কথা বলার প্রক্রিয়ায় এগিয়েও আমরা সেটাকে পরিমার্জিত করি। ছেঁটে দিই। এই গোপন করা মানুষটাই হল আমাদের সত্তার ঝুঁকিপূর্ণ দিক যেটাকে সুবিমল তাঁর গল্পে তুলে ধরেন। অনর্গল কথা বলতে বলতে কখন মাংসময় হয়ে ওঠে গল্প তা বলার অতীত। এখানে অনুভূতির সান্নিধ্যে যে-প্রতিবাদ গড়ে ওঠে সেটা হল মেটাফিজিকাল। একধরনের আলোড়ন তৈরি হয় গল্পে। একটা তীব্র অনর্গল। ঘৃণা। প্যারালাল বিশ্ব। যা আমরা স্বীকার করতে গিয়েও স্বীকার করি না।

‘হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া বা সোনার গান্ধীমূর্তি’ সুবিমলের এটি একটি বহু আলোচিত গল্প। আপাদমস্তক একটি গল্প। কাহিনি আছে। তবে অন্য কোনও জায়গা থেকে না ভেবে যদি মাছের চোখ দিয়ে দেখি। আসলে ফিস আই ভিউ থেকে দেখা চলচ্চিত্রের মতো এই ন্যারেটিভ। এবং এখানে শুধু গল্পকার দেখছেন তা নয় সঙ্গে সঙ্গে অনেক মানুষ দেখছেন। তাঁরা সমকালের চোখ দিয়ে সমকালকে দেখছেন। আর এই মাছের দৃষ্টি নিক্ষেপ করার মধ্যেই আসল রহস্য লুকিয়ে আছে। একটি জলাশয়ে অনেক অনেক অসংখ্য মাছেরা তাদের নিজস্ব আয়তন থেকে দেখে চলেছে। এবং যেহেতু তাদের ভঙ্গিমায় সবকিছু গোলাকার। একটু বেশি ম্যাগনিফায়েড। বারবার একই বিপর্যয় ঘটে যাচ্ছে। হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া ভাসতে ভাসতে মাছেদের সামনে আসছে। বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পথ অবরুদ্ধ করে তুলছে ধীরে ধীরে। লক্ষের দিকে কেউই সঠিক অবলোকন করতে পারছেন না। আর একটা সময় এই ভঙ্গিটা দৃশ্যকবিতার চালচিত্র থেকে বেরিয়ে জায়গা করে নিল শ্রুতি ও গন্ধের জগতে। অনেকেই কলকাতা শহরে সেই মড়া দেখতে পেলেন। অনেকেই মড়ার পঁচা গন্ধ পেলেন। শেয়ালেরা যখন মড়াটাকে ডাঙায় টেনে আনলেন তখন চেরা পেট থেকে শিশু বেরিয়ে এসে ভবিষ্যদ্‌বাণী করল: ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে’। পুরো গল্পটি জুড়েই অ্যানার্কি। বেঁচে থাকাকালীন যে-মর্যাদা হারাণ মাঝির বৌ পায়নি সেটা মরার পর এভাবে আদায় করে নিচ্ছে সে। গল্পটা জুড়েই কোথাও একটা চোরাগোপ্তা অপরাধবোধ কাজ করেছে। একটু হলেও আমরা সবাই দায়ী তার মৃত্যুর জন্য অবহেলার জন্য। এখানে আমাদের রাষ্ট্রের মূল সমস্যা কৃষকদের আত্মহত্যা তাদের ভোগান্তির শেষ নেই। কৃষিকাজে কোনও সুরক্ষা নেই। দারিদ্র্যতা ঘিরে থাকে। হারাণ মাঝির মৃত্যুর পর থেকে দুর্দশা তার বৌয়ের। একটি দেড় বছরের শিশুও আছে। আত্মহত্যা করে হারাণ মাঝির বৌ। আর এই আত্মহত্যাই কাঁটা হয়ে শেষ পর্যন্ত যে রাষ্ট্রের দুর্নীতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এখানে অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই যে, উত্তর ঔপনিবেশিক শক্তির প্রতি এই ন্যারেটিভ একটি বাধ। পাশাপাশি বিদ্রূপও। সুবিমলের অন্যান্য লেখার মতোই এখানে ন্যারেটিভটে লৌকিক চলন আর সুপ্ত মিথিক্যাল লিরিক কাজ করেছে। ন্যারেশনের ছন্দে উপকথা বলবার চোরাগোপ্তা আঁচ পাওয়া যায়। আর শেষ পর্যন্ত বলতে গেলে এই গল্প একজন অসহায় মানুষের কলম থেকে উঠে আসা চিৎকার। এবং অ-রমণীয়।

প্রথমে ওঁর প্রথম অ্যান্টি-গল্পের বইটা নিয়ে আলোচনা করলে ধাপে ধাপে এগোতে সুবিধে হবে। যেহেতু আগের স্তবকে প্রথম গল্পটার আলোচনা করলাম এবার দ্বিতীয় গল্প ‘বাগানের ঘোড়ানিমের গাছে দেখনচাচা থাকতেন’ সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। দেখনচাচা চরিত্রটিকে নিয়ে আমার অনেক ভাবার আছে। গল্পের শুরুতেই দেখনচাচার মুখনিঃসৃত একটি বিচিত্র সংলাপ উল্লেখ করেছেন সুবিমল মিশ্র। ‘বলত ছোঁড়ারা ফুলের গন্ধে ও গুয়ের গন্ধে তফাৎ কি?’ এই কথার কোনও উত্তর না দিয়ে ছেলেরা হেসে পালিয়ে যেত। ‘মানুষের ঐটেই মানায়।’ এরকম উক্তি করেছেন লেখক। এখানে আমার দেখনচাচাকে বারবার মনে হয় প্রকৃত মানুষের মূর্তিমান প্রতীক। দেখনচাচার ভেতর আমরা মানুষের শুভ বুদ্ধির প্রকাশ দেখতে পাই এবং ঘোড়ানিমের গাছকে ভেবে নিতে পারি সেই শুভ বুদ্ধিকে জাগিয়ে রাখার আশ্রয় বা উদ্দীপক। নিমের বাতাসকে আমরা শুভ এবং পরিশুদ্ধির মাধ্যম হিসেবে জানি। তিনি জ্যোৎস্না রাতে ঘোড়ানিম গাছ থেকে নেমে ঘুরে বেড়াতেন, জিভ দিয়ে সোনার পাতের মতো জ্যোৎস্না চেটে চেটে খেতেন। বাঁশবাগানের পাশের ডোবাতে নেমে পড়তেন হামাগুরি দিয়ে। তারপর উঠে আসতেন বুকের ভরে সরীসৃপের মতো। আর তাঁর মন কাচের মতো স্বচ্ছ। খুব খোলা মনে কথা বলতেন। গ্রামে যখন কলেরা হল, সবাই গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেল। কলেরা আক্রান্ত হওয়ার দরুন একজন তার স্ত্রীকে গ্রামে ফেলে পালিয়ে গেল। দেখনচাচার নজরে আসাতে তিনি সেই মহিলাকে সেবা করে সুস্থ করে তোলেন। কিন্তু একদিন সেই মহিলাকেই তিনি কামনা করে বসলেন। এখানে দেখনচাচার মানবিক সত্তা আমরা দেখলেও কিন্তু তাঁর সত্তার মধ্যে অন্তর্নিহিত যৌনতাকে সচরাচর স্বীকার করতে চাই না। প্রথমে দেখনচাচাকে আমার উত্তর ঔপনিবেশিক প্রভাবের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষ মনে হয়েছিল কিন্তু পরে সে-ভুল ভাঙল যখন তিনি সেই মহিলার এত সেবাযত্ন করার পর তাকেই কামনা করে বসলেন এবং তাঁর সঙ্গে সঙ্গম করলেন। তিনিও শেষ পর্যন্ত উপনিবেশের ফাঁদে পড়লেন? উত্তর হল— না। এই গল্পের শুরুতেই দেখনচাচার মন্তব্য মনে পড়ে: ‘দেখন চাচা বলতেন সব শালারই ফুটো-ফাটার ধান্দা।’ এই গল্পে যৌনতাকে উপশম হিসেবে ব্যবহার করেছেন লেখক যদিও তাঁর দুটো গল্প পড়েছিলাম যৌনতাকে কেন্দ্র করে। সেখানে উপশম নয় যৌনতা এসেছে সন্ত্রাস হিসেবে। মানুষের অন্তর্গত ব্যথা-আক্রোশ-ক্রোধের নিবারণ হিসেবে। বর্তমান গল্পে দেখনচাচা আর সেই মহিলার সঙ্গে মিলন হল এক চূড়ান্ত মানবিকতার প্রতীক এবং সামাজিক নিয়ম বিধিনিষেধকে প্রতিবাদ জানানোর একটা তীব্র প্রতীক। যে-সমাজ মেয়েদেরকে শুধুই ভোগ্যবস্তু হিসেবে দেখে তার প্রতি এই প্রতিবাদ। মনুষ্যত্বহীন ভোগ শুধু। এটাও সুবিমল তুলে ধরেছেন গল্পে। ‘গৌর মণ্ডল যুবক, তার বৌ মনোরমা একবার পায়খানা করে এসেই বারান্দায় পড়ে গেল, চোখের তারা মরা মাছের মতো নির্জীব হয়ে যাচ্ছে। গৌরের বাপ বলল: গৌর যদি প্রাণে বাঁচতে চাস ত এই বেলা চল পালাই। গৌর একবার বৌয়ের দিকে দেখল, বৌয়ের প্রতি তার বড় টান, ওই শরীর তখনও পরিপূর্ণ যুবতি।’ এখানেই বিরোধ। সুবিমল কোথাও এখানে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছেন যদিও শেষে গ্রামের লোকেরা দেখনচাচাকে পিটিয়ে মারে। মানবিকতার মৃত্যু হয় এখানে। আমাদের শুভ বুদ্ধির পতন হয় বা সেই নিমগাছ যে ক্রমাগত উজ্জীবিত করে রেখেছিল সেই গাছও একদিন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভেঙে পড়ে। এই অবস্থান থেকে আমি জীবনানন্দের কবিতাকে কাব্যের মহত্ত্বের পাশাপাশি তত্ত্বের রূপায়ক হিসেবেও দেখি যেখানে তিনি মানুষের মৃত্যুর পর মানব থেকে যাওয়ার প্রসঙ্গ আনছেন। এই দিক থেকে গল্পটিও একইরকমভাবে খুবই প্রাসঙ্গিক।

 

দুই.

ভাষার সবসময় একটা চোরাগোপ্তা অন্ধকার থাকে। দৈনন্দিন জীবনে নিত্য আমরা এমন অনেক চোরাগোপ্তা। এমন অন্ধকারের সম্মুখীন হই তা হয়তো খেয়ালও করি না সবসময়। মনে রাখতে হবে সুবিমল একজন মার্কসবাদী। এবং মানবতাবাদী। গদারের আপ্রাণ গুণমুগ্ধ একজন মানুষ। যিনি অনেক সময় বাস্তবকেই গড়ে তুলছেন এমন এক বাস্তব দিয়ে যেখানে বাস্তবের সমান্তরালে যে-বাস্তব গড়ে উঠছে সেটাই হয়ে উঠছে বাস্তবকে অনুধাবন করার আরশি। কখনও কখনও সমান্তরালে একটা জগৎ নয় অনেকগুলো জগৎ মিলে মিশে যায়। যেমন ‘দু-তিনটে উদোম বাচ্চা ছুটোছুটি করছে লেবেল-ক্রসিং বরাবর’ বইয়ের ‘দূরত্ববোধ’ অ্যান্টি-গল্পটি উল্লেখ করা ভীষণ জরুরি। টি জি আলেয়ার একটি চলচ্চিত্রের কিছু সংলাপ দিয়ে গল্প শুরু হচ্ছে। তারপরে গল্পটার অনেকগুলো ভাগ। বারোটা ভাগ। এবং কখনও কখনও মনে হয়েছে এই সবগুলো ভাগে যে যে মূল কাহিনি জড়িয়ে আছে তার ভেতরেও পাশাপাশি সমান্তরালে অন্য গল্পের ভুবনও প্রবেশ করেছে। এতে কোনওভাবেই অসুবিধে হচ্ছে না বরং আরও সুস্পষ্টভাবে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, একটি ভুবনেই অনেকগুলো ভুবন। প্রতিটি ভুবনের এক-একটা অংশ অন্য আরও ভুবনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে আরও প্রাঞ্জল করে তলে গল্পের চিত্রটা। সুবিমলের গল্পে পরিষ্কার একটা গল্প থাকে। এবং সঙ্গে থাকে কোনও এক দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস। সেই প্রয়াসকে সফল করতেই তিনি নানা ফর্ম নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন। আমাদের রক্তমাংশে মিশে আছে তীব্র যৌনতা। তার সঙ্গে সন্ত্রাস। এই যৌনতাকে আমি ফ্রয়েডের লিবিডোর সঙ্গে রিলেট করব। সঙ্গে সমাজ। আমাদের সামাজিক অবস্থান অনেক সময়ই আমাদের যৌন আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে (কখনও কখনও)। এই গল্পের মূল লক্ষ্য হল বিপ্লবের কণ্ঠস্বরকে স্থাপন করা। যদিও এই বিপ্লবকে কখনও কখনও স্বপ্ন ও বাস্তবতার মাঝখানের সিঁড়ি হিসেবে দেখি। এই ইউটোপিয়া না থাকলে হয়তো অবদমিত মানুষেরা পীড়িত মানুষেরা বাঁচতে পারবে না। যেখান থেকে কখনও কখনও আমরা স্বর্গ অথবা নরকের কল্পনাকে লালন করি। ভাবি বসে যে, কোনওদিন স্বর্গরাজ্য পৃথিবীতেই গড়ে উঠবে। এই গল্পের গঠন বুঝতে একটু কয়েকটা অংশ পড়া যাক।

ক। “রাস্তা ক্রমশ চৌকোনও হয়ে যায়। জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠে তার আঁকবাঁক। ইভার খোলস পরে শুয়ে থাকে সোনাবৌদি। দেখে রক্তে সামন্ততান্ত্রিক নীলাভতা ক্রমশ চোঁয়াতে থাকে।”

খ। “সব চাষি ঘরে ফেরে। সব মজুর, সব মুনিশ। একমাত্র সে পড়ে রয়। একমাত্র সে। বৃষ্টিতে ভেজে তার শরীর। রোদে তাপে।… এখন পাকুড়গাছের ডালে অন্ধকার দোলে অসমতল।”

গ। “বন্দুকের নল বুকের ওপর পাতা রয়েছে, সে চিৎকার করে এ মাটি আমাদের। এ মাটির সোঁদাগন্ধ আমাদের গায়ে জড়িয়ে আছে।”

“আমাদের কেউ দেয় না, আমরা ছিনিয়ে নিই।” এরকম এক বিপ্লবের অনুরণন দিয়ে গল্প শেষ হচ্ছে। আমরা সুবিমলের অ্যান্টি-গল্প খুব নিবিড় অনুসন্ধানী হয়ে পড়লে টের পাব যে, গল্পগুলোর মধ্যে মাঝে-মধ্যেই কিছু বিষয় ঘুরেফিরে আসছে। যৌনতা— যা কিনা কখনও সন্ত্রাস মানে শরীরের আত্মগত নিয়ন্ত্রণহীন অভিব্যক্তি, সেখান থেকে উঠে আসা ক্রোধ, অস্তিত্বের বিধ্বংসী বহিঃপ্রকাশ। সত্তাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। বিনির্মাণ ঘটায়। আর কোথাও না কোথাও এই ক্রোধ আর যৌনতা মিশ্রিত সন্ত্রাস আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থানের সঙ্গে জড়িয়ে। ‘দুরত্ববোধ’ গল্পে যেমন আমরা সমান্তরাল জগৎগুলো পাশাপাশি লক্ষ করি। পুঁজিবাদী স্বাচ্ছন্দ্য যে কীভাবে সমাজের একদম গোড়ার মানুষগুলোকে উপেক্ষা করে বা তাঁদের কণ্ঠস্বরকে রোধ করে সেটাই লক্ষণীয়। কৃষকদের কান্না। তাঁদের রক্তাক্ত আর্তনাদ, তাঁদের আত্মহত্যা— এইসবই উঠে এসেছে। আর, ক্রোধ যা সুবিমলের বহু গল্প উপন্যাসের মতোই এই গল্পকেও বিপ্লবের সুর প্রদান করেছে সে এক আশ্চর্য মনোজগৎ। শুধু পাঠক হিসেবে আমি অনুভব করতে পারি কেন সুবিমল এভাবে গল্পের কাম-ক্রোধ-করুণা-বিপ্লবের ভাষ্যে ন্যারেশনকে নির্মাণ করতে চান।

 

তিন.

সুবিমলমিশ্রর আরেকটি গল্প ‘ঘর কইর‌্যা যাইব বন্ধু’ খুব উল্লেখযোগ্য গল্প। অনেকটা সিনেম্যাটিক বিশেষ করে শেষ অংশটা। লিমেরিক, গল্পকথন সেটাও সুবিমলের ঢঙে প্রতিবাদী কণ্ঠে। সিনেম্যাটিক কেন বললাম সেটা বলছি। সংলাপ চলছে সেটাও পরপর ন্যারেশনের ভেতরে প্রশ্নের পর প্রশ্ন অন্তহীন বিদ্ধ করা পাঠককে। পাঠকের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া কথা। হঠাৎই দেখা গেল একই স্তবকে যেভাবে ন্যারেশন প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুরু হয়েছিল আর যেখানে শেষ হল তার পর থেকেই আবার শুরু হয়ে যায় একই কথার রিপ্লে। কথোপকথন একটু এলোমেলোও হয়। আগের মতো সুসংঘটিত না হয়ে আগুপিছু সব ভেঙে দিয়ে সিরিয়ালের দৃশ্য। কেন সিরিয়াল বলছি সেটাও বোঝার। একই দৃশ্য ফিরে ফিরে আসা সংলাপ ন্যারেশনের সবকিছু আবার ঘটে যাওয়া তাও অন্তহীন। এই গল্পটি ১৯৬৭ সালে লেখা। একই সময় লেখা ‘হারাণ মাঝির বিধবা বৌ ও সোনার গান্ধীমূর্তি’ গল্পেও হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের লাশ বারবার গল্পে ঘুরেফিরে এসে গল্পকে অতিনাটকীয় করে তুলেছিল যেন। একে হাইপারবোল বললে ভুল হবে না মনে হয়। একই দৃশ্য ঘুরেফিরে এসে বিষয়টাকে নাটকীয় তো করছেই বরং আরও বেশি ঘোরতর নাস্তিক করে তুলছে যা অনেকটা ঘৃণা মিশ্রিত প্রতিবাদ। সবকিছু ভেঙেচুরে শরীরটা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। সভ্যতার বুকে শরীরের ভাঙচুর সংযোগহীনতার মধ্যে দিয়ে অতিক্রম্য কোনও সুরাহার দিকে হাঁ করে থাকা আমরা পাঠক। সুবিমলের পাঠক, যারা ওঁর লেখা পড়ে ভালোবেসে নয় অভ্যাসে নয় আঘাতে-প্রত্যাঘাতে।

যাঁরা সুবিমলের একান্ত পাঠক তাঁরা জানেন ওঁর সাহিত্যে বানান প্রয়োগ সম্বন্ধে। ‘ং’-এর প্রয়োগ বিভিন্ন বানানে করেন এবং সেটা ‘ঙ’-এর পরিবর্তে। তিনি ‘শুরু’ বানানকে নিজের মতো করে ‘সুরু’ লেখেন। আরেকটা কথা তাঁর লেখায় বানান ঠিকঠাক বিধিমতো দেখলেই অবাক হই। ভুল বানান লেখা যা জ্ঞানত কখনও কখনও বা অনেক সময়, আমার মনে হয় তাঁর প্রতিবাদের রাজনীতির একটা বড় অংশ। সেই বানানগুলোর একটা তালিকা করা যায়: উলংগ, সংগে, অংগ, প্রসংগটা, জংগির, ইংগিত, গংগার, সংগসুখ, শয্যাসংগীর, মংগলবার, লুংগি, ইত্যাদি।

তাঁর বিভিন্ন গল্প বিভিন্ন রকম। তিনি প্রতিটি গল্পে পরিষ্কারভাবে বিপ্লবের কথা বলেন তবে কখনও সেটা কাহিনির ভেতর অন্তর্নিহিত বোধ হিসেবে ধরা দেয়। প্রতিটি গল্পে তার প্রয়োগের ধরন বদলে যায়। বিপ্লব যখন গল্পের শরীরের অংশ হিসেবে দেখা দেয়। যেমন ‘ভারী পড়েছিল এই ছ্যাঁক ছ্যাঁক’ গল্পের শুরুটা:

সে শুনেছিল এমন একটা দিন আসবে
যেদিন গরিব মানুষের হাতে থাকবে ক্ষমতা
দুবেলা দুমুঠো ভাত জুটবে সবার
সবাই অন্তত পেটপুরে খেতেটা পাবে
বন্ধ হয়ে যাবে
মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার-অনাচার
আরও কত কী
কিন্তু লড়াইটা হল ভিন্নভাবে
পথটথ সব ঘুরে গেল
ভিন্ন পথে
এখন শোষক আর শোষিত
কে যে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি
কে কোথায় যে…

সারাজীবন একজন লেখক বিপ্লবের কথা বলে গেল। বলে গেল তরঙ্গের পর তরঙ্গের মতো বাক্য। স্রোতের সমান। দলিত মানুষের কথা। কখনও আবার সম্ভ্রান্ত মানুষের যৌনবিলাসের কাহিনি লিখলেন যেন পাশাপাশি তলে তলে যে-মূলের মানুষেরা অবদমিত হয়ে বেঁচে আছে। সন্ত্রস্ত তাদের জীবন। নিয়ত শোষিত সমাজের উঁচু শ্রেণিদের দ্বারা। একই গল্পে সুবিমল নানারকম জগৎকে তুলে আনছেন গল্পের ছলে, খবরের কাগজ থেকে সরাসরি, বিজ্ঞানের পাতা থেকে সৃষ্টিতত্ত্ব। যে-গল্পটির উল্লেখ করেছি আগের অনুচ্ছেদে সে-গল্পে সৃষ্টিতত্ত্ব, স্থিতিতত্ত্ব আর লয়তত্ত্ব পাশাপাশি চলেছে। প্রত্যেক মানুষের অন্তস্থ তিন অবস্থার বহিঃপ্রকাশ। যৌনতাই হল চিরায়ত স্থিতি— সৃষ্টির বয়ে চলার পথ। সুবিমলের লেখাতে সেটা বারবার আসে বিলাসিতাকে তুলে ধরার জন্য। কখনও তিনি যৌনতাকে সন্ত্রাসের প্রতিরূপ হিসেবেও ব্যবহার করেন। ‘মানুষ রতন’ আর ‘পরীজাতক’ গল্প দু-টিতে যেখানে রক্তমাংসের যৌনতাকে তুলে ধরেছেন লেখক তখন যৌনতা আর বিলাসের পর্যায়ে না থেকে পৌঁছে যাচ্ছে চূড়ান্ত এক অতিবাস্তবে যার মধ্যে দিয়ে খুলে যায় আমাদের পরিশীলিত মানুষের মাংস। মাংসের অন্তর্গত হিংসা ক্ষুধা যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ ঘটে হত্যার পরিণামে। আমরা দেখি সেখানে নীচুতলার মানুষের শোষণ। ‘পরীজাতক’ গল্পে একজন ভাড়া করা নারীকে লক্ষ করি। তার শোষণ লক্ষ করি। তাকে জীবিত অবস্থাতে পর্যন্ত গল্পে দেখানো হয় না যেন সে মাংসের দলা শুধু পুরুষের যৌনক্ষুধা মেটানোর জন্যই তার অস্তিত্বে আসা। রাণীর সেই মৃত শরীরটাকে পুরুষগুলো খুবলে ছিঁড়ে নিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে বালির ভেতর পুঁতে দিল। শেষে একজন পুরুষের শুধু পাপবোধ হয়েছিল। এই পাপবোধকে আমি মহৎ বলে মনে করি না তার কারণ, সে-বোধ কিন্তু ক্ষুধা আর সন্ত্রাসের রক্তে রাঙা। এই পাপবোধ আমাদের ভেতরকার স্থিত ব্যঙ্গাত্মক আত্মা। স্থুল ভীষণ। এবং এটাই রূঢ় বাস্তব। তবে ‘মানুষ রতন’ গল্পের তিনজনই নীচুতলার মানুষ। দু-জন পুরুষ ও একজন মহিলা। দু-জন পুরুষের যৌন ক্ষুধা এতটাই বিকৃত হয়ে উঠল যে, তারা শেষ পর্যন্ত মহিলাটিকে হত্যা করল নৃশংসভাবে। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও এই সন্ত্রাসের জন্য দায়ী। দুটো গল্পের সন্ত্রাস কল্পনা করলে শিহরিত হতে হয়। সে-জন্যই বোধহয় সুবিমলমিশ্রর সাহিত্য অনেক সময় আমাদের পাঠের সময় অস্বস্তি দান করে।

সুবিমলের লেখার অন্তর্নিহিত এই বোধ কেন কীভাবে জাগ্রত হয়েছে এর রাজনীতি বলি, বা সূত্র কোথায়। এটা নিয়ে খুব গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। তাঁর লেখার স্রোত কিংবা স্ফুরণ লক্ষ করলে টের পাব যে, সমস্ত রকম শারীরিক বা মানসিক বিধিনিষেধ অতিক্রম করতে চাইছেন একজন লেখক। নিজের জীবনে এই বোধকে মিশ্রিত না করলে এই ধারা আনা খুব শক্ত। একটার পর একটা অনুষঙ্গ চলে আসে। দীর্ঘ বাক্য যাকে এক নিঃশ্বাসে না পড়ে আমি একটা অনুষঙ্গ অবধি পড়ে অন্য অনুষঙ্গকে শূন্যতা দিয়ে বুঝে নিয়ে বিষয়ান্তরে গিয়ে নিজের ভেতরে বিক্রিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমার নিজের মতো একটা পাঠের রাজনীতি তৈরি করে নিই। সুবিমলের লেখার একটা মজা আছে, তিনি কোনও পার্টিকুলার ভাষা নির্মাণ করার চেষ্টা করেননি যার ফলে তাঁকে নিজের লেখার বা চিন্তার দাস হতে হয়নি। তাঁর সাহিত্যকে অনেকেই চালাকি বলেছেন বা অহরহ বলতে শুনি, তিনি রিপিটেশন এনেছেন লেখাতে। তবে একটা কথা বলা প্রয়োজন যে, সুবিমল এমন একজন লেখক যিনি কোনও নির্দিষ্ট ভাষার দাসত্ব স্বীকার করেননি যাকে আমরা ডিকশন বলে থাকি। সে-জন্যই তাঁর সাহিত্য উত্তর-ঔপনিবেশিক হ্যাংওভারকে কাটিয়ে উঠতে পেরেছে অনেকাংশেই। বিষয়ের বিভিন্নতা এবং ভঙ্গির নানা অ্যাপ্রোচ তাঁর লেখাকে কখনও একঘেয়ে করে না। রাজনীতি এক হতে পারে কিন্তু প্রতিটি গল্পের প্লট আলাদা ফর্ম আলাদা যার দরুন বাংলা সাহিত্য শুধু নয় সমগ্র ভারতীয় সাহিত্যে তিনি একজন সফল সাহিত্যিক।

 

চার.

আমার মতে সুবিমলমিশ্রর কথাসাহিত্যের দুটো ভাগ: প্রাক্-গদারীয় ও গদারীয়। গদারের চলচ্চিত্র ও তাঁর দর্শন থেকে এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি যে, আজীবন গদারের চলচ্চিত্রায়নের পদ্ধতিকে ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন অ্যান্টি-গল্প ও অ্যান্টি-উপন্যাসে। বিভিন্ন চলচ্চিত্রের চিন্তন ও দর্শনকে কেন্দ্রে রেখে সেখান থেকে অবয়ব ও ধারণা অর্থাৎ, রাজনীতির সংমিশ্রণে সুবিমল নিজের সৃষ্টিকর্মে ব্রতী হয়েছেন। গদার যেমন নিজের চলচ্চিত্রে সমস্ত কিছু একসঙ্গে তুলে ধরতে চান— দর্শন, ধর্ম, সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, টেকনোলজি, পপআর্ট, খবরের কাগজের প্রকাশিত চিঠিপত্রাদি প্রভৃতি। আর গদারের আপন কথায়— ‘I want to cover everything— sport, politics, even groceries’। সুবিমলও এরকম সংমিশ্রণে নিজের সাহিত্যকে গড়ে তোলেন তীব্র প্রতিবাদী, সাধারণ মানুষের মুখের কথন। যদিও তাঁর গল্পের শিল্পরূপ বাংলার তথাকথিত প্রচলিত ধারাকে আক্রমণও করে।

সুবিমলমিশ্রর লেখা পড়তে পড়তে অনেকদিন চুপচাপ থাকি। অন্য লেখকের লেখা পড়ি। অতলে সুবিমলের গল্প নিয়ে ভাবতে থাকি। ক্রমাগত… সবকিছু শিথিল হয়ে আসে। তাঁর লেখার বাস্তববোধ এতই দৃঢ় যে, কখনও কখনও মনে হয় রূপকথা পড়ছি। তখন শিথিল হয়ে আসে আমাদের বাস্তববোধ এবং নবনির্মাণ ঘটে সে-বোধের। অদ্ভুত আরেকটা বিষয় নিয়ে ক্রমাগত কাজ করেছেন আজীবন সেটা হল: বাস্তবোচিত কোনও কাহিনি বলতে বলতে সেই বাক্যের রেশ ধরে না যতিচিহ্ন ব্যবহার করে অন্য বাস্তবে প্রবেশ করেন সেটা আদতে বাস্তব হয়েও এক অতিবাস্তব হিসেবে ধরা দেয়। অবিস্মরণীয় এক জগৎ। কখনও রগরগে যৌনতা শরীরের হিংস্রতা বা বাস্তবকে এতই বেশি মহিমান্বিত করেন যাতে আবার পুনরায় সেই চূড়ান্ত বাস্তবে ফিরতে পারেন। এও এক ডিসকোর্স। এবং খুবই স্বকীয়। ইউনিক। বাংলা সাহিত্যে এমন কাজ কেউ করেননি। ভাবনাগত ও ভাষাপ্রয়োগে একদম ইডিয়োসিনক্র্যাটিক। একটু উদাহরণ দিলে বোঝা সহজ হবে কীভাবে দুটো বাস্তব আলাদা হয়েও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ‘৩৬ বছরের রগড়ারগড়ি’ অ্যান্টি-গল্প সংকলনের ‘নিকট প্রবিষ্ট সম্পর্কেও ধারণক্ষমতা’ গল্পের একটা অংশ তুলে দিচ্ছি: ‘…শুধু লিপস্টিক দিয়েই ঠোঁটকে মোহময় করবেন কেন, আপনার তো মহাঅস্ত্র আছে, লিপগ্লস, পুরুষ বধ করার ব্রহ্মাস্ত্র।… নাইটক্লাবে যেতে হলে পারফেক্ট লুক দিতে পারে একমাত্র লিপগ্লস।… পালস পোলিও কর্মসূচিতে যুক্ত থাকার সুবাদে পশ্চিমবংগের প্রত্যন্ত গ্রামেও ঘোরার সুযোগ হয়েছে। অভিজ্ঞতায় দেখেছি আকার প্রকারে সবচেয়ে বেশি বাধার সৃষ্টি করেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক শ্রেণির মাতব্বর। কোনও বাড়ির বাচ্চাগুলোকে প্রতিবেশীর গোয়ালঘরে লুকিয়ে রেখে বলা হল: আমাদের বাড়িতে কোনও বাচ্চাই নেই। সুলুকসন্ধান করে আমরা পাশের বাড়ির গোয়ালঘরে উঁকি দিলাম, তখন বলা হল এক ঘণ্টা বাদে আসুন বাচ্চারা এখন চোর চোর খেলছে। এক ঘণ্টা বাদে গেলাম: একটু পরে আসুন এইমাত্র পুকুরে নাইতে গেল তারা। নাছোড়বান্দা আমরা কিছু পরে ওই বাড়িতে গেলে বলা হল: এত দেরি করে এলেন কেন, এইমাত্র বাচ্চারা সদলবলে ফুফার বাড়িতে চলে গেছে। এভাবে আমাদের চোর পুলিশ খেলা চলতেই থাকল। শেষকালে তিক্তবিরক্ত হয়ে একজন মাতব্বর গোছের লোক বেরিয়ে এল: বাচ্চাগুলো যখন মাদ্রাসায় যায় তখন তো তাদের মিড-ডে-মিল দাও না, এখন এয়েচো পোলিও খাওয়াতে?… খাবালেই বাচ্চারা হিজড়ে হয়ে যাবেক,… আসছি আমবাগানের ভেতর থেকে ইঁটবৃষ্টি শুরু… পোলিও খাওয়াতে এসে পড়ে গেল সন্ধ্যা বাউরি, মাথাটা দু-ফাঁক হয়ে গেল।… দু-ফাঁক মাথার মাঝ দিয়ে গলগল করে হলুদ ঘিলু আর কালচে রক্ত… আলমারিতে সাজানো থাকে মাটির আম, হুবহু আমের মতো।… কমপ্লেকশন অনুযায়ী লিপস্টিক বাছাই নিয়ে কতগুলো জরুরি বিষয়… হলদেটে-ফর্সা, ইয়ালোইশ কমপ্লেকশনে পিচ বা সোনালি লিপস্টিক লাগালে রংটা আরও খুলবে, সহজে পুরুষ ধরতে পারবেন। পুরুষকে সিডিউস করার নানা পদ্ধতি বেরিয়েছে আজকাল, অত্যন্ত গোপনীয় সব ব্যাপার, ***-এ নম্বরে ফোন করে নিন। ফি সামান্য।’ সুবিমলমিশ্রর লেখনী এভাবে সমাজ থেকে ব্যক্তি, খিদে থেকে মাংস, শরীর থেকে মহাবিশ্বে ছড়িয়ে যায়। কাহিনিকে আরও বেশি ভয়াবহ করতে আরও বেশি রুগ্ন করার জন্য ফেটে যাওয়া মাথার ঘিলু রক্তের মিশেলকে আমের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এভাবেই তো গল্প এগোয় আর যেখানে কোনও গল্প নেই সেখানে তাঁর গল্প শুরু হয়।

তাঁর প্রতিটা লেখায় এক ভারতীয়বোধ কাজ করে। কোনও এক সম্পূর্ণ হওয়ার দিকে যাচ্ঞা। আর এই আকুতিকে পূরণ করে বিভিন্ন দিক থেকে ছিন্নভিন্ন ছুটে আসা গল্প। কাহিনিগুলোকে হয়তো কোনওভাবেই গল্প বলা যাবে না। বা সে-সব গল্পই তো। ‘নিকট প্রবিষ্ট সম্পর্কেও ধারণক্ষমতা’ অ্যান্টি-গল্পের শেষের একটা উক্তি পড়লে ধারণা পরিষ্কার হবে। এ-ধারণাও একটা রাজনীতির অঙ্গ হিসেবে আমি অন্তত মনে করি। এটা একমাত্র সুবিমলের একনিষ্ঠ পাঠকেরাই বুঝতে পারবেন। যেরকমভাবে আজীবন তিনি নানা গল্প লিখে গ্যাছেন কোনও অনির্দিষ্টকে তাচ্ছিল্য করে শুধুমাত্র নিজের কাছে পৌঁছানোর জন্য এইসব কসরত। ‘এটা আদৌ কোনও গল্প? লেখা শেষ হয়ে যায় তবু সমস্যা যে ঠিক কি তা স্পষ্ট হয় না। চরিত্রগুলি নিজেদের অবস্থায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। এক চরিত্রের সংগে অন্য চরিত্রের, একটা ঘটনার সংগে অন্য ঘটনার যোগাযোগটাও ভীষণ কৃত্রিম বলে মনে হয়। যথেচ্ছ যৌনতা নিয়ে এ প্রজন্মের মন পাওয়া যাবে কি? মুশকিল। এক স্ট্যান্ট দেওয়া ছাড়া লেখকের আর কোনও উদ্দেশ্য তো দেখতে পাচ্ছি না।……..  অ ব তে রা কে য়া হো গা কা লি য়া’ এই কৃত্রিম সমাজে কৃত্রিম মানুষদের দ্বন্দ্বে ফ্যালার রাজনীতিই করে থাকেন সুবিমল। কোথা থেকে কোথাকার অনুষঙ্গকে লিখতে থাকেন যেন অন্তরের কোনও তাগিদকে মুক্ত করে দিয়েছেন। সে-সব তাগিদ থেকে বেগবান হয়ে চতুর্দিকে ছুটতে থাকে। লাগামহীন মানুষের গল্প লাগামহীনভাবে কখনও ছেয়ে ফ্যালা গল্পের মানচিত্র। আর এই লাগামহীনতাকে কাউন্টার করে ভেতরের কোনও তাগিদ। সেই তাগিদে রহস্যময় কোনও প্রাচীন উপাখ্যান উঠে আসে। সমাজে-সভ্যতায় সে-সব কাহিনি নানাভাবে এবড়ো-খেবড়ো লুকিয়ে আছে যেগুলোকে আমরা যৌনতাগ্রস্ত যন্ত্র অনুভব করতে ভুলে যাই অতলে ডুবতে গিয়ে বিভ্রমতাড়িত হই। এটাই সুবিমলের নানা লেখার দিশাহীনতা। এটাই বর্তমান সভ্যতা। আর এই উল্লেখিত গল্পের শেষ অংশটাকে পাঠকের চোখে এই গল্পের সমালোচনা দেখিয়েছেন তিনি। আর এটাই হয়ে উঠেছে লেখকের স্বগতোক্তি। রাজনীতি।

কখনও কখনও ভাবি— এই বহু পুরোনো মানবসভ্যতার ভার মানবসভ্যতা বহন করে চলেছে, তার ভেতর অন্তরতম ইতিহাসবোধ ঐতিহ্যের বোধ সব নিয়ে এগিয়ে চলা আর থেকে থেকে ভাবতে বসা সবটা নিয়েই অস্তিত্ব এবং তার দহন। সুবিমলের ভিন্নরকম একটা অ্যন্টি-গল্প ‘নাঙা হাড় জেগে উঠছে’ সম্পর্কে বলতে ইচ্ছে করছে। একটা গল্পের মধ্যে মানবসভ্যতার চূড়ান্ত ক্ষুধা যন্ত্রণা ও অধিকারবোধ সমস্ত কিছু মিশিয়ে একত্রে একটা প্যাকেজ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস উঠে আসছে। লেখক মুক্তিযুদ্ধের ন্যায্যতা নিয়ে ভাবাচ্ছেন। অবিভক্ত বাংলার স্বপ্নকে নৈরাজ্যের ভেতর দিয়ে কল্পনার ভেতর দিয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে যাওয়া মানুষের আর্তির ভেতর দিয়ে দেখাচ্ছেন। কলকাতা শহর ধ্বংস হয়ে গ্যাছে আগের দিন রাতে— এরকম প্রেক্ষাপটে গল্প শুরু। তার বিবরণ দিচ্ছে কলকাতার সেই ধ্বংসবিহ্বলতা থেকে বেঁচে ফিরে আসা মানুষেরা। কোনও কিছু স্পষ্ট নয় গল্পে। আখ্যান বয়ে চলেছে। তবে অন্তর্নিহিত ইতিহাসবোধ খুব দৃঢ়। মানুষ যেটা চায় সেটা কখনওই পায় না। তার নানা কারণ, কখনও ব্যক্তিগত স্তরে কখনও সামাজিক বা মূলে যে-রাষ্ট্রনৈতিকতা কাজ করে যেভাবে রাষ্ট্রশক্তির দমন পীড়ন কাজ করে সে-সবের ঊর্ধ্বে উঠে এই গল্প। সেই জন্য দখল দেখানো হয়েছে। পাক-সরকারের দ্বারা অত্যাচারিত বাংলাদেশের সাধারণ মানুষেরা কলকাতা শহরকে দখল করে নিচ্ছে। এর ভেতর একজন মানুষের নিজের মাংসের প্রতি যে-তীব্র বিরোধ কাজ করে সেটাকে কেন্দ্রীভূত করে মুক্তির খোঁজ এই গল্পে আছে। অথচ এই কাহিনির কোনও নির্দিষ্ট নেই, যে যেভাবে পারছে কলকাতা শহরের ধ্বংসের বিবরণ নানাভাবে উঠে আসছে। এই মুক্তির কোনও সুনির্দিষ্ট পথ নেই। গংগা এসে ভাসিয়ে দিচ্ছে গোটা শহরকে। শহরে পাপ বেড়েছে সেই জন্য এই প্লাবন। এখানে মিথকে আশ্রয় করা হয়েছে। মানুষকে মানুষ ভাবার চেষ্টা করা হয়েছে। আসলে এই গল্পের ‘পরিবেশনভংগিই’ মূল। সেটাই লক্ষণীয়। উত্তর আকাশে দ্যাখা গ্যাছে একজন লম্বা মানুষকে লাল লন্ঠন হাতে। মানুষটা লম্বা কেন? এটা নিয়ে ভাবতে বসলে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতে হয়। ধ্বংস হয়ে গ্যাছে কলকাতা শহর কিন্তু তার কোনও স্বচ্ছতা পাওয়া যাচ্ছে না। এটাই রাজনীতি। রাষ্ট্র যেভাবে সাধারণের চোখে পর্দা দিয়ে রাখে সেভাবেই এই গল্প। লেখকের উদ্দেশ্য স্পষ্ট। জাগতিক-মহাজাগতিক মিশ্রণ। কোনও থ্রিলারের চেয়ে কম কী।

 

পাঁচ.

সুবিমল অনেক গল্পেই চৈতন্যপ্রবাহের ওপর নির্ভর করেছেন। ‘ধারাবিবরণী-৭১’, ‘বাব্বি’-র মতো গল্প লিখেছেন। ধারাবিবরণীই। গল্প হওয়ার গল্প। অনেক চরিত্র। তারা সবাই একে-অপরকে বিরোধ করছে। কখনও স্ববিরোধীও। এখানে লেখকও চরিত্র হয়ে পাঠককে বিভ্রান্ত করছেন। এই লেখক নামক চরিত্রটি কি সুবিমল স্বয়ং? এ-প্রশ্নের কোনও উত্তর হয় না। গল্পে সমাজ আর সমাজ থাকছে না হয়ে উঠছে এক-একজন মানুষ। চলমান। নানা দিক থেকে এগিয়ে আসা জলপ্রপাত। গল্পকে ভিজিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। গল্পকে গল্পের অতিরিক্ত করে তুলছে। লেখক ও রেবেকার কথোপকথন: ‘লেখক: গণতন্ত্র সম্পর্কে তোমার কী ধারণা?/রেবেকা: পলিটিক্স নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।’ গণতন্ত্র বিভ্রান্ত হচ্ছে পলিটিক্সে মিশে। না, কাহিনি বলব না। সুবিমলের গল্প হয়ে ওঠা নিয়ে বলব। কত মানুষ। নানারকম বৃত্ত থেকে এসে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ছোটোবেলায় একটা দৃশ্য আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেত: আমাদের ছোটো মালদা টাউনে রথবাড়ি মোড়ে চারদিক থেকে নানারকম মানুষ নানারকম যানবাহন এসে মিশে গিয়ে আলাদা হয়ে যাচ্ছে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তখন থেকে সাহিত্য আমার কাছে সমাজের সেই প্রতিরূপ। সুবিমলের এই গল্পেও আছে সেরকম। যেন একটি চেতনার স্রোত থেকে অনেক শাখাপ্রশাখা বিস্তার করছে বা একটি চেতনার স্রোতে এসে মিশছে নানা ধরনের স্রোত। আর এই চেতনাকে ধারণ করার প্রক্রিয়া ও ক্রিয়াশীলতাও ভীষণ দুর্গম। লেখক নিজেও একজন রক্তমাংসের মানুষ তাঁর নিজের চেতনার নানা অশুদ্ধ দিকও কখনও এসে স্রোতে মিশছে। গণতন্ত্রে ভূত মিশে থাকে সেরকম অনেকটা কি। আর লেখককে নিজের চেতনার সাথে ক্রমাগত সখ্যতা ও বৈরিতা করতে করতে এই ধরনের গল্পে নিজের সাক্ষর রেখে দিতে হয়। আর ‘ধারাবিবরণী-৭১’? সেও এক তীব্র চেতনাপ্রবাহ। একজন বৃদ্ধ হাঁটছেন দিনরাত এক করে কলকাতার রাস্তায়। খুঁজে চলেছেন সাতচল্লিশের দাঙ্গায় খুন হওয়া ছেলের লাশকে। যেন সেই বৃদ্ধ সমাজের চেতনাপ্রবাহ। যেন সে স্বয়ং সমস্ত অনুভূতি। একদম উন্মুক্ত। কলকাতা শহরের অবক্ষয় লক্ষ করছি আমরা। নানাভাবে নুয়ে পড়ে আবার উঠে দাঁড়ানোর গল্প। আর কেন বিবরণী? এরও কারণ ওই শরীর ও অস্তিত্বের মধ্যে সংঘাত। যেখানে শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। আর নানা দিক থেকে আশার চেতনা ও অবক্ষয়ের অন্ধকার পূর্ণ করার চেষ্টা করছে। এটাও গল্প হয়ে ওঠার গল্প। কেন অবক্ষয়? তার হিসেবে বসবার গল্প। আর অস্থিচিহ্ন খুঁজে চলার গল্প। গল্পপ্রবাহও। ভারতবর্ষ উঠে আসছে। দেশভাগ। দাঙ্গা। আফটারম্যাথ। কীভাবে বেঁচে আছি আমরা। রক্তের দাগ ধুয়ে মুছে বেঁচে থাকার গল্প। ইতিহাস বিস্মৃতি ও স্মরণের চরম হিংস্রতার গল্প যেখানে আশ্রয় এই বৃদ্ধের মনোবল। আমরা উঠে দাঁড়াব একদিন। ভবিষ্যৎকে বিবাহ করব কিন্তু সাক্ষী রাখব অতীতকে। এই-ই ধারাবিবরণী।

সুবিমল লিখছেন ‘চেটে চুষে চিবিয়ে গিলে’ অ্যান্টি-উপন্যাসের একটি পাতায়: ‘ঠিক কী ধরনের বিপন্নতা থেকে তৈরি হয় একজন লেখক’। সাদা পাতায় শুধু এটুকুই। বারবার ঘুরে ফিরে এসছে এই উক্তি। এই কথা তিনি কার উদ্দেশে লিখছেন? নিজেকেই বলছেন না কি পাঠকের উদেশে? তাঁর অনেক লেখায় এরকম অনেক মন্তব্য করে থাকেন যেটা একইভাবে পাঠককে তিরবিদ্ধ করছেন ও পাশাপাশি নিজেকেও লিখছেন যেন নিজের লেখা চলাকালীন নিজের চলার পথ চিন্তার পথ পরিষ্কার করে নিচ্ছেন সব আড়াল সরিয়ে ফেলছেন বলতে চাইছেন নিষেধহীন এমন সব কথা যা কোনও লেখক সাহিত্যের ভাষায় বলতে পারেননি বা বলতে চাননি। অবাঞ্ছিত বাক্যে তৈরি তাঁর বিপন্নতাকে আমরা পাঠ করি। যাপন করি।

গত পঁচিশে নভেম্বরে আমার ডায়েরির একটি এন্ট্রি এরকম: ‘সময়টাকে ধরতে পারছি না। খেয়াল পড়ছে এক বহুরৈখিক সামাজিক চিত্র। কেউ বলছে— ভাত দাও বাসস্থান দাও। কেউ বলছে— কাজ দাও। কেউ সুখে উল্লাসে যৌনতায় মেতে উঠেছে। কেউ হাসছে গল্প করছে পাড়ার মোড়ে আড্ডা দিচ্ছে। দলে দলে মানুষ ট্রেন বাস থেকে নেমে গিয়ে নিজ নিজ উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিচ্ছে। রাস্তায় কুকুর বিড়াল চাপা পড়ে থেঁতলে যাচ্ছে। সময়কে তবুও আমি ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছি। হাসপাতাল নার্সিং হোম কোভিড পেশেন্টে ভরতি। বাড়ি বাড়ি করোনা আক্রান্ত। হোটেলে বিয়েবাড়িতে খেতে গিয়ে মানুষে মাস্ক নামিয়ে দু-মুঠো খেয়ে নিচ্ছে। আবার মুখ হাত ধুয়ে মাস্ক পরে রাস্তায় হাঁটা দিচ্ছে। নিজেকে দেখে নিচ্ছে কেউ কেউ। মরে যাচ্ছে কত মানুষ। টিভি দেখছে খুব কেউ। অনেক রাত হল তাও টিভি দেখে চলেছে। শরীর নিয়ে ভেবে চলেছে। শূন্যতা নিয়ে ভেবে চলেছে কেউ। একটানা শরীরের আলাপ হয়েও শান্তি হচ্ছে না কারো কার।’

আজীবন সুবিমল অনেক যুগান্তকারী অ্যান্টি-গল্প লিখেছেন। ‘হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া বা সোনার গান্ধীমূর্তি’ থেকে শুরু করে ‘ঘোড়া যে ভাবে গাধা হয়ঃ ঘোড়া<ঘোধা<ঘাধা<গাধা’ বা ‘নীল ফসফরাস’, ‘নাঙা হাড় জেগে উঠছে’, ‘মানুষ রতন’, ‘আর্কিমিদিসের আবিষ্কার ও তারপর’, ‘পরীজাতক’, থেকে ‘বাব্বি’ পর্যন্ত। এবং এখানেই শেষ নয়। তাঁর প্রতিবাদ কখনও শেষ হয় না। অনন্ত অবধি চলতেই থাকে। আমি রাত বাড়লে, ক্রমশ নিঃসঙ্গ হলে টের পাই। কানে আসে আমাদের অন্তরের আর্তনাদ। পীড়িত মানুষের আর্তি। যে-দেশে শুধু রাজনৈতিক দলের শকুনেরা আমাদের নিংড়ে চেটে চুষে ছোবড়া করে রেখে দেয় সেখানে আমাদের মনের ক্ষততে মলম দেওয়ার জন্য একজন সুবিমলমিশ্রর প্রয়োজন। আমাদের সর্বজনীন অসহায় অবস্থাকেই তিনি লিখেছেন। আমাদের রাগ জন্মায় ক্ষোভে ফেটে পড়ি কিন্তু বাস্তবে কিছুই করতে পারি না। কারণ, আমরা অসহায়। আমরা ‘ভূমিদাস’। ‘চার্ট পাথরের হাত-কুঠার, গায়ে ঘন বেগুনী-নীল প্যাটিনা’ গল্পে লেখক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন: ‘খাটতে এস্যাছিস তো জান-ভর শুধু খেট্যা যা। মারাংবুরু আমাদের পরের দুয়্যারে খাটব্যার লেগ্যাই পাঠালছে।’ আর মনে পড়ে ‘পার্কস্ট্রিটের ট্রাফিক পোস্টে হলুদ রং’ গল্পের ভিখিরিটা মারা যাচ্ছে। খিদিরপুর ব্রিজে পাগলটা চেঁচিয়ে গেল: ভিখিরিটা মারা যাচ্ছে কিন্তু কেউ শুনল না। এখানে বারবার আমি পাগলটার নিঃসঙ্গতা ও অসহায়ত্ব নিয়ে ভাবি। একটা মানুষ মারা যাচ্ছে কিন্তু আমাদের কাছে তার কোনও মুল্য নেই। ভিখিরিটা মারা যাচ্ছে। ভিখিরিটা মারা যাচ্ছে। মারাংবুরু সৃষ্টি করলেন মানুষ আর তিনি নিয়তিকেও নির্ধারিত করে দিলেন। বারবার ঘুরেফিরে একই ভবিতব্য আমাদের। সুবিমল সেটাকেই তুলে আনেন গল্পে, যৌনতায়, কর্মে, মরণে, সংলাপে আর শরীরে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. চমৎকার। এত ভালো বিশ্লেষণ এমন নিবিড় পাঠকের পক্ষেই সম্ভব। সুবিমলের লেখা পড়ার আগ্রহ বাড়িয়ে দিল।

আপনার মতামত...